ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি আর ঘাউড়া স্বভাবের ছিলাম। আমি যেইটা না বলেছি তো সেইটা না’ই,দুনিয়া উলটে গেলেও কেউ আর হ্যাঁ করাতে পারেনি। ছোটবেলায় এসব জ্বালাতন সহ্য করত আম্মু,আর এখন বড় হবার পর এসব জ্বালা সহ্য করছে বউ।
–“এই শুনছ,নীলিমা!”
–“হু বলো।”
–“উঠ তো একটু।”
–“এই রাত করে আবার কী হয়েছে তোমার?”
–“আরে একবার উঠ’ই না!”
চোখ কচলাতে কচলাতে বউ আমার শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। উঠেই ঘড়ির দিকে একবার তাকালো। দেখল রাত বাজে ২ঃ৪৭ মিনিট।
–“এতরাতে কি হয়েছে তোমার?”
–“কই কিছু হয়নি তো।”
–“তাহলে শুধুশুধু কেন আমার কাচা ঘুমটা ভেঙে দিলে?”
–“আরে আমার ঘুম আসছিল না তাই।”
–“তো আমি কী করব এখন!”
–“আমার পিঠ’টা একটু চুলকাই দাও।”
–“এতরাত করে তুমি আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছ পিঠ চুলকানোর জন্য!”
–“আমার তো আর একটা বউ নেই যে তাকে বলবো পিঠ চুলকাই দিতে!”
–“তুমি একটা!”
বউ আমার বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে আমার পিঠে হাত বুলাতে লাগল। বিরক্ত হবেই বা না কেন! এতরাতে কাচা ঘুম থেকে উঠিয়ে কেউ যদি বলে তার পিঠ চুলকাই দিতে তাহলে যে কেউ’ই বিরক্ত হবে।
–“আরে বউ পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে বলিনি। চুলকাই দিতে বলেছি।”
–“উফফ তোমাকে নিয়ে আর পারছি না। এত কেন জ্বালাতন করো তুমি?”
–“বউ যে তাই।”
–“কচু!”
জীবনে প্রেম-ভালোবাসার স্বাদ’টা কখনও গ্রহণ করা হয়নি। হবেই বা কিভাবে! আমার যেই তীক্ষ্ণ স্বভাব,মেয়েরা সাতদিনের বেশি একদিনও টিকতে পারবে না। জেদ,ইগো আর ঘাউড়ামি,এই তিনটা কারণে জীবনে প্রেমের স্বাদ’টা কখনও নেওয়া হয়নি আমার।
–“আজ কী রান্না করেছ?”
–“ইলিশ মাছ দিয়ে বেগুন,মুগের ডাল আর আলু ভাজি।”
–“আমি এইসব খাই না।”
–“খাও না মানে?”
–“খাই না মানে খাই না। খেতে পারি না।”
–“ইলিশ মাছ খাও তাহলে।”
–“ইলিশ মাছে আমার খুব এলার্জী।”
–“তাহলে বাজার থেকে নিয়ে এসছিলে কেন?”
–“তুমি খেতে পছন্দ করো তাই এনেছিলাম।”
–“গত পরশুদিনই তো ইলিশ মাছ খেলে। এখন খেতে কী সমস্যা?”
–“ভালো লাগছে না। তাই খাব না।”
–“তো কী দিয়ে খাবা এখন?”
–“একটা ডিম ভেজে নিয়ে এসো। ডাল দিয়ে মিলিয়ে খাই।”
–“শুধুমাত্র আমি দেখে এখনও তোমার সংসারে পড়ে আছি বুঝেছ। অন্যকোনো মেয়ে হলে সবকিছু ফেলে দিয়ে অনেক আগেই চলে যেত।”
কথাটা বলেই পেঁচার মত মুখ করে নীলিমা ডিম ভাজতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আসলে কথাটা ঠিকই বলেছে। নীলিমা দেখে এখনও সহ্য করে আছে আমার জ্বালাতন,অন্যকোনো মেয়ে হলে সেই কবেই আমাকে ছেড়ে চলে যেত। আর যাই বলুন না কেন,প্যারা নেওয়া কেউ’ই পছন্দ করে না।
–“আজকে অফিস থেকে দ্রুত চলে আসব।”
–“কেন?”
–“আমার ইচ্ছে তাই।”
–“চাকরিটা চলে গেলে তখন বুঝবা।”
–“তুমি আছো না!”
–“আমি আছি মানে?”
–“আমার চাকরি চলে গেলে তুমি চাকরি করবে।”
–“বাসা সামলাবে কে?”
–“আমি।”
–“রান্না করবে কে?”
–“রান্না!”
–“বলো এইটাও তুমি করবে!”
–“আমি কেন রান্না করতে যাব! রান্না করবে তুমি।”
–“হ্যাঁ,অফিস করব তারপর রান্না করব তারপর ঘর গোছাব,আমি তো রোবট তাই না!”
–“তাহলে কী এসব আমি করব?”
–“অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
–“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”
–“সাবধানে যেও।”
–“একটু এখানে আসো তো।”
–“কেন?”
–“তোমার চুলের মধ্যে ময়লা।”
–“থাক আমি আয়না দেখে ফেলে দিব। তোমাকে ভাবতে হবে না। যাও এখন।”
–“যাচ্ছি হুহ!”
ইদানীং বউ আমার খুব চালাক হয়ে গেছে। যাই করি না কেন আমার মতলবটা ঠিক ধরে ফেলে।
বরাবরের মতই অফিসের ব্যপারে আমি খুব’ই আলসে স্বভাবের। অফিসে যেতে খুব আলসেমি লাগে। বিরক্ত লাগে। তবুও বাধ্য হয়ে প্রতিদিন যেতেই হয়। কারণ ঘরে বউ আছে,মা-বাবা আছে। মাসে একটা খরচাপাতি আছে তো। চাকরি না করলে সংসার চলবে কী করে! আমি যে এত আলসে স্বভাবের তারপরও ম্যানেজার সাহেব আজ অব্দি আমাকে কিছু বলেননি এই নিয়ে। মাঝেমধ্যে গ্যাপও দিই। তবুও কিছু বলেন না। বলবেন’ই বা কীভাবে! আমি যে কাজে খুব’ই দক্ষ। অন্য সবার থেকে আমার কাজের হাত অনেক পাকা। একদম ম্যানেজার স্যারের মনমত। সেজন্যই আমাকে কিছু বলেন না। আর আমি এই সুযোগ’টাই প্রতিবার কাজে লাগাই। কথায় আছে না,ছোট মরিচের ঝাল একটু বেশিই।
–“চলে এসেছি।”
–“হু দেখতেই তো পাচ্ছি। তা আজ এত আগে আসার মতলবটা কী শুনি?”
–“মতলব আবার কী হবে!”
–“সেইটা তো তুমিই জানো।”
–“আচ্ছা একটা আবদার করব এখন।”
–“হু করো।”
–“রাখবে তো?”
–“রাখার মত হলে অবশ্যই রাখব।”
–“রাখার মতই।”
–আচ্ছা বলো তাহলে।”
–“নীল শাড়িটা পড় এখন।”
–“কিহহহ!”
–“শাড়িটা পড়।”
–“হাতে অনেক কাজ এখন। পারব না।”
–“প্লিজ! একটু।”
–“এখন শাড়ি কেন?”
–“তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব এখন।”
–“সত্যি?”
–“এজন্যই তো আজকে আগে চলে এসেছি।”
–“ওলে ওলে আমার কিউট বরটা রে! তুমি জাস্ট পাঁচ’টা মিনিট এখানে দাঁড়াও। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
ঘুরতে নিয়ে যাব শুনে বউ আমার আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে। সারাদিন অফিস করে একদমই সময় পাই না নীলিমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে।
–“এইতো আমি রেডি।”
বউয়ের দিকে একবার ভালো করে তাকালাম। নীল শাড়িটা পড়েছে,চোখে কাজল দিয়েছে,ঠোটে হাল্কা একটু লিপিস্টিক দিয়েছে। এক কথায় আমি ফিদা হয়ে গিয়েছি। এ যেন নতুন প্রেমে পড়ার আভাস!
–“চল ঘুরতে যাই।”
–“আচ্ছা আগে আসো তোমার সাথে একটা ছবি তুলে নিই।”
–“হু আসো।”
মোবাইলের সামনের ক্যামেরা’টা অন করে বউয়ের সাথে সুন্দর করে একটা সেল্ফি তুললাম। বউকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। লাগবেই বা না কেন! মুখে একটু হলেও তো ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখেছে।
কয়েকটা ছবি তুলে আমি চার হাত পা চারদিকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
–“কী ব্যপার বিছানায় শুয়ে পড়েছ কেন?”
–“তো কী করব এখন?”
–“আজব তো! তুমি না ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাকে!”
–“ধুর এত জার্নি করে এসে বাইরে ঘুরতে ভালো লাগবে না এখন। অন্য একদিন নিয়ে যাব।”
–“মানে? তাহলে শাড়ি পড়তে বলেছ কেন?”
–“দুইটা ছবি তোলার জন্য শাড়ি পড়িয়েছি। এমনিতে তুমি শাড়ি তো তেমন একটা পড় না। তাই স্মৃতি রাখার জন্য তোমাকে শাড়ি পড়িয়েছি।”
বউ আমার আর কিছু বলল না। সোজা হেঁটে পাশের রুমে চলে গেল। আমি চোখ বন্ধ করে চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে শুয়ে আছি। আহা কী শান্তি! মারাত্মক পরিশ্রম করার পর যখন বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিই,তখন এক স্বর্গীয় সুখ সারা শরীরে অতিবাহিত হতে থাকে।
প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ করে যে কেন মুখের উপরে এক বালতি পানি এনে ঢেলে দিল। ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে গেলাম।
–“এই নীলিমা এইটা কী করেছ তুমি?”
–“কী করেছি দেখতে পাচ্ছ না?”
–“পানি ঢেলে দিলে কেন?”
–“আমাকে এত্ত বড় ধোকা কেন দিলে হ্যাঁ?”
নীলিমা বড় বড় চোখ করে আমারদিকে তাকিয়ে আছি। সেই বড় বড় চোখগুলোতে এক অদৃশ্য মায়া কাজ করছে,আমি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
পানি ঢেলেছে বেশ ভালো কথা কিন্তু পানি থেকে কেমন যেন একটা বিশ্রী ঘ্রাণ আসছে।
–“এই নীলিমা এইগুলা কিসের পানি? এমন গন্ধ আসছে কেন?”
–“এইগুলা আজকে দুপুরের চাল,আদা,পেয়াজ,আলু ধোয়ার পানি।”
–“ছিঃ ছিঃ তুমি এইগুলার পানি আমার মুখে ঢেলে দিয়েছ!”
–“তোমার ভাগ্য ভালো এর থেকেও খারাপ পানি তোমার শরীরে দেইনি।”
–“এই বিকেলবেলা করে তুমি আমাকে গোসল করিয়ে’ই ছাড়লে।”
–“আর এমন করবা আমার সাথে?”
–“গোসল পড়ে করছি। আগে তোমার একটা ব্যবস্থা করে নিই দাঁড়াও।”
বলেই নীলিমার দিকে আগাচ্ছিলাম কিন্তু নীলিমা বুঝতে পেরে সুযোগ বুঝে দিয়েছে একদৌড়।
–“এই যে ম্যাডাম,আজকে রাতে ঘুমাতে আসেন। তারপরে বুঝাব।”
–“আমি আজ রাতে আম্মুর সাথে ঘুমাবো হিহিহি।”
–“হুহ!”
মেয়েটাকে যতই জ্বালাতন করি না কেন মেয়েটাকে ছাড়া যে আমি অচল সেইটা একটু হলেও বুঝি। হয়তো অনেক প্যারা দিই কিন্তু মেয়েটাকে ভালোবাসি অনেক।
–“এই ঘুম থেকে উঠ।”
–“কেন?”
–“মুরগি নিয়ে আসো।”
–“পারব না। ঘুমাতে দাও।”
–“ঘুমাও তুমি। রান্না বন্ধ আজকে।”
রান্না বন্ধ শুনে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লাম।
–“রান্না বন্ধ মানে?”
–“বন্ধ মানে বন্ধ।”
–“ঘরে আর কিছু নেই?”
–“হু আছে।”
–“তাহলে?”
–“থাকলেও রাঁধব না।”
–“কিন্তু কেন?”
–“আমার ইচ্ছে তাই।”
–“তোমার ইচ্ছে’তেই হবে?”
–“আজ থেকে হবে। নয়তো রান্না বন্ধ।”
–“কী সব বলছ!”
–“এতদিন তুমি জ্বালাতন করেছ আমাকে,আর এখন আমি জ্বালাতন করব তোমাকে। আমার কথা না মানলে রান্না বন্ধ।”
–“আচ্ছা কী লাগবে আবার বল। নিয়ে আসছি।”
–“এইতো আমার লক্ষ্ণী জামাইটা!”
–“কচু! শুধু রান্না বন্ধের হুমকি দিয়েছ বলে যাচ্ছি,নয়তো ভুলেও পাঠাতে পারতে না।”
–“এখন যাও। আসলে মিষ্টি দিব।”
–“মিষ্টি কোত্থেকে?”
–“মিষ্টি কী বুঝো না?”
–“দোকান থেকে কিনেছ নাকি?”
–“ধুর! অতকিছু জানি না আমি।”
–“আচ্ছা দ্রুত চলে আসব।”
আমি সবকিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে রাজি আছি কিন্তু খাবারের সাথে ভুলেও না। আগে খাবার তারপর বাকী সবকিছু। গুরু বলেছেন, ‘পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।’
বউটা আমার এত জ্বালাতন সহ্য করে এখনও টিকে আছে। কারণ সে জানে,তার হাত’টা বুকে না নিলে আমার ঘুম আসে না রাতে,সে জানে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে তার কপালে চুমু না দিলে আমার ঘুম আসে না,সে জানে প্রতিদিন সকালে সে আমার কপালে চুমু না দিলে আমার ঘুম ভাঙে না। এতকিছুর পর সে কীভাবে আমাকে ছেড়ে দূরে যাবে?? দূরে যাবে তো দূরের কথা এসব ভুল করেও কখনও মাথায় আনে না সে। কারণ আমার এই জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যেই সে ভালোবাসা খুঁজে পায়।
সব ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করা যায় না। কিছু ভালোবাসা দৈনন্দিন কাজকর্মের মাধ্যমে বুঝে নিতে হয়। আমি তাকে খুব প্যারা দেই তারমানে এই না যে আমি তাকে একটুও ভালোবাসি না। বরং আমার এই জ্বালাতনগুলোর মাঝেই সুপ্ত ভালোবাসা লুকায়িত,যেইটা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকল পবিত্র ভালোবাসাগুলো,সুখে থাকুক সকল স্বামী-স্ত্রী,ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক পুরো পৃথিবী’টা।