আমরা চারজন ফ্রেন্ড মিলে পান্থপথে একটা ফ্ল্যাটের চিলেকোঠা বাড়া নিয়ে থাকি। আগে মিরপুর ছিলাম, আগের চাইতে এই এরিয়াটা অনেক এলিট। সকালে ভাবলাম একটু যমুনা ফিউচার পার্কের শপিং মলটা ঘুরে আসি। কেনাকাটা’টা অবশ্য আমরা গরিবের নিউমার্কেট ফিউচার পার্কের মল থেকেই করি। যাইহোক, মলের ভেতর যেই ঢুকবো সেই একটা সুন্দরীর দেখা পেয়ে গেলাম। মাই গুডন্যাস! সেইই সুন্দরী। টল ফিগার, লাইট ব্রাউন ব্রাশ করা হেয়ার, জিন্স শার্ট, স্ট্রিচ ব্ল্যাক প্যান্ট, হিল শু, সানগ্লাস সবমিলিয়ে ওয়াও আরকি। সাথের তিনটাকে দেখালাম। বললাম দোস্ত এইবার প্রেম করেই ফেলবো এইটা তদের ভাবী। ঠিকাছে? চল পিছু নেই। নিলাম পিছু, সারা মল ঘুরলাম। পা ব্যথা হয়ে গেছে। এই মেয়ের এতো ধৈর্য মাইরি, সারাটা মল উলট পালট করে ঘুরে ফেলছে সাথে আমরাও। আমরা চারজন হাঁপিয়ে গেলাম আর ও! এক একটা জিনিস কিনতে চল্লিশ মিনিট করে সময় নিছে তাও কসমেটিকস প্রোডাক্ট! ফ্রেন্ডসদের বললাম, দোস্ত বিয়ের পর তর ভাবীরে একা পাঠাবো। দেখছস কি অবস্থা?
তারপর আরো এটা সেটা কিনলো। মাঝখানে একবার রেস্ট নিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি ওরে। আমি কান্নায় শেষ। এখনো প্রপোজ বিয়ে বাসর বাচ্চা কিছুই হলো না এর মধ্যেই হারিয়ে ফেলছি! চারজন চার দিকে ওরে খুঁজতে বের হলাম। প্রায় এক ঘন্টা পর দেখি আমি একা। ওদের ভাবীসহ ওদেরকেও হারিয়ে ফেললাম। ফোনেও ব্যালেন্স নাই। কি মুশকিল! হঠাৎ একটা ফ্রেন্ড ফোন দিয়ে জানালো, দোস্ত নিচে নাম ভাবীরে পাইছি, ভাবী চলে যাচ্ছে দৌড়ে আয়। গেলাম নীচে, আবার নিলাম পিছু। হাটতে হাটতে মেইন রোডে এসে একটা রিকশা নিলো, আমরাও রিকশা নিলাম ওর বাসা, ঠিকানা, পারলে নামটা এবং প্রপোজটাও করে ফেলবো। অনেক হইছে সিঙ্গেল থাকা, আর না। একটা গলি দিয়ে ঢুকে দশ মিনিট পরেই একটা বাসায় টুপটাপ ঢুকে গেলো। ধ্যাত কথা বলার’ই সুযোগ দিলো না। মলে চেষ্টা করলেই লাভ হতো। তারপর ফ্রেন্ডরা বায়না ধরলো খাওয়ানোর জন্য। পাশেই একটা হোটেলে গিয়ে ঢুকলাম। একটা ফ্রেন্ড বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো;
– একটা জিনিস ভাবছস রবিইন্না?
আমি বললাম,
– কী?
– আরে ব্যাটা ধর এই মেয়েকে প্রপোজ করলি তারপর রাজি হলো। না না হয়নাই, ডায়মন্ড রিং কিনে প্রপোজ করলি তারপর রাজি হলো। তারপর কি হবে জানিস?
ডায়মন্ডের রিংএর কথা শুনে এমনিতেই ভেতরটা শুকিয়ে গেলো, বললাম,
– না দোস্ত জানিনা।
– শোন এখন তুমি টিউশনি করে দশ হাজার টাকা কামাও বাড়ি থেকে আরো পাঁচ হাজার আনো। পনেরো হাজারে ভালোভাবে দিন কাটে। তারপর তোমার বাড়ি থেকে দশ হাজার আনতে হবে প্লাস টিউশনি আরো চারটা করে মাসে ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে এই গফ নিয়ে ঘুরতে। আরে ব্যাটা বড়লোকের মেয়ে ফরমালিটিস মেনটেইন করতেই এই টাকা লাগবে তোমার। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আরো শোন, তুই এখন রাত দশটায় ঘুমিয়ে পরিস। সেদিন এগারোটায় ভূমিকম্পও তরে জাগাতে পারে নাই। আর এই গফ হলে মিনিমাম সারারাত তোমাকে সজাগ থাকতে হবে ঠিকাছে? নইলে চিলের ডিম কাঁকে ফুটিয়ে ফেলবে। বিভিন্ন অকেশনে তোমায় হাজার পাঁচেক করে খরচা করতে হবে। প্রতিদিন তোমায় বাইরেও হাজার পাঁচেক খরচা করা লাগবেই। কারন তুমি বফ, আর বফের এটা দায়িত্ব। আর উল্টো পাল্টা কিছু করছো তো তুমি গেছো। এখন হালকা কুঁজো হয়ে হাটোনা? পরে একদম সোজা হয়ে যাবা। আর তোমার পড়াশোনা? হুহুহুহাহাহা বুঝেছো?
ঘেমে গেছি একদম। মনে হচ্ছে বিসিএস’এর সিলেবাস কেউ বুঝিয়ে দিচ্ছে।
– হো দোস্ত বুঝলাম। কিন্তু আমার ওরেই লাগবো।
এবার আরেকটা ফ্রেন্ড সিঙ্গাড়া খেয়ে হাত ঝেড়ে বললো আমার কিছু বলার আছে। আমি ওরে আদর করে গরীবের নিউটন ডাকি। খুব গম্ভীর আর আবিষ্কার স্বরুপ কথাবার্তা ওর। আর চুল পুরাই নিউটনেরটা টেনে খুলে নিয়ে এসেছে এমনটাই লাগে। বলা শুরু করলো;
– শোন রবিন তর আরো কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত। তুমি ভদ্রসদ্র মানুষ যাকে ভালোবাসবা তাকেই তো বিয়ে করবা তাইনা? তুমি শহরে থাকো, বড়লোক গফ আর ফইন্নির মতো বিয়ে করবা তা তো আর হয়না, তাইনা? এটা কেউ মেনে নিবে না। তোমাকে বিয়ের আগে একটা ব্যাচেলর পার্টির অ্যারেঞ্জ করতে হবে। এজন্য লাখ খানেক টাকা দিয়ে একটা পার্টি সেন্টার বুক করা লাগবে মাস্ট। ঠিকাছে? এটা আমাদের দাবি।
তারপর আসো হলুদ সন্ধ্যা। এটার জন্য ভালো স্পেস দেখে একটা হল বুক করা লাগবে, ওয়েডিং প্ল্যানার আর বাদবাকি মিলে তিন চার লক্ষ টাকার মধ্যে একটা প্যাকেজ আছে সবচেয়ে কম এটা আমি ম্যানেজ করে দিতে পারবো। দ্যান বিয়েতে আসো।
স্বর্ণ পঞ্চাশ ভরি হলে বাইশ লক্ষ টাকা ম্যানেজ করে রাখো। আর বিয়ের কাবিন যদি ডক্টর আকাশ ভাইয়ের মতো পঁয়ত্রিশ লক্ষ হয় তবে তার অর্ধেকটা দিয়ে দেয়া উত্তম, ইহাই নিয়ম। যদিও এটা একটা বানিজ্য, তুমি মুরগি হলে অংকটা সিস্টেম করে কণের বাপ আর কণে এটাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। আর বিয়েতে সেন্টার অবধি আসা যাওয়া, কণের কসমেটিকস বাদবাকি মিলে তিন লক্ষ টাকা মিনিমাম ধরলাম। তোমার বাড়িতো আবার সিলেট।
তারপর আসো বৌভাত, এখানে পাঁচ লক্ষ ধরে রাখো। এখন আসো জয়েন্ট মোমেন্ট শেয়ার। এটা ডিজিটাল ট্রেন্ড, এখানে আরো লাখ খানেক যাবে। এবার বাপু, শালা শালি শ্বশুর বাড়ির সব লোকদের কিছু গিফট না করলে মানায় নাকি? যাও দুই লক্ষই ধরলাম, যদিও এক লক্ষ ধরলে রিস্ক হয়ে যাবে তাই আরকি। এবার ভাই হানিমুন তুমি কোন দেশে করবা এটা তোমার ইচ্ছা আমার কিছু বলার নেই। তবে একটা প্যাকেজ আছে কম টাকার, এই ধরো এক লক্ষ টাকা হলে তিনদিনের জন্য থাইল্যান্ড ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
নিউটনের সূত্র; থুক্কু নিউটনের কথা শুনতে শুনতে আমার বিড়ির আগুন কখন নিভে গেলো টেরই পাইনি। কখন হাতের চা ঠান্ডা বরফ হলো তাও জানিনা। সিঙ্গাড়ায় একটা কামড় দিছিলাম তা আর গিলার সময় পাই নাই। জানি শুধু আমি মহাকাশে আছি। এমন সময় তৃতীয় বন্ধু চিৎকার করে জানালো, দোস্ত ভাবী বাসা থেকে বের হইছে। এটা শুনে মহাকাশ থেকে পরিমরি করে দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
– এক্সিউজ মি, আপনাকে কিছু বলার ছিলো।
– জ্বি বলুন।
– একটু ইমপর্টেন্ট আরকি। কোথাও বসলে ভালো হতো না?
– সরি ভাইয়া যা বলার এখানেই বলুন আর তাড়াতাড়ি বলুন, আমার হাজব্যান্ড পার্কিং জোন থেকে গাড়ি নিয়ে আসতেছে। দেখলে মাইন্ড করবে, উনি এখানকার এসপি।
– আসলে আপু পান্থপথটা কোন দিকে জানতে চাচ্ছিলাম আরকি।
– এই যে সামনের রাস্তা দিয়ে যাবেন।
– আচ্ছা আচ্ছা, তারপর?
– তারপর বামে মোচড় দিয়েই পান্থপথ।
– অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
ভাবতেছি এই শহরে আর থাকবো না। এই জগত, জাগতিক, আর জৈবিক সংসার মিথ্যা বানোয়াট। প্রেম ভালবাসা গফ সব মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা। বনে জঙ্গলে ধ্যান সাধনা তপস্যাই উত্তম পন্থা।