প্রিয় সুখ

প্রিয় সুখ

উনি অনেকক্ষণ ধরেই বেশ আনমনা হয়ে ছিলেন। কী ভাবছিলেন উনি ই জানে। ওনার ভাবনা বেদ করে ওনার জন্য বানিয়ে আনা চা টা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার চা।’ উনি প্রথম ডাকে হয়ত আমাকে খেয়াল করেনি তাই কোনো সাড়া দিলেন না। আমি দ্বিতীয়বার জোরগলায় বললাম, ‘এই নিন আপনার চা।’ উনি ভাবনা থেকে বের হয়ে বললেন,

– হু! দাও।

– কী ভাবছিলেন এতো? দু’বার ডাকার পর শুনতে পেলেন।
উনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তেমন কিছু না।’
– আমাকে কী বলা যাবে না?
– কেন বলা যাবে না। আমার জীবনের কোনো কথাই তো তোমার কাছ থেকে লুকাইনি। আসলে মাকে খুব মনে পড়ছিলো আর সেদিনটার কথা ভাবছিলাম।

– সেদিনটা যদি আপনি এমন সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে আমি আপনার সাথে থাকতে পারতাম না। এতোদিনে হয়ত আপনার জীবনে অন্য কেউ আসতো। আপনার কয়েকটা বাচ্চাও থাকতো। যারা সারাক্ষণ আপনাকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতো।

– এখনও তো আমাদের রাহা আমাদের মাতিয়ে রাখে। আর আল্লাহ না চাইলে তো জোর করে কোনো কিছু হয় না।
– সেদিন এমন সিদ্ধান্ত না নিলে তো অন্যকিছুও হতে পারতো।
– যা হওয়ার হতো এসব ভেবে লাভ নেই। আমাদের তো রাহা আছে। সে তো কোনো অংশে কম না। বাসায় আসলে এখনো তো বাচ্চাদের মতো দুষ্টামি করে। ও হ্যাঁ, আজকের চা টা অন্যদিন থেকে ভালো হয়েছে।
– জ্বি, প্রতিদিন ই এক কথা বলে যান। আজকের চা টা অন্যদিন থেকে ভালো হয়েছে। তার মানে প্রতিদিন ই আমার চা ভালো হয় না।
– না সত্যি আজকের চা টা খুব ভালো হয়েছে।
– হয়েছে! সন্ধ্যা হয়ে গেছে কুয়াশা পড়া শুরু হইছে নিচে চলেন। পরে আবার ঠাণ্ডা লেগে বসবে।
– হুম চলো…

আমি বিয়ের আগেও চা বানাতে পারতাম না। বিয়ের পর থেকেও পারি না। আমাদের বিয়ের প্রথম সকাল আমার শাশুড়ির কথায় আমি ওনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম। লজ্জায় ওনাকে বলিনি যে, আমি চা বানাতে পারি না। ওনাকে যখন চা দিলাম। উনি প্রথম চুমুক দিতেই আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম কোনো একটা বেশি নাহয় কম হয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বললাম, ‘আসলে আমি চা বানাতে পারি না।’ উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন আর বললেন মায়ের আদুরী কন্যা। তখন আমার অনুভূতিটা কাজ করেছে সে মুখে বলে বুঝানো সম্ভব না। বিয়ের পর ওনার প্রথম হাসি ছিলো ঐ হাসিটা। প্রিয় মানুষটার হাসিটাই হচ্ছে একটা মেয়ের জন্য অনেক সুখের।

পরেরদিন খুব অবাক হই যখন আমি ওনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে যাইনি। উনি সেদিনই আমাকে বলেছিলো, ‘আজকে থেকে প্রতিটা সকালে আমি তোমার হাতের চা পান করতে চাই। যেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে থাকবো সেদিনও তোমারই হাতের চা পান করতে চাই।’ আমার প্রতি ওনার ভালোবাসা দেখে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। সদ্য বিবাহিতা বউকে কেউ এতো ভালোবাসতে দেখে।

সেদিন থেকে আজ অবধি আমি ওনার জন্য চা বানাই। প্রথম প্রথম চা খুব একটা ভালো হতো না। ওহ, প্রথমদিন চায়ে এতো বেশি চা পাতা দিয়েছি যে চা প্রচুর তিতা হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন থেকেই উনি একটাই কথা বলে, ‘অন্যদিন থেকে আজকের চা টা ভালো হয়েছে।’ আমি প্রতিবার মুচকি হেসে বলি, ‘হয়েছে, আর বলতে হবে না। আমি জানি আমি কেমন চা বানাই?’

একটা কথা ভাবলে আমি খুব কষ্ট পাই। যেটা আমাকে মরণ অবধি কষ্ট দিবে। আমাদের প্রথম সন্তান যখন আমার পেটে ছিলো। তখন আমি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যাই। আর সেদিনই আমি মা হবার স্বাদটুকু হারিয়ে ফেলি। সেদিন কথা মনে হলে আজও আমার দু’চোখ জুড়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়। সেই দিনের দুর্ঘটনা আমার জীবনে কালো আধার নামিয়ে দিয়ে যায়। ডাক্তার বলেছিলেন আমি আর কখনো মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবো না। সেদিন খুব বেশি কেঁদেছিলাম।

ভেবেছিলাম কেউ আমার পাশে থাকবে না। কিন্তু সবাই আমার বিপক্ষে গেলেও পাশে ছিলো আমার প্রিয় হাতজোড়া। উনি ই আমার হাতে হাত রেখে বলেছিলেন। কখনো এই দু’হাত ছেড়ে দিবো না। ওনার বুকে ইচ্ছা মতো কাঁদার সুযোগ দিয়েছেলেন উনি। আমিও ওনাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম।

আমার শাশুড়ি বরাবরই চাইতেন আমাকে ডিভোর্স দিয়ে উনি নতুন করে বিয়ে করে ঘর সংসার করুক। উনি শাশুড়ি মাকে একটাই জবাব দিতেন, ‘মা এটা দুর্ঘটনা ছিলো, ওর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিলো না।’ বেশ কয়েকবার শাশুড়ি মা ওনার সাথে রাগারাগিও করতেন। খুব ঝগড়া হতো আমাকে নিয়ে। ওনাদের এসব দেখে আমিও ওনাকে বেশ কয়েকবার বলেছিলাম মায়ের কথা যেন শুনে। কিন্তু প্রত্যেকবারই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরতেন আমার বলতেন, ‘আমার জীবনে এই পাগলিটা ছাড়া আর কাউকে চাই না।’ আর প্রতিবারই আমি ওনার শার্ট ভিজাতাম অশ্রুতে।
রাহা আমাদের দত্তক সন্তান। কিন্তু ওকে কখনো জানতে দিইনি সে যে আমাদের নিজের সন্তান নয়। আমার শাশুড়ি মা প্রথমদিকে নারাজ থাকলেও পরে পরে রাহার যখন বড় হতে শুরু করে আর দুষ্টামি করে উনিও রাহাকে আদর করা শুরু করে। ওকে কখনো বুঝতে দেইনি যে সে আমাদের পালিত সন্তান। ঠিক নিজের মেয়ের মতো করে ওকে বড় করেছি ভালোবেসেছি।

রাহাকে দত্তক নেওয়ার কিছুদিন পর আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা আপনি কোনো ছেলে বাচ্চা দত্তক নেননি কেন?’ উনি বলেছিলেন, কোনো পরিবারের প্রথম সন্তান যদি কন্যাসন্তান হয় তাহলে সন্তান মাবাবার জন্য রহমত হয়েই আসে। রাহাও যখন একটু বড় হয়। তখন আমাদের জিজ্ঞেস করতো, ‘আচ্ছা আমার কোনো ভাই নেই কেন?’ আমরাও ওকে একসাথে জবাব দিতাম, ‘আমাদের রাহামণিটার ভালোবাসা কমে যাবে তাই রাহামণির কোনো ভাই নেই।’ ও তখন মিষ্টি করে হাসতো আর আমাদের মনকে জুড়িয়ে দিতো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত