ভালবাসার নির্মম পরিনতি

ভালবাসার নির্মম পরিনতি

*** বাসের ভেতরের আলো নেভানো, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে মুকিদ চেষ্টা করছে প্রমির শরীরে হাত দেয়ার। মুকিদের এমন আচরনে প্রমি যতোটা না অবাক হয়েছে তারচেয়ে বেশি ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছে তার মাঝে। সে বারবার মুকিদের হাত সরিয়ে দিচ্ছে। তার কি করা উচিত সে বুঝতে পারছেনা। এখন তার মনে হচ্ছে সে এসে অনেক বড় ভুল করেছে। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এভাবে।

ভার্সিটির বেশ কিছু ফ্রেন্ড মিলে শীতার্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরনের জন্য টাকা তুলেছে। তারা রওনা দিয়েছে তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে। শীতবস্ত্র বিতরন সাথে ভ্রমন এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে। সাধারনত মেয়েরা আলাদা ছেলেরা আলাদা বসলেও প্রমি আর মুকিদ একসাথে বসেছে কারন তাদের প্রেমের সম্পর্কটা কারো অজানা নয় ।

মুকিদের এমন আচরন প্রমির কল্পনাতীত। এমন আচরন সহ্য করতে না পেরে প্রমি সজোরে মুকিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো “মুকিদ স্টপ দিস প্লিজ”। সাথে সাথে বাসের আলো জ্বালিয়ে দেয়া হলো। রাতের খাওয়ার জন্য গাড়ি থামানো হয়েছে। মুকিদ লক্ষ্য করলো প্রমির চোখ ছলছল করছে। মুকিদ নিজের আচরনের জন্য লজ্জিত বোধ করছে প্রমির দিকে তাকাতে পারছেনা। গাড়ির সবাই নেমে গেছে। পারভেজ মুকিদকে ডেকে বললোঃ

— কিরে তোরা নামবিনা?
.
– যাচ্ছি তুই যা।
.
মুকিদ প্রমির দিকে তাকিয়ে বললোঃ
– তুমি নামবেনা?
প্রমি কথার জবাব দিলোনা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, তার দিকে তাকাচ্ছেনা। মুকিদ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে বাস থেকে নামলো। বাইরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, প্রচন্ড কুয়াশা। মুকিদ একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার পাশে দাড়ালো।
– একটা সিগারেট হবে ভাই ?
একজনের কন্ঠ শুনতে পেয়ে মুকিদ পেছন ফিরে তাকালো। চল্লিশ উর্ধ্ব একজন ব্যাক্তি এই ঠান্ডায় শুধুমাত্র হাফ হাতা সাদা শার্ট গায়ে দাড়িয়ে আছেন, পায়ে দুফিতার জুতা। লোকটা ঠান্ডায় রীতিমত কাঁপছে। পাগল অথবা কোন নেশাখোর হবে হয়তো। লোকটা মুকিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো বললোঃ
– ভাই একটা সিগারেট হবে।
মুকিদ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিলো। লোকটা কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেটটা নিয়ে বললোঃ
– ভাই লাইটার টা।
মুকিদ লাইটারটা দিলো। লোকটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লো। সিগারেট দেয়ার পরেও লোকটা সেখান থেকে যাচ্ছেনা দাড়িয়ে মুকিদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুকিদ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলোঃ
— টাকা লাগবে?
.
– না।
.
— তাহলে দাড়িয়ে আছেন কেন?
.
– আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই।
.
— কি?
.
-গল্প।
.
— ফাইজলামো করেন, মতলব কি আপনার?
.
– ভাই একটা গল্প বলবো। একটু শুনার পরে শুনতে ইচ্ছা না করলে আপনি চুপ করতে বলবেন আমি আর বলবোনা।
.
মুকিদ পাগল ভেবে তার কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটা তার কথা শুরু করলোঃ
– তেরো বছর আগের কথা। তখন আমি বিএ শেষ বর্ষের ছাত্র। ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলাম। মেসে থেকে পড়ালেখা করতাম। পরিবারের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালোই ছিলো। পরীক্ষার আগে একটু অসুস্থ্য হয়ে পরি। পাশের এলাকায় আমার এক দূর সম্পর্কের চাচা থাকতেন। বাবা বললেন সেখান থেকেই পরীক্ষা দে। মেসে থাকা খাওয়ার সমস্যা। সেখানে থাকলে আমরাও একটু দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবো। বাবার কথা মতো ব্যাগ গুছিয়ে চাচার বাসায় গিয়ে উঠলাম। পুরোনো দোতলা এক বাসা। নিচতলায় দুটো রুম, একরুমে চাচা থাকতেন অন্যরুমে তার মেয়ে শাহানা থাকতো। আমার থাকার ব্যবস্থা হলো দোতলার একটি ঘরে। বাসাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিলো, গাছপালায় ঘেরা নিরিবিলি একটা বাসা। দুপুরে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম ঠিক সেসময় একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম “খাবার কি ঘরে দিয়ে যাবো নাকি নিচে এসে খাবেন”। আমি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটার বয়স সতেরো কি আঠারো হবে। দেখতে শ্যামলা হলেও রূপবতী ছিলো। কিশোরি কিশোরি চেহারা, পাতলা ঠোট, তীক্ষ্ণ নাকের উপর গোল ফ্রেমের চশমা। মনে হয় সদ্য গোসল করেছে। ভেজা চুলগুলো গামছা দিয়ে খোপা বাঁধা। মেয়েটা আবার বললো “খাবার কি ঘরে এনে দিবো”। প্রথম দেখাতেই আমি শাহানার প্রতি দুর্বল হয়ে পরি। সময় যেতে থাকে তার প্রতি আমার দুর্বলতা বাড়তে থাকে। কয়েকদিন পরে বুঝতে পারি শাহানাও আমার প্রতি দুর্বল।

আমি দেখতে যথেষ্ট্য সুদর্শন ছিলাম, গায়ের রঙ ফর্সা, কাঁধ পর্যন্ত ঘন চুল, স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো। কলেজ জীবনে অনেক মেয়ের প্রেম পত্র পেয়েছি। শাহানা আমার প্রতি দুর্বল কিভাবে বুঝলাম সেটা বলি। আমি যখন পড়তাম তখন সে চুপ করে এসে দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকতো। চা দেয়ার অযুহাতে, পানি দেয়ার অযুহাতে বারবার আমার ঘরে আসতো। প্রথম কিছুদিন আমি নিজের কাপড় নিজে ধুয়েছি কিন্তু একদিন লক্ষ্য করলাম ধোয়ার জন্য যেই কাপড়গুলো রেখেছি সেগুলো নেই। পরে দেখলাম শাহানা ধুয়ে দিয়েছে। সেদিনের পর থেকে আমার কাপড় সেই ধুয়ে দিতো। আমার ঘর গুছিয়ে দিতো। মশারি টানিয়ে দিতো। রাতে ঘুমানোর আগে ফ্লাক্সে করে চা দিয়ে যেতো। একদিন দেখি মানিব্যাগ থেকে আমার ছবিটা নেই। মানিব্যাগ যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই আছে, টাকাও ঠিক আছে শুধু ছবিটা নেই। বুঝতেই পারছেন বাসায় তিনটা মাত্র মানুষ ছবিটা কে নিতে পারে। একটা কাজের মহিলা এসে টুকটাক কাজ করে দেয় তার দোতলায় আসার অনুমতি নেই। সে নিলে নিশ্চই টাকা নিবে ছবি নিবেনা। আমি একবার শাহানার জন্য চুড়ি কিনে এনে বিছানার উপর রেখেছি। গোসল করে এসে দেখি চুড়ি নেই। আমি খাওয়ার জন্য নিচতলায় যেতাম। খাওয়ার সময় শাহানা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখলাম দুহাত ভর্তি চুড়ি পড়েছে। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম পরীক্ষা শেষ করে একটা চাকরি পেলেই শাহানাকে বিয়ে করে ফেলবো। ততোদিনে তার ইন্টার শেষ হোক।

আমরা কেউ কখনো কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি। মনে মনে ভালোবাসা, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি বিনিময় করা। এর মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা আছে। সবকিছুই ঠিক মতো চলছিলো, সেদিন দুপুরে কোন এক প্রয়োজনে আমি শাহানার রুমে যাই। শাহানা ভরদুপুরে ঘুমাচ্ছিলো। শাহানার দিকে তাকাতে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিলো কারন তার শাড়ির আচল শরীরের উপর ছিলোনা। শাহানার উন্মুক্ত পেট আমার মাঝে কেমন যেন নেশা সৃষ্টি করছিলো। আমি ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। বারান্দায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে বললাম হয়তো তার শরীর খারাপ যাই একবার তার কপালে হাত দিয়ে দেখি। এটা একটা বাহানা ছিলো শাহানাকে স্পর্শ করার তবুও আমি নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম যে আমার মনে কোন পাপ নেই শুধু তার জ্বর দেখবো। মানুষ পাপ করার আগে তার বিবেক তাকে একবার হলেও বাঁধা দেয়। বেশিরভাগ মানুষ পাপ জেনেও নিজের কাছে একটা যুক্তি দাঁড়া করিয়ে ফেলে পাপ কাজটা করার জন্য। আমি আবারো ঘরে ঢুকলাম। শাহানার পাশে বসে তার কপালে হাত রাখলাম। সত্যি তার শরীরে জ্বর ছিলো। কপালে হাত রাখতেই শাহানা চোখ খুলে তাকালো। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। শাড়ির আচলটা দিয়ে শরীর ঢাকলো। সে কিছুটা অবাক আর রাগের সাথেই বললো আপনি এখানে কি করছেন। আমার মধ্যে সেসময় কি কাজ করছিলো বলতে পারবোনা। আমি যেন নিজের মাঝে ছিলাম না। পশুতে রূপান্তরীত হয়ে গেছিলাম। আমি শাহানার হাত শক্ত করে ধরলাম। শাহানা অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে ছাড়ানোর। তার সেই অসুস্থ্য শরীরের শক্তি আমার শক্তির কাছে পেরে উঠেনি। তার মুখ চেপে ধরায় সে চিৎকার ও করতে পারেনি। একটা সময় সে চিৎকার করার চেষ্টাও করেনি আর। শুধু তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু ফেলেছে। আমি এতোটাই পশুতে রূপান্তরীত হয়েছিলাম যে তার চোখের জল আমার হৃদয় গলাতে পারেনি। ঘর থেকের বের হওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম হাতের চাপ পড়ে শাহানার চশমাটার একটা কাঁচ ভেঙ্গে গেছে। হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
.
মুকিদ কখন লোকটার কথায় মনোযোগ দিয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি। লোকটার কথা শুনে মুকিদ প্রশ্ন করলোঃ
— আপনি শাহানাকে ধর্ষণ করলেন?
.
– হ্যাঁ…
.
— তারপর?
.
– আমি ভয়ে ছিলাম শাহানা তার বাবাকে কিছু বলে কি না। কিছু বলেনি। সেদিন দুপরে আর রাতে শাহানা কিছু খায়নি। ঘর থেকেই বের হয়নি। সেদিনের পর শাহানা কখনো আমার ঘরে আসেনি। শাহানার সাথে আমার দেখা হতোনা। টেবিলের উপর খাবার রাখা থাকতো আমি নিজে নিয়ে খেতাম। সেসময় শাহানার দাড়িয়ে থাকা মিস করতে শুরু করি। পড়ার সময় বারবার দরজার দিকে তাকাতাম কিন্তু শাহানা আর কোনদিন আসেনি। তার অনুপস্থিতি আমাকে ভেতরে ভেতরে কষ্ট দিতে শুরু করলো। একদিন বাসায় ফিরে দেখি আমার বিছানার উপর আমার ছবিটা রাখা। শাহানা সেদিনের পর থেকে পুরোপুরি বদলে গেলো। কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিলো। সেদিনের পর কখনো তার মুখে হাসি দেখিনি। সারাক্ষন ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতো। খাওয়া দাওয়া করতোনা। একদম চুপচাপ থাকতো। তাকে দেখে মনে হতো একটা মৃত লাশ।

সপ্তাহখানেক পরে একদিন রাত জেগে পড়ছিলাম। পড়ছিলাম বললে ভুল হবে কারন পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না। অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা হলে বাসায় জানাবো আমি শাহানাকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু হঠাৎ শাহানার চিৎকার শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠলো। শাহানা চিৎকার করে কাদছে। আমি দ্রুত নিচতলায় নেমে আসলাম। চাচা ভীত মুখে শাহানার দরজার সামনে ডাকাডাকি করছে। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে শাহানার চিৎকার করে কান্নার শব্দ আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছিলো। একসময় কান্নার শব্দ কমে আসলো। চাচাকে তার ঘরে পাঠিয়ে আমি দোতলায় চলে আসলাম। সারারাত চেয়ারে বসে কাটালাম। এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাতে পারলাম না। দিন দিন শাহানার পাগলামো শুরু হলো, সেদিন শাহানাকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চোখ যেন কোঠরে ঢুকে গেছে, শুষ্ক ঠোট, এলোমেলো চুল। হাতের নখ দিয়ে সারা শরীর আঁচর কেটেছে এমনকি মুখেও। বিছানা ভর্তি কাঁচের চুড়ির ছোট ছোট টুকরায়। কি ভয়ংকর অবস্থা। শাহানাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আমি সবকিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে পালিয়ে আসলাম।
.
মুকিদ প্রশ্ন করলোঃ
— তারপর? শাহানার কি হলো।
.
– জানিনা।
.
— জানেন না মানে?
.
– আমি পালিয়ে ঢাকা চলে আসি।
.
— আপনি বলেছেন এটা তেরো বছর আগের ঘটনা।
.
– জ্বি…
.
— তেরো বছরে শাহানার খোঁজ নেননি?
.
– সে উপায় ছিলোনা।
.
— উপায় ছিলোনা নাকি ভয়ে খোঁজ নেননি?
.
– আমি জেলখানায় ছিলাম।
.
— ও পুলিশ আপনাকে ধরেছে তাহলে।
.
– হুম ধরেছে তবে অন্য অপরাধে।
.
— আর কি অপরাধ করেছেন?
.
– ঢাকায় পরিচিত কেউ ছিলোনা। প্রথম দিন রাস্তার পাশে ঘুমিয়েছি সকালে দেখি ব্যাগ নেই। পথে পথে ঘুরেছি। যেখানে সেখানে ঘুমিয়েছি। খাওয়া নেই গোসল নেই পাগল প্রায় অবস্থা। এক লোক দয়া করে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
.
— এতো কথা না বলে জেল এ কিভাবে পৌঁছালেন সেটা বলেন।
.
– একদিন পুলিশ এসে মার্ডারের অপরাধে ধরে নিয়ে গেলো।
.
— আপনি মার্ডার ও করেছেন।
.
– না। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। বস্তিতে এক ঘরে চারজন থাকতাম। তারা এর সাথে জড়িত ছিলো আমি বিনাদোষে দু নম্বর অপরাধী হয়ে জেল খাটলাম।
.
— ছাড়া পেয়েছেন কবে?
.
– আজ দুদিন হচ্ছে।
.
— তবুও একবার শাহানার খোঁজ নিতে ইচ্ছা করেনি?
.
– তার খোঁজেই যাচ্ছি। ট্রাকওয়ালাকে অনুরোধ করে এই পর্যন্ত পৌঁছে নিয়েছি। সে অন্যপথে যাবে তাই অপেক্ষা করছি কোন ট্রাকের। টাকা ছাড়া কেউ সাথে নিতে চাচ্ছেনা।
.
— যাবেন কোথায়?
.
– পঞ্চগড়। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
.
–তেতুলিয়া।
.
– ভাই কোন ভাবে আমাকে সাথে নেয়া যায়?
.
— দেখছি ব্যাপারটা।
.
খাওয়া শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠছে। মুকিদ সবার সাথে কথা বলে লোকটার সাথে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। পারভেজ লোকটাকে তার ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে দিলো। লোকটার সাথে সেল্ফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করলো। ক্যাপশনে লিখলো পছন্দের চাদরটা এক অসহায় ভাইয়ের কষ্টের কাছে কিছু না। কথাটা মিথ্যা চাদরটা তার পছন্দের না। পুরোনো চাদর দুজায়গায় ছেঁড়া। সে সেটা সাথে নিয়েছে কাউকে দান করে সেল্ফি তুলে আপলোড করার জন্য। যাই হোক কারো উপকার হয়েছে এটা সত্য। মুকিদ প্রমির পাশে বসতে গিয়ে কেন যেন বসার সাহস করতে পারলোনা। পিছনে গিয়ে সেই লোকটার পাশে বসলো। এতোক্ষনে আলোতে লোকটার মুখটা ভালোভাবে দেখলো সে মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উজ্জল ফর্সা, লোকটা সত্যি অনেক সুদর্শন। যুবক কালে কতোখানি সুদর্শন ছিলো সেটা ধারণা করে বলা যায় লোকটা শত নারীর প্রেম পত্র পাওয়ার যোগ্যতা রাখতো। কিন্তু লোকটার চোখের নিচটা কালি জমে একদম কালো হয়ে গেছে যেন কতোরাত ঘুমায় না।

মুকিদ লোকটাকে বললোঃ
— আপনার যদি শাহানার সাথে দেখা হয় আপনি তাকে কি বলবেন?
.
– ক্ষমা চাইবো। বলবো সৃষ্টিকর্তা আমার পাপের শাস্তি আমাকে দিয়েছেন, তুমি যা শাস্তি দিতে চাও দিতে পারো।
.
— বিনা দোষে নাহয় তেরো বছর জেল খেটেছেন। আপনি মনে করছেন আপনার পাপের প্রাশ্চিত্ব হয়ে গেছে?
.
– যদি বলি আমি তার থেকে বড় খেসারত দিয়েছি।
.
— কিভাবে?
.
– সমকামিতা বুঝেন।
.
— সরি?
.
– সমকামিতা। আগের যুগে যখন জলদস্যুরা যখন মাসের পর মাস জাহাজে করে সমুদ্রে ভেসে বেড়াতো তখন যাত্রা শুরুর আগে অনেক পুরুষ অন্যপুরুষকে সঙ্গি হিসেবে বেছে নিতো। জেলেও অনেকসময় এটা দেখা যায়। সভ্য সমাজ যৌনতার কথা শুনলে নাক সিটকায়।
.
— এসবের সাথে আপনার সম্পর্ক কি?
.
– জেলখানায় বেশ কিছু কয়েদি দীর্ঘসময়ের জন্য জেল খাটছে। যারা বড় মাপের অপরাধী তারা জেলের ভেতর থেকেই বাইরের অপরাধ নিয়ন্ত্রন করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য জেলের পুরুষদের ব্যবহার করে।
.
— কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে। এখন তো মনে হচ্ছে আপনার মাথায় সমস্যা।
.
– আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাদের থেকে বাঁচার। কিন্তু জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই করে বাঁচা সম্ভব না। পুরুষ হয়ে পুরুষের কাছে ধর্ষিত হবার পরে আমি জেলের ভেতরে ফাঁস লাগানোর চেষ্টা করি। কোন ভাবে বেচে যাই। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে স্পর্শ করলে কতোখানি জঘন্য অনুভব হয়। কতোখানি অপমানিত বোধ হয়। আমি সেই মুহূর্তে অনুভব করেছি শাহানার কষ্টের কথা। জেলে থাকতে আমি ঘুমাতে পারতাম না চোখ বন্ধ করলেই শাহানার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। স্বপ্নের মাঝে শাহানার কান্না শুনে চিৎকার দিয়ে ঘুম ভাঙ্গতো। আমি মানছি আমি এমন অপরাধ করেছি যার কোন ক্ষমা নেই কিন্তু এও সত্যি আমি তাকে ভালোবাসি।
.
মুকিদের লোকটার কথাগুলো শুনতে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে, কেমন যেন রুচিতে বাঁধছে। সে উঠে গিয়ে প্রমির পাশের সিটে গিয়ে বসলো। প্রমি ঘুমাচ্ছিলো কিন্তু মুকিদের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র জেগে উঠলো। প্রমির আতঙ্কে ভরা ভীত মুখ দেখে মুকিদের বুক ধ্বক করে উঠলো। ক্ষনিকের জন্য মনে হলো প্রমির মাঝে সে শাহানাকে দেখতে পাচ্ছে। শাহানা যেমন তার ভালোবাসার মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়ে প্রমিও ক্ষেত্রেও সেটা হচ্ছে। একটা মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ অনুভব করার কথা তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে। কিন্তু তার কাছেই যদি নিজের সাবধনে থাকতে হয়, ভয়ে থাকতে হয় তাহলে ভালোবাসার মূল্য কোথায়। যদি রিক্সার হুট তুলায় সময় প্রেমিকের আচরন কি হতে পারে সেটা ভেবে ভয়ে মেয়েটির বুক কাঁপে তাহলে সেই প্রেমিকের চেয়ে রাস্তার মানুষ অনেক ভালো। প্রেমিকের অন্যায় আবদার পূরণের জন্য যদি মেয়েটির নিজের আত্মসন্মান বিসর্জন দিতে হয়, যদি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য প্রেমিককে শরীর দান করে নিরবে অশ্রু ফেলতে হয় তবে সেই প্রেমিকের ভালোবাসায় ধিক্কার। মুকিত নিজের অপরাধ বুঝতে পেরে প্রমির দিকে তাকাতে পারছেনা। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। সে কোন ভাবেই কান্না থামাকে পারছেনা। প্রমি বিষয়টা খেয়াল করতেই বললোঃ
.
— এই কি হলো কাদছো কেন? মুকিদ। কি হয়েছে তোমার।
.
– প্রমি আই এ্যাম সরি।
.
— কি হয়েছে বলবে তো।
.
– আসলে আমি অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম, প্রমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কখনো এমন ভুল হবেনা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।
.
মুকিদের কান্না দেখে প্রমির কান্না পাচ্ছে। প্রিয় মানুষের কান্না উপেক্ষা করা যায়না। প্রমি মুকিদের হাতটা শক্ত করে ধরে বললোঃ
– প্লিজ কান্না থামাও আমার ভালো লাগছেনা। তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারিনা। প্লিজ।
.
প্রমি দুহাতে মুকিদের চোখের পানি মুছে দিচ্ছে আবারো মুকিদের চোখ ভিজে যাচ্ছে।
.
খুব ভোরে বাস লোকটিকে পঞ্চগড়ে নামিয়ে দিলো। তখনো মুকিদ আর প্রমি দুজনে ঘুমে। প্রমি মুকিদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। মুকিদ প্রমির হাত ধরে রেখেছে।

.. গাড়ি থেকে নেমে সারোয়ার দেখলো শহরটা কতোখানি বদলে গেছে। সারোয়ার সাহস করতে পারছেনা শাহানার বাসায় যাওয়ার। অনেকক্ষন রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সারোয়ারের চোখ থমকে গেলো। রাস্তার পাশে এক পাগলী ঠান্ডার কারনে নবজাতক শিশুর মতো হাটু বুকের কাছে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে ঠান্ডায় কাঁপছে। পাগলির গায়ের ময়লা ছেঁড়া শাড়িয়া খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। পাগলিটাকে চিনতে খুব বেশি কষ্ট হলোনা সারোয়ারের। মুখের আঁচরের দাগগুলো কালো হয়ে গেছে। চোখে এখনো একটা কাচ ভাঙ্গা চশমাটা রয়েছে। চশমার কাঁচটায় ময়লার স্তর জমেছে। সারোয়ার তার চাদরটা খুলে শাহানার গায়ের উপর রাখতেই শাহানার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অনেকক্ষন সারোয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরুর করলো। শাহানা সারোয়ারকে চিনতে পেরেছে কি না সারোয়ার জানেনা তবে শাহানা তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বহুকালের তৃষ্ণা ও চোখে। সারোয়ারের সাহস নেই সেই চোখের দিকে তাকানোর। তবে বাকি জীবনটা সে শাহানার সাথে কাটাতে চায়। প্রয়োজনে রাস্তার পাশেই থাকবে সে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য হলেও চোখের আড়াল করবেনা।

.. মুকিদের আর প্রমির যখন ঘুম ভাঙ্গবে মুকিদ হয়তো প্রমিকে সন্মানের চোখে দেখতে শিখে যাবে। আজকের পর থেকে প্রমি হয়তো বাবার পরে আরেকটি নিরাপদ বুক খুঁজে পাবে মাথা রেখে নির্ভয়ের ঘুমানোর জন্য।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত