বৃষ্টি পাগলীর রাজকন্যা

বৃষ্টি পাগলীর রাজকন্যা

সেদিন হঠাৎ মাঝরাতে আকাশে মেঘেরডাক। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, বইছে ঝড়ো হাওয়া। আমি বসে আছি আমার ঘুমন্ত মেয়েটির পাশে। প্রিয়ন্তী নেই, আজ চৌদ্দতম রাত! জানালার গ্লাস খুলে বসে আছি। বৃষ্টিগুলোর সাথে একমনে কথা বলে যাচ্ছি কাকে খুঁজতে এসেছিস তোরা? তোদের পাগলীটা যে আজ নেই। খুঁজে এনে দিবি আমার প্রিয়ন্তীকে? বিড়বিড় করে পাগলের মতন কথা বলে যাচ্ছি। কিছুটা ঘুম.. কিছুটা জাগ্রত.. নেশা না করেও মানুষ কখনো কখনো মাতাল হয়ে যায়। আমিও ঠিক তেমন। মাঝরাতের বৃষ্টিগুলোকে জীবন্ত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো তারাও আমার কথাগুলি শুনতে পাচ্ছে। আজ তারা পাগলীটাকে খুঁজে না পেয়ে মনমরা হয়ে চলে যায়। আমিও জানালার ধারে বসে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ি।

রাত তখন সাড়ে তিনটা বাজে। আচমকা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি মোবাইলে রিং হচ্ছে। মাঝরাতে কল দেখলেই ভয় শুরু হয়ে যায়। এই টাইমের কল গুলি বেশিরভাগ অশুভ বার্তা নিয়ে আসে। কেউ মারা গিয়েছে নতুবা কোথাও আগুন লেগেছে কিংবা চুরি, ডাকাতি, এক্সিডেন্ট এইটাইপের আতংকিত যত খবর এই মধ্যরাত গুলোতেই কানে আসে। তারমধ্যে প্রিয়ন্তী নিখোঁজ, প্রতি মুহূর্তে মনে হয় কল রিসিভ করতেই কেউ একজন বলে উঠবে.. স্যার প্রিয়ন্তীর ডেট বডি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে! ধুর..যত্তসব আজগুবি ভাবনা, মাথাথেকে ঝেড়ে দিয়ে কলটা রিসিভ করি। ঐপাশ থেকে নিচু কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে

— হ্যালো আমি, মেঘা কেমন আছে?
— প্রিয়ন্তী!!! ঢোকচিপড়ে কান্নাটা আটকে রেখে বলে যায়

— হুম, কেমন আছো? আমার বাবুটা কেমন আছে??
— প্রিয়ন্তী! তু তুমি কই??? ফিসফিসিয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে.

— বেঁচে আছি  একটু বিপদে
— এখন কোথায় তুমি??

বিকট শব্দে কলটা কেটে যায়। বার বার কল ব্যাক করি মোবাইল বন্ধ। ভোর হওয়ার আগেই মেঘাকে বাবা মার রুমে রেখে থানায় ছুটে যাই। প্রিয়ন্তীর নিখোঁজ সংবাদের পর থেকে বাবা মা আমাদের এখানে চলে আসেন। আজ সবার ভেতরেই কিছুটা আশার আলো।

প্রিয়ন্তীর কন্ঠে ভেসে আসা “বেঁচে আছি!” লাইনটা বার বার কানে বেজে যাচ্ছে। পুলিশ স্টেশনে অফিসারদের আজকের ঘটনা সব কিছু খুলে বলি। সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী নিখোঁজ, তাই স্থানীয় প্রশাসন শুরু থেকেই কেসটি শক্তপোক্ত ভাবে হাতে নিয়েছিল। প্রিয়ন্তীর কলের খবর শুনে তারাও দ্রুত কমিটি বসিয়ে ফেলে। কল ট্র‍্যাকিং থেকে শুরু করে যা যা তদন্তের প্রয়োজন সব ই তারা করে যায়। অবশেষে ঠিক সতেরো দিনের মাথায় প্রিয়ন্তীকে উদ্ধার করে আনে। প্রিয়ন্তী জীবিত ! থানায় বসে আছি। অনেকদিনপর এক ছাদের নিচে.. আমি আর প্রিয়ন্তী! তখনো আমার জানা হয়নি কি হয়েছিল প্রিয়ন্তীর সাথে। সত্যি বলতে জানার আগ্রহটাই মরে গিয়েছে। প্রিয়ন্তীকে জীবিত পেয়েছি এই মুহূর্তে এর বেশিকিছু জানার আর ইচ্ছে নেই। আমি থানায় আসতে আসতে পুলিশ অফিসাররা প্রিয়ন্তীর থেকে জবানবন্দী নিয়ে নেয়। এবার তিনি সব কিছু আমাকে খুলে বলেন।

প্রিয়ন্তী কিডন্যাপ হয়েছিলো! তার বাবার বাড়ির এলাকারই এক বখাটে ছেলের হাতে। ছেলের নাম লিমন। লিমন ক্যাডার নামেই পরিচিত। নামটা প্রিয়ন্তীর মুখেই শুনেছিলাম। প্রিয়ন্তীকে একসময় প্রায়ই রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করে যেত। প্রিয়ন্তীর পরিবার অনেকটা তার ভয়েই লোক জানাজানি না করে চুপেসারে বিয়েটা দিয়ে দেয়। কিন্তু এতদিন পর সে কিভাবে এতকিছু ঘটালো! জানতে পারি পিরোজপুর ছেলেটির মামার বাড়ি। প্রিয়ন্তীর খোজ পেয়ে তাকে তুলে নেওয়ার বিশাল প্ল্যান করে যায়। এবং সে সাকসেস। তবে শেষ অধ্যায়টা সমাপ্তি হয় নি, প্রিয়ন্তীকে নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। মেঘা আর আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে প্রিয়ন্তীকে বন্দী রেখেছিল। এক ফ্ল্যাটে একটি রুমেই আটকে রেখেছিলো টানা সতেরো দিন! সে নাকি প্রিয়ন্তীকে অনেক ভালবাসে। তবে পুলিশের ভাষ্যমতে সে একজন সাইকো। ভালবাসা কি সেটা বুঝার নলেজ তার নেই, পা থেকে মাথা পর্যন্ত শুধু জেদ আর জেদ।

এসব কথা শোনার পর কোনো ছেলেই স্বাভাবিক থাকতে পারে নাহ। গায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। আমার মুখটা রক্তিম লাল হয়ে আসে। পুলিশ অফিসার আমাকে শান্ত করে বলে উঠে… সাদিক সাহেব.. বি কুল। লিমন এখন আমাদের আন্ডারেই আছে। আপনার ব্যাপারটি নিয়ে উপরমহল থেকে যে পরিমাণ চাপ এসেছিল পুরো চাপ লিমনের উপর ঢেলে দিয়েছি। সালা পুরাই সাইকো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই ইন্সপেক্টরের গালে থাপ্পড় মেরে বসেছে! বুঝতেই পারছেন তার কি অবস্থাটা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আধমরা অবস্থায় ট্রিটমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। আসলে সত্যি বলতে এই টাইপের সাইকো আসামীরা কারাগারেও টিকতে পারে না, এদের জায়গা একটাই… আঙুল ইশারা দিয়ে উপরের দিক দেখিয়ে মুচকি হেসে উঠে। এরপর ফর্মালিটি পূর্ণ করে, বিভিন্ন কেইস লেখিয়ে প্রিয়ন্তীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনি। মেঘা খুঁজে পায় তার মায়ের কোল। সে আজ অনেক অনেক খুশি। আর আমি ? আসলে কিছু অনুভূতির লিখিত ব্যাখ্যা থাকে না।

প্রিয়ন্তীর সাথে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্ট যতটা সহজ ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম প্রিয়ন্তী ততটা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। হাস্যজ্জ্বল মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে যায়। আমি জানি সতেরোটা রাত একটি মেয়ের জীবন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তবুও সবকিছু ভুলে প্রিয়ন্তীর মনে সাহস যোগিয়ে যাই। প্রিয়ন্তী আমি আছি তোমার পাশে, হাতে হাত রেখে প্রতিটা মুহূর্তে কাছে থাকার চেষ্টা করি। প্রিয়ন্তীকে একটু একটু করে স্বাভাবিক গড়ে তোলার চেষ্টা করি। তবুও দিন শেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই বাকি থাকে না। আমি হারিয়ে ফেলেছি সেই বৃষ্টি পাগলীটাকে। তাকে জীবিত খুঁজে পেয়েও তার ভেতরের সত্তাটা আজ মৃত। প্রিয়ন্তী ভুলে গিয়েছে সেই বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ, ভুলে গিয়েছে মেঘের ডাকের সেই শিহরিত অনুভূতি। ঝুম বৃষ্টি এখন আর তাকে বাহিরে টেনে নিয়ে যায় না। বৃষ্টি নামলেই তার চোখের বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, হয়তো এই বৃষ্টিগুলোই সেই সতেরো রাতের ভয়ানক সাক্ষী হয়ে আছে।

টিপটিপ বৃষ্টি। অফিসথেকে প্রিয়ন্তীকে কল দিচ্ছি কল রিসিভ হচ্ছেনা। আজ মাসের শেষের দিক, অফিসে অনেক চাপ। সব কাজ ফেলে সন্ধ্যারাতেই বাসায় ফিরে আসি। বাড়ির গেইট থেকে দেখা যাচ্ছে প্রিয়ন্তী ছাদে একা দাঁড়িয়ে! দূর থেকে অন্ধকারে ছায়া মূর্তির মত দেখাচ্ছে। ডাক্তার বারন করে দিয়েছিল তাকে যেন কটাদিন বৃষ্টিতে ভিজতে না দেওয়া হয়। প্রিয়ন্তীর ট্রিটমেন্ট চলছে, মানসিক ট্রিটমেন্ট। দ্রুত ছুটে যাই ছাদের দিকে।

রেলিং ধরে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে মোবাইলটা পানিতে ভিজে যাচ্ছে, সেদিকে প্রিয়ন্তীর কোন খেয়ালই নেই। আমার ডাকেও কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। ভয় ভয় নিয়ে কাছে এগিয়ে যাই। আলতো করে হাতে স্পর্শ করে ডেকে উঠি.. “প্রিয়ন্তী…!” কেমন যেন ঘোরের মধ্য থেকে আচমকা ফিরে আসে। হাত পা একদম ঠান্ডায় জমে আছে, পুরো দেহটা ফ্যাকাসে। হাইপোথার্মিয়া হয়ে দেহ অসাড় হয়ে আছে। দ্রুত কোলে তুলে নিচে নামিয়ে আনি। শুকনো কাপড় গায়ে জড়িয়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে যাই রান্নাঘরের দিকে। সরষের তেল গরম করে হাত পা ম্যাসেজ করে দেই। শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিকে ফিরে আসে। প্রিয়ন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটি প্রশ্নই করে যাই

— কেন স্বাভাবিক হচ্ছনা তুমি? কেন? আমি সব কিছু মেনে নিয়েছি,, সসব, কেন তবুও সেই একইরকম!
— আমিতো চাই স্বাভাবিক হয়ে যেতে আমি চাই সব ভুলে যেতে  কিন্তু ভাগ্য আমাকে হাসিমুখে বাচতে দেবে না

সত্যিই ভাগ্যে নেই। নিয়তি, সাদিক প্রিয়ন্তীকে সত্যিই হয়ত সুখী হতে দেবে না। ড্রেসিং টেবিলে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া খামটা চোখে পড়ে। খুলে জানতে পারি প্রিয়ন্তী প্রেগন্যান্ট !!

আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। এই মুহূর্তে জীবনের রঙ শুধু একটাই, কালো নাহ এটা কখনওই মেনে নেওয়া সম্ভব না। প্রিয়ন্তীর পেটে সেই লম্পটের সন্তান। অ্যাবর্শন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অপশন হাতে নেই। প্রিয়ন্তীর এই নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই, আমার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে জানিয়ে দেয়। আমি জানি সন্তান যার ই হোক মা’তো মা ই। স্বাভাবিক কোনো নারীই চাইবেনা তার বাচ্চাটি ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলতে। প্রিয়ন্তীর মানসিক চিকিৎসা করে যাওয়া ডাক্তারকে সবকিছু খুলে বলি। অ্যাবর্শন করানোটা তার মানসিক অবস্থার জন্য রিস্কি হয়ে যেতে পারে, তবুও বলে দেয় বাকিটুক এখন আপনাদের ব্যাপার।

সিদ্ধান্তে অটল থেকে যাই। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়, কাল অ্যাবর্শন। আজ কারো চোখে ঘুম নেই। দুজনেই চুপচাপ। হঠৎ মাঝরাতে প্রিয়ন্তী পেটে হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে। এটা সাধারণ কোন কান্না নয়, এই কান্না একটি মায়ের মায়া কান্না, তাকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। চোখ বন্ধকরে নিজের সত্তার সাথে তর্ক করে যাই… হায় সেলুকাস! ভ্রূণ হত্যা নিয়ে কতশত প্রতিবাদী কলাম লিখে আসলাম, আজ আমি নিজেই এর ভুক্তভোগী। কাল সাদিকও হয়ে যাবে একজন মানুষ হত্যাকারী! বাস্তবতা সব নীতিবাক্য গুলোকে শেষপর্যন্ত হার মানিয়ে দিচ্ছে। বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

তখন আমি গভীর ঘুমে… চোখের সামনে একটি অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠে. আমি শুয়ে আছি একটি খেয়া নৌকায়, চারিদিক শুধু পানি আর পানি, কালো অন্ধকার নিস্তব্ধ পরিবেশ। আমি একদম নদীর মাঝখানটায়। নৌকাটা আমাকে নিয়ে চর্কির মতন ঘুরছে। নদীর পাড়ে সাদা জামা পরিধেয় একটি বাচ্চা দেখতে পেলাম, পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! ঘুম ভেঙে যায়; ফজরের আজান কানে ভেসে আসে চোখে আর ঘুম আসে না। অস্বস্থিকর.. বিধ্বস্ত অনুভূতি।

সকাল দশটা বাজে অফিস চলে যাই। এরকিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয়ন্তীর ফেইসবুকে একেরপর এক ম্যাসেজ আসতে থাকে, মোবাইলে একটার পর একটা কল। সবার মুখে মুখে একটাই কথা “কনগ্রেচুলেশনস”!  পরিবার আত্মীয়স্বজনদের জানিয়ে দেই… প্রিয়ন্তী দ্বিতীয় বারের মতন মা হতে যাচ্ছে। হুম মেনে নেই পেটে আসা সেই নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে। প্রিয়ন্তীর মানসিক অবস্থার কথা ভেবে কিছু আর করার সাহস পাইনা। তার মধ্যে ভোরে দেখা সেই স্বপ্ন কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা ভুলে গিয়ে জীবনটাকে দায়িত্বের পথে নিয়ে যাই। উপরওয়ালা চেয়েছে বলেই হয়তো নতুন এই প্রাণের স্পন্দন।

হসপিটালে অপেক্ষায় বসে আছি। দখিনা বাতাস বইছে। আমার মত মেঘেরাও আজ ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। প্রিয়ন্তীকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে, আজ রাতেই ডেলিভারি। অপেক্ষারত আমিই মনে হয় একমাত্র নিষ্ঠুর বাবা.. যে কিনা মনেমনে চাচ্ছে বাচ্চাটি মরে যাক! কি অদ্ভুত মন বাসনা! সত্যি বলতে বাস্তব অনুভূতি গুলো গল্পের মতন এতটা পবিত্র হয় না। বাচ্চাকে দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিতে পারলেও কখনো নিজ সন্তানের মত ভালবাসায় আগলে রাখতে পারবো না। আল্লাহ্‌’র দান.. যদি আল্লাহ্‌ই আবার নিয়ে যায় ক্ষতি কি?! মুক্তি পেতাম এতবড় একটি কষ্টের বোঝা থেকে। নার্সরা হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসে “স্যার আপনার মেয়ে হয়েছে!” মনেমনে বলে যাই আমার না, প্রিয়ন্তীর মেয়ে। কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নে চলে যাই.. প্রিয়ন্তী কেমন আছে? — মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ। আলহামদুলিল্লাহ্‌। দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেল। প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে এভাবেই মেয়েটাকে দায়িত্ব নিয়ে বড় করে যাচ্ছি। বৃষ্টি পাগলীর দ্বিতীয় কন্যার নাম রাখা হয় বর্ষা। সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে কন্যার বাবা হয়ে যাই। কন্যার আসল বাবা আজ মৃত। পুলিশের কয়েক দফা রিমান্ডে অসুস্থ হয়ে দুবছর আগেই সে মারা যায়। লম্পটটা মরে গেলেও রেখে দিয়ে যায় অক্ষত বেদনার স্মৃতি।

প্রিয়ন্তী সবদিক দিয়েই প্রায় সুস্থ, তবে আমি হারানো সেই বৃষ্টি পাগলীকে আর খুঁজে পাইনি! এই চারটি বছরে আমি কখনওই প্রিয়ন্তীকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি! এই কষ্টটা আমাকে প্রতিনিয়ত তেড়ে বেড়ায়। যে মেয়েটির রক্তের সাথে মিশেছিল বৃষ্টির পানি সেই মেয়েটি নাকি আজ বৃষ্টি দেখে ভয় পায়! আকাশে মেঘ জমে আসলেই দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকে। নিজেও ভিজে না তার মেয়ে গুলিকেও ভিজতে দেয় না। প্রতিবার বৃষ্টি নামলে আমি সেই পুরনো স্মৃতিচারণে চলে যাই। প্রিয়ন্তীর পুরনো সেই সব পাগলামির দৃশ্য গুলো সাদিককে কখন যে বৃষ্টি প্রেমী বানিয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারিনি।

আজ এই দিনে প্রিয়ন্তীকে বিয়ে করে এনেছিলাম। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। বাহিরের বৃষ্টিদেখে এতক্ষণ সেই স্মৃতিগুলি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আকাশে মেঘের দেখা পেয়েই প্রিয়ন্তী জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঘা আর বর্ষা জানালার গ্রিল ধরে আমার সাথে বৃষ্টি দেখছে। হাজার হলেও বৃষ্টি পাগলীর মেয়ে, ভেতরটা তাদের ছটফট করছে বৃষ্টির স্পর্শ পেতে। প্রিয়ন্তী কখনওই ওদের ভিজতে দেয় না। আজ সে ঘুমিয়ে আছে, সেই সুযোগে মেঘার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠি.. ভিজবি নাকি? এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে.. জিজ্ঞেস করে

— কিন্তু মামুনি ??
— আমি পাহারা দিচ্ছি, কিচ্ছু হবে না, যা ভিজে আয়।

শব্দবিহীন চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ছুটে যায়। এদিকে ছোট মেয়ে বর্ষা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা জন্মের আগের থেকেই এই ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে অধিকার আদায় করতে জানে!

— কি রে মা? তুইও বৃষ্টিতে ভিজবি? একথা বলে নিজেই চুপসে যাই। মেঘাকে দিনে একশোবার মা বলে ডাকলেও বর্ষাকে কখনোওই মা বলে ডাকিনি! বর্ষা উপর নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে যায়। সেও ভিজবে।
— ঠিকাছে আপুর সাথে যা তাহলে। অর্ধেক পথ গিয়ে দৌড়ে ফিরে আসে। আর বলে…
— আব্বু, তুমিও চল আমার সাথে, একা একা ভয় লাগে।
— ভয়ের কিচ্ছু নেই, উপরে মেঘা আছে তো।
— তুমি যাবা না?
— আচ্ছা আমি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেই
— তুমি যাবা না??
— তোর মাকে কে পাহারা দেবে?
— তুমি যাবা না???!

আমি হো হো করে হেসে উঠি! এ তো দেখছে প্রিয়ন্তী নাম্বার টু! সুর.. কথার স্টাইল অবিকল মায়ের মতন! বৃষ্টি পাগলীর মেয়ে বলে কথা। কি আর করার ঘারে চাপিয়ে সোজা চলে আসি ছাদে। বর্ষার এবারই প্রথম বৃষ্টিস্নান। নতুন অতিথিদের পেয়ে বৃষ্টিগুলোও আজ চেপে বসেছে।  বর্ষা বাবার ঘারে বসে দু হাত আকাশের দিকে মেলে দেয়। কখনওই বর্ষাকে এত আদর দিয়ে কোলে তুলে নেই নি। বৃষ্টির পানি তার পুরো দেহ ভিজিয়ে দেয়। টপটপ করে গা ভেজা পানি আমার মুখ গড়িয়ে পড়তে থাকে। চোখ বন্ধ করে এক মনে নিয়ে যাই নিষ্পাপ শিশুর ঘ্রাণ! একটি পবিত্র আত্মা!  আমার মনের ভুলটা নিমিষেই ভেঙে যায়। নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে একদম মন থেকে আপন করে নেই।

হঠাৎ মেঘা দৌড়ে এসে আমার শার্ট খামচে ধরে, বর্ষাও হুড়মুড় করে কোল থেকে নেমে মেঘার পেছনে লুকিয়ে যায়। আরে আরে কি হল হুট করে?! পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ন্তী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে! চোখ বড়বড় করে ভয়ংকর রূপ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে! কাছাকাছি এগিয়ে যাই, আগ বাড়িয়ে বলে উঠি.. “বাচ্চাদের দোষ নেই, আমি নিয়ে এসেছি ওদেরকে”  মুশলধারে বৃষ্টি দেখে প্রিয়ন্তী থরথর করে কাঁপছে, রাগে মুখটা লালচে বর্ণের হয়ে যায়। কিছু বলে উঠার আগেই খুব কাছেই বিকট শব্দে বজ্রপাত! প্রিয়ন্তী ভয়ে এক ঝটকায় আমাকে জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টিরা মুহূর্তেই ভিজিয়ে দেয় প্রিয়ন্তীর দেহকে। আচমকা প্রিয়ন্তীর স্পর্শে এবার আর পা পিছলে পড়ে যাইনি, আজ আমি পড়ে গেলে এদেরকে ধরবে কে? নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হাতে আগলে রাখি সবাইকে। বহুদিনপর বৃষ্টি পাগলীকে খুঁজে পেয়ে বৃষ্টিরা প্রবল বেগে ধেয়ে আসে। প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় প্রতিটা ফোটা তীরের মতন শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তীর হাতটা তখনো কাঁপছিল। তাকে সাহস দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাই, । একটু একটু করে পুরনো যত ভয় গুলি তার কেটে যায়। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে আবারো সে নিজেকে মাতিয়ে তোলে। প্রিয়ন্তীর মুখটায় ফিরে আসে সেই মাতাল করা প্রাণোচ্ছল হাসি! বহুদিন পর খুঁজে পাই আমার হারিয়ে যাওয়া বৃষ্টি পাগলীটাকে।

বৃষ্টিস্নান শেষে প্রিয়ন্তী সিক্ত মনে নিচে চলে যায়। আমাদের বাপ বেটিদের তৃপ্তি তখনো মেটেনি। আরো কিছুক্ষণ মেয়েগুলির সাথে পানিতে লাফালাফি করি। এরপর তিন জন শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে আসি। দরজাটা খুলতেই পুরো বাসা জুড়ে ধোয়া উঠা খিচুড়ির ঘ্রাণ! পাগলীটা একটুও ভুলেনি তার দেওয়া সেই ওয়াদাটিকে!! ভেজা চুল নেড়েচেড়ে সোজা চলে গিয়েছে রান্নাঘরের দিকে!  আমি এরথেকে সুখকর আর কিছুই চাইনাহ। শুধু আরো কয়েকটিবার এই মুহূর্ত গুলি কাটিয়ে যেতে চাই, আরও কয়েকটিবার পাগলের মতন ভিজতে চাই এই পাগলীদের সাথে নিয়ে।

 সমাপ্তি

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত