“তুই আমাকে কেন বিয়ে করেছিস” ছোঁয়ার কথার প্রত্যুত্তরে কি বলবো আমি ভেবে পাই না৷ আমি চুপ করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আমি জানি আমার এমন নির্বোধ থাকার কারণে ছোঁয়া আরো রেগে যাচ্ছে৷
উত্তর দে অতীত ভুলতে না পারলে কেন বিয়ে করেছিস” কথাটা বলেই হু হু করে কেঁদে উঠে ছোঁয়া৷ ছোঁয়ার চোখের জলগুলোকে মাঝে মাঝে আমার বুকের রক্ত মনে হয়৷ নোনাজল ভরা চোখ গুলো দেখলেই আমার বুকের ভেতর রক্তকরণ শুরু হয়৷ মেয়েটার প্রতি আমার এক আকাশ অনূভূতিগুলো বুকের ভেতরেই আটকে থাকে৷ দিনের পর দিন অনূভূতিগুলো আটকে থেকে জমে গিয়েছে৷ আমি চাইলেও আর অনূভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারি না৷ ছোঁয়া নামের মেয়েটার সাথে আমার বছরখানেক আগে বিয়ে হয়েছে৷ আমি জানি না,কেন সেদিন হুট করে বিয়ে করে ফেলেছি৷ আমি এখনো দ্বিধায় ভুগি, অণুকে কি আমি ভুলতে পেরেছি? ছোঁয়াকে বিয়ে করার পর থেকে প্রশ্নটা প্রতিনিয়ত আমার মষ্তিষ্কে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে৷ আমি যতবারই সবকিছু ভুলে ছোঁয়াকে আপন করে নিতে চেয়েছি৷ তখনই অস্পষ্ট অবয়ব আমাকে আটকে দিয়েছে৷ অণুর সাথে পরিচয়ের পর থেকেই আমি মেয়েটাকে নিয়ে দ্বিধায় কাটিয়েছি প্রত্যেকটা মূহূর্ত৷
অণুকে আমি কখনোই ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি৷ সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল বন্ধুত্ব দিয়ে৷ ক্যান্টিনের আড্ডায় যখন আমি অণুর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম৷ অণু তার হাতের লম্বা নখগুলো দেখিয়ে বলতো এমন ভাবে কি দেখিস হু? চোখ তুলে ফেলবো নখগুলো দিয়ে৷ জবাবে আমি ম্মিত হাসতাম৷ চোখ সরিয়ে নিতাম৷ আবার শেষবিকেলে যখন নদীর পাশ ঘেষে অথবা ব্রিজের রেলিং ধরে দু’জন মিলে আকাশ দেখতাম৷ অণু তার কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলতো, তুই এতো হাবলা কেন রে? পাশে এত সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়ানো৷ কোথায় হাত ধরবি৷ কিন্তু তা না করে হ্যাবলার মতৌ দাঁড়ায় আছছ৷ নে হাত ধর৷ আমি আবার দ্বিধান্বিত হতাম৷ আমার খুব বলতে ইচ্ছে করতো মেয়েরা এমন কেন” শেষমেষ আর বলা হতো না৷ যদি কিছু মনে করে বসে৷
অণুর প্রচন্ড রকমের মন খারাপ হতো হুট করে৷ মেয়েটা তখন উশকোখুশকো চুলে মুখে মন খারাপের আভা মাখিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হতো৷ আমার পাশে বসে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতো৷ আমার খুব ইচ্ছে করতো, এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে কি হয়েছে মেয়ে? মন খারাপ কেন? পরে আর জিজ্ঞেস করা হতো না৷ আমি যখন বলতাম বিরিয়ানী রান্না করবি? অণু তখন মুখ ভেঙিয়ে বলতো আমি কি তোর মতো বেকার নাকি? প্রেমিকা জুটোতে পারিস না একটা? যে তোকে বিরিয়ানী রেঁধে খাওয়াবে৷ মেয়েটার কথার উত্তর দিতাম না আমি৷ হুট করে মন খারাপ হয়ে যেতো আমার৷ কিন্তু ঠিক তারপরের দিনই নিজের হাতে রান্না করা বিরিয়ানী নিয়ে হাজির হতো অণু৷ আমার বিষণ্ণ মনটা আনন্দে ভরে যেতো তখন৷
ঘোর লাগানো বর্ষার এক ঝুম বৃষ্টির দিনে অণুকে বলেছিলাম আমাকে ভালোবাসবি? আমার কথা শুনে অণুর মুখটা দেখার মতো হয়েছিল৷ সময়টা থমকে গিয়েছিল৷ মিনিট কয়েক তাকিয়ে থেকে আমার পাশ থেকে উঠে পরেছিল মেয়েটা৷ অণু চলে যাওয়ার পর আমি চারপাশটা ভালো ভাবে দেখে নিলাম৷ পাশের মানুষগুলো যে যার মতো ছিল৷ ভাগ্যিস কেউ দেখেনি৷ নিরিবিলি জায়গা হলে হয়তো আমার গালটা লাল করে দিতো অণু মেয়েটা৷ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে ছিলাম আমি৷ তারপর বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা ধরেছি৷ ভাগ্যিস বৃষ্টি ছিল৷ নয়তো সবার কাছে ছিচকাঁদুনে ছেলে হিসেবে পরিচিতি পেতাম সেদিন৷ ঝুম বৃষ্টির মাঝেই চোখের জল লুকিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম৷ ঠিক তার পরের দিন জ্বর এসে হাজির৷ জ্বরটা সেদিন উপভোগ করেছিলাম বেশ৷ নয়তো অণুর প্রতি জন্মানো অনূভূতিগুলো আমাকে গলা টিপে মারতো৷
দু’দিন পরে আমার দরজায় এসে হাজির হয় অণু মেয়েটা৷ আমার গরম কপালে তার শীতল হাতের পরশ বুলিয়ে দেয়৷ আমি চুপচাপ অনুভব করি৷ চোখ দু’টো খুলতেই খানিকটা অবাক হই আমি৷ অণুর চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে৷ সরু নাকের মাথাটাও হালকা লাল৷ আমি হুট করে এই লাল হওয়ার কারণ জানতে চাই৷ জবাবে অণু বলেছিল সর্দি লেগেছে তোর মতো৷ আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি৷ অণুর কথাটা অবশ্য আমার বিশ্বাস হয়নি৷ আমার কেন জানি মনে হয়েছিল মেয়েটা কেঁদেছে৷ অণুর হাতে বানানো বিরিয়ানী খেয়েছিলাম সেদিন৷ খাওয়া শেষে অণু যখন নিজহাতে ঔষধ খাইয়ে দিতে চেয়েছিল৷ আমি খেতে চাচ্ছিলাম না৷ অণু ভ্রু কুচকে বলেছিল ঔষধ না খেয়ে মরবি নাকি? জবাবে আমি “হ্যা” বলেছিলাম৷ অণু রাগী রাগী মুখ নিয়ে কোমরে হাত রেখে বলেছিল তুই মরলে আমার সাথে প্রেম করবে কে শুনি? মরারই যদি শখ থাকে আমাকে ভালোবাসার কথা বললি কেন হু?
কথাটা শোনামাত্রই আমার ভোতা হয়ে যাওয়া অনূভূতিগুলো পুনরায় জেগে উঠে৷ অসুস্থ শরীর নিয়ে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিলাম৷ আমার পাগলামো দেখে অণু সেদিন খিলখিল করে হেসেছিল৷ পরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো৷ নিজেকে পৃথিবীর সুখী মানুষগুলোর একজন ভাবতে শুরু করেছিলাম৷ আমার প্রত্যেকটা সকাল শুরু হতো অণুর মুখে “ভালোবাসি” কথাটা শুনে৷ হোক না সেটা মোবাইল ফোনে৷ আমার মনে হতো, আমার কানের পাশে মুখ গুজে অণু বলছে “ভালোবাসি” শেষবিকেলের ম্লান রোদে নদীর পাড়ে বসে থাকা৷ কিংবা রিক্সায় পাশাপাশি বসে হা করে বাতাস গেলা৷ মন খারাপের ভান করে অণুর গালটানা৷ অরুচির কথা বলে বিরিয়ানী খাওয়ার বাহানা ধরা৷ এক রৌদ্রজ্জল সকালে বিষণ্ণ মুখ নিঃযে আমার কাছে হাজির হয় অণু৷ আমার হাত ধরে বলেছিল “নীল তুই আমার প্রেমিকের আগে একজন ভালো বন্ধু৷ আমি তোকে ঠকাতে পারবোনা৷ বিশ্বাস কর৷
আমি প্রচন্ড পরিমাণের চেষ্টা করে তোকে প্রেমিকের আসনে বসাতে৷ কিন্তু বারবার ব্যার্থ হয়েছি আমি৷ প্রেমিক হিসেবে আমি কখনোই তোকে ভালোবাসতে পারিনি৷ আমি অনুভব করি, তোর মায়া মায়া মুখটার আবদার আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি সেদিন৷ তাই হুট করে ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছি৷ আমি সারাটা জীবন তোকে বন্ধু ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারবো বলে মনে হয় না৷ আমি ধোঁকা দিতে চাই না তোকে৷ তোর জায়গায় অন্যকেউ হলে আমি এতদিনে নিরুদ্দেশ হতাম৷ কিন্তু তুই বলে আমি পারছিনা৷ তোর অনূভুতির সাগরে হাত ছোঁয়ানোর যোগ্যতা আমার নেই৷ ভালো থাকিস তুই৷ আর হয়তো এই অপরাধী মুখ নিয়ে তোর সামনে আসা হবে না” কথাগুলো বলেই দ্রুত প্রস্থান নেয় অণু৷ আমি চুপ করে ছিলাম৷
সেদিন বৃষ্টি ছিল না৷ কড়া রোদের নিচে বসে চুপচাপ চোখের জল ফেলেছিলাম৷ ঘুমহীন রাতে অণুকে ভেবে মুখে বালিশ চেপে কেঁদেছি৷ মাঝরাতে হুট করে ঘুম ভাঙার পর অণুকে মনে পরেছে৷ শেষবিকেলের ম্লান রোদে বিষণ্ণতা ভর করতো আমার মনে৷ দিনশেষে নিজেকে প্রচন্ড রকমের একা মনে হয়েছিল৷ বিষণ্ণতার সাগরে যখন গা ভাসিয়ে দিচ্ছিলাম৷ ঠিক তখনই মায়ের স্নেহভরা হাতটা পরশ বুলিয়ে দেয় আমায় মাথায়৷ এরপরে যখনই অণুকে মনে করে বুকের বেদনাটা উকি মেরেছে৷ আমি ততবারই মায়ের কোলে মাথা রেখেছি৷ সেই ছোট্ট খোকার মতো মায়ের কোলে মাথা রেখে জোৎস্না দেখেছি৷ মনের আকাশের বিষণ্ণতাগুলো কাটতে খুব বেশিদিন লাগেনি৷ মন খারাপের শক্ত কাঁচে ফাটল ধরিয়ে ঠিকই রোদ এসে উখি মেরেছে আমার মনের আকাশে৷ কাটিয়ে দিয়েছিল বিষণ্ণতাগুলো৷
এক সন্ধ্যায় মা আমার পাশে এসে চুপচাপ বসে ছিল৷ কারণ জিজ্ঞেস করতেই একটা ছবি ধরিয়ে দিয়েছিল হাতে৷ লজ্জা পেয়েছিলাম বটে৷ ছোঁয়া মেয়েটা আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকতো৷ মেয়েটার সাথে বার কয়েক চোখাচোখি হয়েছিল৷ কথা হয়নি কখনো৷ মায়ের ভাষায় প্রচন্ড পরিমাণের লক্ষী মেয়ে ছোঁয়া৷ আমিও মায়ের পছন্দ অনুযায়ী সায় দিয়েছিলাম৷ বিয়েটাও হয়েছিল ঠিকঠাক৷ তারপরেই সবকিছুর শুরু৷ অণু নামটা মনে পরলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ আমি জানি না, একজন বিশ্বাস ঘাতকের জন্য আমার কেন এতো মায়া হয়! প্রতিটা রাতে আমি প্রতিজ্ঞা নিয়ে চোখ বুজেছি, আগামী দিনের সকালটা নতুন করে শুরু করবো বলে৷ কিন্তু সকালের রোদটা আমার চোখেমুখ ছুঁয়ে দিতেই আমার অন্যরকম লাগতো৷ অণুর প্রতি জমানো অনূভূতিগুলো রোদের স্পর্শে এসে আবারো জেগে উঠতো হয়তো৷
ছোঁয়ার জন্য আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয়৷ মায়া মায়া চাহনীর গোলগাল মুখ ওয়ালা মেয়েটা আমার মতো চালচুলোহীন একজনের জন্য দিমের পর দিন অবহেলা সহ্য করে যাচ্ছে৷ সবকিছু হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে৷ বিনিময়ে আমি কিছুই দিতে পারিনি৷ আচ্ছা, একজন বিশ্বাস ঘাতকের জন্য কেন এত ভাবছি আমি? ( সবার মুখে জবাব চাই) বিশ্বাস ঘাতকের জন্য জমিয়ে রাখা এক আকাশ অনূভুতিগুলো দিয়ে আমার জন্য পথ চেয়ে থাকা মায়া মায়া চেহারার মেয়েটার দিনগুলো রাঙিয়ে তুলি! খুব কি ক্ষতি হবে? না আজ আমি দ্বিধায় ভুগছিনা৷ আমার পাশটায় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে ছোঁয়া৷ আমি জানি মেয়েটা কিছুক্ষণ পর আমাকে সরি বলবে৷ আর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলবে আপনার আমাকে ভালোবাসতে হবে না৷ আমিই ভালোবেসে যাবো আপনাকে ৷ সত্যিই মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে ৷ নয়তো আমার মতো একজনের জন্য কখনোই বসে থাকতো না কেউ৷ যে কিনা এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়ে এক টূকরো ভালোবাসা দিতে পারিনি ৷
আমি টুপ করে ছোঁয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বসি৷ ছোঁয়া চমকে উঠে৷ তার হাত দু’টো আমার দু’গালে চেপে ধরি৷ ছোঁয়া আমার প্রতিসকালের ঘুমটা তোমার ভেজা চুলের পানি চিটিয়ে ভাঙাবে৷ ঘুম ভাঙার পরেও আমি অনেকক্ষণ তোমায় জড়িয়ে ধরে রাখবো৷ শেষবিকেলে হাত হাত রেখে হাঁটবো৷ জোৎস্না রাতে বারান্দায় আমার কাঁধে মাথা রেখে তুমি বসে রইবে৷ তুমি চাঁদ দেখবে, আর আমি দেখবো চাঁদের ন্যায় তোমাকে৷ আমার প্রচন্ড মন খারাপে প্রতি মিনিটে তিনবার তোমার গাল টানবো৷ অরুচির ভান করে তোমার হাতে রান্না করা বিরিয়ানী খাবো৷
ও হ্যা! তোমাকে বলা হয়নি৷ তোমার হাতে রান্না করা বিরিয়ানী গুলো অনেক মজার৷ আমার এতসব আবদার পূরণ করে আমাকে আবার ভালোবাসবে নতুন করে? ছোঁয়া আমার কথার উত্তর দেয় না৷ ঠোঁটে ঠোঁট চোখ জল বিসর্জন এর সাথে মুচকি হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখে৷ আমার হুট করে নিজেকে সুখী মানুষ মনে হয়৷ আর কিছু বলিনা আমি৷ আমাদের দু’জনের অনূভূতি মিলিয়ে একটা সাগর তৈরী হবে৷ সেই সাগরে আমরা সাঁতরে বেড়াবো৷ হাতে হাত রেখে পার করবো বাকি জীবনটা৷ বিঃ দ্রঃ উপরের করা প্রশ্নের জবাব টা দিতে ভুলবেন না।
সমাপ্ত