বিবাহ বার্ষিকী

বিবাহ বার্ষিকী

সুজাত আর নিপার আজ পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী। এই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মরিয়া চেষ্টা সুজাতর।সুজাতর আগ্রহ দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায় দিতে বাধ্য হয় নিপা।

দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি,গড্ডলিকা প্রবাহের মত বহমান পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সুজাত।একটু স্বাদ বদল করতে ক্ষতি কি?তদুপরি চাকরি ক্ষেত্রে সে যে কতটা উচ্চ পদে আসীন,তাও কিছুটা বোঝানো যাবে আত্মীয় স্বজনদের।

নিপা এখন সব ব্যপারেই বড়ো নির্লিপ্ত থাকে।একমাত্র ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার নিপার।ছেলে অভীক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।চাকরির বড়সড় অফার এসেছে।

বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন অনেকেই আমন্ত্রিত। তবে সবাই প্রায় সুজাতর তরফ থেকে।নিপার বাড়ির না আছে কোন আত্মীয়স্বজন, না আছে নিপার কোন বন্ধুবান্ধব।সেটা অবশ্য সুজাতর কল্যাণেই।নিপার বাড়ির আত্মীয়দের খুব অপছন্দ সুজাতর।আর গৃহবধূর বন্ধুবান্ধব থাকা তো মহাপাপ। তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হওয়া উচিৎ তার স্বামী, সন্তান, সংসার আর শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়।

উচ্চশিক্ষিতা নিপা অবশ্য সবটাই মানিয়ে নিয়েছে।স্বামীর মনের মত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এত বছর ধরে।
অবশেষে পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন হতে চলেছে মহা সমারোহে আজ।

ভোরবেলায় দক্ষিণের বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারে বসতে ভালোবাসে নিপা।সঙ্গে এক কাপ চা।আজও সে এসে বসেছিল ইজিচেয়ারে।তবে আজ হাতে আর চায়ের কাপ নেই।মাথাটা ডানদিকে ঈষৎ হেলানো।চোখদুটি আধবোজা,যেন ধ্যানমগ্না।কাজের মাসি বেশ সকাল সকালই চলে আসে।বৌদিমণিকে সে খুব ভালোবাসে তার মিষ্টি শান্ত স্বভাবের জন্য।

“বৌদি,ও বৌদি” বেশ কয়েক বার ডাকলেও সাড়া দেয় না নিপা।সুজাতকে গিয়ে ডাকে।সুজাত নিপার গায়ে ধাক্কা দিতে যায়,কিন্তু একি? নিপার গা এত ঠান্ডা কেন?ভালো করে ওর দিকে ঝুঁকে দেখে সুজাত।একইরকম ভাবে শুয়ে আছে নিপা।কোন নড়ন চড়ন নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, নিপা আর নেই।

বেলা বেশ বেড়ে চলেছে।ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ আগে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন।মৃত্যুর কারণ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।

আমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছেন।কিন্তু আনন্দ করতে এসে যে এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তা বোধকরি স্বপ্নেও কেউ ভাবেননি।

বাড়িতে ভিড় খুব বেড়ে চলেছে।নিপার মৃত্যু সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলে ছুটে আসছে তাকে শেষবারের মত একবার দেখতে।পাড়াপ্রতিবেশীদের মুখে তো ধন্যিধন্যি পড়ে গেল,” আহা! কি সতীলক্ষ্মী, মাথায় সিঁদুর নিয়ে চলে গেল।”এয়োরা সবাই সেই সতীলক্ষ্মীর মাথায় সিঁদুর দিয়ে নিজেরা ধন্য হচ্ছেন, সেই সিঁদুর পরম ভক্তিভরে নিজেদের সিঁথিতে ছোঁয়াচ্ছেন।বাড়িতে যেন বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব।

সুজাত আর অভীক ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে,এইসব মেয়েলি কান্ডকারখানা দেখছে।
জীবনের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতে প্রথমবার সুজাত নিপার জন্য একটা ভালো শাড়ি এনেছে। পরম যত্নসহকারে আত্মীয়রা নিপাকে সেই শাড়িতে সাজিয়ে দেয়।মাথায় টকটকে লাল সিঁদুর, কপালে চন্দনের টিপ, পা ভর্তি আলতা। রাজরানীর মত স্বামীসন্তানের কাঁধে চেপে শববাহী গাড়ি অবধি পৌঁছে যায় নিপা।

ইলেকট্রিক চুল্লীতে নিপার বড়ো ভয়,একথা বারকয়েক বলেছিল নিপা।নিপার সেই ইচ্ছার সম্মান জানাতে সুজাত আজ কাঠের চুল্লিতেই দাহের ব্যবস্থা করে।

নিপার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুজাত।কতদিন হয়ে গেল ও নিপার সাথে ভালো করে কথা বলেনি,ফিরেও তাকায়নি।কত বদলে গেছে ও!ভীষণ সুন্দর লাগছে নিপার মুখটা।

কিন্তু এমন কেন করত সুজাত নিপার সঙ্গে?নিপাকে তো ও কখনো বোঝার চেষ্টাই করেনি।ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওরা।তাতে নিপার বাড়িতে ঘোরতর আপত্তি ছিল।মন থেকে সেভাবে মেনে নিতে পারেননি নিপার বাবা মা।আর সেখান থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত সুজাত ও নিপার বাড়ির লোকজনের।

বদলির চাকুরীর কারণে সুজাত নিপাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।তাই স্থায়ীভাবে কোথাও চাকুরী করার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয় নিপাকে।এরপর আসে অভীক।তাকে পেয়ে আঁকড়ে ধরে নিপা।সন্তান মানুষ করতে হবে ভালো করে,মেয়েরা চাকুরী করলে সংসার অবহেলিত হয়, এই বদ্ধমূল ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নিপার মধ্যে।নিপাও মেনে নেয়,স্বচ্ছল সংসারে সত্যিই তো দুজনের চাকুরী করার কোন মানে হয়না।বরং মাতৃস্নেহ থেকে যেন অভীক কোনভাবেই বঞ্চিত না হয়, সেই দিকেই সদাসতর্ক দৃষ্টি থাকত নিপার।

দিব্যি বেড়ে ওঠে অভীক।জীবনের সমস্ত রকম মূল্যবোধ ভালোভাবেই তাকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছে নিপা।চুরি করতে নেই,কখনো কারো কাছে কিছু চাইতে নেই,গুরুজনেদের সম্মান করা,কারো মনে দুঃখ না দেওয়া,গরীব মানুষকে নিজের সামর্থ্য মত সাহায্য করা, উচ্চ নীচ প্রভেদ না করা, আরো কত কী।কিন্তু অভীক বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড্ড যেন অন্যরকম হয়ে যায়।ঠিক নিপার মনের মতন নয়।সর্বক্ষণ ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া। নিপার বারণ সত্ত্বেও সুজাত অভীকের হাতে তুলে দিয়েছে দামী মুঠোফোন।অভীক আর সেভাবে পড়াশোনায় মনযোগ দেয় না।তাই দেখতে দেখতে বিরক্ত নিপা অভীকের ফোনটা একদিন ছুঁড়ে ভেঙে দিতে যায়,পরিবর্তে অভীক তার মায়ের হাত এমন ভাবে মুচড়ে দেয় যে নিপার ডান হাতের একটা আঙুল ভেঙে যায়।

ভীষণ রাগ অভীকের।প্রথম যেদিন নিপাকে “পরজীবী”বলে সম্বোধন করে অভীক, সেদিন আর চোখের জল বাধ মানে নি নিপার।সুজাতকে জানিয়েছে নিপা ছেলের সকল দুর্ব্যবহারের কথা, কিন্তু এ ব্যপারে সুজাত কখনো শাসন করেনি অভীককে।বরং একাধিকবার বিভিন্ন কারণে ছেলের সামনেই তিরস্কার করেছে নিপাকে।তাই অভীক আজ বোঝে ওর মায়ের স্থানটা সংসারে ঠিক কোথায়। বাবা যেখানে মাকে সম্মান করেনা,সেখানে তারও তো দায় নেই মাকে সম্মান দেখানোর।বাবা মা ডাকটা যে কবার মুখে উচ্চারণ করেছে অভীক, তাও ঠিক মত মনে পড়েনা সুজাতর।সন্তান মানুষ করতে নিপা একদম গোহারান হেরে গেছে।

আজ সুজাতর আত্মগ্লানি হচ্ছে।ও নিজেও তো কতসময়ে নিপার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। অফিসের বন্ধুবান্ধবরা এলে, নিপাকে তাদের সাথে আলাপ করানো তো দূর অস্ত, কাজের লোকের মত ব্যবহার করেছে।শুধু চা জলখাবার দেওয়ার ফরমাশ করেছে।

সুজাতর আবার বন্ধুর থেকে বান্ধবীর সংখ্যা একটু বেশী। অফিসে মেয়ে কলিগদের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলা ওর স্বভাব।কারণ কোনভাবে ও মেয়েদের অপমান করতে চায়না,তারা কষ্ট পাক সেটা ও একদম চায়না।এহেন অফিসের মেয়েরা তাদের স্যারের যখন ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম ভাবে তারিফ করে, তা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সুজাত।মধ্যবয়সে বা যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষ এর চেয়ে বেশী আর কি চায়? ফোনে নিয়মিত চ্যাটও চলে বিভিন্ন বান্ধবীদের সাথে।নিপা আগে আগে তীব্র প্রতিবাদ করেছে কিন্তু কোন ফল পায়নি।একদিন তো সুজাতর এক বন্ধুর স্ত্রী নিপার সামনেই সুজাতর হাত ধরে টানতে টানতে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়।নিপা সেটা সহ্য করতে পারেনি। সুজাতকে ওর বিরক্তির কথা প্রকাশও করে। পরিবর্তে সুজাত বলে,নিপার মন নোংরা, তাই সে এভাবে ভাবে।আসলে ভদ্রমহিলা নাকি সুজাতর বোনের মত।কিন্তু এই বোনের মত ভদ্রমহিলা কেন যে নিপার সাথে কথা বলার সৌজন্যতাটুকু পর্যন্ত দেখান না, তা নিপার বুঝতে অসুবিধা হয়না।তবে নিপা যদি কোন পরপুরুষের সাথে কখনো কথা বলে, তখন তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতে সুজাতর কিন্তু কোনদিন ভুল হয়নি।

প্রতিসপ্তাহেই প্রায় সুজাত যায় তার নিজের বাড়িতে।ছেলের পড়াশোনার কারণে সবসময় বাড়িতে বন্দী থাকত নিপা।নিজের বৃদ্ধ বাবা মাকে ছয়মাসে একবার একদিনের জন্যও দেখতে যেতে পারত না নিপা, যদি সুজাত বা অভীকের কোন অসুবিধা হয়,সেই চিন্তায়।

ফেসবুকের দৌলতে এখন আবার স্কুল,কলেজ, ইউনিভার্সিটির বন্ধুবান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ খুব বেড়ে চলেছে। গেট টুগেদারের হিড়িকটাও বড্ড বেশী দেখা যাচ্ছে সুজাতর মধ্যে।সেখানে অবশ্য নিপা ব্রাত্য। ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না।অফিসের পার্টি , পিকনিক,কোথাও কখনও নিপাকে নিয়ে যায়নি সুজাত।কারণ কি পরিচয় দেবে সেখানে ও নিপার?একজন গৃহবধূ যে কিছুই করেনা,তাহলে কোন সম্মান থাকবে ওর, সোসাইটিতে?তবে অবশ্য ঘটা করে ভিডিও করে এনে দেখাত নিপাকে।বন্ধুর বৌদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে করতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠত।কোন কিছুই চোখ এড়ায় না নিপার।কোন বন্ধুর বৌ ভালো গান গায়, কোন বান্ধবী দূর্দান্ত আবৃত্তি করে তা বাড়িতে এসে ছবির মতো বর্ণনা করে যেত সুজাত। নিপা একদিন শুনতে শুনতে বলে ফেলে যে সেও তো ভালো গান গাইত,কিন্তু তাকে তো সুজাত গান গাইতে উৎসাহ দেয়নি কখনও।শুনে সুজাত ও অভীকের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে নিপার মাথা নত হয়ে যায়।

নিপার চাহিদা ছিল খুব কম।গয়নাগাটি, ভালো কাপড়চোপড় কোন কিছুতেই ওর কোন আকর্ষণ ছিল না। তাই সুজাত সামান্য যা কিছু ওকে এনে দিত তাতেই ও খুশি থাকত।সুজাতর পছন্দই ছিল নিপার পছন্দ। স্ত্রীকে নিয়ে পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে ঠিক কটা সিনেমা দেখেছে বা বেড়াতে নিয়ে গেছে, তা হাতে গুণে বলে দিতে পারে সুজাত।সব সময় কাজের অছিলায় এড়িয়ে গেছে নিপাকে।তবে বন্ধুবান্ধবের ডাকে, হাজার কাজের চাপেও ছুটে যেতে ভুল করেনি ও।

ধীরে ধীরে নিপা নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে তার স্বামী সন্তানের থেকে।সবার মধ্যে থেকেও, কিভাবে একা থাকতে হয়, তা শিখে যায় নিপা।চরম উদাসীন হয়ে যায় সে।সবকিছুতেই একটা নির্লিপ্ততা। কোনকিছুই আর সেভাবে নাড়া দেয় না ওকে।নিজের মনের কথা আর কারো সাথে ভাগ করেনা।অবশ্য ভাগ করবেই বা কার সাথে!! ওর কথা শোনার আগ্রহ কার আছে?

কিন্তু কোন কাজে কখনও এতটুকু ফাঁকি দেয়নি নিপা।ফুলশয্যার পরদিন থেকে যেমন সংসারের সব কাজ মুখ বুজে করত, তেমন জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত তার ব্যতীক্রম হয়নি।”সংসারকে কখনো অবহেলা করবেনা”,এটা যে নিপার বাবা মায়ের শিক্ষা।

চিতার ওপর কাঠ সাজানো হয়েছে।মায়ের মুখাগ্নি করতে এগিয়ে যায় অভীক।সুজাত আজ নিজের মনেই বলে ওঠে,”যাও নিপা যাও।এতদিন তুমি বেঁচে মরেছিলে, আজ তুমি মরে বেঁচেছো।তোমার সব অভিমানের মূল্য আমি আমার সারাজীবন ধরে দিয়ে যাব।পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতে এটাই তোমার কাছে আমার প্রতিশ্রুতি। ”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত