আব্বু-আম্মু আর আমি৷ তিনটি প্রাণ নিয়েই আমাদের পরিবার৷ আব্বু মোটামুটি বেতনের একটা চাকরী করতো আর আম্মু ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা৷ আব্বু সকালে চাকরীতে চলে যেতেন আর আমি আম্মুর হাত ধরে স্কুলে৷ আর স্কুল শেষ হওয়া মাত্রই আম্মুর স্কুলে চলে যেতাম৷ আম্মু মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন আর আমি তখনও সবে প্রথম শ্রেণীতে৷ স্কুল শেষ করে যখন আম্মুর স্কুলে যেতাম, তখন স্কুলপড়ুয়া আপুগুলোর সাথেই বেশীরভাগ থাকতাম৷ তারা খুব আদর করতো আমাকে৷ মাঝে মাঝে তো আমাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি পরে যেতো৷ আমিও ভাবনায় পরে যেতাম, কাকে রেখে কার কোলে যাব? শেষমেষ দেখা যেতো, সুন্দরী আপুটার কাছে গিয়েই বসে থাকতাম৷ আম্মু স্কুল শেষ করার আগেই আব্বু এসে স্কুল গেইটে দাড়িঁয়ে থাকতেন আমাদের জন্য৷
সন্ধার পরেই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি পরিবার ছিল৷ আব্বু আর আমি কার্টুন দেখতাম অথবা লুডু খেলতাম৷ আম্মু রান্না শেষ করে আমাদের সাথে যোগ দিতেন৷ আম্মু আর আব্বু কখনো লুডুতে পারতেন না আমার সাথে৷ কারণ তারা জানতো আমি হারলে রাতে ভাত খাওয়া হবে না কারোরই৷ সপ্তাহের ছুটির দিনটাতে আব্বু-আম্মুর সাথে ঘুরতে বেরোতাম৷ শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানাসহ হরেক রকমের জায়গায় যেতাম৷ পার্কের বেণ্ঞ্চীতে বসতেন আব্বু-আম্মু, আমি আম্মুর কোলে মাথা রাখতাম বাকি শরীরটুকু আব্বুর কোলে৷ আমার সবচাইতে আনন্দের মূহূর্ত ছিল, যখন আব্বু আমাকে আকাশের দিকে ছুড়েঁ মেরে আবার কোলে ধরে ফেলতেন তখনই৷”
-সংসারটা ভালোই ভালোই চলছিল৷ আব্বুর চাকরী, আম্মুর মাষ্টারি আর আমি একেক ক্লাস পাশ করে উঠতে লাগলাম৷ যখন চতুর্থ শ্রেণীতে উঠলাম তখন খেয়াল করতাম প্রায় বন্ধুদের ভাই অথবা বোন আছে৷ শুধু আমারই নেই৷ ওদের পিচ্চি পিচ্চি ভাই-বোনগুলা যখন ওদের মায়ের সাথে স্কুলে আসতো তখন পিচ্চিগুলোর গাল টেনে দিতাম৷ আমার গালটানা খেয়ে কয়েকটা কেদেঁ দিতো মাঝে মাঝে৷ আমার সবচাইতে ভালো বন্ধুর নাম ছিল অয়ন৷ ওর পিচ্চি বোনটার একদম পুতুলের মত তুলতুলে গাল ছিল৷ সেদিন পিচ্চিটার গাল ধরা মাত্রই ভ্যা করে কেদেঁ দিল৷ পিচ্চিকে যখন কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না, ঠিক তখনই অয়নের আম্মু হাজির৷ আমাকে নিষেধ করা হল ভবিষ্যতে যেন ওর বোনের গালে হাত না দিই৷ সেদিন কেন জানি বড্ড কষ্ট পেয়েছিলাম৷
আমার কচি মনটাও সেদিন কেদেঁ উঠেছিল৷ সন্ধায় আম্মু বাসায় এসে যখন দেখলেন আমি শুয়েঁ আছি৷ আম্মু আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, বাবুর কি শরীর খারাপ? জবাবে আমি চুপ করেছিলাম৷ তারপর হঠাৎ আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আম্মু আমার একটা পিচ্চি বোন চাই! আমি সারাদিন ওর সাথে খেলবো, ঘুম পাড়িয়ে দিব আর আস্তে আস্তে গাল টেনে দিব! আমি আম্মুর মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলাম, আম্মু আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমার সোনামণিটা যা চাই তাই এনে দিব৷ কিন্তু আমি এখন আমার সোনামণিটার সাথে রাগ করে আছি৷ আমি বললাম, কেন আম্মু? আম্মু বলল, আমার সোনামণিটা আজকে সারাদিনে একবারও তার মা কে জড়িয়ে ধরেনি৷ আর প্রতিদিনের মত বলেনি”আম্মু আই লাভ ইউ”৷ আম্মুর কথা শুনে আম্মুকে যখন জড়িয়ে ধরে প্রতিদিনের মত বললাম” আম্মুউউ! লাভ ইউ এত্তগুলো”৷”
-দিনের পর দিন যেতে লাগলো৷ এখন আর পিচ্চিদের দেখলেও গালটানা দেয়া হয়না৷ অয়নের বোনটাকে দেখলে আরো বেশী গাল টানতে ইচ্ছে করে৷ পিচ্চিটা যখন তার চুলগুলো মাথার দুইপাশে গরুর শিং এর মত বেধেঁ স্কুলে আসতো, তখন ইচ্ছে হত পিচ্চিটার গাল টেনে লাল করে দিতে৷ ৫ম শ্রেণীতে যখন উঠলাম তখন আম্মু একটু গাইডের মধ্যেই রাখা শুরু করলেন৷ আগে শুধু আদর করতো এখন একটু শাসনও করেন৷ ততদিনে পিচ্চিদের গালটানার ভূতটা একটু নেমে গিয়েছিল৷ মাঝে মাঝে আম্মুর গালগুলোই টেনে দিতাম হি হি৷
-সেদিন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আনতে গিয়েছিলাম বাবার সাথে৷ স্কুল থেকে বাসায় ঢুকেই শুনতে পেলাম বাচ্চার কান্না৷ আমি আব্বুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম৷ আব্বুর হাত ধরে রুমে গিয়ে দেখলাম আম্মুর কোলে সাদা ধবধবে ছোট্ট একটা পরী! পরীটা অনবরত কান্না করছিল৷ আম্মু আমাকে দেখে বললেন, আমার আব্বুটার জন্য বোন এনেছি৷ এখন আর অন্যকারো গালটেনে আদর দিতে হবে না৷ আমি ধীরপায়ে আম্মুর পাশে গেলাম আর ছোট্ট পরীটার হাতে আমার আঙুলটা যখন দিলাম তখনই পরীটা তার ছোট আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ধরলো৷ সেদিনের অনূভূতিটা অন্যরকমের ছিল৷ সেদিনের পর থেকেই আমাদের পরিবারের ভালোবাসার পরিমাণটা আরো বেড়ে গেল৷ সারাদিন ছোট পরীটার সাথে থাকতাম৷ প্রথম প্রথম পরীটা কান্না করতো কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে গেল সব৷ পরীটার নাম দেয়া হল আমার সাথে মিল রেখে৷ শুভ্রর বোন শুভ্রতা৷ যেদিন অয়নকে বুক ফুলিয়ে বললাম, আমারও বোন আছে হু! যখন ইচ্ছা তখন গালটানতে পারি৷ আমার বোন গালটানলে তোর বোনের মত ভ্যা ভ্যা কান্না করে না৷ অয়ন আমার কথশুনে হো হো করে হেসে বলল, ঐটাতো তোর নিজের বোন না৷ অন্যকারো কাছ থেকে এনেছে তোর আম্মু৷ নাহ! সেদিন অয়নের কথাশুনে একটুও মন খারাপ হয়নি৷ কেন জানি আমার ছোট্ট পরীটার প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল৷
-যখন ৭ম শ্রেণীতে উঠলাম ততদিনে পরীটা হাটঁতে শিখেছে৷ একটু আধটু কথা বলা শিখেছে৷ আমি বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে কোলে ঝাপিঁয়ে পড়তো৷ আর তার ছোট ছোট ঠোঁট দিয়ে আমার গালে চুমু দিতো৷ মাঝে মাঝে অবশ্য কামড় ও দিয়ে দিতো৷ টিফিনের টাকা দিয়ে পরীটার জন্য খেলনা কিনে নিয়ে যেতাম৷ যদিও আব্বু তার জন্য অনেক কিছু কিনে রেখেছিল৷ আম্মু যখন আমাকে বলতো, বাবা শুভ্রতার অনেক খেলনা আছে৷ তুমি টিফিনের টাকা দিয়ে এগুলো আনার কি দরকার? জবাবে আম্মুকে বলতাম, ভাই বলে একটা দায়িত্ব আছে না হু? আম্মু আমার কথা শুনে হেসে বললেন, ওলে বাবা! আমার আব্বুটাতো বড় হয়ে গেছে দেখছি৷ বোনের দায়িত্ব নেয়া শুরু করে দিয়েছে৷ তারপর আম্মু পরম মমতায় দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরতেন৷”
-যখন ১০ম শ্রেনীতে উঠলাম তখন শুভ্রতাকে স্কুলে ভর্তি করানো হল৷ ততদিনে শুভ্রতা ৫বছরের বুড়ি৷ আমি সবসময় বুড়ি বলেই ডাকতাম৷ সকালে আমিই স্কুলে এনে দিতাম ৷ আমি স্কুল শেষে বাসায় যাওয়ামাত্রই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো৷ যেহেতু আম্মু দিনের বেলা বাসায় থাকতেন না আর আব্বুও চাকরীতে থাকতেন সেহেতু বাসায় আমরা ভাইবোনই থাকতাম৷ আমার ৫বছরের বোনটাই তখন আমার অভিভাবক হয়ে যেতো৷ টাওয়েল দিয়ে ঘাম মুছে দিতো আর ঠান্ডা পানি দিয়ে শরবত এনে দিতো৷ রাতে ভাইবোন মিলে পড়তে বসতাম৷ বুড়িটা নিজের বই না পড়ে আমার সাইন্সের বইগুলো নিয়েই পৃষ্ঠা উল্টানো শুরু করতো৷ রাত হলে আমার বুকের উপরই ঘুমিয়ে পড়তো৷ রোজ সকালে আমার কপালে চুমু দিতো৷ আমাদের ভাইবোনের ভালোবাসা দেখে আব্বু-আম্মু হাসঁতো৷ আমাদের পরিবারটাকে তখন পৃথিবীর সবচাইতে সুখী পরিবার মনে হতো৷”
-সুখ জিনিসটা কখনোই বেশীদিন স্থায়ী হয়না৷ দীর্ঘস্থায়ী সুখ হয়তোবা বিধাতারই পছন্দ হয়না৷ সময়টা ছিল আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষের দিকে৷ আম্মু ঈদানিং স্কুলে যায় না৷ চোখের নিচটা কালচে হয়ে পড়েছে৷ আম্মুর দিকে তাকালেই মনটা ঢুকরে কেদেঁ উঠে৷ আব্বু জিজ্ঞাসা করা শর্তেও কিছুই বললোনা৷ বোনটাও আমার কাছে এসে বলে, ভাইয়া আম্মুর কি হয়েছে? বোনের প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না আমি৷ বোনটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি৷ পড়া বাদ দিয়ে আম্মুর পাশে বসে থাকতাম৷ আমার মা জননী কে এই অবস্থায় দেখিনি কখনো৷ সারাদিন হাসাহাসি করা আম্মুটার হাসিতে যেন ক্লান্তি ভর করেছে৷ যখন পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসতাম তখন দেখতাম, আম্মু বোনটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কান্না করছে৷ রাত হলে আব্বু নির্ঘুম কাটাতেন আর আমি আমার বোন দুজন দুপাশ থেকে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে রাখতাম৷ হঠাৎ করেই সুখের সংসারটাতে নীরবতা ভর করা শুরু করেছে৷
-সন্ধ্যায় পড়ছিলাম৷ আম্মু হঠাৎ ডাকলেন আমাকে৷ আম্মুর রুমে গেলাম সাথে শুভ্রতাও গেল৷ আম্মু শুভ্রতাকে পাশের রুমে পাঠিয়ে দিলেন৷ আর আমাকে বললেন,
-শুভ্র! তোর বাবা না বললে তুই হয়তো বুঝে গিয়েছিস আমি আর বেশিদিন বাচঁবোনা!
-আমি ছলছল চোখে আম্মুর চেহারার দিকে চেয়ে রইলাম৷ মুখ দিয়ে কিছুই বেরোচ্ছেনা৷ আম্মু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন৷ আর বললেন, বাবা মানুষতো আর চিরদিন বেচেঁ থাকেনা৷আজ নয়তো কাল সবাইকেই যেতে হবে৷ কেউ আগে আর কেউ পরে৷ আমি চলে গেলে তুই শুভ্রতাকে দেখে রাখিস৷ আমি জানি তুই পারবি৷ আর আরেকটা সত্য তোকে জানানো দরকার৷ শুভ্রতা তোর মায়ের পেটের বোন না৷ আমার একছাত্রীর বোন ছিল শুভ্রতা৷ ওর জন্মের সময় ওর মা মারা গিয়েছিল৷ ওর বাবা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল৷ আর শুভ্রতার বোন চাচীর বাসায় আশ্রিত থাকতো৷ ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না শুভ্রতাকে ওর কাছে রাখার৷ মেয়েটাকে যখন তোর আবদারের কথা শুনিয়েছিলাম, মেয়েটা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল৷ তুই যখন ছোটবেলায় আমার স্কুলে যেতিস তখন তোর আপুটা সারাক্ষণ তোকে নিয়ে থাকতো৷ তুইও মেয়েটাকে দেখলেই ছুটে যেতি ওর কাছে৷ তোর মত ওর ও একটা শখ ছিল, তার একটা ভাই থাকবে৷ কিন্তু সবার সব ইচ্ছা পূরন হয়না৷ বাবা! তোর বোনটাকে আগলে রাখিস৷
-আম্মুর কথা শুনে ম্মিত হেসে বললাম,
মাগো! শুভ্রতা আমার বোন না সেটা আমি জানতাম৷ তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছিলে তোমার খোকাটা তখন ছোট ছিল না৷ তোমাদের কাছ থেকে পাওয়া সেরা উপহার হল শুভ্রতা৷ যেইদিন ওর ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আমার আঙুলটা
শক্ত করে ধরেছিল, সেইদিন থেকেই ও আমার রক্তের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে৷
সেইদিনআমার কথা শুনে মায়ের মুখে নিশ্চিন্তের হাসি ফুটে উঠেছিল৷ সেই হাসি আমি পরজনমেও ভুলবোনা৷”
-পরেরদিন পরীক্ষা শেষে বাসার সামনে যখন মানুষের কোলাহল দেখলাম, তখনই বুঝে গিয়েছি মা আমার আর নেই৷ শুভ্রতা কাঁদছে, আর বাবা সোফায় থমকে বসে রয়েছে৷ আমি কাদাঁর শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছি৷ হাত-পা নিস্তেস হয়ে আসছিল৷ মা আর কোনোদিন সোনামণা বলে ডাকবেনা আমাকে৷ নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিবে না৷ ধীরপায়ে মায়ের পাশে এগিয়ে গেলাম, জননীর ললাটে শেষবারেরমত চুমু দিয়েই বোনটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি৷”
-মা মরে যাওয়ার পর যার উপর ভরসা ছিল সেই বাবাটাও কেমন জানি হয়ে গেল৷ সারাদিন উদাস হয়ে আকাশপানে চেয়ে থাকতো৷ মাঝে মাঝে চাপা আর্তনাদে ঢুকরে উঠতো৷ বড্ড মায় হতো বাবাটাকে দেখে৷ বোনটা ততদিনে ২য় শ্রেণীতে উঠেছে৷ এই বয়সে যার খেলনার হাড়িঁ-পাতিল সামলানোর কথা ছিল সেই বোনটাই এখন বাস্তবে হাড়িঁ-পাতিল সামলানো শিখে গিয়েছে৷ মাধ্যমিকে মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট এসেছিল৷ কিন্তু সেবার কলেজে এডমিশন নিই নি৷ আব্বুও দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো৷ তখন আম্মুর পরিচিতদের বদৌলতে দুটো টিউশনি জোগার করলাম৷ ৩জনের পরিবারটা মোটামুটি চলে যেত৷ বোনটা কিছুই আবদার করতোনা, তারপরও যথাসম্ভব চেষ্টা করতাম শখগুলো পূরণ করার৷”
-টিউশন থেকে এসেই দেখলাম আব্বু আর শুভ্রতা লুডু খেলছে৷ যেমনটা আমি আর মা খেলতাম৷ লুডু দেখেই চোখের কোণে জলের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম৷ তারপরও ভালো লাগছিল আব্বু অনেকদিন পর স্বাভাবিক হওয়াতে৷ অনেকদিন পর আব্বুর মুখে খোকা ডাকটা শুনেছি৷ সেদিন সবাই একসাথে খেলাম আর গল্প করলাম৷ সৃষ্টিকর্তা হয়তো আব্বুকে আমাদের কাছ নেয়ার আগে একটিবার সেই আগের বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন৷ হ্যা! বাবা মারা গেলেন তারপরের দিনই৷ তখন পুরোটাই অভিভাবকশূন্য আমরা৷”
-এখন শুভ্রতার বাবা-মা আর ভাই সবগুলোই আমি৷ বোনটাও আমার পিচ্চি বয়সে অনেককিছুতেই মানিয়ে নিয়েছে৷ আমার সবকিছুতেই তার কঠোর নজরদারী ছিল৷ রাতজাগতে দিতো না, সন্ধ্যাবেলায় বাইরে ঘুরাঘুরি বন্ধ, খাবারের নিয়ম, ঘুমের নিয়ম সবকিছুতেই তার কঠোর নজরদারী৷
যেদিন ২য় শ্রেনী থেকে পাশ করে ৩য় শ্রেণীতে উঠলো৷ সেদিন দৌড়েঁ এসে হাপাঁতে হাপাঁতে বলল,
-ভাইয়াাাাাাা! আমি পাশ করেছি৷ থ্রিতে উঠেছি আমার রোল-১৷
-আলহামদুলিল্লাহ! তাইলেতো আপুটাকে একটা পুরষ্কার দিতে হবে তাই না? (আমি)
-হ্যা তা তো দিতেই হবে৷ (শুভ্রতা)
-বল কি চাই? (আমি)
-যা চাই তাই দিতে হবে কিন্তু! (শুভ্রতা)
-হ্যা দিবো৷ (আমি)
-এবার তুমি কলেজে এডমিশন নিবা৷ এখনতো আমি বড় হয়ে গেছি তাই না! এখন আমার কথা শুনতে হবে৷ (শুভ্রতা)
-আচ্ছা ঠিক আছে৷ (আমি)
-হু৷ এবার কপালটা একটু নামাও৷ (শুভ্রতা)
-কেন? (আমি)
-পাপ্পি দিবো তাই৷ বড়বোন পাশ করেছে সেই খুশিতে ছোটভাইকে একটা পাপ্পি দিতেই পারে! তাই না? (শুভ্র)
-হ্যাাা! তা তো অবশ্যই, দেন আপু৷(আমি)”
-পরেরবার কলেজ গিয়ে এডমিশন নিলাম৷ শুভ্রতাও সাথে গিয়েছিল৷ সাইন্স পাল্টে কমার্সে চলে গিয়েছিলাম৷ সাইন্স পড়া সম্ভব ছিলো না৷ টিউশন আর কলেজ শেষ করেই বাসায় চলে আসতাম৷ শুভ্রতা বিকেলের দিকে স্কুল শেষ করে আসতো৷ সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসতাম একসাথে৷ আমি ছাত্র আর সে ম্যাম৷ কলেজের পড়া কমপ্লিট করার জন্য সে টাইম বেধেঁ দিত৷ আর আমাকে সেই টাইমের ভিতরেই পড়াটা শেষ করে ওকে দিতে হতো৷ পড়া পারলেই পাপ্পি দিতো আর না পারলে কামড়৷ সবকিছু ঠিক ছিল শুধু হিসাব বিজ্ঞানে গিয়ে আটকে যেতাম৷ সেটা শুভ্রতা খেয়াল করতো৷ তার ঠিক দুইদিন পরেই সামনের বাসার মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলল শুভ্রতা৷ মেয়েটা কমার্স নিয়েই পড়তো৷ আমার যেহেতু ১বছর লস ছিল সেহেতু মেয়েটা ১বছরের সিনিয়র ছিল৷ মেয়েটার সাথে প্রথমে বন্ধুত্ব করলো তারপর নাকি বায়না ধরলো আমার ভাইকে হিসাব-বিজ্ঞান বুঝাতে হবে৷ মেয়েটার নাম আফিয়া৷ আমি বসতে না চাইলেও শুভ্রতা জোর করে বসাই রাখতো৷ আফিয়া যখন আমাকে বুঝাতে শুভ্রতা আমার পাশেই বসে থাকতো৷ আফিয়ার সাথেও আমরা ভাই-বোনের ভাবটা জমে গেল৷ আমি বাসায় না থাকলে আফিয়া আমাদের বাসায় চলে আসতো৷ নয়তো শুভ্রতা আফিয়ার বাসায় চলে যেত৷”
-সকালে কলেজে এসে শুনলাম আজ নতুন ম্যাম ক্লাস নিবেন৷ ক্লাসে ঢুকেই মাঝখানের একটি বেন্ঞ্চে বসলাম৷ ম্যাম ঢুকতেই সবাই দাড়িঁয়ে গেল৷ ম্যামের চেহারা দেখেই কেমন জানি চেনা চেনা লাগল৷ মনে হচ্ছিল, আমি উনাকে কোথাও দেখেছি কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলাম না৷ হয়তো না ও হতে পারে৷ সবচিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিলাম৷ ম্যাডাম একটু বেশীই মেজাজী টাইপের৷ পান থেকে চুন কষলেই পেয়ে বসবে৷ আর যেদিন যাকে ধরেছে সে শেষ৷ শাস্তি তো দিবেন সাথে কথাও শুনাবেন৷ আর ম্যামের ক্লাস কিছুতেই মিস দেয়া যাবে না৷ যে মিস দিবে তার খবর করে দিতো৷ আর যারা নিয়মের বাইরে যেত না তাদের খুব ভালোবাসেন৷ সবচাইতে ভালো লাগে উনার চোখে লাষ্ট আর ফাষ্ট দুই বেণ্ঞ্চই সবাই গুরুত্ব পেয়ে থাকে৷
-বোনটার দুই দিন ধরে জ্বর৷ চেহারাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে৷ আমার চণ্ঞল বোনটা হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে গেল৷ মনে অজানা ভয়ের শিহরণ বয়ে যাচ্ছিল৷ বাবা-মা হারানোর শোকটা ভুলেছিলাম যার মুখের দিকে তাকিয়ে, তাকে হারাতে হবে বলে৷ ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিলাম৷ রাত্রে জলপট্টি দিচ্ছিলাম তখন শুভ্রতা বলে উঠল,
-ভাইয়া আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর৷ জ্বর কমে যাবে৷ তুই একদম ভয় পাবিনা৷ আমি কোথাও যাবোনা আমার পাগলা ভাইটাকে রেখে৷
আমি প্রতিনিয়ত অবাক হই পিচ্ছিটার কথা শুনে৷ একদম বুড়ির মত কথাবার্তা বলবে৷”
-সৃষ্টিকর্তা এবার আমাকে নিরাশ করেনি৷ বোনটা অল্পতেই সুস্থ হয়ে উঠলো৷ খুশিমনে কলেজে গিয়ে নতুন ম্যামকে দেখার পরেই খুশিটা হাওয়াই মিলিয়ে গেল৷ ম্যাম কোনো এক্সকিউজ শুনেন না৷ সরাসরি শাস্তির পর্যায়ে চলে যান৷ আমাকে দেয়া হলো কঠিন শাস্তি, যেহেতু ৪দিনের অনুপস্থিতি ছিল৷ পায়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে কানে ধরা৷ জীবনে এরকম ভয়ংকর শাস্তি পাইনি৷”
-ম্যামের শাস্তির কারণে রাতেই জ্বর উঠে গেল৷ পিচ্চি বোনটা খুব যত্নের সহকারে সামলাতে লাগলো সবকিছু৷ আফিয়াকে সাথে নিয়ে ডাক্তার আনিয়েছে৷ নিজের হাতে রান্না করেছে৷ অবশ্য লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিল৷ পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর বাসায় নতুন কারো গলা শুনতে পেলাম৷ রুম থেকে বেরিয়েই দেখলাম সিনথিয়া ম্যাম(নতুন ম্যাম)৷ উনি দেয়ালে লাগানো ছবিটার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আমাকে দেখামাত্রই ,
আমি কিছু বলার আগেই সিনথিয়া ম্যাম জড়িয়ে ধরলেন আমাকে৷ আমি তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ ততক্ষণে শুভ্রতা এসে হাজির৷ শুভ্রতাকে দেখামাত্রই ম্যাম কোলে তুলে নিলেন৷ শুভ্রতা হঠাৎ ম্যামকে জড়িয়ে ধরলেন৷ আমি অবাক হয়ে তাদের কান্ড দেখছি৷ কিসের মধ্যে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছিলাম না৷”
-পরে সিনথিয়া ম্যামের কথা অনুযায়ী যা বুঝলাম তা হল, গতকালই সদ্য ৫ম শ্রেণীতে উঠা পন্ডিত বোনটা কলেজে গিয়েছিল প্রতিবাদ করতে৷ সাথে আফিয়াকে নিয়ে সরাসরি সিনথিয়া ম্যামের কাছে৷ তারপর সকালে সিনথিয়া ম্যাম বাসায় আসলেন৷”
-সবকিছু শোনার পর আর বুঝার কিছুই বাকি থাকলোনা৷ মা মারা যাওয়ার আগে যার কথা বলে গিয়েছিল তিনিই আজকের সিনথিয়া ম্যাম৷ শুভ্রতার মায়ের পেটের বোন৷ পিচ্চিটাও সব বুঝে ফেলেছে হয়তো এতক্ষনে৷
আমি সিনথিয়া আপুকে বললাম,
-এখন কি করা যায় আপু? শুভ্রতা কিন্তু আমার প্রাণ৷ ওকে আপনি কোথাও নিয়ে যাবেন না৷
-শুভ্রতা! এই গরুটাকে কি করা যায় তুই বল৷ (সিনথিয়া আপু)
-সিনথিয়া আপুর কথা শুনেই পিচ্চিটা দৌড়েঁ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল, আমার ভাইকে কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনা হু!”
-সিনথিয়া আপু অভিমান ভরা কন্ঠে বলে উঠলো,
ও আমি বুঝি কেউ না৷ এতদিন পর ভাইবোন দুটোকে পেলাম, কিন্তু তারা একটিবারও জড়িয়ে ধরলোনা হু৷ আর শুভ্র গরু! ছোটবেলায় স্কুলে গেলেতো খুজেঁ খুজেঁ আমার কোলেই উঠতি৷ আমার আঙুল ধরে হাটঁতি৷ চুল ধরে টানতিস৷
-সিনথিয়া আপুকে আর কিছুই বলতে দিই নি৷ শুভ্রতা আর আমি মিলে জড়িয়ে ধরেছি৷ ঠিক যেমন আমাদের মা কে আমরা জড়িয়ে ধরতাম৷ আপু আমাদের দুজনের কপালে চুমু দিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷
-পরদিন সকালেই আপু একেবারে এসে গেলেন আমাদের বাসায়৷ অনেকদিন পর ঘরটা পূর্ণতা পেল৷ অন্তত একজন অভিভাবক এর ছায়াতো পেয়েছি৷ তারপরের দিনগুলো বলতে গেলে অসাধারণ ছিল৷ আমাদের মায়ের অভাবটা অাপু অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছিল৷”
-সেদিনের পিচ্চি শুভ্রতা এইবার কলেজে এডমিশন নিয়েছে৷ আমি বছর আড়াই ধরে চাকরী করছি৷ পেশা হিসেবে মা আর বোনের পেশাটাই বেছে নিয়েছি৷ যে স্কুলে মা শিক্ষকতা করতেন সেই স্কুলেই৷ সিনথিয়া আপুকে চাকরী পাওয়ার পরেই আমি আর শুভ্রতা মিলে জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি৷ মেয়ে কিছুতেই বিয়ে করতে চাচ্ছিল না, আমাদের ভাই-বোনকে ছেড়ে তিনি যেতে পারবেন না৷ শেষমেষ অনেক বুঝিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম৷ এখন আপুর একটা মেয়ে হয়েছে৷ একদম পুতুলের মত৷ আমাকে দেখলেই কোলে ঝাপিঁয়ে পড়ে৷ মামা ডাকতে না পারলেও তার চেষ্টার কমতি নেই৷ সবচাইতে ভালো লাগে যখন সে আমার বুকের উপর বসে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার নাক, কান, চুল আর কপালটা ছুঁয়ে দেয়৷ আর শুভ্রতা! সে তো এখন মহাপন্ডিত! আমার জন্য বৌ আনার মিশনে নেমেছে সে৷ পাত্রী তার বান্ধবীর বড় বোন ঠিক করে রেখেছে৷ কিন্তু আমি কিছুতেই তার কথায় সাড়া দিচ্ছিনা বলে সে ভীষণ রেগে আছে৷ আজকে বাসা থেকে বেরোচ্ছিলাম তখন সে বুয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে “আজকে থেকে বাসায় কোনো রান্না হবে না বুঝেছো! আমি অনশনে! বুইড়াটাকে বল তারাতারি রাজী হতে৷ নয়তো ঘরের মধ্যে আমি ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতি শুরু করে দিব!৷
” নাহ! বোনটাকে আর নিরাশ করে লাভ নেই৷ আজকেই হ্যা বলে দিব৷ আর বান্ধবীর বোনটাও যথেষ্ট সুন্দরী৷ তখন আবার পরে পস্তাতে হবে৷
আমার কলিজার সমার্থক “শুভ্রতার” কথা আমি ফেলতে পারবো না কখনোই৷”
-আকাশটা আজ আর বিষণ্ণ নয়৷ রং ধনুর সাত রঙে রাঙানো৷ আজ মা-বাবা থাকলে কত খুশিই না হতো! আকাশপানে তাকিয়ে মা বাবা বলতে ইচ্ছে করছে” মা-বাবা শুনো! তোমাদের সিনথি ,শুভ্র আর শুভ্রতা বড্ড ভালো আছে৷ তোমরা সাথে থাকলে আরো বড্ড বেশীই ভালো থাকতো”৷ তোমরাও ভালো থেকো ঐ পারে৷