সকাল ৬ টা। এলার্রমটা বেজেই চলছে। জেবিন ঘুমাচ্ছে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। তার মায়ের ডাক।
– এই জেবু ওঠ। দেখ সকাল ৬ টা বাজে জেবিন তার ঘুমের দেশেই আছে। দেখছে স্বপ্নে কোন এক রাজকুমার তার দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক সেসময় বৃষ্টি শুরু হল। স্বপ্নের দেশে জেবিন, তার রাজকুমার হেটে আসছে, সাথে বৃষ্টি হচ্ছে, উফফ কি সুন্দর এক রোমান্টিক দৃশ্য। কিন্তু হঠাত তার স্বপ্নগুলো তলিয়ে যাচ্ছে সে রাজকুমার সরে যাচ্ছে, জেবিন দৌড়তে লাগল কিন্তু না সে ধরতে পারলো না। ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠল জেবিন। তার শরীর ভেজা। তার মা জগ নিয়ে দারিয়ে আছে। তার উপর পানি ঢেলে দিয়েছে। রাগ করে
– মা এসব কি?
– সেই কতক্ষন ধরে ডাকছি তোকে হিসাব আছে। আর ঘুমের মধ্যে তোর এই লাফালাফি দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই, ভাবছি তোর মনে হয় কিছু হয়ে গেছে, তাই তাড়াতাড়ি পানি ঢাল্লাম।
– উফফফ মা কি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। কি সুন্দর একটা রাজকুমার আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। স্বপ্নেই তো বৃষ্টিতে ভিজতাছিলাম। আর তুমি বাস্তবে পানি ঢেলে দিলে, আমার সব স্বপ্ন পানি করে দিলে।
– হইছে তোর স্বপ্ন দেখা। কাম নাই কাজ নাই, সারাদিন খাও, ঘুমাও আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে লাফালাফি কর।।।।
আজ আসলেই দেরি হয়ে গেছে জেবিনের। তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে গেল।তার মা বল্ল
– এই জেবু টেবিলে নাস্তা দিয়ে রাখছি। খেলি না কেন?
– মা আজ সময় নাই। বাইরে কিছু খেয়ে নিব। তাড়াতাড়ি রিকশা পেয়ে গেল জেবিন। অল্প সময়ের ভিতর পৌছে গেল ভার্সিটি। এখনও কিছু সময় বাকি আছে। দেখা হল তার বান্ধবী রিতার সাথে
-দোস্ত আজ এত দেরি কেন?
– আরে হইয়া গেছে একটু।
– তোর ক্রাশতো সেই কখন আসছে?
– তাহিন এসেছে?
– হ্যা সেই লাইব্রেরিতে কখন থেকে বসে বসে পড়ছে। এত পড়ে যে কি হয় কে জানে। পুরাই আবাল একটা।
– ওই দেখ একদম উলটা পালটা বলবি না। আমার একমাত্র ভালবাসা ও। আমার প্রথম আর শেষ শুধু তাহিন ।
– তুই ওকে কি তোর ভালবাসার কথা বলেছিস আজ পর্যন্ত। ২ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেল।
– নারে বলতে পারিনি। কেমন জানি একটা ভয় ভয় কাজ করে। যদিও ফ্রেন্ডশিপ ভাল, কিন্তু তাও ওকে দেখলে কেমন জানি ধুকধুকানি হয় বুকে, ভিতরের কথা সব ওলটপালট হয়ে যায়। তাই মুখ দিয়ে কথাও বের হয় না।
– তুই এমনই থাকবি। ফিজিক্স এর এসাইনমেন্ট করছিস।
– কিছুটা বাকি আছে। সোহেলের থেকে সাহায্য নিয়ে করব ভাবছি।
– ও হ্যা। তোর ক্রাশ তো ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। তার প্রথম স্থান কেউ দখল করতে পারে না। যাই হোক এখন ক্লাসে চল।
দুই বছর আগের ঘটনা। সকাল এর স্বপ্নের মতই ঘটনা। সেদিন জেবিনের ভার্সিটির প্রথম দিন। তাড়াতাড়ি ভার্সিটি যাচ্ছে। কিন্তু হঠাত বৃষ্টি নেমে যায়। ভার্সিটির কাছা কাছি এসে দৌড় দিয়ে ভিতরে ভিতরে ঢুকে যায়। ঢুকতে ঢুকতেই ধাক্কা খায় তাহিনের সাথে। জেবিনের মাথাটা তাহিনের বুকে ঠেকে যায়। জেবিন তাহিনের বুকের ধুকধুক শুব্দ শুনতে পায়।জেবিন তার মাথা তুলে তাকালো তাহিনের দিকে। জেবিন তাহিনের চেহারার দিকে তাকালো। সেই প্রথম দেখল তাহিনকে, প্রথম দেখাতে প্রেম” লাভ এট ফাস্ট সাইট”।।তাহিনের চেহারার দিকে তাকিয়ে জেবিন যেন এক অন্য জগতে হারিয়ে গেল।বৃস্টি তখনও হচ্ছে। জেবিন কিছু না বলে সেখান থেকে সরে যেতে নিল । কিন্তু পারল না। জেবিনের ভেজা চুল তাহিনের শারটের বোতামে পেচিয়ে গেছে।জেবিন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। এই প্রচণ্ড বৃস্টির মাঝেও জেবিনের গালের লাল আভা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জেবিন তার চুল ছাড়ানোর চেস্টা করল। কিন্তু পারল না। চুল সেখানে শক্ত হয়ে পেচিয়ে গেছে। জেবিন আরো লজ্জা পেয়ে চুল টানাহেছরা শুরু করল। তাহিন বল্ল
– আমি করে দিচ্ছি। বলে তাহিন তার চুল গুলো বোতাম থেকে আলাদা করে দিল। তারপর বল্ল
– কোন কিছুতে তাড়াহুড়া ভাল না। আস্তে ধীরে ঠাণ্ডা মাথায় করা লাগে।
জেবিন কিছু না বলে সেখান থেকে দ্রুত চলে আসে। রুম খুজে ক্লাসে বসে পড়ল। আজ ভেজা অবস্থাতেই তার ক্লাস করতে হবে। কিন্তু সে ভাবছে তাহিনের কথা। কি সুন্দর মায়াবী চেহারা ছেলেটার। আস্তে আস্তে তার অন্য বান্ধবীরা আসে। তারা গল্প গুজব করতে থাকে। এমন সময় ক্লাসে ঢুকে তাহিন। তার জামাকাপড়ও ভেজা। তাহিন সবার শেষে গিয়ে বসল। জেবিন দূর থেকে তাহিনকে দেখল। বুঝতে পারলো তাহিন তাদের ডিপার্টমেন্ট এরই ছাত্র। মনে মনে জেবিন খুব খুশি হল। তবে জেবিন খেয়াল করল যে তাহিন ক্লাসে খুব কম কথা বলে। এভাবে কিছু দিন যায়, দিন যেয়ে মাস আসে। জেবিন কেবল ক্লাসে আড়চোখে লুকিয়ে দেখে। তাহিনের প্রতি তার দুর্বলতা দিন দিন বাড়তে থাকে। তাহিম ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ছিল। তাই একদিন ক্লাস শেষে জেবিন তার কাছে গিয়ে বল্ল
– আপনার নাম কি ( যদিও নাম জানে, ক্লাসে ভাল ছাত্র হিসেবে তার পপুলারিটি আছে)
– তাহিন মাহমুদ। তোমার নাম?
– জি ভাইয়া আমার নাম, নাম,নাম উম্মম্মম্ম (প্রচণ্ড নার্ভাস তাই নিজের নাম ভুলে গেছে)
– শরীর কি ঠিক আছে, শরীর কেমন করে কাপছে, কপাল থেকে ঘাম ঝরছে।
– আমার নাম জেবিন। জি একটু শরীর খারাপ।
– তাহলে বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।
– আসলে একটা সমস্যা ছিল ভাইয়া। ফিজিক্স এ একটা টপিক বুঝতাছিলাম না। একটু যদি সাহায্য করতেন ভাইয়া।
– সমস্যা পরে সমাধান করা যাবে এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আর আমাকে এইসব ভাইয়া/আপনে করে সম্মধন করবা না। আমারা একই ডিপার্টমেন্ট এবং ক্লাসমেট তাই তুমি করে নাম ধরেই কথা বলবা।
-( মারাত্মক রকমের খুশি হয়ে) আমরা একই ডিপার্টমেন্ট এর তাহলে আমরা বন্ধু হতে পারি।
– হুম্ম। হতে পারি।
– ইয়াহুউউ ( লাফ দিল)
– অসুখ এত তাড়াতাড়ি ভাল হয় আগে জানতাম না। বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাহিন সামনের দিকে হাটা শুরু করল। জেবিন আবারো লজ্জা পেয়ে তার মুখ নিচে দিকে করে একাই হাসা শুরু করল। এমন সময় তার এক বান্ধবী রিতা এসে বল্ল।
– কিরে পাগল হয়েছিস, এভাবে একা একা হাসছিস কেন
– আরে দোস্ত প্রেমে পরেছি। তাহিনের সাথে।
– কোন তাহিন। আমাদের ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট।
– হ্যা, ও। সেই কবের থেকে প্রেমে পরে আছি। আজ বন্ধু হলাম
– দোস্ত এত লাফাইস না, প্রেম আর বন্ধুত্ব এক জিনিস না। আগে ওকে ভাল করে বুঝে নে। তারপর হবে প্রেম। প্রেম এত সহজ না যে যেনতেন ভাবে একটা হয়ে গেল।
– হ্যা তা ঠিক। তবে আমার যে সইছে না। ওকে দেখলেই আমি অজানায় হারিয়ে যাই।
এরপর থেকে জেবিন আর তাহিন এর ফ্রেন্ডশিপ ভাল হতে থাকে। বেশিরভাগ সময় তাহিনের সাথে কাটায়। একসাথে পার্কএ ঘুরা, ক্লাস করা, লাইব্রেরিতে বই পড়া। পড়ালেখার বিষয়ে আলোচনা করা ইত্যাদি। তাহিন জেবিনের সাথে ফ্রি ভাবেই কথাবার্তা বলে। কিন্তু জেবিন তার ভালবাসার কথা বলতে পারেনা। বন্ধুত্ব নস্ট হওয়ার ভয়ে। তার মনের ভিতর চাপা কস্ট কাজ করে। যখনই ভালবাসার কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয় তখনই নার্ভাস হয়ে যায়। আর তাহিনও ফ্রেন্ডশিপের বেশি কোন রিয়েক্ট করে না।অর্থাৎ তাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না তাহিন এতক্ষণ দুই বছর আগের কথা বসে ভাবছিল জেবিন। সে লাইব্রেরি যায়নি তাহিনের সাথে দেখা করতে,। অযথা তাকে আর বিরক্ত করেনি। দুই বছরে যার ভিতর কোন ফিলিংস কাজ করে নাই তার থেকে ভালবাসা আশা করা যায় না। নিজের অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পরল জেবিনের চোখ থেকে।
– এই জেবিন। চোখ মুছে পিছনে ফিতে তাকিয়ে দেখে তাহিন দারিয়ে।
– হ্যা বল।
– লাইব্রেরিতে ছিলাম। রিতা বল্ল তোমার নাকি এসাইনমেন্টে সাহায্য লাগবে।
– না থাক।
– তুমি দাও, আমি করে কাল দিয়ে দিবনে।
– থাক অযথা কষ্ট করার দরকার নাই।
– আরে দাও। এটা কোন ব্যাপার না।
অনিচ্ছা সত্তেও জেবিন তার খাতা দিল। পরের দিন তাহিন এসাইনমেন্টের খাতা দিয়ে দিল জেবিকে। জেবিন খাতা খুলে দেখল, সবই ঠিক আছে, পুরাটা না দেখেই সে খাতা ব্যাগে রেখে দেয়। সেদিন তাহিন ও জেবিনের মধ্যে কোন কথা হল না। ক্লাস শেষে যে যার মত চলে গেল। বাসায় এসে জেবিন বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাত খেয়াল হল এসাইনমেন্টা পুরাটা দেখা হয়নি। সে এসাইনমেন্ট দেখা শুরু করল। শুরু থেকে শেষ সব ঠিক আছে। কিন্তু শেষ পাতায় একটা গোলাপি কাগজ ভাজ করে রাখা। হাতে নিয়ে বুঝা গেল যে ডায়রির ছেড়া পাতা। সেটা খুলে পড়া শুরু করল।এটা তাহিনের চিঠি।
” জেবিন আজ তোমাকে যা বলতে যাচ্ছি জানিনা সেটা শুনে তুমি কি রিয়েক্ট করবা। তবে আজ আমার রিদয়ের গভীরে থাকা কথাটা বলে দিতে চাই। আমি তোমাকে ভালবাসি জেবিন। সেই ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই যেদিন তুমি আমার সাথে ধাক্কা খেয়েছিলা।তারপর থেকে মনে মনে তোমার কথাই ভাবতাম।তবে তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপের চেয়ে বেশি কোন রিয়েক্ট করতাম না যদি তুমি কিছু ভুল মনে করে আমার থেকে দূরে চলে যাও। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম কোন এক রাজকুমারী আমার দিকে আসছে বৃস্টিতে ভিজে ভিজে।ভাবতাম রাজকুমারীটা তুমিই। কিন্তু সেই রাজকুমারীর আর আসা হয় না। কোননা কোন কারনে স্বপ্ন ভেংগে যায়। শুধু স্বপ্ন দেখলে তো আর হয় না। স্বপ্ন পুরনও করতে হয়।জানিনা আমার এ ভালবাসার স্বপ্ন পুরন হবে কিনা। যদি তুমি রাজি থাকো এ স্বপ্ন পুরন করতে, তাহলে আজ বিকালে পার্কএ আসবে আর যদি রাজি না হও তাও এসে অন্তত বলে দিও যে তুমি রাজি না। তারপর আমি এ শহর ছেড়ে চলে যাব।
তোমার অপেক্ষায় রইলাম। তাহিন” জেবিনের চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়তে লাগলো। চিঠিটা বুকে শক্ত করে চেপে ধরল। বিকাল না হতেই ছুটে গেল পার্কএ। অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে তাহিনের। তাহিনের সকল স্বপ্ন পুরন করতে রাজি আছে। এটাতো শুধু তাহিনের স্বপ্ন নয়। এটা জেবিনেরও স্বপ্ন, তারা সারাজীবন একসাথে থাকবে, একে অপরের ভালবাসার সকল স্বপ্ন পুরন করবে।অনেক্ষন হয়ে যাচ্ছে তাহিন আসছে না। একটা ফোন এল তাহিনের নম্বর থেকে জেবিনের কাছে।
– হ্যাল, তাহিন কই তুমি।
– জি আপু, আসলে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাকে হাস্পাতল নেয়া হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন…..
জেবিনের কানে কথা গুলো যেন যাচ্ছে না,,,, হাত থেকে মোবাইল পরে গেল মাটিতে… সব কিছু শুন্য শুন্য লাগছে জেবিনের। কিছুটা সামলে হাস্পাতালে গেল জেবিন। তাহিনের কথা জিজ্ঞেস করলে তাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি রুমে। সাদা কাপড় লাল রক্তে ভিজে আছে। ডাক্তার কাপড়টি সরিয়ে দিল। রক্তাক্ত নিথর হয়ে শুয়ে আছে তাহিন। একদম নিষ্প্রাণ। জেবিন চিৎকার করে আছড়ে পরল তাহিনের বুকের উপর। আজ তার বুকেও কোন শব্দ নেই। সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে।
– এই তাহিন তোমার স্বপ্ন পুরন করতে আমি রাজি আছি। এটা আমাদের দুজনেরই স্বপ্ন। আমিও স্বপ্ন দেখতাম রাজকুমার বেশে তুমি আসছ, কিন্তু সেটা ভেংগে যেত।স্বপ্ন পুরনের প্রত্যাশা আমিও করতাম তোমাকে নিয়ে। তাহিন আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। প্লিজ তাহিন ফিরে আসো।( প্রচণ্ড চিতকারে কান্না) ডক্তারেরা তাকে সান্তনা দিয়ে রুম থেকে বের করে আনল। তাহিন আর কখনো ফিরবে না। সে চির নিথর হয়ে গেছে। জেবিনের কোন কথা তার কানে যাবে না। সেই ভালবাসার স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রয়ে গেল। ভালবাসার অপূর্ণ স্বপ্ন হয়ে থাকল।