ভালবাসার চাদর

ভালবাসার চাদর

আমি যখন মানহার মেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন রাত প্রায় দশটা বেজে এগারো মিনিট।এসময় এই রাস্তায় গাড়ির শব্দ শোনা গেলেও কোন মানুষের আনাগোনা পাওয়া যায় না।বলতে গেলে একদম ফাকা বললেই চলে।মাঝে মাঝে দু একজন দেখা গেলেও তা নিমিশেই মিলিয়ে যায়।দু একজনকে দেখা যায় বাসায় ফিরতে হাতে ব্যাগ নিয়ে।

মানহার রুমের বেলকুনিটা এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্পষ্টই দেখা যায়।আমিও ঠিক ওই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম।মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেছে নাকি জেগেই আছে।অবশ্য জেগে থাকলে ওর রুমের লাইটটা জ্বালানো থাকতো।আবার এমনও হতে পারে হয়তো লাইট অফ করে মাত্রই শুয়েছে।আমি মানহার নাম্বারে দু বার কল দিতেই মেয়েটা ফোনটা ধরলো।তবে ওর কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ও ঘুমায়নি,হয়তো শুয়েই ছিল।
আমি মানহাকে আস্তে করে বললাম,

-একটু বের হবে?
আমার কথায় যে মানহা একটু অবাক হলো এটা আমি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারলাম।অবশ্য এখানে মানহার জায়গায় অন্যকেও থাকলেও সেও অবাক হতো।এত রাতে মেস থেকে বের হওয়াটা যে অসম্ভব ব্যাপার এইটা আমার বেশ ভাল করেই জানা।মানহা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

-তুমি আজকেও এসেছো এই রাতের বেলা।
-অফিস থাকে বলে দিনে তো আর দেখতে পারি না ওই চাদমুখ খানা,তাই রাতেই আসতে হয়।
আমার কথায় মানহা একটু চুপ করেই রইলো।জানি মেয়েটা এখন বেলকুনিতে এসে দাঁড়াবে,আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলবে আমি যেন চলে যাই।

মানহা ঠিক দু মিনিট পর বেলকুনিতে আসলেও আজ ওর হাতটা নড়ছে না।অন্ধকারে ওর ছায়াটা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মানহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-নয়টার পরেই মেস বন্ধ,এটা তুমি জানা সত্বেও প্রতিদিন কেন আসো এভাবে?
-তোমার টানে।
-কিন্তু তোমাকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে আমার খারাপ লাগে,তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে এইটা বুঝতে পারো না?

মানহার কথায় আমি কিছু বললাম না।এই মেসগুলাও কেমন যেন,আরও দু ঘন্টা সময় বাড়িয়ে দিলে কি এমন হয়।অবশ্য দারওয়ানটা যদি একটু ভাল হতো,তাহলে মন্দ হতো না।

কিন্তু এই দারওয়ানের চাকরীটা যদি আমার ফ্রেন্ডদের কোন একজনকে যদি দিতে পারতাম।মেহেদী, তুষার, পান্থ যে কোন একজন এই চাকরী টা পেলে আজ অন্তত মানহাকে নিয়ে বের হতে পারতাম।

কিন্তু এদের দিয়েও বিশ্বাস নেই।কখন যেনো শুনবো মেসের কোন এক কন্যাকে নিয়ে দারওয়ান উধাও। তখন আবার আরেক ঝামেলা হবে।আমার চুপ থাকা দেখে মানহা আবারও বললো,

– শীতের কাপড় পড়ে আসোনি আজ, শীতে তো কাপছো।
-আসলে তাড়াহুড়োয় ভুলে গিয়েছিলাম।
আমার কথায় মানহা যে রেগে যাবে এটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম।কিন্তু এতটা যে রেগে যাবে সেটা বুঝিনি।মেয়েটা আমাকে আর দাড়াতে দিল না,একটু রাগ দেখিয়েই বললো,

-বাসায় গিয়ে ফোন দিবা।
কথাটি বলেই ফাজিল মেয়েটা ফোনটা কেটে দিল।তবে আমি গেলাম না,কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম।কেমন যেন টানছিল আমাকে ওর মায়াটা।তবে এখানে এভাবে বেশিক্ষন দাড়িয়েও থাকা যাবে না।

আমি যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পেছন থেকে একজন বেশ জোরেই ডেকে উঠলো।অবশ্য এসময় আস্তে ডাকলেও বেশ জোরেই শোনা যায়।আমি লোকটার ডাকে ওনার দিকে তাকালাম।কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল।তবে ওনার পোষাক দেখে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে এই মেসের দারওয়ানের দায়িত্বটা ওনার কাধেই।হাতে একটা লাঠিও দেখা যাচ্ছে।

আমি লোকটার দিকে তাকাতেই উনি একটু হেসে বললেন,
-স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?ওই যে আমার মেয়েকে আপনি রক্ত দিলেন।
লোকটার কথায় আমার মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা।অনলাইনে রক্তের লাগবে এরকম একটা পোষ্ট দেখে হসপিটালটা কাছে হওয়ায় আমিই গিয়েছিলাম।সেদিনই এই লোকটার সাথে পরিচয়।ওনার মেয়েকে রক্ত দিয়েছিলাম।কিন্তু লোকটা ঠিকই আমাকে মনে রেখেছে আর ভুলে গেছি আমি।
আমার চুপ থাকা দেখে লোকটা আবারও বললো,

-স্যার,এখানে এই রাতে,কোন কাজে এসেছিলেন?
লোকটাকে মানহার কথা বলবো কি বলবো না এসব ভাবতে ভাবতে বলেই দিলাম।
আমার কথা শুনে লোকটা মুচকি হেসে বললো,

-আপনি আমার উপকার করেছেন,আজ আমি আপনার উপকার করবো।কিন্তু স্যার কাউকে বলতে পারবেন না।
লোকটার এই রহস্যময় কথা আমার মাথায় ঢুকলো না।এই লোকটা কিই বা করতে পারবে।

আমি মানহার হাতে নিয়ে আসা শিউলি ফুলের মালাটা পেচিয়ে দিতেই মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-দারওয়ান চাচাকে কিভাবে পটিয়ে ফেললে?
মানহার কথায় আমার ঠোটের কোনেও মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো।আমি মানহার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আজ তুমি যার উপকার করবে কাল ঠিকই দেখবে তোমার বিপদে সে পাশে এসে দাড়িয়েছে।এটাও ছিল সেরকম কিছুই।

-যাই হোক,এই চাদরটা জড়িয়ে নাও।
মানহার হাতে রাখা চাদরটা আমি নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ভাবতে লাগলাম দারওয়ানের কথা।লোকটা এত বড় রিস্ক নিয়ে মানহাকে বের হতে দিল,সেটাও এই রাতের বেলা।

আজ ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে চাদর দিয়ে আগলে রাখি।দুজনে এক চাদরে,ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।অবশ্য আমার মনের কথা মানহা একটু তাড়াতাড়িই বুঝে যায়।আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।মেয়েটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো।আমিও আর দেড়ি করলাম না,চাদর দিয়ে মানহাকে আমার বুকে জড়িয়ে নিলাম আর মনে মনে বললাম,

হ্যা আমার তোমাকেই লাগবে,তোমাকেই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত