ছোটছেলে

ছোটছেলে

সময়টা শীতের শুরুর দিকে। এক সন্ধ্যে বেলায় এহসান সাহেব চেয়ারে বসে কী যেন ভাবছিলেন। কিছুক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ তিনি স্ত্রীর উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন: কই গো, একটু এদিকে শুনে যাও তো?” একটুপর ভেতর থেকে এহসান সাহেবের স্ত্রী রেহানা বেগম বের হয়ে এলেন আঁচলে হাত মুছতে মুছতে। তারপর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন: কি বলবে বলো?” এহসান সাহেব একটু নড়েচড়ে বসে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন: কি করতেছিলে? ঐ তো, রাতের খাবার রান্না করতেছিলাম। ও বলছি, শীত তো শুরু হয়ে গেলো। ঠান্ডা লাগতেছে। তুমি একটা কাজ করতে পারবে? পুরোনা শীতের জামাটা একটু বের করে দিতে পারবে?  ওটা তো খুঁজতে হবে। পুরোনো কাপড়ের সাথে রাখা। ও একটু খুঁজে দাওনা? দেখো এখানে বসেছি, কেমন শীত শীত লাগতেছে।

আচ্ছা, আমি খুঁজে দেখি” বলেই রেহানা বেগম ভেতরে চলে গেলেন। আর এহসান সাহেব আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলেন। অনেক্ষণ ভাবার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর দেরি দেখে ভেতরে গেলেন ধীরপায়ে হেটে। রেহানা বেগম তখন পুরোনো কাপড়ের ভাজ থেকে একটা জ্যাকেট বের করে বুকে চেপে ধরে বসে আছেন, আর চেপে চেপে কাঁদতেছিলেন। এহসান সাহেব পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন স্ত্রীর। তারপর স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে বললেন: রেহানা, আর কতদিন কাঁদবে পুরোনো কথা ভেবে? যে ধন আমরা হারিয়েছি, তা আর ফিরে পাবোনা।” স্বামীর কথা শুনে রেহানা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। তারপর স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললেন:ওগো কী করবো? আমি তো আমার নিলয়কে ভুলতে পারছিনা। তার জ্যাকেটটা দেখলেই তার কথা মনে পড়ে। এই দেখো, তুমি দেখো এখনো জ্যাকেটটাতে নিলয়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে।” বলেই রেহানা বেগম কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলেন। এহসান সাহেব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন জ্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে। উনার চোখেও জল আসার উপক্রম হলো। মনে পড়তে লাগলো পুরোনো স্মৃতিগুলো।

কোনো এক শীতকালে নিলয় সবার জন্য শীতের জামা নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। চাকরির প্রথম মাসের টাকা পেয়েছিল সে। তার মা তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো: কি রে বাবা, তুই এতো টাকা কোথায় পেয়েছিস?” নিলয় হেসে জবাব দিলো: মা, আজ আমার প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েছি। তাই সবার জন্য শপিং করে আনলাম। তোমরাই তো আমার সব, বলো?”রেহানা বেগম তখন খুশি হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। নিলয় আবার জিজ্ঞেস করলো: বাবা, শ্রাবণ, প্রীতি এরা কোথায়? ঐ তো তোর বাবা এসেছে। আর শ্রাবণ এখনো ফিরেনি বাসায়, প্রীতির নাকি ভালো লাগতেছেনা, তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।” ও বাবা এসেছো? এই নাও এটা তোমার জন্য।” বাবাকে দেখে নিলয় একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো বাবার দিকে। এটা কি?” বাবা একটু অবাক হলো। তোমার জন্য একটা কোট আর একটা চাদর। আজ স্যালারি পেয়েছি। তাই সবার জন্য এসব কিনে আনলাম।” হাসিমুখে জবাব দিলো নিলয়। ভালো করেছিস বাবা। যা এখন হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। রেহানা, ওকে খেতে দাও…” এহসান সাহেবের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।

মা তুমি খাবার বাড়ো। আমি আসছি।” বলেই নিলয় প্রীতির রুমে গেল। প্রীতি ঘুমাচ্ছিলো। নিলয় তার পাশে বসে কপালে চুমো খেলো। তখন প্রীতি চোখ মেললো। নিলয়কে দেখে বললো: ও ভাইয়া, তুই এসেছিস?” হ্যা, তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি কি?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো প্রীতি। নিলয় প্রীতির কানে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো:  চকলেট কই দেখি” উত্তেজিত হয়ে উঠে বসলো প্রীতি। না না, দেবোনা দুষ্টামি করে নিলয় চকলেটের প্যাকেটটা পেছনে লুকিয়ে ফেললো। প্রীতি নিলয়ের কাছ থেকে চকলেট কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো, আর বলতে লাগলো: দে ভাইয়া, দে দে লক্ষী ভাই আমার তুই।” কিছুক্ষণ এভাবে চললো তাদের মাঝে। তারপর দুজনে থমকে গেলো হঠাৎ বাইরের রুমে শ্রাবণের চিৎকার শুনে। নিলয় এবং প্রীতি উঠে দেখতে গেলো কি হয়েছে। শ্রাবণ হাতে একটা জ্যাকেট নিয়ে মায়ের সামনে চিৎকার করে বলতে লাগলো: এটা কোনো জ্যাকেট? এই সস্তা জ্যাকেট পরে আমি বাইরে বের হবো? দরকার নাই এই জ্যাকেট….” বলেই জ্যাকেটটা ছুড়ে মারলো সে। ওটা এসে পড়লো নিলয়ের উপর। নিলয় স্তব্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো প্রীতি।

অন্য একটা রুম থেকে তখন এহসান সাহেব বের হয়ে এসে শ্রাবণের গালে কষে একটা চড় বসালেন। তারপর বললেন: যেটা পেয়েছিস ওটা নিয়ে খুশি হ। দামি জ্যাকেট পরতে চাইলে নিজের টাকায় কিনে নে। নিজে তো ২ টাকা আয় করিসনা, আবার বড় বড় কথা।” গজরাতে গজরাতে বাবা আবার নিজের রুমে ফিরে গেলেন। শ্রাবণও নিজের রুমে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো। একটুপর তার কাছে এলো নিলয়। এসেই সে শ্রাবণের পাশে বসলো। শ্রাবণ তখন মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। নিলয় শ্রাবণের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো:রাগ করেছিস?”  শ্রাবণ কোনো উত্তর দিলোনা।

নিলয় আবার বললো: এভাবে মুখ ভার করে থাকিসনা, কাল তোকে তোর পছন্দের জ্যাকেট কিনে দেবো। সত্যি?” শ্রাবণের মুখে হাসি দেখা গেলো। হুমম সত্যি….” শ্রাবণের হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরে বললো নিলয়। ভাইয়া আমার না পকেট একদম খালি, কিছু টাকা দিস তো কতো লাগবে? এইতো হাজার দুয়েক হলে চলবে আচ্ছা এই নে, এখানে চারহাজার টাকা আছে, একটা জ্যাকেট কিনবি পছন্দমতো। বাকি টাকা তুই রেখে দিস। ওকে ভাইয়া, থ্যাংক ইউ।” বলেই শ্রাবণ খুশি হয়ে নিলয়ের গালে চুমু খেলো। নিলয় হাসতে হাসতে বললো: খেয়েছিস? না খেলে আয়, একসাথে খাবো। হুমমম চল।” দুজনে উঠে দাঁড়ালো খেতে যাওয়ার জন্য। খাবার টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছিলো। তখন এহসান সাহেব বললেন: বাবা নিলয়, একটা কথা বলবো হ্যা বাবা, বলো” সবাই তাকালো এহসান সাহেবের দিকে। এহসান সাহেব আবার বললেন: বলছি ঐ আসলামের দোকানে কয়েকমাসের বাজারের টাকা দেয়া হয়নি।

কতো টাকা পাবে বাবা? পাবে তের হাজার, সাড়ে তের হাজারের মতো। ওকে বাবা, তুমি কাল আট হাজারের মতো টাকা দিয়ে দিও। বাকি টাকা পরের মাসে দিয়ে দেবো বলবে আচ্ছা এবার রেহানা বেগম বললেন: বাবা, জুয়েলারির দোকানেও এক হাজার টাকা পাবে, প্রীতির কানের দুল চেঞ্জ করেছিলাম। মা ওটাও কাল দিয়ে দিও। আমি কাল অফিসে যাওয়ার সময় টাকাগুলো দিয়ে যাবো।” বলেই নিলয় খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। বাকিরাও ধীরে ধীরে খাবার শেষ করলো। পরদিন সকালে এহসান সাহেব একটা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন চা খেতে খেতে। এলাকার আরো কয়েকজন সমবয়সী লোক ছিল সেখানে। এহসান সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন: বুঝলা কাসেম, আসলামের দোকানে কয়েকমাসের টাকা বাকি ছিল, আজ অর্ধেকের বেশি দিয়ে দিয়েছি। বাকিটা পরের মাসে দিয়ে দেবো।

ছেলে বুঝি বেতন পেয়েছে তোমার?” হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন কাসেম নামের লোকটা। মাথার দুপাশে চুল আছে লোকটার। কিন্তু মাঝখানে টাক। হুমম, গতকাল নিলয় বেতন পেয়েছে। আর সবার জন্য শীতের কাপড়চোপড় কিনে নিয়ে এসেছে। এই যে আমার গায়ে চাদর দেখতেছো, এটা ও কিনেছে কাল। বাহ! বাহ! হীরার টুকরো ছেলে তোমার।” হ্যা, এই ছেলে তো হীরার টুকরো। কিন্তু অন্য ছেলেটা? ও তো একেবারে বরবাদ হয়ে গেছে।” কাসেমের পাশ থেকে বললেন রহিম মিয়া নামের অন্য একটা লোক। তার কথা শুনে এহসান সাহেব আফসোস করে বললেন: হ্যা রে ভাই রহিম, আমার একটাই আফসোস, ছোটছেলেটাকে মানুষ করতে পারলাম না।” রহিম মিয়া আবারো বললেন:গতকাল দেখলাম, শ্রাবণ একটা মেয়ের আঁচল ধরে টানাটানি করতেছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার বিষয় ভাবা যায়?” এহসান সাহেব লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেললেন। তারপর চায়ের কাপটা রেখে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন: কতো আসছে বিল?

১২ টাকা এই নাও” টাকাটা দিয়ে এহসান সাহেব বেরিয়ে এলেন চায়ের দোকান থেকে। তারপর আনমনা হয়ে হাটতে লাগলেন বাসার দিকে। কিছুদূর হাটার পর তিনি দেখলেন তার ছোট ছেলে শ্রাবণ একটা মেয়েকে ডিস্টার্ব করতেছে। মেয়েটার পথ আটকে আছে সে। এহসান সাহেব গিয়ে ছেলেকে একটা চড় দিয়ে বললেন: লজ্জা করেনা রাস্তায় রাস্তায় মেয়েদের ডিস্টার্ব করতে? তোর জন্য আমাকে লোকের সামনে অপমানিত হতে হয়।”শ্রাবণ মুখ নিচু করে রইলো।  এহসান সাহেব এবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন: যাও মা, তুমি বাসায় চলে যাও।” মেয়েটা শ্রাবণকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তখন শ্রাবণ উত্তেজিত হয়ে বললো: বাবা, আমি এই মেয়েটাকে ভালোবাসি।” এহসান সাহেব বিদ্রুপ করে বললেন: তোর কোনো যোগ্যতা আছে মেয়েটাকে ভালোবাসার?” বলেই তিনি হাটতে শুরু করলেন আবার। আর শ্রাবণ উল্টো পথে চলে গেল।

রাতে প্রীতি তার পড়ার টেবিলে বসে পড়তেছিল। তখন তার পাশে এসে বসলো শ্রাবণ। প্রীতিকে সে জিজ্ঞেস করলো: কি রে, কি করিস?  দেখছিসনা পড়ছি হুমমমম দেখছি একটা কথা বলি? বল হৃদিতাকে তোর কেমন লাগে? কোন হৃদিতা? আরে তোর বান্ধবী হৃদিতা। আমি কোনো হৃদিতাকে চিনিনা।” বলেই প্রীতি জোরে জোরে পড়তে লাগলো। শ্রাবণ তার বইটা বন্ধ করে বললো: চিনিসনা? উফ ছোট ভাইয়া, এতো জালাস কেন? সামনে আমার মাস্টার্সের পরীক্ষা। আগে বল হৃদিতাকে কেমন লাগে তোর? মেয়েটা তো ভালোই। কিন্তু তোর চোখ যদি তার উপর পড়ে, তাহলে বলতে হবে মেয়েটার মতো তার কপালটা অতোটা ভালোনা।” শ্রাবণ প্রীতির কানটা টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো: কেন? আমি কি খুব খারাপ?

এই যে, রাত করে বাসায় ফিরিস, ফালতু ছেলেদের সাথে মিশিস, বাবা মার কথা শুনিসনা। এগুলো কি ভালো? ইদানীং শুনছি তুই নাকি সিগারেটও খাওয়া শুরু করেছিস। এতো কথা তোকে কে বলে? বলে বলে, সবাই তো জানে এসব। আর হৃদিতা তোকে ভালোবাসতে যাবে কোন দুঃখে?  কি রে, কি নিয়ে কথা হচ্ছে তোদের?” বলতে বলতে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো নিলয়। কিছুনা ভাইয়া।” বলেই প্রীতি তার পড়ায় মন দিলো।  শ্রাবণ নিলয়ের হাত ধরে বললো: একটু এদিকে আয় তো ভাইয়া….” বলেই সে নিলয়কে নিজের রুমে নিয়ে এলো। তারপর বললো: ভাইয়া, দেখতো আমার চেহারা কি খারাপ?” নিলয় শ্রাবণকে একবার দেখে নিয়ে বললো: না, মোটেওনা। এই এলাকায় আমার ভাই এর মতো আর একটা সুদর্শন ছেলে আছে নাকি?” তাহলে ঐ হৃদিতা আমাকে পাত্তা দেয়না কেন? ওকে যতবার ভালোবাসার কথা বলতে যায়, ততবার অপমানিত হতে হয়।” কোন হৃদিতা? আরে ঐ যে, ইব্রাহিম মাষ্টারের মেয়েটা, প্রীতির বান্ধবী।”

নিলয় শ্রাবণের কাঁধে হাত রেখে বললো:শুন শ্রাবণ, শুধু চেহারা নিয়ে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায়না। এর জন্য তোকে ভালো হতে হবে, খারাপদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, ভদ্রভাবে চলতে হবে। আর তুই তো এসবের উল্টো। শুন, তোর জন্য একটা অফার আছে। কি অফার? আমাদের অফিসে চাকরি করবি তুই, বেতন ভালোই দেবে। না ভাইয়া, এখন আমার চাকরি করার মুড নেই। শুন, এটা ভালো জব। ইদানীং চাকরি পাওয়া এতটা সহজ না ভাই। এটা হাতছাড়া করিসনা।বলছি তো ভাইয়া, এখন আমার চাকরি করার ইচ্ছে নেই। তোর যদি আমাকে খাওয়াতে কষ্ট হয়, বলে দে আমি চলে যাবো বাসা থেকে। আরে পাগল, আমি কি তাই বলেছি? তোরাই তো আমার সব। তোদের জন্য আমার কোনকিছুকেই কষ্ট মনে হয়না।” বলতে বলতে বেরিয়ে গেল নিলয় রুম থেকে।

একদিন বিকেলে শ্রাবণ আবার পথ আটকালো হৃদিতার। হৃদিতা বললো: পথ ছাড়ো শ্রাবণ, নয়তো আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবো। আমি তোমার ফ্যামিলির কথা ভেবে কিছুই করিনি এতদিন।” তোমার যা খুশি করো হৃদিতা। তবুও বলবো আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এই তৃষ্ণার্ত হৃদয়টা ছুটে আসে বারবার তোমার কাছে। কেন তুমি বুঝোনা? হুহ ভালোবাসা? তোমার মতো ছেলেকে কোনো মেয়ে ভালোবাসতে পারেনা। পথ ছাড়ো আমার, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কেন? কেন আমার মতো ছেলেকে ভালোবাসা যাবেনা? আমি কি দেখতে খারাপ?” বলেই শ্রাবণ হৃদিতার হাত ধরতে চাইলো। তখন হৃদিতা রেগে উঠলো।

হাউ ডেয়ার ইউ!!” বলেই ঠাস করে একটা চড় বসালো সে শ্রাবণের মুখে। তারপর পাশ কাটিয়ে সে চলে গেল। আর শ্রাবণ গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে গালে হাত রেখেই হাটতে লাগলো অন্যমনস্ক হয়ে। রাস্তায় এদিক থেকে ওদিকে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার মাথা শুধু ঘুরতেছে হৃদিতার হাতের চড় খেয়ে। একটা ছুটন্ত ট্রাক ছুটে আসতেছে তার দিকে, আর সে একইভাবে হাটতেছে। ট্রাকটা যখন তার খুব কাছে চলে এলো, তখন সে শুনলো কেউ একজন তার নাম ধরে চিৎকার দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়েছে। কিছুটা দূরে গিয়ে পড়লো শ্রাবণ, কিছু রক্তের ছিটা এসে পড়লো তার গায়ে। সাথে সাথে অনেকগুলো লোক জড়ো হলো সেখানে। শ্রাবণ ঘুরে দেখলো তার ভাই নিলয় পড়ে আছে রাস্তায় রক্তাক্ত লাশ হয়ে। নিলয়ের গায়ের জ্যাকেটটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। কিছু মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো শ্রাবণ তা দেখে। তারপর ভাইয়ের লাশটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো: ভাইয়া রে, এ তুই কী করলি? কেন আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটা দিয়ে দিলি। কেন ভাই কেন? আমি মরলে তো কিছুই হতোনা কারো। কিন্তু তুই চলে গিয়ে তো সবার বড় ক্ষতি করে গেলি। এটা কেন করলি ভাই?” শেষের কথাটা শ্রাবণ জোরে চিৎকার দিয়ে বললো।

এরপর কয়েকবছর পেরিয়ে গেলো। নিলয়ের মৃত্যুর পর থেকে এ বাড়ির সাথে শ্রাবণের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ সবাই নিলয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে শ্রাবণকে। শ্রাবণ বারবার ক্ষমা চেয়েছিল তার পরিবারের কাছে। কিন্তু ক্ষমা সে পাইনি। এহসান সাহেব তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলেন। শ্রাবণ দুচোখে অশ্রু নিয়ে বেরিয়ে যায় সেদিন এ বাড়ি থেকে। কেউ কোনদিন তাকে আর কোথাও দেখেনি। যখনই নিলয়ের কথা মনে পড়ে তখন সবাই মুখ লুকিয়ে কাঁদে। আজও যখন নিলয়ের জ্যাকেটটা চোখের সামনে পড়লো, তখন আর কান্না বাঁধ মানেনি রেহানা বেগমের চোখের। কাঁদতে লাগলেন তিনি স্বামীর বুকে মাথা রেখে। সেদিন তারা এক ছেলেকে হারায়নি, হারিয়েছে দুই ছেলেকে। নিলয় এবং শ্রাবণকে।

তাদের এই কান্নাকাটির মুহূর্তে তখন বাহির থেকে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরলো প্রীতি। বাবা-মার কাছে আসতেই সে বললো: আজকেও তোমরা বড় ভাইয়ার কথা মনে করে কান্না করতেছো তাইনা?” প্রীতিকে দেখে এহসান সাহেব এবং রেহেনা বেগম নিজেদের সামলে নিলেন। এহসান সাহেব বললেন: মা প্রীতি, তুই এসেছিস? যা মা, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নে।”আচ্ছা কিন্তু তোমরা আর কতদিন এভাবে কাঁদবে? জানো তো, যতোই কান্না করোনা কেন, আমার ভাইটা আর ফিরে আসবেনা” বলেই সে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছিল ওরা বাবা মা আর মেয়ে মিলে। দুটো চেয়ার শূন্য পড়ে আছে। একসময় চেয়ার দুটোতে বসতো নিলয় আর শ্রাবণ। খেতে খেতে হঠাৎ প্রীতি বলে উঠলো: বাবা, আসলাম আঙ্কেলের দোকানে কত টাকা বাকি আছে কাল একটু হিসাব করবে। দুইদিন পর বেতন পাবো, সব দিয়ে দেবো একসাথে।

তা ঠিক আছে। কিন্তু মা, একটা কথা বলি তোকে হ্যা বাবা বলো আমাদের জন্য তুই আর কতো করবি? তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আমাদের জন্য কেন তুই নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করে দিচ্ছিস? এবার একটা বিয়ে কর বাবা, তোমাকে না কতবার বলেছি, আমার বিয়ের কথা বলবেনা? আমি বিয়ে করে নিলে তোমাদের পাশে কে এসে দাঁড়াবে বলো?” শেষের কথাটা করুণ শুনালো প্রীতির। এহসান সাহেব বললেন: তারপরও মা, সব নরনারীর উপর বিয়ে ফরজ। এবার একটা তুই বিয়ে কর। আমি আর তোর মা মিলে কিছু একটা করে চলে যেতে পারবো। আমাদের জন্য আমার মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাক, তা আমরা চাইনা।” কথাটি বললেন রেহেনা বেগম।ঠিক আছে, তোমরা যখন এতো করে বলছো, আমি ভেবে দেখবো।” বলেই উঠে দাঁড়ালো প্রীতি নাস্তা শেষ করে।

নিলয়ের মৃত্যুর পর এই সংসারের হাল সে নিজে ধরে। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই সে একটা চাকরি পায়। তারপর থেকেই তার বেতনের টাকায় এই সংসার চলে। বাবা মার কথা ভেবে সে এখনো বিয়ে করেনি, এখন সে যদি বিয়ে করে তাহলে তার বাবা মাকে দেখে রাখবে কে? বিয়ে করবে নাকি করবেনা কিছুতেই মাথায় ঢুকছেনা তার। রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলো প্রীতি।

চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা শেষ করে এহসান সাহেব হাটতে লাগলেন বাজারের দিকে। তখন হঠাৎ তার চোখে পড়লো মসজিদের ময়দানে অনেকগুলো ফকির মিসকিনকে খাবার দেয়া হচ্ছে। আরো একটা জিনিস দেখে তিনি চমকে উঠলেন। কিছুটা দূরে একটা ব্যানারে নিলয়ের ছবি আঁকা, আর তাতে লেখা: *নিলয়ের ৪র্থ মৃত্যু বার্ষিকী ও দোয়া মাহফিল দেখে এহসান সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। কে করছে এসব? কাসেমকে দেখতে পেলেন তিনি। তারপর কাসেমকে জিজ্ঞেস করলেন: কাসেম, এসব কী? কে করছে এসব?”

কাসেম মিয়া তখন কবরস্থানের দিকে ইশারা করলেন। ওখানে নিলয়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন জিয়ারত করতেছিল। একটুপর লোকটা জিয়ারত শেষ করে ঘুরে দাঁড়ালো। এহসান সাহেব দেখেই চমকে উঠলেন। কোট, টাই, আর চশমা পরা এক ভদ্রলোক, দাঁড়িয়ে আছে, এ তার ত্যাজ্যপুত্র শ্রাবণ। অনেকদিন পর দেখা হলো বাপ ছেলের। শ্রাবণ ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো কিছুটা দূরত্বে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার বাবার দিকে। চোখে জল এসে গেল তার। খুব ইচ্ছে হলো, একবার বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরতে। পরক্ষণে সে সামলে নিলো নিজেকে। বাবা ডাকার অধিকার সে হারিয়েছে অনেক আগে। নিলয়ের মৃত্যুর জন্য তার বাবা তাকে দায়ী করেছিল। হয়তো এখনো তাই মনে করে। চার বছর আগে তার বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে বলেছিল:
–তোকে আমি ত্যাজ্য ঘোষণা করলাম, আর কখনো বাবা বলে ডাকবিনা আমায়। বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে।” ঘটনাটি মনে পড়তেই টুপ করে এক ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো শ্রাবণের চোখ বেয়ে।

পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ এভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর ঘুরে দাঁড়ালেন এহসান সাহেব। তারপর চলে যেতে লাগলেন। বাবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ চোখেরজল ফেলতে লাগলো। তখন তার পাশে এসে কাঁধে হাত রেখে কাসেম মিয়া বললেন: তোর বাবা চলে যাচ্ছে, বাবা বলে ডাক দে, বুকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চা” শ্রাবণ করুণ কণ্ঠে বললো: না চাচা, আমি জানি, আমি ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাবোনা। আমার বাবাকে আমি চিনি। তো এখন কি করবি?  চাকরি থেকে ২০ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। নিজের এলাকাটাকে খুব মনে পড়ছিল। আর বাবা মা, প্রীতিকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। দূর থেকে ওদের একবার দেখে নেবো। ২০ দিন এখানে কাটিয়ে তারপর চলে যাবো আবার”তো কোথায় উঠেছিস তুই? এখনো কোথাও উঠিনি। একটা ভাড়া বাসা খুঁজবো ২০ দিনের জন্য। ভাড়া বাসায় থাকতে হবেনা, তুই আমার বাসায় থাকবি আয়, তোর ব্যাগ কই? মসজিদের ভেতর আচ্ছা চল তারপর কাসেম মিয়া শ্রাবণের ব্যাগসহ শ্রাবণকে নিয়ে নিজের বাসার দিকে চললেন।

সেদিন রাতে শ্রাবণ চোরের মতো চুপিচুপি যায় ওদের বাড়িতে। জানালাা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো ওর বাবা মা আর প্রীতি মিলে ডিনার করতেছে। শ্রাবণ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। খুব জোরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো তার, “বাবা, মা তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও, স্বীকার করো আবার আমি তোমাদের সন্তান। বোন প্রীতি, একবার ভাইয়া বলে ডাক আমায়, দেখ আমি আর আগের মতো তোর সেই খারাপ ভাইয়াটি নেই, দেখ কতটা বদলে গেছি আমি।” বুকের চিৎকার বুকেই রয়ে গেলো শ্রাবণের, ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। হঠাৎ কিছু একটার সাথে শ্রাবণের পা লেগে শব্দ হওয়ায় ভেতরে থেকে সবাই চমকে তাকালো জানালার দিকে। শ্রাবণ নিজেকে আড়াল করে ফেললো সাথে সাথে। এহসান সাহেব খাবার রেখে উঠে এলেন জানালার পাশে। তারপর “কে কে?” বলে কয়েকবার ডাক দিয়ে কারো সাড়া পেলেননা। আর শ্রাবণ তখন চলে যেতে লাগলো কাসেম মিয়ার বাড়ির দিকে।

পরদিন ফজরের নামাজ শেষ করে এহসান সাহেব মেবাইলের আলোতে তার জুতো খুঁজছিলেন মসজিদের বাইরে। কোন জায়গায় যে জুতো জোড়া রেখেছেন তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেননা। বয়স কি তবে বেড়ে গেলো? হঠাৎ তিনি দেখলেন কেউ একজন তার জুতো জোড়া এনে তার পায়ের সামনে রেখেছে। ছেলেটা দাঁড়াতেই এহসান সাহেব তার দিকে তাকালেন। দেখলেন মাথায় টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। কেউ কোনো কথা বললোনা। তারপর এহসান সাহেব ঘুরে চলে যেতে লাগলেন বাড়ির দিকে। আর শ্রাবণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে যতক্ষণ বাবাকে দেখা যায়। তারপর চোখ মুছে সেও ঘুরে দাঁড়ালো।

প্রীতি অফিসে যাওয়ার জন্য বাইরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন সে শুনলো কেউ একজন তাকে উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করছে: কেমন আছিস প্রীতি?” ভালো” বলেই সে ঘুরে তাকালো পেছনে। দেখলো তার ভাই শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণকে দেখে সে থমকে গেলো কিছু সময়ের জন্য। মুখ দিয়ে তার আর কোনো কথাই বের হলোনা। শ্রাবণ জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো প্রীতির দিকে। তারপর বললো: চকলেট। তুই না চকলেট অনেক পছন্দ করতি? তোর জন্য আমি আরো অনেকগুলো চকলেট নিয়ে এসেছি।” প্রীতি প্যাকেটটা সরিয়ে দিয়ে বললো: স্যরি, নিতে পারলাম না,, একসময় চকলেট খেতে খুব পছন্দ করতাম, কিন্তু এখন আর পছন্দের কোনো জিনিসই পছন্দ হয়না।”

শ্রাবণ থমকে গেলো প্রীতির এই ব্যবহারে। মুখের হাসিটা মুছে গেলো তার, আর হাত দুটো নামিয়ে নিলো ধীরে ধীরে। ঠিক তখনই রেহানা বেগম বের হলেন একটা ফাইল নিয়ে। তিনি ফাইলটা প্রীতির দিকে এগিয়ে দিতে যাবেন, তখনই চোখ পড়লো শ্রাবণের উপর। সাথে সাথে তিনিও থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ মা ছেলে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর রেহানা বেগম দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ফাইলটা আবার প্রীতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: তোর ফাইল। ফেলে এসেছিস, নে ফাইলটা প্রীতির হাতে ধরিয়ে দিয়েই রেহানা বেগম ভেতরে ঢুকে গেলেন। একটা রিকশা এসে থামলো তখন প্রীতির পাশে, প্রীতি ওটাতে উঠে চলে গেলো। আর শ্রাবণ করুণ দৃষ্টতে একবার রিকশাটার দিকে তাকালো, আরেকবার বাড়িটার দিকে তাকালো। তারপর একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলো।

এলাকায় ফিরে আসার পর কয়েকদিন কেটে গেল শ্রাবণের। একে একে সবার সাথে দেখা হয়েছে তার। শুধু হৃদিতার সাথে দেখা হয়নি। একদিন তার সাথেও দেখা হয়ে যায় শ্রাবণের। শ্রাবণ সেদিন আসরের নামাজ পড়ে কাসেম মিয়ার বাসায় যাচ্ছিলো। পথে হঠাৎ দেখলো হৃদিতা কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে রিকশায় করে আসতেছে। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। হৃদিতাও কোলের বাচ্চাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। রিকশা যখন শ্রাবণের কাছে আসলো, শ্রাবণ তখন হৃদিতাকে না চেনার ভান করে চলে যেতে লাগলো। হৃদিতা রিকশাওয়ালাকে উত্তেজিত হয়ে বললো: এই এই এই রিকশা থামান, রিকশা থামান রিকশা থামলে হৃদিতা রিকশা থেকে নেমে পড়লো, তারপর ডাক দিলো শ্রাবণের নাম ধরে: শ্রাবণ হৃদিতার ডাকে শ্রাবণ থেমে গেলো। হৃদিতা বাচ্চাটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে শ্রাবণের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শ্রাবণ চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে বসিয়ে তাকালো হৃদিতার দিকে। হৃদিতা জিজ্ঞেস করলো: এতদিন কোথায় ছিলে? এত বদলে গেলে কীভাবে?” শ্রাবণ নরমকণ্ঠে বললো: বদলায়নি তো, অভিশপ্ত জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছি, যে জীবন আমায় কিছুই দিতে পারেনি। ঐ জীবনে আমি কারো ভালোবাসা পাইনি, পেয়েছি শুধু হারানোর যন্ত্রণা।

তুমি কি এখনো আমার উপর ক্ষোভ নিয়ে আছো? নাহ, এখন আর কারোর উপর ক্ষোভ নেই আমার। তোমার জায়গায় আমি হলে, আমিও তাই করতাম। আ’ম স্যরি শ্রাবণ। স্যরি বলার কি আছে? আমি কাউকে দোষ দিইনা। সবি আমার নিয়তি। নিয়তিকে আমি মেনে নিয়েছি। যাইহোক, বাচ্চাটি কি তোমার? হুমমম এক বছর বয়স ওর। ও বিয়ে করেছো কবে? দুই বছর প্রায় ওহ, ওকে ভালো থেকো।” বলেই হৃদিতাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো শ্রাবণ। অনেকদিন পর হৃদিতাকে দেখে পুরোনো প্রেমের ব্যথা নতুন করে জেগে উঠলো তার বুকে, তা সে বুঝতে দেয়নি হৃদিতাকে। তাকে পাশ কাটানোর পর চোখ থেকে চশমাটা খুলে চোখেরকোণের অশ্রুকণাটুকু মুছে নিলো সে। পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হৃদিতা।

এক রাতে শ্রাবণ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। আর কি যেন চিন্তা করতেছে। এমন সময় কাসেম মিয়া এসে বললেন: বাবাজি শুনছিস, তোর বোনের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলের নাকি বিরাট কাপড়ের ব্যবসা আছে।” শ্রাবণ অন্ধকারের দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর করুণকণ্ঠে বললো: কিন্তু আফসোস চাচা, আমার বোনের বিয়েতে আমি থাকতে পারবোনা, ওরা এখনো আমায় ক্ষমা করতে পারেনি। ওরা কেন বুঝেনা নিলয় ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী না, ওর মৃত্যুতে ওরা যতটুকু আঘাত পেয়েছে, আমিও তো কম আঘাত পাইনি চাচা। ঐ আঘাতটা পাওয়ার পরপরই আমি আরেকটা আঘাত পেলাম। আমি আমার পুরো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। এই চারটা বছর আমি যে কতটা কষ্ট পেয়েছি, তা কেবল আমিই জানি।

তুই কাল আরেকবার যা তোদের বাসায়, ক্ষমা চা ওদের কাছে। না চাচা, আমি চিনি আমার পরিবারকে। বারবার ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাবোনা আমি। তাহলে কী করবি তুই?” শ্রাবণ আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে একটু বিরতি নিলো। তারপর খুব করুণ করে বললো: চাচা, কাল আমি চলে যাবো এই এলাকা ছেড়ে চিরদিনের জন্য। আর কখনো হয়তো আসবোনা। চাচা, তুমি একটা শেষবারের মতো আমার উপকার করবে?” কাসেম মিয়া শ্রাবণের কাঁধে হাত রাখলেন, তারপর বললেন: বল, কি উপকার করতে হবে? আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। এক মিনিট দাঁড়াও” বলেই শ্রাবণ বেডের নিচ থেকে একটা স্যুটকেস বের করলো। তারপর ওটা কাসেম মিয়ার সামনে ধরে বললো: চাচা, এই স্যুটকেসটা কাল আমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবে একটু কষ্ট করে?” হুমমম দেবো। কিন্তু এতে কী আছে?”

চার বছর ধরে আমি যা রোজগার করেছি, সব এতে আছে। পনেরো লক্ষ টাকা। এগুলো আমার বাবার হাতে তুলে দেবে কাল। আচ্ছা দেবো শ্রাবণ আবেগে আর থাকতে পারলোনা, স্যুটকেসটা নিচে রেখে জড়িয়ে ধরলো কাসেম মিয়াকে। তারপর নিরবে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলো। আর কাসেম মিয়া শ্রাবণকে শান্ত করতে তার পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। পরদিন সকালে শ্রাবণ রিকশায় উঠে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় বারবার পেছনে ফিরে দেখতে লাগলো। হয়তো ভেবেছে তার বাবা পেছন থেকে এসে তাকে থামতে বলবে। প্রতিবারই পেছনে ফিরে কাউকে না দেখে শ্রাবণ নিরাশ হয়েছে। শেষে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে সে চলে যেতে লাগলো।

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পার শ্রাবণ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো। তারপর নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে টিকেট কাউন্টারের দিকে পা বাড়ালো। সাথে সাথে থমকে দাঁড়ালো সে। দেখলো টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার মা বাবা আর বোন। এহসান সাহেব এগিয়ে এসে শ্রাবণের গালে একটা থাপ্পড় মারলেন। তারপর বললেন: কোথায় যাচ্ছিস তোর বাবাকে ছেড়ে?” বাবার কথা শেষ হতেই শ্রাবণ বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর “বাবা বাবা” বলে কাঁদতে লাগলো। কতদিন “বাবা” বলে সে ডাকতে পারেনি। রেহানা বেগম পাশে এসে দাঁড়ালেন। শ্রাবণ “মা” বলে জড়িয়ে ধরলো উনাকেও। কিছুক্ষণ কান্না করলো মা ছেলে মিলে। তখন প্রীতি এসে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো শ্রাবণের দিকে। তারপর বললো: ভাইয়া, চকলেট দিবিনা?”

হ্যা দিবো” বলে শ্রাবণ ব্যাগের চেইন খুলে অনেকগুলো চকলেট তুলে দিলো প্রীতির হাতে। প্রীতির মুখে হাসি ফুটে উঠলো, কিন্তু চোখে তার জল। শ্রাবণ অনেকদিন পর বোনকে বুকে টেনে নিলো। আজ সে খুব খুশি, ফিরে পেয়েছে তার পরিবারকে। আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়তেছে তার চোখ বেয়ে। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো: সবাইকে তো শান্ত করলে, কিন্তু আমার কি হবে?” চমকে পেছনে তাকালো শ্রাবণ। দেখলো কাসেম চাচার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতা। অবাক হয়ে শ্রাবণ প্রশ্ন করলো: তুমি?” হৃদিতা এগিয়ে এলো শ্রাবণের দিকে। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বললো: এই চারটি বছর যে তোমার জন্য অপেক্ষা করলাম, তার কি কোনো প্রতিদান দেবেনা তুমি?” কিন্তু তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে…??” শ্রাবণের চোখে বিস্ময়। না, হয়নি আমার বিয়ে তাহলে ঐ বাচ্চা?

ওটা আমার আপুর বাচ্চা। তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো কিনা জানার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম। কিন্তু আমি তো চলে যাচ্ছি শ্রাবণের কথা শেষ হতেই হৃদিতা তার শার্টের কলার ধরে বুকে টেনে নিলো। তারপর প্রেমজড়িত কণ্ঠে বললো: কোথাও যেতে দেবোনা আর তোমাকে। বেঁধে রাখবো এই হৃদয়ের সাথে অনন্তকাল।” শ্রাবণের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অনেকদিন পর সে প্রাণখুলে হেসে জড়িয়ে ধরলো হৃদিতাকে। আজ তার মনে হলো জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর। সবাই তখন চোখেরজল মুছে ফেললো, তারপর হাসতে লাগলো, আনন্দের হাসি।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত