ভালবাসার রং

ভালবাসার রং

বিয়ের প্রথম রাতেই বউ আমাকে জিজ্ঞেস করলো। রান্না করতে পারেন? প্রথমে শুনেও না শুনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। বউ আবার জিজ্ঞেস করলোঃ- কি হলো রান্নাবান্না করতে পারেন? একটুআধটু পারি। তবে মাঝেমধ্যে তরকারীর মধ্যে মরিচ,হলুদ এসব দিতে প্যাচ লাগে। কোনোদিন ঝাল বেশি হয় আবার কোনোদিন হলুদে আপনার হুলুদ শাড়ীর মত হয়ে যায়। কিন্তু ডিম ভাজি করতে পারি। সমস্যা নাই চলবে। কি চলবে..? আপনার রান্নাবান্না চলবে। আপনি তাহলে আমাকে দিয়ে এসব করাবেন। হুম,,, আর কি পারেন? খাইতে পারি। আরে এইটা তো সবাই পারে। কাপড়চোপড় ধুইতে পারেন..? পারি কিন্তু অন্যের কাপড় ধুইতে গেলে বমি আসে। নাকে কস লাগিয়ে কাজ করবেন।

কি সাংঘাতিক কথা রে বাবা। শ্বাস বন্ধ করে কাজ করলে আমি কি বাচঁবো? বিয়ের আগে প্রেম করছিলেন..? হুম,, করছিলাম। ছাড়ছেন কেন? আমি ছাড়ি নাই মেয়েটা ছেড়ে দিছে। সিগারেট খান? দৈনিক এ প্যাকেট লাগে। মেয়েটে যেভাবে আপনাকে ছেড়ে দিছে আপনিও ঠিক সেইভাবে সিগারেট ছেড়ে দিবেন। মেয়েটার সাথে সিগারেট এর সম্পর্ক কি? আমি ভালো করেই জানি আপনাদের কাছে একটা মেয়ের চাইতে সিগারেট এর মূল্য কম না। হুম,, এই সিগারেট ছাড়া আমার দিন যায় না। আজ থেকে খাওয়া যাবে না। বললেই হলো?  আমি বলছি খাবেন না। আজ থেকে যেনো সিগারেট খেতে না দেখি। মনে থাকবে তো.? আমি মাথা নাড়িয়ে হা সূচক বলে দিলাম। মনে থাকবে

সকালবেলা বউ আমারে এক বালতি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। মনেমনে ভাবছি মা-বাবা এ কেমন বউ আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলো। না পারছি কিছু বলতে না পারছি ছাড়তে। ভাবছিলাম সকাল সকাল বউ এক কাপ চা নিয়ে কাছে এসে বলবেঃ ওগো শুনছো সকাল হয়ে গেছে উঠো। ফ্রেশ হয়ে এসো দুইজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো। কিন্তু এখন তো দেখছি তার বিপরীত হলো। বিছানা থেকে উঠে মনে হচ্ছে সব কাজ আমাকে করতে হবে। মোবাইলের স্কিনের দিকে চোখ যেতেই দেখি ৭ টা বাজে। চোখ আমার কপালে উঠে গেলো। স্বাবালক হওয়ার পর সকাল ৭ টায় উঠছি বলে মনে হয় না।

নাস্তা খেয়ে চাকরির জন্য বের হলাম। নতুন বউ আমার মাথাটা ধরে কি জানি মনেমনে বলে ঝাড়ফুঁক দিলো। যাবার সময় বলে দিলো এদিক ওদিক না গিয়ে যাতে সোজা বাসায় আসি। চাকরী ইন্টার্ভিউ দিয়ে বউয়ের কথামত সোজা বাসায় আসলাম। এ নিয়ে পাঁচটা ইন্টার্ভিউ দিলাম। পাঁচ নাম্বার ইন্টার্ভিউ সাকসেস। পরশুদিন জয়েন করতে বললো। বেতন একটু কম হলেও আপাতত আমাকে এই চাকরী করতেই হবে। রুমে ঢুকতেই দেখি বউ বটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলামঃ- আপনার হাতে বটি আসলো কেমনে..? রান্নাঘর থেকে এই ঘরে কিভাবে আসলো? এখানেই তো ছিলো। আপনি কি বটি দিয়ে মানুষ খুন করেন? ছিঃ কি যে বলেন. জীবনে একটা পিঁপড়া পর্যন্ত মারতে পারি নাই আর আপনি বলছেন মানুষ। আমার কিন্তু মানুষ মারার অভ্যাস আছে তবে এসব বটি দিয়ে না। আমতা আমতা করে বললামঃ-তা তাহলে কি দিয়ে মারেন..? ভয়ে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। গায়ে একটা শার্ট ছিলো সেটাও ঘামে ভিজে গেছে। এইটা কি বউ নাকি জল্লাদ। তারপর বউ বললোঃ- সময় হলে সব জানতে পারবেন।

একটুপর মায়ের ফোন আসলোঃ- বউমাকে নিয়ে আমাদের বাসায় কখন আসবি? মা আমি চাকরী পেয়ে গেছি। পরশুদিন জয়েন করবো তাই কালই তোমাদের বাসায় আসছি। আলহামদুলিল্লাহ’ আমি অনেক খুশি হয়েছি। এখন বউমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আয়। আচ্ছা মা এ কেমন মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিলে? কেন কি হইছে বাপ? জল্লাদ মেয়ের মত। আমার খুব ভয় করে। আরে পাগল ও তোরে পরিক্ষা করতেছে। ও খুব সরল সোজা একটা মেয়ে কিন্তু রাগলে একটু ভয়ানক লাগে। তবে রাগী মানুষের যত রাগ তত ভালোবাসা। আচ্ছা মা এখন তাহলে রাখি কাল নাস্তা খেয়েই আসছি। আচ্ছা।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমানোর সময় আমি আগে থেকেই খাটের এক পাশে শুয়ে আছি আর উনি আয়নার সামনে বসে চুলগুলো ঠিক করছেন। ভয় করে বলে মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখি। ভয় না করলে তার উপর থেকে চোখ ফিরাইতে পারতাম না। ভালো করে বউয়ের চোখের দিকে তাকাতেই পারি না। তারপর আয়নার সামনে থেকে উঠে বিছানায় এসে বসলো। ঘরে আলো থাকলে আমি আবার ঘুমাইতে পারি না। বিছানা থেকে উঠে লাইট বন্ধ করতে গেলাম। তখন বউ বললোঃ- এই এই কি করছেন..? ঘরে আলো জ্বললে আমি ঘুমাইতে পারি না। ঘর অন্ধকার থাকলে আমিও ঘুমাইতে পারি না।

মহাযন্ত্রনায় পড়লাম। আমার সাথে কিছুই মিলে না। যদি বলি আজকে মুরগির মাংস খাবো তাহলে উনি বলবে গরুর মাংস খাবে। এ কেমন বউ বুঝলাম না। তারপর আবার সেই খাটের এক পাশে শুয়ে পড়লাম। কি ব্যাপার আপনি এতদূরে শুয়ে আছেন কেন?? কাছে আসেন বলছি। এমা সাথে আবার এইডা কি..? শীত করে তাই কোলবালিশ নিয়ে শুয়ে আছি। আমি কে..? আমার বউ। তাহলে আমি থাকতে কোলবালিশ কেন? তারপর বউ আমার কাছ থেকে কোলবালিশ কেড়ে নিয়ে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলো দিলো। আমি হা করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর আমার মুখ চেপে ধরে বললোঃ- এইবার শুয়ে পড়ুন।

সকালে সকাল ঘুম থেকে উঠে হাতে এক কাপ নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াইলাম। দেখলাম একটা ছেলে আমার কোলবালিশ নিয়ে একটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। হয়তো এই কোলবালিশ অন্য কোথাও বিক্রি করে যে কয় টাকা পাবে সেই টাকা দিয়ে তার এক বেলার খাবার জুটবে। বউয়ের এই কাজটা আমার অনেক ভালো লাগছে। আজকে আমাদের মা-বাবাদের বাসায় যাওয়ার কথা আমি ঠিক করলাম আজকে রাতটা এখানেই থেকে যাবো। তারপর বউকে একটা মিথ্যে কথা বলে মা-বাবাদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

আরেক রাতে একটা দামী জিনিষ এই জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। পরেরদিন সকালে লক্ষ করলাম। ঠিক সেই ছেলেটা আবার আসলো। কিন্তু এবার ছেলেটা এই জিনিষটা না নিয়ে সোজা আমাদের রুমে এসে কলিং বেল চাপলো। ছেলেটির এ কাজ দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। ছেলেটা এ জিনিষটা নিতে পারতো কিন্তু নেয়নি। সে বুঝতে পারছে এটার অনেক দাম। দরজাটা খুলে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এসব কাজ করো কেন? ছেলেটা উত্তর দিলো এ কাজ না করলে খাবো কি স্যার। এত অল্প বয়সে এসব কাজ। আচ্ছা তোমার মা-বাবা কই? নেই স্যার। জন্মের পর থেকেই আমি একা। তারপর মনেমনে একটা ডিসিশন নেই। আজকের পর থেকে ছেলেটা আমাদের সাথে থাকবে। আমাদের কাছে রেখে দিলাম ছেলেটাকে। তারপর মার্কেট থেকে ছেলেটার জন্য নতুন কাপড় কিনে আনলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে ভালো মন্দ খাইয়ে একটা রিক্সা নিয়ে সোজা মা-বাবারদের বাসায় গেলাম।

যাওয়ার পর ছেলেটাকে আমার সাথে দেখে আমার বউ জিজ্ঞেস করলোঃ- এই ছেলে আপনার সাথে কেন? তার মানে এর আগে আপনি আরেকটা বিয়ে করছিলেন। বলতে বলতে কেঁদে দিলো। আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। মাঝখানে মা এসে বললোঃ- তুই এর আগে আরেকটা বিয়ে করছিলি? আমাদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? ইত্যাদি অনেক কথা বললো। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটির কথা ভাবছিলাম। এমন হাজার ছেলেমেয়ে আছে যাদের ঠিকানা নাই। হঠাৎ ছেলেটা এসে মার্কেট থেকে কেনা কাপড়চোপড় দিয়ে বললোঃ- স্যার আমার জন্য আপনাকে সবাই সন্দেহ করে। আমার জন্য আপনার এত বড় ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। আমি চলে যাচ্ছি।

একদম চুপ কথা বলবি না। সত্যিটা জানার পর আর সন্দেহ করবে না। দেখিস একদিন তাদের ভুল ভাঙ্গবেই। তারপর ছাদ থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম। মা আর বউ ছাদের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনছে। আমি তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলাম। মা কেঁদে দিয়ে বললোঃ- বাজান আমারে মাফ করে দে আমার অনেক বড় ভুল হইছে। সাথে সাথে বউটাও এসে পায়ে ধরে মাফ চাইতে লাগলো। মায়ের মুখে মাফ চাওয়ার কথা শুনে আমিও কেঁদে দিলাম। তারপর মাকে বললামঃ- মা কখনো সন্তারের কাছে মাফ চাইতে পারে না।

বাবার সাথে কথা বলে সবাই মিলে নতুন একটা বাসায় উঠি যেখানে আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারবো। খুব সুখে কেটে যাচ্ছে আমার দিনগুলি। সবার উদ্দেশ্যে করে একটা কথা। মানুষকে সহজে ভুল বুঝবেন না। সে কি বলতে চায় তার কথা শুনে তারপর তাকে দোষারোপ করবেন। ভালো করে যাচাই করে নিবেন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত