বৃষ্টি পাগলীর বিয়ে

বৃষ্টি পাগলীর বিয়ে

আজ এই দিনে প্রিয়ন্তী নামের মেয়েটিকে আমি ঘরে তুলে এনেছিলাম। হুটহাট এরেঞ্জ বিয়ে। বাবা মা দশ বাড়ি খুঁজে মেয়েটিকে পছন্দ করে আসে। সেই থেকে প্রতিনিয়ত কানের কাছে চলতো মেয়েটির রূপগুণের প্রশংসা। ছুটিতে বাড়িতে আসলেই আমার আর রেহায় নেই। মা’য়ের একটাই আবদার “চলনা মেয়েটাকে গিয়ে একবার দেখে আসি মাঝেমাঝে মনে হত দ্রুত চাকুরী পেয়ে যাওয়াটা মনে হয় গুরুতর অপরাধ! সেই অপরাধের শাস্তি সরূপ সবাই বিয়ে করাতে উঠেপড়ে লেগেছে। ইচ্ছে ছিল আরাম আয়েশ করে নিজ টাকা উড়িয়ে বিন্দাস দুই একটা বছর কাটিয়ে দেব; তা আর হল না।

প্রতিবার নানান অজুহাতে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও শেষমেশ প্রিয়ন্তীর দাড়প্রান্তে এসে ধরা পড়ে যাই। মেয়েটা আসলেই প্রশংসা করার মতনই একটি মেয়ে। সামনাসামনি তাকে দেখে.. না আর করতে পারি না। প্রথম দেখাতেই মনের জঙ ধরা তালাটি ভেঙে যায়! মনে মনে অজান্তেই বিয়ের স্বপ্নে হাবুডুবু খেয়ে বসি! ছেলের সম্মতির আভাষ পেয়ে আব্বু আম্মুর আর কোনো দেরি নেই। মেয়েকে আংটি পড়িয়ে সব ঠিকঠাক করে আসে। মুরুব্বীরা কথাবার্তা এগিয়ে ফাইনাল করে দেয়… সামনের শুক্রবারেই সাদিক প্রিয়ন্তীর বিয়ে! জাঁকজমক অনুষ্ঠানের বোঝা টানার সামর্থ্য প্রিয়ন্তীর পরিবারের নেই। কোন মতে মেয়েটিকে গুছিয়ে দিতে পারলেই যেন তারা বেঁচে যায়। অবশ্য এই নিয়ে আমার বাবা মায়ের কোনো অবজেকশন নেই, মনের মতন লক্ষী একটা বৌ পেতে যাচ্ছে, তাতেই বা কম কি?! অবশেষে বিয়ের দিনটি চলে আসে।

সকাল থেকেই টুপটাপ বৃষ্টি। বৃষ্টি আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর। এই বৃষ্টি নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা কেন যে এত মাতামাতি করেন আমার কিছুতেই বুঝে আসে না। ছ্যাতছ্যাতে ঘুমন্ত একটি পরিবেশ, এই নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে! আজ বৃষ্টি থামার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে হচ্ছে বৃষ্টিরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে সব যুক্তি করে এসেছে! ঘুরেফিরে বিয়ের দিনটাকেই তারা বেছে নিয়েছে, সাদিক বাবু… এবার পালাবে কোথায়! ঐপ্রান্তে নববধূ সাজে বসে থাকা প্রিয়ন্তীর চোখদুটি.. খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। জানালার পাশে বসে বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণে ডুবে রয়েছে সে। বড্ড আফসোস, বিয়ের জন্যে আজ তার বৃষ্টিতে ভেজা হলনা। বাহিরে দিনভর বৃষ্টি হচ্ছে আর প্রিয়ন্তী হাত পা গুটিয়ে ঘরে! এমন ঘটনার ইতিহাস নাকি খুবই কম।

মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলি। যদি কেউ প্রিয়ন্তীকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে.. মেয়েটি কেমন?, তাহলে এককথায় উত্তর দেব হাস্যোজ্জ্বল বৃষ্টি পাগলী একটি মেয়ে! বৃষ্টির প্রতি তার যে প্রবল টান.. তা প্রথম রাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। গাড়ির ভেতর বিদায়ের কান্না থেমে যাওয়ারপর উইন্ডো গ্লাস অর্ধেক নামিয়ে দেই। বাহিরে বাতাস.. সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এই সুযোগে মেয়েটি মেহেদী রাঙা হাতটা বাহিরে বাড়িয়ে দেয়, বৃষ্টির স্পর্শে নিজ আত্মার পিপাসা মেটায়। আমি অবাক নন্দিত চোখে তাকিয়ে মেয়েটার কান্ড দেখছি প্রিয়ন্তী কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে দেয়.. আর বলে উঠে… “বৃষ্টি আমার অনেক অনেক অনেক ভাল লাগে! আচ্ছা আপনার বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে?!” তাহার প্রশ্নটা শুনে আমার মুখখান ফুটো বেলুনের মত চুপসে যায়! মনে মনে বলি… হায় রে কপাল!  আমি নিশ্চিত বাহিরে বৃষ্টিগুলো সব দল বেধে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে… “সাদিক বাবু… এইবার কেমন লাগে??!”

এলাকায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা বেজে যায়। বৃষ্টিগুলো সাদিকের বিয়েতে আনন্দমিছিলে মেতে উঠেছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি রূপ পালটে ঝুমঝুম করে ঝড়তে থাকে। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি, এদিকে অবিরত পানি ঢুকে যাওয়ায় গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। খুব সামান্য একটু পথ বাকি, বাসা দেখাই যাচ্ছে কিন্তু হাঁটার মতন সেই অবস্থাটা বর্তমানে নেই।  ইতিমধ্যে দুটো ছাতা হাজির হয়ে যায়। একে একে ছাতায় চেপে সবাই বাসার গ্যারেজে গিয়ে উঠে। এবার লাস্ট ট্রিপে.. আমি আর প্রিয়ন্তী।। দুজনে এক ছাতার নিচে; খুব কাছাকাছি কদম মিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

উৎসুক প্রতিবেশীরা আমাদের আসার অপেক্ষায় বাড়ির গেইট থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ করেই তীব্র আলোকছটা চোখে এসে পড়লো, খুব কাছেই প্রকট শব্দে বজ্রপাত! প্রিয়ন্তী বৃষ্টি যতটা ভালবাসে ঠিক ততটাই ভয় পায় বজ্রপাতকে। বিকট শব্দে ভয়ে আমার বাহুটা খামচে ধরে! আচমকা অচেনা নারীর স্পর্শে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই। ফলাফল পা পিছলে.. ঠাশ !! বাতাসে ছাতাটা দুমড়েমুচড়ে কয়েক গজ পেছনে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা হৈহুল্লোর শুরু করে দেয়…. “হায় হায় সর্বনাশ! বউ ভিজে গেলো!!” জামাই পড়ে গিয়েছে এদিকে কাউরো ভ্রুক্ষেপ নেই, বউ ভিজে গেল, এই নিয়ে সবার যত মাথাব্যথা! এদিকে আমি অসহায় হয়ে ছাতা সামলাতে ছুটে যাই।

ততক্ষণে দুজন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার !! কি আর করার, দুজনে কাকভেজা হয়ে বাসার নিচে পা রাখি। দুজনের গা বেয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। সবাই আমাদেরকে দেখে হতভম্ব!  রমজান চাচ্চু এগিয়ে আসেন, বয়স উনার পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব হয়ে গেলেও রসকস একটুও কমেনি। দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে.. দরাজ কন্ঠে বলে উঠেন “সা..দি..ক….. সামান্য একটা ছাতাই সামলাতে পাড়িসনেএএ, …বউ সামলাবি কি করে?? !!” একেকজন হাতে তালি মেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। প্রিয়ন্তী অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখেছিল। নতুন বউদের নাকি হাসতে মানা। এটা আমাদের অলিখিত দেশীয় সংস্কৃতি। চাচার রসিকতায় সংস্কৃতিটা আর ধরে রাখতে পারলো না, মুখে হাত রেখে প্রিয়ন্তীও খিক খিক করে হেসে দেয়। আর আমি, ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে!

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখি মানুষটি হচ্ছে প্রিয়ন্তী। বৃষ্টি পাগলী মেয়েটাকে প্রকৃতিরা এমন সারপ্রাইজ গিফট দেবে, ভাবতেও পারেনি। জীবন সঙ্গীর হাত ধরে.. বৃষ্টি রাতে ভিজে ভিজে শশুড়বাড়িতে প্রথম পদার্পণ! তাও আবার এমন বৃষ্টি বিমুখ ছেলেটিকে নিয়ে! আহা… প্রকৃতির তরফ থেকে এ এক অসাধারণ সংবর্ধনা !!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত