ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী সে। খুবই দরিদ্র পরিবারের ছেলে সে। বাবা বর্গাচাষী। চাষবাস করে যা পায় তা দিয়ে কোন কোনদিন সকালে দুমুঠো পান্তা জুটলেও। দুপুরে কি খাবে তা জানা নেই তাদের। অশিক্ষিত পরিবার হওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা ছাড়াই ৫ টা ছেলে হয়েছে একটা মেয়ের আশায়। অবশেষে হাল ছেড়ে দেন রহিম মিঞা। সেই পরিবারের ৫ ছেলের ভেতর বড় ছেলের নাম নিশু।
আগেই তো বললাম ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছেলেটা। নিশুর বয়স যখন ৫ বছর রহিম মিঞা আর তার সহধর্মিণী আছিয়া বেগম সিদ্ধান্ত নেয় তারা তাদের ছেলেদের শিক্ষিত করবে। চাষাভুষা বানাবে না। তাই তারা বড় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। গ্রাম্য স্কুলে যাতায়াত শুরু হয় নিশুর। কিছুদিনের মধেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখের মনি হয়ে যায় নিশু। অসম্ভব রকমের মেধাবী হবার কারনে ১ম শ্রেণী থেকে রোল ১ নিয়ে ২য় শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হয় নিশু। এইভাবে এক এক করে ২য়,৩য়,৪র্থ,৫ম সকল শ্রেনীতেই রোল ১ ধরে রাখে নিশু। ৫ম শ্রেনীতে পাশ করে নিশু। তখন P.S.C প্রচলন হয় নি। 1st division এ সব বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে ঢাকা বোর্ডে প্রথম হয় নিশু নামের ছেলেটি। এইবার প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়ার পালা। অর্থাৎ সরকার তাকে আর কোন বই ফ্রীতে দেবে না। সব বই কিনে তার পড়তে হবে( ২০১০ সাল থেকে সরকার কতৃক বিনামূল্যে বই প্রদান করে) অর্থাৎ তার আগের গল্প এইটা। নিশু তার বাবাকে বলে।
নিশুঃ আব্বা আমার কি আর পড়ালেখা হইবো না আব্বা? আমার হক্কল বন্ধুরা ওই জেলা স্কুলে ভর্তি হইতাছে। হেরা পড়ালেখা হইরা বড় হইয়া ডাক্তার হইবো,ইঞ্জিনিয়ার হইবো। আমি কি কিছু হইতে পারুম না আব্বা? নিশুর বাবা চুপ করে আছে। কোন কথা বলতে পারছে না। বলার ভাষা নাই তার মুখে। আজকেই তাকে বর্গা নেয়া ক্ষেত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মহাজন। এখন খাবে কি তারই ঠিক নেই। আর এর ভেতরে ছেলের বই কেনার টাকা দেবে কেমন করে? স্কুলে ভর্তি করাবে কি করে? আরো কিছুক্ষন ভেবে ছেলেকে বললো।
বাবাঃ কত ট্যাকা লাগবো তোগোর স্কুলে ভর্তি হইতে?
নিশুঃ (চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হাসিমুখে বলে উঠলো) ১৫০০ ট্যাকা আব্বা। নিশুর বাবার মুখ কালো হয়ে গেলো। ঘরে চাউল নাই। হাতে যা আছে সব মিলাইয়া এক করলে ২০০ টাকার মতোন হইব। এখন এতো টাকা পাবো কই? কারো কাছে থেকে ধার নেব তারও উপায় নেই। চারিদিকে ধারদেনায় ডুবে আছে নিশুর বাবা। তারপর কি ভেবে আবার বলে উঠলো।
বাবাঃ কাল আমার লগে হাটে যাইতে পারবি?
নিশুঃ পারুম আব্বা। তয় হাটে যামু কেন?
বাবাঃ আমগো গাভী ডা তো আর দুধ দেয় না অইডা বেইচা দিমু।
নিশুঃ আমাগো ভিটা আর গাভীটা ছাড়া তো আর কোন সম্পত্তি নাই আব্বা। এতো দুঃখের দিন গেছেগা তুমি তো কোনদিন বেচতে চাও নাই। এখন দুধের লাইগা বেইচা দিবা?
বাবাঃ খালি দুধের লাইগা না। বুড়া হইয়া গেছে কবে মইরা যায় আল্লাহ জানে। বেইচা যেই ট্যাকা পামু তা দিয়া নতুন একখান বাছুরও হইব। তোর স্কুলে ভর্তিও হইয়া যাইবো। এতোক্ষনে নিশু বুঝতে পারে তার বাবা কেন গাভী বেচার কথা বলেছে। নিশু একবার তার বাবাকে বলতে চায়। “তুমি গাভী বেইচো না আব্বা। আমি আর পরুম না।” কিন্তু বলতে পারে না। কারন সে জানে লেখা পড়া বাদ দিলে তার জীবনও তার বাবার মতো অসহায় জীবন হয়ে যাবে। সেও একটা অসহায় বাবা হবে একদিন। তাই নিশু মনে প্রতিজ্ঞা করে সে বড় হবে অনেক বড়। আর তার বাবা মা ভাইদের কষ্ট মুছে দেবে। অতঃপর জেলা স্কুলে ভর্তি হলো নিশু। ওহ একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি। নিশু ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে ৫ম শ্রেনীর পরীক্ষাতে।
সরকার তাই তাকে প্রতি ৬ মাস পর পর বেশ কিছু টাকা দেয় পড়াশোনা করার জন্য। তাছাড়াও নিশু পরিবারের অবস্থা বুঝতে পেরে ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে। এতে করে নিশুর বাবা অনেক উপকৃত হয়। দেখতে দেখতে আরো ৫ টা বছর চলে গেছে। নিশুর পরিবার এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী। নিশুর ছোট ভাইয়েরাও তারই মতোন মেধাবী। তারাও ভাইয়ের মতোই ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা রোজগার করে। নিশুর বাবা আর বর্গাচাষ করে না। তিনি এখন ঘরে বসে থেকে তাদের ছোট ছোট ছেলেদের দেখেন মন ভরে শ্বাস নেন। নিশুর এস.এস.সি পরীক্ষা সামনে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে নিশু। হাই স্কুলেও তাকে কোনদিন ১ রোল থেকে সরাতে পারেনি কেউ। তবুও ওর চিন্তা হয় ভালো রেজাল্ট না হলে বাবার অসহায় মুখটা দেখতে হবে তাকে। সে আর ভাবতে পারে না। যে কোন মূল্যেই তাকে পড়তে হবে। অনেক বড় হতে হবে।
নিশুর পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়েছে আজ। যেখানে সারা বাংলাদেশে ২৩.৪৭% শিক্ষার্থী পাশ করেছে। নিশু সেই পরীক্ষাতে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে এইবারও। সবাই দূরে থেকে ওকে দেখতে আসছে। আর বলছে “গোবরেও পদ্মফুল ফোটে।” ওর খুব আনন্দ হচ্ছে আজ। বাবার মুখে হাসি দেখে। কিন্তু এবার তাকে ভালো জায়গায় ভর্তি হতে হবে। নইলে তার লেখাপড়ার মান কমে যাবে। তাই এইবার গ্রাম্য ছেলে গ্রামের মায়া কাটিয়ে শহরে পাড়ি জমায়। বড় হতে হবে তাকে অনেক বড় হতে হবে। এই মাত্র গ্রামের ছেলেটি শহরে পদার্পন করলো। চোখে অনেক স্বপ্ন তার। এখন তার প্রথমত থাকার জায়গা দরকার। সব মেসে খোজ করতে লাগলো নিশু। কিন্তু কোন মেসের সিট ফাকা ছিলো না। তাই বাধ্য হয়েই প্রায় ২ দিন স্টেশনের মেঝেতে আর পার্কের ব্রেঞ্চিতে জায়গা করে ঘুমাতে হলো নিশুকে। আজ তার শহরে ৩য় দিন। ও বুঝে যায় মেসে তার জায়গা হবে না। তাই সে ঠিক করলো বাসা খুজবে। তো সে বাসা খোজা শুরু করলো। সারাদিন বাদে বিকালের দিকে একটা বাসা পেয়ে গেল সে। মাসে ৩০০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আর খাওয়া দাওয়া নিজের। সে তাতেই রাজী হলো।
কলেজে Admission test দিলো আর টিকেও গেল। তারপরেই সে বুঝতে পারলো তার আরো টাকা দরকার। বাবার অতো ভালো অবস্থা নয় যে বসে বসে খাওয়াবে পড়াবে। তাই নিশু কাজ জোগাড় করার চেষ্টা করতে লাগলো। বাড়িওয়ালার কাছে থেকে জানতে পারলো পাশেই একটা কোচিং সেন্টার আছে। তাই নিশু সেখানে গেলো। আলাপের পরে সিদ্ধান্ত নিলো সে কোচিং এ শিক্ষকতা করবে। বিকাল ৫ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত পড়াতে লাগলো সেইখানে। দিনে কলেজ দুপুরে পড়াশোনা। বিকালে কোচিং আবার রাতে বাসায় এসে পড়াশোনা করে ঘুম। এইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো নিশুর। কোচিং এ ইংরেজী পড়ায় নিশু। একমাস কেটে গেছে এরই ভেতরে। কোচিং থেকে বেতন টা নিয়ে সে বাড়িভাড়া পরিশোধ করলো। নিজের জন্য অল্প কিছু রাখলো। বাকীটাকা গ্রামে পাঠিয়ে দিলো।
কয়েকদিন পরে কোচিং এ একটা নতুন মুখ দেখতে পেলো নিশু। আগে কোনদিন দেখে নি তাকে কোচিং এ। ভাবনা বাদ দিয়ে পড়ানো শুরু করলো। রাতে বাসায় ফিরে পড়তে বসেছে নিশু। হঠাৎ ওই মুখটা ভেসে উঠেছে কিন্তু কেন। ছাত্রীর মুখ ভেসে উঠছে কল্পনায় এইটা ভালো লক্ষন না। তবে কি নিশু মেয়েটাকে ভালো বেসে ফেললো? কিন্তু এটা কেমন করে সম্ভব। মেয়েটা তো মাত্র সিক্সে পড়ে। “তাকে নিয়ে এসব কি ভাবছি।” মনে মনে বলে ওঠে নিশু। আবার পড়া শুরু করে। নিশুর ভাষায় আর আগের মতোন গ্রাম্য টান টা নেই। সহজ সাবলীল হয়ে উঠছে দিন দিন।আজকেও ক্লাস নিচ্ছে নিশু কিন্তু কেন জানি ওই মেয়েটার দিকেই তাকাচ্ছে বারবার। কোন এক অদৃশ্য টান কাজ করছে তার ভেতরে। পড়া জিজ্ঞেস করতে সে তাকালো মেয়েটার দিকে বললোঃ
নিশুঃ (প্রশ্ন করল)Present tense এর অর্থ কি?
মেয়েটাঃ বর্তমান কাল স্যার।
নিশুঃতোমার নাম?
মেয়েটাঃ নিঝুম স্যার।
নিশুঃ বসো। নিঝুম বসে পড়লো।নিশু চিন্তা করতে লাগলো নিঝুম নাম টাকোথায় যেন শুনেছে। কিছুতেই মনে করতে পারলো না। নিশুর ক্লাস শেষ তাই বাড়ি ফিরছে।হঠাৎ সামনে নিঝুমকে দেখে চমকে গেলো। কারণ নিশুর সামনে সামনে হাটছে নিঝুম। নিশু কিছু বললো না। তার মতো যেতে লাগলো। আর লক্ষ্য করতে লাগলো নিঝুম কোথায় যায়। সে দেখলো নিঝুম বাড়িওয়ালাদের ফ্লাটে ঢুকছে। যা বোঝার নিশু বুঝে গেলো। সঙ্গে এইটাও মনে পড়লো যে প্রতিদিন রাতে বাড়িওয়ালা বাড়ি ফিরে বাড়ীওয়ালীকে ডাকেন। বলেন নিঝুমের মা দরজা খোলো। নিশু ভয় পেয়ে যায়। যদি বাড়ীওয়ালা জেনে ফেলে নিঝুমকে আমি ভালোবাসি তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
এতো বড় শহরে আমি থাকবো কোথায়। তাই নিশু যতটা পারে নিজেকে সংযত করে নেয়। কিন্তু নিঝুমকে ভুলতে পারে না কোনমতেই। কয়েকদিন যাবৎ নিশু লক্ষ্য করছে কোচিং এ কেউ একজন তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। নিশু যখন সামনে তাকায় তখন দেখতে পায় না। এমনটা শুধু ক্লাস সিক্সের ক্লাস নেয়ার সময় মনে হয় নিশুর। তোএকদিন নিশু তালে তালে রয়েছে তাকানো মাত্রই ধরবে কে তাকায়।হ্যা আজকে নিঝুম এর সাথে নিশুর বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো। তাহলে কি নিঝুমই তার দিকে তাকাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। কিন্তু কেন? তবে কি নিঝুম বুঝতে পারলো নিশুর মনের কথা? নিশু কোচিংপরিচালকের কাছে বলে কাল থেকে সিক্সের ইংরেজী ক্লাসের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে। কোচিং পরিচালক সমস্যা জানতে চাইলে মিথ্যা কথা বলে। নিশু সিক্সের ইংরেজী ক্লাসে আর যেতে হয় না এখন।
কিন্তু এখন অন্য একটা সমস্যা মাথা চারা দিয়ে ওঠে। অন্যান্য ক্লাসের ক্লাস নেয়ার সময় তার মনে হয় দুইটা চোখ তাকে লক্ষ্য রাখছে। দরজার কাছে থেকে কিন্তু তাকানোর সাথে সাথেই শুধু পর্দা নড়ে ওঠা ছাড়া কিছুই চোখে পরে না নিশুর। তবে নিশু ভালোই বুঝতে পারে এটা কার কাজ। আসল ঘটনা শুরু হলো পরের মাস থেকে। একদিন সকালে বাড়িওয়ালী আসে নিশুর ফ্লাটে। আর বলে তার একমাত্র মেয়ে নিঝুমকে বাসায় যেন একা যেয়ে পড়িয়ে আসে। তাহলে আর বাড়িভাড়া দিতে হবে না। নিশু কোন উপায় না দেখে অগত্যা রাজী হয়। নিশু নিঝুমকে পড়াতে যায় রাত ৮ টার পরে। কয়েকদিন কোন সমস্যা হলো না। তারপর নিশু বুঝতে পারে নিঝুম তাকে ভালোবাসে। কারন নিঝুমের খাতায় বড় বড় করে নিঝুম+নিশু লিখা ছিলো। নিশু কি করবে বুঝতে পারে না। কারন নিশুর জন্যে বাড়িটা জরুরি নিঝুম কে পড়ানোবাদ দিলে নিশুকে হয়তো বাসা ছাড়তে হবে। তাই উপায়ান্তর না দেখে পড়ানো চালিয়ে গেলো নিশু।
২ টা বছর কেটে গেছে নিশুর ইন্টার শেষের দিকে।এখন পর্যন্ত কোন খারাপ ঘটনা ঘটে নি। নিঝুম নিশুকে অনেক ভালোবাসে নিশু জেনে গেছে ব্যাপারটা। তাই নিশু এবার সব ভয় তুচ্ছ করে নিঝুমকেবলার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন আর ভয় না পাওয়ার কারন হচ্ছে আর কয়েকদিন পর তাকে এমনিও শহর ছেড়ে চলেযেতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার কয়েকদিন পরে নিশু নিঝুমের জন্য নিঝুমের স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আগেও অনেকবার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিবে নিজের ইচ্ছায় না বাড়ীওয়ালীর আদেশে। আর আজ দাঁড়িয়ে আছে হাতে গোলাপ নিয়ে নিঝুমকে প্রপোজ করার জন্য। ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে নিশুর। ও কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওইতো নিঝুম আসছে।নিঝুম যখন ১০ হাত দূরে তখন নিশু মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। নিঝুমেরবান্ধবীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিশুর দিকে সাথে নিঝুমও। নিশু চিৎকার করে বলতে শুরু করলোঃ
নিশুঃ (চিৎকার করে) তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লেগে গিয়েছিলো নিঝুম। সে ভালোলাগা কখন ভালোবাসাতে পরিনত হয়েছে আমি জানি না। তোমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিবে সেই ভয়ে কিছু বলতে পারি নি। কিন্তু আজ আমি বলছি সবার সামনে বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিঝুম অনেক বেশিভালোবাসি। তুমি ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। I love you. ( উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তখনো তাকিয়ে আছে)
নিঝুমঃ (দৌড়ে এসে নিশুকে মাটি থেকে তুলে দাড় করায়।তারপর নিশুকে নিয়ে একটারিক্সাতে ওঠে আর রিক্সাওয়ালাকে চালাতে বলে)তারপর তারপর নিঝুম রিক্সার ভেতরে নিশুকে বলে ওঠে।
নিঝুমঃ ফুলগুলো কি হাতেই থাকবে নাকি আমাকেও দেবে? (মুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট)
নিশুঃ (অবাক হয়ে গেছে। কারণনিঝুম আগে কখনো তাকে তুমি বলে সম্বোধন করে নি। কিছুটা সামলে নিয়ে) উত্তর ছাড়া কি করে দেই বলো?
নিঝুমঃ উত্তর জানো না বুঝি?
নিশুঃনাহ, জানি না তো? ( না জানার ভান করে)
নিঝুমঃ I love you too (বলেই লজ্জায় মুখ ঢাকলো নিঝুম)
নিশুঃ আমাকে ছেড়ে কখোন যাবে না তো?
নিঝুমঃ নাহ, তবে তুমি যখন বুড়ো হয়ে যাবে তখনকার কথা বলতে পারলাম না। (দুষ্টুমির ভঙ্গিতে।)
নিশুঃ তাহলে তো দেখছি কোনদিন বুড়ো হওয়া যাবে না। হি হি হি
নিঝুমঃ এবার তো ফুল দাও।
নিশুঃ এই নাও।শুরু হলো তাদের খুনসুটি প্রেম। বাবামায়ের নজর এড়িয়ে বিভিন্ন খাবার রেধে তার প্রিয় মানুষের ফ্লাটে নিয়ে যাওয়া। পার্কে পার্কে সময় কাটানো।
আর সারা রাত জেগে ফোনে কথা বলা এইভাবেই চললো কিছুদিন। সামনে নিশুর H.S.C এক্সাম। তাই নিঝুম তোড়জোর শুরু করে নিশুর পড়ার উপর। পরীক্ষার কয়েকদিন যোগাযোগ খুব কম হয় তাদের। শুধু সকালে গুড মর্নিং আর রাতে গুড নাইট টুকু ছিলো তাদের কথা। নিঝুমের খুব খারাপ লাগলেও সে মানিয়ে নেয়। কারন সে জানে নিশুর পরিবারের কথা। নিশুর স্বপ্নের কথা। কিভাবে নিঝুম রাগারাগি করবে নিশুর উপর। সে চায় নিশু ভালো রেজাল্ট করে যেন ওর পরিবারের সকল আশা মেটাতে পারে। রেজাল্ট বেড়িয়েছে নিশুর। প্রতিবারের মতোন এবারেও বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে নিশু। নিশু খুশি,নিশুর পরিবার খুশি, স্যারেরা খুশি সঙ্গে নিঝুমও খুশি। নিঝুম খুশিতে সারা এলাকায় মিষ্টি বিলি করে। আর নিশু এদিকে ভার্সিটি তে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরো চার মাস চলে যায়।
নিশু আর নিঝুমের পবিত্র ভালোবাসা ভালোভাবেই চলছে। এর ভেতর নিশুর একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি হয়ে যায়। নিশুই আবেদন করেছিলো। কারন ভার্সিটিতে খরচ আরো অনেক বেশি। শুধু কোচিং এর টাকা দিয়ে হবে না। চাকরীর সাথে সাথে ভার্সিটিতেও চান্স পায় নিশু। নিঝুম অনেক খুশি হয়। সপ্তাহে ১-২ দিন ভার্সিটি আর বাকী দিনগুলা বরাদ্দ কোম্পানী আর নিঝুমের জন্য। নিঝুম ভাবে সেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। কারন নিশুর মতোন এতো ভালো মনের মানুষ বিধাতা তাকে দিয়েছেন। নিঝুম আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। নিশুও চাকরী করে টিউশনী করে মোটামুটি ভালোই রোজগার করে।কিছু টাকা নিজের জন্য রাখে, বাকি টাকা বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ভার্সিটি শেষ হয় নিশুর। এইখান থেকেও ১ম শ্রেনীর সন্মান নিয়ে বের হয় সে।
তার লক্ষ্য এখন বি.সি.এস। নিঝুম তখন ইন্টার পাশ করে ভার্সিটি ভর্তি হয়েছে। আর নিশু ২৪ তম বি.সি.এস এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বি.সি.এস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীর ক্যাডার হয় সে। সাথে সাথেই একটা সরকারি ব্যাংকে ম্যানেজার পোস্টে চাকুরি হয় তার। ওইদিকে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নিঝুমের দিকে অনেকেরই চোখ পড়েছে। তাই নিঝুম নিশুকে বলে তাড়াতাড়ি বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। নিশুর আর কোন পিছুটান নেই। এখন সে যথেস্ট সাবলম্বী। তাই বাবা মা আর ভাইদের শহরে নিয়ে আসে এবং নিঝুমদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এতোদিনের চেনা ছেলে আর কোন খারাপ দিক না থাকায় তারা সম্পর্ক মেনে নেন এবং বিয়েতে সম্মতি জানান। অতঃপর নিশু আর নিঝুমের বিবাহ সম্পূর্ন হয়। গল্প শেষ।
একটা ছোট্ট ছেলে বলে উঠলো “আচ্ছা দাদু নিশু নামের ছেলেটা কি নিঝুম নামের মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো? আর সে কেমন বাবা হয়েছিলো? অসহায় তার বাবার মতোন?” বুড়োমতো এক ভদ্রমহিলা পাশের ঘর থেকে আসতে আসতে বলছেন। নাহ নিশু নামের ছেলেটি খুবই ভালো ছিলো। তাই সে নিঝুম কেও তার স্বপ্ন পূরন করতে দিয়েছিলো। আর সে অনেক ভালো বাবা হয়েছিলো। কোনদিন কষ্টের মুখ পরিবারকে দেখতে দেন নি। ছোট্ট ছেলে বলে উঠলো “তোমরা দুইজন তাকে এতো ভালোভাবে কেমন করে?” তখন দুই বুড়ো-বুড়ি এক রহস্যময় হাসি হেসে উঠলো। এই হাসি পরিতৃপ্তির হাসি এই হাসি পাওয়ার হাসি।
সমাপ্ত