কেমন যেন বাচ্ছা বাচ্ছা লাগে আপনাকে| যখন আপনি ললিপপ খান|
ভার্সিটিতে দুটো ক্লাস করে বের হয়ে যখন রাস্তায় দাড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন আমার ডান পাশ থেকে কে যেন ঐ কথাগুলো বলল|
অসাধারণ চাহনি এবং দুষ্টুমির হাসি মুখে রেখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে উনার কথার উত্তরের আশায়| কথাটা শুনে অবাক হলাম| কারণ, আমি ললিপপ খাই ঠিক কিন্তু এমন কথা কেউ আমাকে আজ পর্যন্তও বলেনি| কথার উত্তর দিলাম না| উনার দিকে একবার তাকালাম| বাম হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ডান হাত দিয়ে ললিপপটা আবারও মুখের ভিতরে দিলাম| তাঁরপর সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম|
> কি মিস্টার ললিপপ, এত ভাব নিচ্ছেন কেন হুম?
কথাটা শুনে মাথা গরম হয়ে গেল| কে না কে এসে কথাগুলো বলে যাচ্ছে| ললিপপ খেলেই কি ললিপপ ডাকতে হবে? মাথাটা গরম| তবুও মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে একটু জোরেই বললাম…
> কে আপনি?
কথাটা বলেই তাকিয়ে থাকলাম| দেখি কি বলে| অবশ্য আমি উনাকে চিনিই| প্রথম যেদিন দেখেছিলাম চুল খোলা, চোখে কাজল, ফর্সা মুখ, পড়নে লাল রঙ্গের ড্রেস| দেখা মাত্রই আমার ঘুমন্ত অনুভূতিগুলো লাফ দিয়ে সজাগ হয়ে গেলো| আমার ভিতরে কেমন যেন এক শান্তির বাতাস বয়ে গেল| সেদিন ছিলো ভার্সিটির প্রথম দিন| আমার পাশেই বসে আছে বন্ধু আসিফ| তাকে বললাম…
> বন্ধু! মেয়েটাকে দেখতো!
আসিফ মেয়েটাকে দেখলো ভালো করে| আমি আবার বললাম…
> এই বেশি চেয়ে থাকিস না| তাড়াতাড়ি অর নাম ঠিকানা বের কর|
সে আমার দিকে তাকালো প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে, তাঁরপর বলল…
> কিভাবে বের করবো?
> আরে গাধা, আজ ভার্সিটির প্রথম দিন না?
আমার এই কথা বলাতে অমনি সে বুঝে গেছে| তাঁরপর সে দাড়িয়ে মেয়েটিকে ডাক দিলো| আমি বসে বসে মোবাইল টিপা শুরু করলাম|
> জ্বি ভাইয়া?
মেয়েটি কাছে আসার পর তার সৌন্দর্যের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো| আমার বুকেও দুরু দুরু শুরু হলো পচন্ডভাবে| তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম সে ভয়ে ভয়ে আছে| না জানি বড় ভাইয়েরা কি বলে, এই ভেবে| আসিফ যখন নাম ঠিকানা নিয়ে নিলো তখন আমি দাড়িয়ে আসিফকে বললাম…
> এই কি করছিস রে? তুই অর নাম ঠিকানা নিচ্ছিস কেন? তোদের মত ছেলেদের কারনে নিচের ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা ভয়ে ভয়ে আসে ভার্সিটিতে| তুই আমার বন্ধু হয়ে এরকম করতে পারলি? দাঁড়া! তকেতো আজ…
এইটুকু বলে আমি খুজতে লাগলাম বেত| আসিফ আমার এই অবস্থা দেখে সে ভয়ে ভয়ে বলল…
> এই কি করছিস তুই?
তাঁরপর আর এই জায়গায় থাকেনি| দৌড়ে ক্যান্টিনে চলে গেলো| আর আমি নিধির দিকে তাকিয়ে মুখে ইতস্তত ভাব এনে বললাম…
> স্যরি, আমি অর হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি| ও আসলে বুঝতে পারেনি|
ঠিক আছে বলে নিধি আমার সামনে থেকে চলে গেলো| আমি অর চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম| আমাকে অবাক করে দিয়ে সেও পিছনে ফিরে আমাকে আরও একবার দেখে মুখে মিষ্টি একটা হাসি হেসে আবারো চলে যেতে লাগলো|
ক্যান্টিনে গিয়ে আসিফকে বুঝালাম যে নিধিকে ইম্প্রেস করতে আমার এইরকম প্লান ছিলো| তাঁরপর থেকে যখনই নিধির সামনে পড়তাম তখন একটু ভাব নিয়ে চলতাম| আর নিধিকে বোঝাতাম আমি কোনও মেয়ের সাথে কথা বলিনা, একদম ভদ্র ছেলে| জানিনা নিধি বুঝতো কিনা| কিন্তু তবুও আমার সেইম স্টাইল চালিয়ে যেতাম| আর আজ ক্লাস করতে ভালো লাগছিলনা বলে দুটো ক্লাস করে যখন বের হয়ে আসলাম তখন আমায় অবাক করে দিল নিধি কথা বলতে এসে|
> এই কয়েকদিনেই আমাকে খেয়ে ফেলছেন?
> মানে?
> মানে কিছুনা। আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা ছিল বলে এখানে আসছি। পরিচয় নিয়ে কথা বলে সময়কে অকাজে ব্যয় করে লাব নেই। আসুন। ক্যান্টিনে বসে কথা বলি।
> স্যরি। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলিনা। আমি গেলাম।
যখনই চলে আসলাম তখন নিধির দিকে চেয়ে দেখি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অর রাগি মুখটা দেখে মনের ভিতর এক প্রকার ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেলো। মাস শেষ। টিউশনির টাকাও পেয়ে গেছি। কাল শুক্রবার। ভার্সিটিও বন্ধ। আজকে আরাম করে ঘুম একটা দিলাম। শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়ে একটু বের হলাম। আজ কেন জানি মনের মধ্যে অজানা এক আনন্দ তৈরি হলো। রাস্তায় একটু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরেই রিক্সা পেয়ে গেলাম। চাচাকে দেখে মনে হলো উনার শরীর খারাপ। মনে হয় সকাল থেকে এখনো পেটে ভাত যায়নি। মনের সন্দেহ দূর করতে জিজ্ঞেস করলাম…
> চাচা কিছু খেয়েছেন আজকে?
চাচা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার গাড়ির দিকে মন দিলো। কি ছিলো সেই দৃষ্টি ঠিক জানিনা। তবে সেই দৃষ্টি দেখার পর চাচাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমারও খাওয়া হয়নি। চাচাকে সাথে করে নিয়ে ভাতের অর্ডার করলাম। তারপর চাচাকে বললাম…
> চাচা! বাড়িতে কে কে আছেন?
কেন জানি মনে হচ্ছে আমার এসব ব্যবহার চাচার বিশ্বাস হচ্ছেনা। উনার মুখে যেই হাসিটা ফুটে উঠেছে সেই হাসিটা আমি আর কোনদিন দেখিনি। উনি বলতে লাগলেন…
> আমার একটা ছেলে আছে বাবা। ছেলেটা এখন সিক্সে পড়ে। ছেলেটা অনেক দিন ধরেই বলতেছে তাকে তার জন্মদিনে সুন্দর একটা উপহার দেয়ার জন্য। এই কয়েকদিন ধরে খানাপিনা ছেড়ে ছেলেটাকে ভালো একটা উপহার দিতে দিনরাত রিক্সা চালাচ্ছি।
উনার কথাগুলো গায়ে প্রচন্ডভাবে আঘাত করলো। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি খুব নিষ্টুর। নিজের স্বার্থকে পুরন করতে গিয়ে এইরকম চাচাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছিনা। অথচ এই চাচারা নিজের পরিবারকে নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। নিজের ছেলেমেয়ের চাহিদা পুরন করতে নিজে না খেয়ে চলেছে। আর আমি কি না নিজে পেটপুরে খেয়ে নিজের চাহিদা পুরন করার পরেও এমনি এমনি টাকা উড়াচ্ছি? আর কিছু না ভেবে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম…
> চাচা আপনার ছেলের জন্মদিন কবে?
ওয়েটার কিছুক্ষণ আগেই ভাত দিয়ে গেছে। ভাত আসার পরপরই চাচা খানা শুরু করে দিয়েছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে।
> কেন বাবা! আজকে তার জন্মদিন।
> আপনার ছেলে কি উপহার নেয়ার জন্য বলেছিলো?
> থাক না বাবা? ওসব কথা বাদ দাও।
> চাচা! আমিও কিন্তু আপনার ছেলের মতই। আর হ্যা আজকে আমারও জন্মদিন। আমি চাই আমার জন্মদিনটা আপনার ছেলের সাথে উদযাপন করতে।
চাচা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বলতে পারছেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে আস্তে করে বললেন।
> ঠিক আছে বাবা।
একটু পর খানাটা শেষ করে যখন বিল দিতে এসে শুনলাম আমাদের বিল দেয়া হয়ে গেছে তখন আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। ওয়েটার বলল।
> স্যার! আপনাদের বিল দেয়া হয়ে গেছে। আর যিনি বিল দিয়েছেন উনি বাইরে অপেক্ষা করছেন।
বাইরে এসে আরও আশ্চর্য হলাম। ওয়েটার নিধির কথাই বলছিলো। নিধি আমাদের বিল দিয়ে দিছে। আমি আসছি টের পেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো।
> আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আসলে আপনাদের সব কথা শুনে ফেলছি। আর আপনার কথা শুনে আমি চাচ্ছিলাম আপনার সাথে যোগ হতে। তাই উপায় না পেয়ে এই কাজটা করলাম।
আমার অবাকের পালা এখনো শেষ হয়নি। ওর এরকম কথা আমি মোটেও আশা করিনি। কি বলবো খুজে পাচ্ছিলাম না। মানিব্যাগ থেকে দুশো টাকা বের করে বললাম।
> বিল দিয়েছেন ভালো কথা। আমি আসলে কারো কাছে ঋণ হয়ে থাকতে পছন্দ করিনা। এই নিন টাকাটা। আর আমাকে যেতে দিন।
সে টাকা না নিয়ে উল্টো রাগ করে আর একটু জোরেই বললো।
> কি ভাবেন নিজেকে হ্যা? হিরো! কিং! এত বড়লোক ভাবেন কেন? আমি যেটা ভাবছি সেটাই হবে। চলুন বলছি?
আমি তো এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা। কি বলবো বুঝতে পারছিনা।
> মেয়েটা যখন এত করে বলছে তখন সাথে নিয়েই চলো বাবা? আর দাড়িয়ে থেকোনা চলো?
নিধির কথার উত্তর খুজা থেকে বের হলাম চাচার কথায়। তারপর নিধিকেও সাথে করে নিয়ে গেলাম। চাচার বাড়িতে যাবার আগে কিছু কাপড় কিনলাম চাচা, চাচি এবং চাচার ছেলেমেয়েদের জন্য। নিধিকে রিক্সায় বসিয়েই আমি এসব কিনে নিয়ে আসলাম। চাচার ছেলে এসব দেখে সে কি খুশি। ছেলের আনন্দ দেখে চাচা এবং চাচি কেদেই দিলেন। তদের সবার আনন্দ দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার ভিতরে কি চলতেছে। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে তাদের এই আনন্দ উপভোগ করলাম। তারপর কেক বের করে কেক কাটলাম সবাই মিলে। কেকের উপর লিখা ছিলো Abid and Nabil। সন্ধা হয়ে গেছিলো এসব করতে করতে। যখন সব কিছুু শেষ করে চলে আসছিলাম তখন চাচা চাচির চোখে পানি দেখেছিলাম। সেই চোখের পানিটা আমার ভিতরে আনন্দের ঝড় তুলে দিয়েছিলো। সেই চোখের পানি যে আমার জন্যই ছিলো সেটা ভালো করে বুঝতে পারছিলাম। তাদের থেকে কিছুদুর চলে আসার পর চাচি ডাক দিলেন। আমি কাছে যাওয়ার পর বললেন।
> বাবা! মেয়েটাকে সুখে রেখো। মেয়েটার চোখে অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য। তাকে সাথে রাখলে অনেক ভালো থাকবা তুমি বাবা?
আমি একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে হুম নামক একটা শব্দ উচ্ছারন করে বললাম।
> আপনিও আমার চাচাকে ভালো রাখবেন চাচি।
একটা রিক্সা দিয়ে নিধিকে নিয়ে ওর বাসার সামনে এসে দাড়িয়েছি। রিক্সায় কোন কথা হয়নি আর। নিধিকে চলে যাচ্ছি বলে যখন ঘুরে দাড়ালাম তখন নিধি আমার সামনে এসে একটা টি শার্ট একটা জিন্সের প্যান্ট আর একটা হাত ঘড়ি আমার হাতে দিয়ে বললো।
> কাল ঠিক চারটায় আজকের ঐ চাচা চাচির বাসায় আসবেন। আর হ্যা। এগুলাও পরে আসবেন। ঠিক চারটায় মনে থাকে যেন।
কথাগুলো বলে নিধি চলে গেল। আমিও রিক্সা করে চলে আসতে আসতে চিন্তা করতে লাগলাম। কাল নিধি কি করবে? আজ আমার জন্মদিনের পার্টি কি কাল সে করবে? নাকি ওর জীবনের সাথে আমার জীবনকে একসাথে করে তেনাতেনা করার জন্য প্রপোজ করবে?