কোনোরকমে রবীন্দ্রভারতী থেকে বেরিয়ে অটো ধরে চলে এলাম আনন্দলোক।বাবা ফোন করে বলল,
-তোকে খুঁজছে, আসতে পারবি?
স্যারকে বলেই বেরিয়ে এলাম।এম.এ পড়ছি, বাংলা নিয়ে এখানে এই তিন মাস হলো।অনেক দূর থেকে আসতে হয় জানেন! বাড়ি সেই টিকিয়াপাড়াতে।বাসে করে সল্টলেক আসতে আসতে কী যে ঘুম পেত আগে! পড়তাম না, বলতে পারেন ইচ্ছে পূরণ। পুরো রাস্তা শুধু হাত জুড়ে প্রার্থনা করতে করতে এলাম ঠাকুরকে,
-যেন দেখতে পাই।
বাঁ হাতের মুঠোয় ওই টক হাজমলাটা লুকিয়ে রাখা, ওই যে হলুদ রঙেরটা।নেমেই দৌড়ে তিন তলা উঠলাম, লিফ্টের দিকে আর চোখ গেল না আর!
আইসিউর এর বাইরের কাঁচ থেকেই দেখলাম।আসলে এই কদিন ভেতরে যাইনি।আমায় দেখলে না খুব ছটফট করে!চোখের পাশ দিয়ে জলটা যখন গড়িয়ে পড়ে, বিশ্বাস করুন মোছাই না।কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে খুব মারতে থাকে বুকের বাঁ দিকে।ইশারায় কিছু না বলে ডাক্তারের সাথে কথা বলার ভান করি।উনিও বোঝেন, বুঝে হয়ত চোখটা বুজে অপেক্ষা করেন।
আজ সকালেই খবরটাএল বাবার কাছে।ফোনটা রেখেই মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, যাওয়ার সময় বলে,
-তুই যা ইউনিভার্সিটি, ফোনটা খোলা রাখিস।
বুঝতে পেরেছিলাম কিছু, তাই ডেস্কের নীচের শেলফে রাখা ছোট্ট টেডিটা বের করে বললাম ,
-প্লিস গুড়িয়া এটা করিস না আমার সাথে।তুই তো আমায় জানিস বল?
কী জানি কি বুঝল ও? আজ ভেতরে ঢুকলাম।বাবা এক পাশে বসে, মা আঁচল চাপা দিয়ে মুখে।এগিয়ে গেলাম খাটের কাছে, চোখটা মাথার পাশে রাখা মনিটরের দিকে।চলছে, কিন্তু …
বাবা মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ধরে কেঁদে ফেলল এবার,
-শ্রী
হাত থেকে প্যাকেটটা পড়ে গেল মাটিতে, কেঁদে ফেললাম আমি..
জ্ঞান যখন ভালো করে হলো, মাকে প্রথম দেখলাম।জল ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে ছিলাম মাকে।বাবাকে দেখলাম, তবে বিশাল একটা বাক্সে।পরে শুনলাম ওটা নাকি ট্যাব।আমার বাবা তখন ব্যাঙ্গালোরের অফিসটায়।শুনেছিলাম ট্রান্সফার পেয়েছে আগেই তা প্রায় ছয় মাস হলো।সে কী কান্না বাবার! ট্যাবের স্ক্রিনে বাবাকে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস আমার!বেগতিক দেখে আমায় কোলে তুললেন তিনি, আমার ভ্যালেন্টাইন।বাবাকে বলল,
-এই কাঁদবি না একদম, ভালো করে কাজ কর।তাড়াতাড়ি ফিরে আয়, আমি আছি আমার শ্রী মার জন্য।
একটা ছোট্ট উত্তর আসে বাবার,
-আচ্ছা বাবা
হু আমার দাদু, আমার জীবনের প্রথম হিরো।প্রথম বন্ধু, বা বলা যায় আমার দোসর।আমি নাম বলেছি আমার ? বলিনি না? আমার নাম শ্রীনন্দা, শ্রীনন্দা মুখার্জি, ডাকনাম শ্রী।
মা আবার চাকরিটা জয়েন করে।বুঝতেই পারছেন, একার খরচায় কিছু হয় না।একটু বড় হতেই যখন সকাল সকাল মা মাথায় আদর করে বেরিয়ে যেত, পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতাম।মা না যেত পারত না কোনো কোনোদিন।ওঘর থেকে দাদু ছুটে এসে কোলে নিত আমায়, মাকে বলত,
-তুমি যাও, আমি আছি তো দিদিভাইয়ের কাছে।
আমার দাদু ছিলেন ছাপোষা একটা করণিক।বাবার যখন তিন বছর বয়স, ঠাকুমাও দাদুকে ছেড়ে চলে যায় চিরদিনের মত।সেদিন থেকে মানুষটি নাকি চুপ করে গেছিল একদম।আমি যেদিন এসেছিলাম পৃথিবীতে, কোলে নিয়ে সর্বপ্রথম মাকে বলেছিল,
-দেখো, শ্রীনন্দা ফিরে এসেছে।চোখটা দেখ, সেই হাতে হাত রেখে প্রথম দেখেছিলাম যেদিন, ঠিক তেমন।
প্রথম স্কুল থেকে যেদিন ফিরেছিলাম, দাদুকে দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে।আমায় দেখেই দৌড়ে এসে বলল,
-দিদিভাই কেমন লাগল? নতুন বন্ধু হলো?
কিছু বুঝিনি কথা গুলো, শুধু ভ্যাঁ করে গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম।উনি শুধু “আচ্ছা, আচ্ছা আর যেতে হবে না ইস্কুল” বলতে লাগল।কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম শেষে।
সেবার যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম, মাকে বললাম,
-একটা সাইকেল কিনে দাও না।
হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই, দাদু বলে,
-দিদিভাই , তার আগে যে ভালো করে পড়াশুনা করতে হবে তোমায়।ইয়া বড় হতে হবে, তোমার বাবার থেকে,আমার থেকেও খুব বড়।আমি তোমায় সাইকেল কিনে দেব কথা দিলাম।
কিছু কিছু কথা তখন মাথার ওপর দিয়ে যেত।যা বুঝলাম, তাতে ভালো করে পড়তে হবে আমায়।
রেজাল্ট যখন বেরোল, প্রথম লিস্টে নিজের নাম না পেয়ে ভাবলাম কমপ্লেন করি, ভুল করেছে ওরা হয়ত।দ্বিতীয় লিস্টে পেলাম নিজেকে খুঁজে।
বাড়ি এসে দেখলাম, দরজার বাইরে সাইকেল দাঁড়িয়ে।দাদু হেসে কিছু বলার আগেই,
-দাদু আমি তো…
“ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি”শেষ করে বলেই বললেন আবার,
-আচ্ছা পরের বার হবে, কিন্তু দিদিভাইয়ের ইচ্ছে, পূরণ হবে না মানে!!!
আনন্দে চোখ চিক চিক করে উঠল।মা কে শুধু বলতে শুনেছিলাম রাতে ওঁনাকে,
-কেন বাবা পেনশনের টাকাটায় হাত দিলেন আপনি? আমি, ওর বাবা দিতে পারতাম না? পড়াশুনা করে না, যা চাইছে পেয়ে যাচ্ছে আপনার কাছ থেকে!!
দাদু বলছিল হাসতে হাসতে,
-আঃ, বৌমা! কী হয়েছে? একটু আবদার ই তো করেছে।ভালো করে পড়বে দেখো!
গজগজ করতে করতে মা চলে যায়।খুব কান্না পাচ্ছিল আমার।না, ভালো করে পড়তে হবে এবার।
মাধ্যমিকে যখন স্কুল থেকে ফার্স্ট হলাম, স্কুল থেকে ফোন করে বলি,
-দাদু, তোমার শ্রী ফার্স্ট হয়েছে।
আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে রিসিভার ফেলে দেয় দাদু।
একটা একটা করে পথ পেরিয়ে যখন গ্রাজুয়েশনের রেজাল্টটা নিয়ে ওঁনার ঘরে গিয়ে মাথার কাছে বসলাম, আমায় দেখে উঠতে যাবে।জোর করেই শুইয়ে বললাম,
-শুয়ে শুয়ে বলো।
বয়সটা বড্ড জাঁকিয়ে ধরেছে ওঁনাকে।কাঁপা কাঁপা হাতে আশীর্বাদ দিয়ে বলল,
-অনেক বড় হ মা তুই, আরো পড় যত ইচ্ছে।স্কুল টিচারি করবি? বাংলা পড়াস কিন্তু,বড্ড ইচ্ছে ছিল আমার।বাবাটা ওই ভাবে চলে না গেলে..
না, কাঁদব না ঠিক করেছি।বললাম,
-হাজমোলাটা এনেছি, খাবে?
-লাল না হলুদ? লালটা ভালো না!
বললাম,
-হলুদ, তোমার ফেভারিট!
মুখে দিল, বললাম,
-দাদু টক করে আওয়াজটা করো।
করতে গিয়ে গিলে ফেলল, সে কী অবস্থা! মা এসে প্রায় মেরেই ফেলে আমায়।
এম.এ ভর্তির দিন ফোনটা এল বাবার,
– তাড়াতাড়ি আসিস।
সারা রাস্তা “কু” ডাকছিল মনে।বাড়ি এসে দেখি , ডাক্তার বসে।বলছে বাবাকে,
-ইউরিন তো একদম বন্ধ হয়ে গেছে, ইমিডিয়েট ভর্তি করিয়ে দিন।
হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষে।ভুগছিল অনেকদিন, লড়ছিল নিজের সাথে রোজ।এবার মনে হয় শেষমেশ অস্ত্র মাটিতে রাখার পালা।বললাম,
-কোনো উপায় নেই ডাক্তার বাবু।
বললেন,
-কিডনিটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে।
যখন দাদুকে ওরা নিয়ে যাচ্ছিল, আমার না স্কুলের ওই প্রথম কান্নাটা মনে পড়ে গেল।দাদু মনে হয় খুঁজেছিল আমায়..মনে হয়..
রোজ যেতাম দেখতে।বাইরে থেকেই দেখতাম, কিভাবে দুটো অসহায় চোখ খুঁজছে আমায়।বাবাকে বলত,
-অভিমান করেছে শ্রী? আমার কিছু হয়নি।মাকে আসতে বল না আমার কাছে ।
না, যাইনি কাছে।কেন এমন করল উনি? সারারাত ঠাকুরকে বলতাম,
-ফিরিয়ে দাও ওঁনাকে প্লিস।
হাজমোলাটা উঠিয়ে ওঁনার বাঁ হাতটা ধরলাম।দেখছে আমায়, না চোখে জল নিই।শুধু দেখছে, খুব ভালো করে।অনেকক্ষন তো হলো,ডাকলাম,
-দাদাই, ও দাদাই।
না তাকিয়ে আছে।মাথার ওপর মনিটরে দেখলাম একটা সরলরেখা শুধু।সেদিকে তাকিয়ে বললাম দাদুকে,
-ও দাদাই উঠবে না?এই দেখো মাথায় তেল দিতে হবে আমার, দিয়ে দাও না।ওই যেমন বিছানার নীচে বসে থাকতাম, তুমি তেল দিয়ে দিতে।এই দেখো হাজমোলা, খাবে না?সেই আওয়াজটা করবে? আর আমরা দুজনে হাসব।এই তো সেদিন কথা হলো, প্রথম চাকরির টাকা পেয়ে একটা লাঠি কিনে দেব।ও দাদাই ওঠো না, তোমাকে তো রাহুলের কথা বলাই হলো না।ওই যে সেবার যার ছবি দেখে আমার থেকে ব্ল্যাকমেল করে আইসক্রিম খেয়েছিলে! ও দাদাই…
চোখটা মুছে জানলার কাছে এগোলাম।আকাশটা বড্ড শান্ত, কিন্তু রোদটা প্রখর।হাত নাড়ালাম, দাদাই হয়ত হাত নাড়ল।আটকিয়ে লাভ নেই, আবার ফিরে আসতে হবে ওঁনাকে, অন্য কোথাও, অন্য কারো ভ্যালেন্টাইন হয়ে।