-এই যে মি: এরপর থেকে অামার দিকে এমন করে তাকিঁয়ে থাকতে দেখলে কিন্তু চোঁখ দুটো তুলে নেব। এই বলে দিলাম।একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল।
(-আমি আকাশ । অনার্সে ৩য় বর্ষে পড়ি। আর যে উপরের কথাগুলো বলল সে হল -‘ঋদ্ধি’। আমাদের পাশের বাসার থাকে।এবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে। আমার জুনিয়র হলে কি হবে? আমার সাথে এমন ব্যবহার করে যেন আমার সাথেই পড়ে।’ঋদ্ধিকে’দেখলে কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। ওর কাছে গেলে মনে হয় আমার চারপাশ স্তব্ধ হয়ে গিয়ে তার মাঝে বিলিন হয়ে যায়।)
-যাই হোক, প্রতিদিনের মত আজও বন্ধুদের সাথে টং দোকানে বসে আড্ডা দিতেছিলাম। বরাবরের মত ‘ঋদ্ধি’ টং দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আর আমি এক মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে চেয়ে ছিলাম।প্রতিদিন কিছু না বললেও, আজ আমার সামনে এসে ধমকের সাথে ওপরের কথাগুলো বলল।
-আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।
-‘ঋদ্ধি’ চোঁখ দুটো বড় বড় করে বলল,মুখ দিয়ে কথা বের হয় না? বোবা হতে ইচ্ছা করে? কাল থেকে কিন্তু মুখে টেপ মেরে দিব। .
-আমি একটু ভয় পেয়ে বললাম,আমার বোবা হতে ইচ্ছা করে না। তোমার সাথে কথাবলতে খুব ইচ্ছা করে। যাও কাল থেকে আর এমন করে তাকাবো না।
– ‘ঋদ্ধি’ মনে হয় অন্য কিছু একটা ভেবে ছিল।তাই একটু মনমরা হয়ে বলল হুম, মনে থাকে যেন। বলেই হাঁটতে শুরু করল।
-এর মধ্যে বন্ধুরা আমাকে বলতে শুরু করল,বলেছিলাম না? এই মেয়ের সাথে কখনো প্রেম করতে পারবিনা। তোর মত এমন কত ছেলে গেল আর আসল।
-আমি বললাম,দেখা যাবে সময় হলে।
আসলে আগে ‘ঋদ্ধি’ এত সাহস দেখাতে পারতনা।আমরা এই মহল্লায় এসেছি ৬ মাস হল। প্রথম দেখাতেই ‘ঋদ্ধি’ কে ভালো লেগেযায়। ‘ঋদ্ধি’ আমাদের বাসায় এসেছিল তার মায়ের সাথে। সেদিন তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি আবার মনের কথা পুষে রাখতে পারিনা। তাই হঠাৎ করে তার সামনে যেয়ে বলেছিলাম -“আমি তোমাকে ভালোবাসি”।
এইটুকু বলেই এক দৌড়ে বাসায় চলে এসে ছিলাম। এরপর থেকে তার সাথে দেখা হত কম। মহল্লার কিছু ছেলে যারা আমার সাথে পড়ে। তাদের সাথে ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক হয়েগিয়েছে। যেদিন বন্ধুদের বললাম জানিস, আমি না ঋদ্ধিকে ভালোবাসার কথা বলে দিয়েছি।
-বন্ধুরা সব আমাকে জানি কেমন করে দেখতে লাগলো। মনে হয় আমি ভিন গ্রহের মানুষ।
-আমি বললাম,এমন করে কি দেখছিস?
-এক বন্ধু বলল,তোর কোন গালই তো লাল দেখাচ্ছে না।
-আমি বললাম, আরে আজব তো গাল লাল হবে কেন?
(এরপর যা বলল বন্ধুরা তা শুনে আমারহাত আপনা আপনিগালে চলে গেল। আর ভাবতে থাকলাম, ভাগ্যিস সেদিন দৌড় দিয়ে চলে আসছিলাম। এখন শুধু তারদিকে চেয়ে থাকতাম। কিন্তু এটাও ‘ঋদ্ধি’ মানা করে দিল।)
-আমি এখন অার ‘ঋদ্ধিকে’ পাওা দেই না। ওকে দেখলে আমি স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে যাই। এমন ভাব করি যেন তাকে আমি দেখিনি। যাই হোক, আজ সেলুনে গিয়ে বরাবরের মত স্টাইলে চুল না কাটিয়ে অন্যরকম স্টাইলে চুল কাটালাম। কেমন যেন লাগতেছে। মনের দিক থেকে মোটেও ভালো লাগছে না। তারপরও এখনকার মেয়েদের তো এই স্টাইলই ভালোলাগে। কলেজে গিয়ে এক জায়গার বসেবন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতেছি। এমন সময় দেখলাম ‘ঋদ্ধি’ ও তার বান্ধবিরা এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
-আমি এমন ভাব করলাম, যেন তাদের দেখিই নি। (আমার পাশ দিয়ে যাওয়া সময় বলতে শুরু
করল – ছিঃ, ছিঃ,কি চুলের স্টাইল। দেখেছিস কিরকমখাড়া খাড়া চুল ,একদম ঘোড়ার মত দেখা যায়।)
-আমি জানি এই চুলের স্টাইলে আমাকে ভালোইলাগতাছে। কারন আমার বন্ধুদেকে বলেছি,কি রে কেমন লাগছে?
-তারা বলল,পুরাই জোশ মামা। বন্ধুদের কথাও বিশ্বাস করতাম না যদি এক জুনিয়র মেয়ে এসে না বলত,ভাইয়া আপনায় চুলের স্টাইলটা অনেক সুন্দর। আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
-আমাকে না চুলের স্টাইলটাকে?
-একটু লজ্জার স্বরে বলল,না মানে চুলের স্টাইলটাকে।
-আমি বললাম,ও আচ্ছা তাই বল!
-কিন্তু ঋদ্ধি কেন এমন করল তা আর জানার চেষ্টা করছিনা।
পরের দিন,(যে ছেলেটি প্রচন্ড গরমের মধ্যেও ফুল হাতা শার্টের হাতের কবজি পযন্ত লাগিয়ে রাখত। জিন্সের পেন্ট কখনো পড়তো না। অলটাইম সাধারন জুতা পড়ে ঘুরে বেড়াত।আজ তাকে দেখে শুধু তার বন্ধুরা আর ‘ঋদ্ধি’ অবাক নয়। সারা কলেজের সবাই অবাক। কারন, আজ সে ফুল হাতা শার্টের হাতা, কুনুই পযন্ত কুচিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে একটু ছিড়া এইরকম জিন্স পেন্ট পড়ে এসেছে । আর পায়ে কনভার্স পড়ে এসেছে।)
-সে আর কেউ নয়,আমি নিজেই।
‘ঋদ্ধিকে’ দেখিয়ে দেখিয়ে ‘ঋদ্ধির’ ক্লাসের একটা মেয়ের সাথে হেসে কথা বলছিলাম। ‘ঋদ্ধি’ আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। আমি তেমন একটা কেয়ার করি না, এমন একটা ভাব ধরলাম। এভাবেই কেঁটে গেল প্রায় কয়েকটা দিন ।
-আমি একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম। এমন সময় দেখি ‘ঋদ্ধি’ আমার সামনে দাড়িয়ে আছে।
আমি-কিছু বলবে?
ঋদ্ধি-আমি আবার কি বলব? .
আমি-তুমি কি জেলাছ ফিল করছো? (একটু নরম স্বরেই বললাম)
ঋদ্ধি-আমি জেলাছ ফিল করতে যাবো কোন দুঃখে।
আমার কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নাই। এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। ধ্যাত। (উচ্চস্বরেই কথাগুলো বলল)।বলেই হনহন করে চলে গেল। আসলে, সুন্দর মেয়েগুলো এমনই। যখন তাকে পাওা দিবেন না,তার চেয়ে কম সুন্দর মেয়েদের সাথে ভালোভাবে কথা বলবেন,তখন সে জেলাছ ফিল করবে। আর আমি তো ঋদ্ধিকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম।তার আরও বেশি জেলাছ হওয়ার কথা। বরাবরের মত, আজ আগের মত স্টাইল করে কলেজে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি। তখন দেখলাম হাতে চিরুনি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি যখন ভাব ধরে সামনে দিকে আগালাম। তখননি,
-‘ঋদ্ধি’ দৌড়ে এসে আমার কলার ধরে বলল,ওই তুই নিজেকে কি মনে করিস, হ্যাঁ??
-আমি উওর না দিয়ে বললাম,কি হচ্ছেটা কি? আমার কলার ছাড়। মানুষ দেখলে কি ভাববে?
-এখন মানুষে দেখলে দোষ। যখন জুনিয়র মেয়েগুলোর সাথে আড্ডা দিস, তাদের ফুচকা খাইয়ে দিস। তখন কিছু না।
-আমি কিছু বললাম না।
-‘ঋদ্ধি’ কলারটা ছেড়ে দিয়ে বলল,এরপর থেকে যেন ওই মেয়েদের সাথে না দেখি। .
-আমি(নরম স্বরে বললাম),আর কিছু বলবে? .
-হুম।
-বল।
-সোজা হয়য়ে দাড়াও।
-আমি সোজা হয়ে দাড়ালাম।
-‘ঋদ্ধি’ আমার পায়ের উপর দাড়িয়ে তার হাতের চিরুনি দিয়ে আমার চুলগুলোকে ডান দিকে সিথি করে দিল। (ঋদ্ধিকে এত কাছ থেকে কখনো দেখিনি। আমি অপলোক সৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছি।)
-এই যে মি:আবিদ,কি দেখছেন এমন করে?.
-আআমি…না কিছু নয়তো।
-এবার শার্টের হাতা ঠিক করেন মি: আবিদ সাহেব ।
-(আমি মাথা নিচু করে বললাম),পারিনা তো। -(‘ঋদ্ধি’ আমার শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে বলল)আগে করতেন কিভাবে?
– (আমি আবার সেই আগের আবিদ হয়ে গেছি)আমি কিছু টা অস্পষ্ট ভাষার বললাম,তুমি পাশে থাকলে এই সব পারি না।
-কিহ??
– কিছু না। এখন আমার সাথে চল।
-কি বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাবা তাই তো ?
-(আমি কিছু না বলে, ‘ঋদ্ধির’ হাত ধরে রিক্সার উঠালাম।)
রিক্সায় হাত ধরে থাকলাম। ঋদ্ধি হয়ত কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে। তাই সে মাথা নিঁচু করো আছে। টং দোকেন সামনে গিয়ে রিক্সা ওয়ালা মামাকে বেল দিতে বললাম। বন্ধুরা আমাকে আর ঋদ্ধিকে একসাথে দেখে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। দেখলাম ঋদ্ধি তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসতেছে। আমি রিক্সাওয়ালা মামাকে সামনে দিকে চালাতে বললাম।
আমি যখন আমার ভাবনার কল্পনা গুলোর আর এখনকার অবস্থার সাথে মিল খুজে বের করার ব্যার্থ চেষ্টায় মগ্ন। তখনি ঘটল, আমার হ্নদয় কক্ষটাকে ছিন্ন- বিছিন্ন করার ঘটনা। হ্যাঁ, ঋদ্ধি আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। বিখ্যাত কবিদের লেখা থেকে জেনেছি,প্রিয় মানুষটি যখন কাঁধে মাথা রাখে কেমন লাগে তার, সেই বিষয়ের ব্যাখা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই মনের ভাব কোন কিছুর মাধ্যমে প্রকাশ করারা যাবে না। কি যে ভালোলাগা আর প্রশান্তি বিরাজ করছে তা বলে বুঝানোর নয়।
আমি আলতো করে আমার ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ঋদ্ধিকে। ঋদ্ধি মন্ত-মুগ্ধ করা সেই চাহনি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার কাঁধে নয়, বুকে মাথা রাখল। আমার মনে হল – তার দুঃসময়ের সকল প্রতিকূলের একমাত্র আশ্রয় স্থল সে খুঁজে পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে তার সব মান-অভিমান, ব্যক্ত- অব্যক্ত কথা বুঝে নেওয়ার মানুষ। আমি আর কিছু বললাম না। রিক্সা ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে। গতকাল এই পরিবেশটাই রুক্ষ ছিল। আজ তা মনে হচ্ছে সবুজে পরিপূর্ণ।
শহরের কোলাহল ভেদ করে রিক্সা ছুটে চলেছে গ্রামের সেই আকা-বাঁকা মেঠো পথ ধরে। আর দুজন মানব-মানবীর না বলা সেই ভালোবাসার অনুভূতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে, রাস্তার দুইপাশে।