__”কি রে আদি কাল আরুষিকে দেখে এলি তারপর কিছু বললি নাতো আমাদের যে ওকে তোর কেমন লাগলো?ওদের বাড়িতে তো জানাতে হবে আমাদের মতামত।ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি বল?” প্রাতরাশ টেবিলে একমাত্র ছেলে আদিকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করেন পরমাদেবী।বরাবরের মতই ছেলের উত্তর “না” আসবে এটা ধরেই ছিলেন উনি আর ওনার স্বামী সমীরণবাবু দুজনে।কিন্তু ফলের রসে চুমুক দিতে দিতে আদির উত্তর এলো,”হ্যাঁ মা ওনাদের হ্যাঁ বলে দাও আমি রাজি এই বিয়েতে।”,এই বলে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যায় ও।ঈষৎ নিশ্চিন্ত বোধ করেন স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে।যাক এতদিন পরে এই বসন্তেই তাহলে বিয়ের ফুল ফুটলো তাহলে ওনাদের আদির!কতদিন পর এই মজুমদার বাড়িতে নহবৎ বসবে,আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীতে গমগম করবে গোটা বাড়ি।মা,বাবা হিসেবে সন্তান বড় হলে তার বিয়ে নিয়ে মনের ভিতরে একটা চাপা চিন্তা কাজ করে। পরমাদেবী আর ওনার স্বামীও তার ব্যতিক্রম নন।তাও যদি হয় আবার আদির মত সুপূত্তুর।শুধু পড়াশুনোটাই করে এসেছে ও,ত্রিশটা বসন্ত পার করে দিলেও আদির জীবনে কেউ আসেনি যার সাথে একসাথে সারাজীবন কাটানো পারে ও।ছেলেকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছেন এই ব্যাপারে কিন্তু প্রতিবার ওর তরফ থেকে উত্তর এসেছে,”না মা কেউ নেই থাকলে কি আমি জানাতাম না!”
পেশায় একজন মনোবিদ আদি।নিজের ডাক্তারি,রুগী,গবেষণা ইত্যাদি নিয়েই মেতে আছে ও।তাই বিশেষ করে পরমাকেই হাল ধরতে হয়েছে ওর বিয়ের ব্যাপারে।ঘটক,সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন,নামকরা ম্যাট্রিমনিয়াল ওয়েবসাইটে কম কারুর সঙ্গে তো যোগাযোগ করেননি কিন্তু কাউকেই মনে ধরেনি আদির। প্রায় যখন হাল ছেড়ে দিয়ে বসতে চলেছেন পরমা তখন আদির পিসি গ্রামের বাড়ি থেকে জানালেন এই আরুষি মেয়েটির কথা,ওনাদের ওখানকার বাড়ি।আদির পিসি আরো বলেছিল মেয়েটি ওর মা বাবাকে খুব ছোটবেলায় হারিয়েছে। তারপর থেকে জেঠুজেঠিমার কাছে মানুষ। মা বাবাকে হারিয়ে অন্যের সংসারে মানুষ হলে যা হয় আর কি!আরুষি নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়।জেঠুর দয়ায় বাড়ির সমস্ত কাজ সামলে কলেজের পড়াশুনো শেষ করেছে মেধাবী আরুষি।কিন্তু আর নয় এবার ওর বাড়ির লোক চাইছে ওর বিয়ে দিয়ে দিতে।সবটা শুনে প্রথমে পরমা গ্রামের মেয়ে শহরে এসে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা এসব ধারণা করে দেখতে গেলেও শেষমেশ সামনে গিয়ে পুরো ধারণা পাল্টে গেছিল।বড় মায়া জেগেছিল আরুষির গভীর কাজলকালো চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে।কত ব্যথা যেন লুকিয়ে আছে।এককালে নিজের একটি মেয়ের খুব সখ ছিল পরমার আজ আরুষিকে দেখে মনে হচ্ছে ওকে নিজের কোলে টেনে নেন।কিন্তু আদির কথা ভেবে পাকাপাকি কোনো কথা দিয়ে আসেননি। গত রবিবার আদি ঘুরে আসার পর সব জানাবেন বলেছেন ওদের।যাক এবার তাহলে সুখবর দিয়ে ওদের বাড়ি ফোন করা যাক,বিয়ের দিন ঠিক করতে হবে তো।
মেয়ের জেঠিমা সুজাতার নম্বর ডায়াল করেন উনি।ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ,”নমস্কার পরমাদেবী আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।” পরমা বলেন,”আপনাদের মেয়েকে আমাদের আদিত্যর পছন্দ হয়েছে।কথায় বলে শুভস্য শীঘ্রম একদিন এসে তাহলে পাকা কথা বলে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে যান।আর হ্যাঁ,আমাদের কোনো চাহিদা নেই।আরুষিকে আমরা মেয়ের মতোই ঘরে আনবো।” এবার ভেসে আসে সুজাতার গলা, “বাঁচালেন পরমা আপনি”।ঘাড় থেকে বোঝা নেমে যাবার খবরে শাখ বাজাতে ছোটেন উনি।বাড়ির দাওয়াতে ছোটছোট ছেলে মেয়েগুলোকে পড়াতে পড়াতে আরুষির মন তখন কিছুটা আনমনা।জেঠি ওকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচে কিন্তু ও কি পারবে আদিত্যকে ভালো রাখতে? পুরুষ মানুষ নিয়ে যে ওর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। ছোটবেলায় জেঠিমার ভাই এসে যখন ওকে ঘরে ডেকে গাল টিপে দেবার নাম করে কোলে বসিয়ে সারা শরীরে আঙ্গুলের খেলা চালিয়ে যেত সেই কথা ভাবলেও আজও শিউরে ওঠে ও।সময়মত যৌবনে পা দিলেও শরীর নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে আরুষি।কিন্তু বিয়ে মানে যে পুরুষমানুষ কি ওটা ছাড়া আর কিছু জানে!ক্ষুধার্ত বিড়ালের মতই পায়রার শরীর ছিন্নভিন্ন করবে তারা নারীদের মনের খবর না রেখেই।তবে কি ও একবার আদিকে ফোন করে জানাবে ওর পূর্বের কথা সব?তাহলে বিয়েটা ভেঙে যাবে ঠিকই কিন্তু কারুর জীবন তো শেষ হবেনা। তারপর ও ভাবে এখন বিয়ে ভাঙলে জেঠি ওকে ছেড়ে কথা বলবেনা। খুব তাড়াতাড়ি একটা দিন দেখে শুভপরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় আরুষি আর আদিত্য।
পরদিন নিয়ম অনুযায়ী স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাবার পালা। গাড়িতে আসতে আসতে নিজের মা বাবার কথা মনে হচ্ছিল আজ ওরা থাকলে বোধয় ওর মনের কথাগুলো ভাষা পেত।যাইহোক গাড়ি এসে দাঁড়ায় মজুমদার বাড়ির গেটে।দুরুদুরু বুকে দুধে আলতা পায়ে রাঙিয়ে প্রবেশ করে ও।নানারকম আচার বিচার,কালরাত্রি এসবের পালা পেরিয়ে পরদিন বৌভাত পর্ব।রিসেপশন হলে সন্ধেবেলা অতিথি অভ্যাগতদের ভিড়, নহবতের সুর,ফটোসেশন চলছিল ভালোই।বাড়ি ফিরে হটাৎ আরুষি অনুভব করে তলপেটে ব্যথা।ঋতুস্রাব ওকে খুব কষ্ট দেয় কিন্তু এখন তো হবার কথা নয়,দিন এগিয়ে এসছে তাই এই বিপত্তি। পরমাকে ডেকে বলে আরুষি ওর শরীরের অসুবিধার কথা। পরমা মৃদু হেসে বলেন,”সব ঠিক হয়ে যাবে কোনো চিন্তা করিসনা।আমার আদি ওরকম ছেলে নয় একটু অন্য প্রকৃতির ও ছোট থেকেই।তুই একদম ভয় পাসনা নিশ্চিন্তে থাক।” পরমা যতই ভরসা দিন না কেন ভয় ক্রমশ জেকে বসে ওর শরীরে। ফুলশয্যার খাটে বসে ঘামতে শুরু করে আরুষি,মনেমনে ভাবে আজ ওর জীবনের সব কথা জানাতেই হবে আদিত্যকে। তারপর নাহয় এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ও।এমনসময় ঘরে ঢোকে আদি।মিষ্টি হেসে বলে,”কি ভয় করছে তোমার? এত ঘামছ কেন?”,এই বলে নিজের রুমাল বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে।
মনের বাঁধ ভাঙে এবার আরুষির।একে একে বলতে শুরু করে ওর না বলা সমস্ত কথা।যখন কথা শেষ হয় তখন আরুষি খেয়াল করে দেখে আদি পরম নির্ভরতার সঙ্গে শক্ত করে ধরে আছে ওর হাতদুটো।অদ্ভুত মানুষ তো এতকিছু শোনার পর কোনো রাগের লেশমাত্র নেই শরীরে?ওর চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা মুক্তোর মত বিন্দুগুলো মুছিয়ে দেয় আদি তারপর বলে “আচ্ছা অরু এই যে বিয়েতে আমরা দুজনে ‘যদিদং হৃদয়ং তব’ মন্ত্র পাঠ করলাম তার মানে কি জানো?বিয়ে মানেই তো শুধু শরীরী কামনা বা আদিম রিপুর খেলা নয়।শরীরের সুখ তো ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় বলো কিন্তু তাতে কি মনের সুখ পাওয়া যায়?মনের মেলবন্ধন ছাড়া সেটা তো স্রেফ ধর্ষণের সমতুল্য।জোর করে স্বামীর অধিকার দেখিয়ে আমি শুধু তোমার শরীর পেতে চাইনা অরু।তার থেকে আগে আমরা ভালো বন্ধু হই দুজন দুজনকে ভালো করে চিনি জানি বুঝি। মনোবিদ হয়ে যদি মন ছুতে না পারি তাহলে তো ডাহা ফেল করে যাব তোমার কাছে।” আদির বলার ধরণে মনের গুমোট ভাব কেটে যায়, হেসে ওঠে আরুষি।যে মানুষটাকে বড্ড অচেনা মনে হচ্ছিল এতক্ষণ সেই আদির মুখের দিকে এবার ভালো করে তাকায় ও।
জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের একফালি হালকা রোদ এসে দুজনের মুখে পড়ে।কথার উপর কথা জুড়তে জুড়তে কখন সকাল হয়ে এসছে খেয়াল করেনি ওরা দুটিতে।বাইরে শোনা যায় পাখির কলরব।আরুষি বোঝে এখনও কিছু পুরুষমানুষ আছে এই পৃথিবীতে যারা শুধু মন্ত্রপাঠ করে স্বামী হয়না মন ছুয়ে প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে আদিত্যর মত।স্নান সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় আরুষি।আদি এক চিলতে সিঁদুর ছুঁইয়ে দেয় ওর সিঁথিতে। বাড়ির অন্য কেউ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।আদির কাঁধে মাথা রেখে ধীরে ধীরে বাড়ির বাগানে এসে দাঁড়ায় আরুষি।শীতের রুক্ষতা,শুষ্কতার কেটে কৃষ্ণচুড়া ফুলগাছগুলোতে এখন আসন্ন ঋতুরাজের যাদুকাঠিতে নতুন প্রাণের ছোয়া লেগেছে।ফাগুন রঙা বসন্তের আগুন রঙা উপস্থিতিতে নয়নাভিরাম লালের লালিত্যে ভরে আছে চারদিক।এমনসময় আদি গুনগুন করে গেয়ে ওঠে “মাধবী মধুপে হল মিতালি এই বুঝি জীবনের মধু গীতালি।” সলজ্জ হেসে আরুষি মুখ লুকায় আদির বুকে।মনের শীতলতা কাটিয়ে এক হয় দুটি হৃদয়।বসন্তের মিষ্টি বাতাস ছুয়ে যায় ওদের দুটিকে জুটিকে।
(সমাপ্ত)