গল্পের পেছনের গল্প

গল্পের পেছনের গল্প

অন্ধ জগৎ সম্পর্কে রিসাদের কোন ধারণা নেই শুধু এতটুকু জানে চোখ বুঝলে আলোকিত পৃথিবীটা আন্ধকারে ছেয়ে যায় ।

সামনের দৃশ্যমান বস্তু মুহূর্তের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়, সেখানে খেলা করে কালোর মিছিল ।

প্রচণ্ড ভয় ছিল এই অন্ধ জগৎ নিয়ে অথচ রিসাদকেই আজ অন্ধ জগৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে ।
.
প্রথম প্রথম চোখে সামান্য কম দেখতো রিসাদ ।

চক্ষু ডাক্তার দেখিয়ে চশমাও নিয়েছিল কিন্তু ইদানিং চশমাতেও কাজ হচ্ছে না সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ।

আজ যখন চক্ষু হাসপাতালের বড় ডাক্তার নাদিম মাহমুদ রিসাদকে চরম সত্যটা বললো কেন যেন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছিল না তার ।

রিসাদের চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যাচ্ছে । এখন যে পর্যায়ে আছে এতে ভালো হওয়ার কোন লক্ষণ নেই ।

আগামী ছয় মাসের ভেতর রিসাদ দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হয়ে যাবে । সামান্যতম আলো তার চোখে আর অবশিষ্ট থাকবে না ।

এই কথা শোনার পর কোন সুস্থ মানুষ সুস্থ থাকার কথা না তবুও রিসাদ এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে । নিজের সাথে অনেক বোঝাপোরা করেছে ।

নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হয়ে যাবে এতে তার কোন দুঃখ নেই । সমস্ত দুঃখ তনুকে নিয়ে ।

যাকে সত্যিকারের ভালোবাসা যায় তাকে তো কখনও ঠকানো যায় না ।

রিসাদের পক্ষে এই চরম সত্যিটা হয়তো তনুর কাছে বলা হবে না কিন্তু তনুর সুখের জন্য যে তাকে একটা প্রচণ্ড কষ্ট পেতেই হবে ।
.
উত্তরা লেকের উপর ভেসে থাকা কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি গুলোকে বড়ই অদ্ভুত দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে পানিতে আগুন ধরেছে ।

সেই আগুন গুলো হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে দোল খাচ্ছে ।

অন্য সময় হলে দৃশ্যটি নিয়ে একটি কবিতা লেখা যেত কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠবে না,

হয়তো কারণ কিছু দিনের ভেতরেই কবির কবিতা ঘুমিয়ে যাবে অন্ধ গহবরে ।
.
লেকের কিনারায় বসে রিসাদ তনুর জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো এটাই হবে তনুর সাথে তার শেষ দেখা ।

রিসাদ খুব জরুরি ভাবে আসতে বলেছে তনুকে কিন্তু এখন পর্যন্ত তনুর আসার খবর নেই ।

রিসাদ ঠিক জানেনা তনুর সাথে তার সম্পর্কের বিচ্ছেদ কিভাবে হবে ? কিভাবেই বা ফিরিয়ে দিবে অনুকে ।

রিসাদ শুধু এতটুকু জানে সারা জীবন কষ্টে থাকার চেয়ে সাময়িক কষ্ট পাওয়া অনেক ভালো ।
.
– কি ব্যাপার রিসাদ জরুরী তলব কেন ?
.
আচমকা তনুর উপস্থিতি রিসাদ কিছুটা বিচলিত । হঠাৎ প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ।
.
– বসো রিসাদ তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে ।
.
– রিসাদের কথায় কিছু একটা ছিল যার দরুন চঞ্চলা তনু মুহূর্তের ভেতর থেমে গেছে । তার মুখয়বে ফুটে উঠেছে চিন্তার ছাপ ।
.
– কি এমন জরুরি কথা যে এক ঘন্টার ভেতর আসতে বললে ?
.
– তোমাকে কিছুদিন আগে বলেছিলাম না আমার এক মামা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন ।
.
– হ্যা বলেছিলে ।
.
– সে গতকাল ফোন করেছিল আমার জন্য সে স্টুডেন্ট ভিসার ব্যস্ততা করেছেন ।

আমি সেখান থেকেই লেখা পড়া করবো এবং সেখানেই সেটেল্ট হয়ে যাব ভাবছি । সেখানে জবের মার্কেট নাকি খুবই ভালো ।

বাংলাদেশে থেকে নিজের ভবিষ্যৎটা নষ্ট করতে চাই না ।
.
– এই কথা আগে চিন্তা করোনি কেন ? কেন আমার সাথে এই চারটি বছর ভালোবাসার অভিনয় করলে ?
.
– অভিনয় বলছ কেন ? আমি কি আমার ভবিষ্যতের কথা ভাববো না ।
.
– অবশ্যই ভাববে তবে আমাকে বাদ দিয়ে কেন ?
.
– কিছু পেতে চাইলে কিছু বাদ দিতে হয় । আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলেনা ।

তোমার সাথে আমার সম্পর্ক রাখা সম্ভব হচ্ছে না । এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা ।
.
– কি বলছ এসব আমার ভালোবাসা কে তুমি অপমান করতে পার না । আমাকে তুমি বিনা কারণে কষ্ট দিতে পার না ।

উপর ওয়ালা কিন্তু একজন আছেন ।
.
– অভিশাপ দিচ্ছ, দেও অভিশাপকে আমি ভয় পাই না । আর কথা না বাড়ালেই আমি খুশি হব । যা বলার আমি বলে দিয়েছি ।
.
রিসাদের শেষের কথাটা বেশ কঠিন ছিল, তনু কিছু বলতে চেয়েও আর কিছুই বলেনি ।

শুধু অশ্রু ভেজা নয়নে মুখে ওড়না গুঁজে চলে এসেছে রিসাদের কাছ থেকে ।

তনু হয়তো জানেনা সে যতটুকু না কষ্ট নিয়ে ফিরে এসেছে তার থেকে বেশি কষ্ট নিয়ে অনেক বেশি অশ্রু ঝরিয়েছে রিসাদ ।
.
রিসাদের সাথে তনুর কোন সম্পর্ক নেই । পরিচিত মোবাইল সিমটি সেই দিনই লেকের পানিতে ভেঙে ফেলে দিয়েছে ।

যদিও বা রিসাদের তনুর ফোন নাম্বার মুখস্থ ছিল তারপরও কখনোই ফোন দেওয়া হয়নি তার,

কিন্তু ফোন না দিলে কি হবে রিসাদের হৃদয় গহীনে তনু তখনও জীবিত ছিল বট বৃক্ষের মতো ।
*****
আজ সাত বছর হয় রিসাদ অন্ধ জগতের বাসিন্দা, আলোকিত পৃথিবীটা খুব ধীরে ধীরে রিসাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে ।

খুব কষ্ট হলেও রিসাদ কিভাবে যেন মানিয়ে নিয়েছে এই অন্ধ জগতটাকে ।

মা বাবার বাধা শর্তেও বর্তমান একটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি স্কুলে জব করছে রিসাদ ।

এক পরিচিত রিকশাওয়ালার রিকশায় সে প্রতিদিন সময় মতো আসা যাওয়া করে কিন্তু আজ কেন যেন সেই রিকশাওয়ালা আসেনি ।

কারো কাছ থেকে সাহায্য চাইতেও সংকোচ বোধ করছে রিসাদ ।

একটি দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে তনু তার কিছুটা সামনেই হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিসাদ ।

রিসাদের ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি কিন্তু কিভাবে হলো এটা ?

রসিদের তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকার কথা কিন্তু সে এই ভাবে এই অবস্থায় বাংলাদেশে কেন ?
.
– আম্মু দাঁড়িয়ে আছ কেন বাসায় চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো ।
.
– হ্যা যাব বাবা একটু দাঁড়াও । সামনে যে অন্ধ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে একটু কথা বলবো ।
,,,
একটি পরিচিত গন্ধ রিসাদকে বিমোহিত করে তুলেছে ।

তার পরিচিত কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিসাদ ভালো ভাবে বুঝতে পারছে ।

অন্ধ লোকদের অনুভূতি শক্তি বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা খুব প্রখর ভাবে দিয়ে দিয়েছেন ।
.
– কে ? আমার সামনে কে ?
.
– আমি ,,,,,
.
– আমি কে ?
.
– আমি তনু
.
– তনু !!
.
– হ্যা তনু ।
.
– তনু ভালো আছ ?
.
– হ্যা ভালো আছি, কিন্তু রিসাদ আমি তো তোমাকে এই অবস্থায় দেখবো আশা করিনি ।
.
– অনেকেই তো অনেক কিছু আশা করে না তারপরেও তো সেটা তাদের ভাগ্যে জুটে যায় ।
.
– হ্যা ঠিকই বলেছ দুঃখ বোধটা স্থায়ী ভাবে আমার ভাগ্যে জুটে গেছে ।

আচ্ছা আমার কথা বাদ দেও তোমার এই অবস্থা হলো কিভাবে ? তোমার না অস্ট্রেলিয়ায় থাকার কথা ।
.
– হা হা হা ,,,,,, অস্ট্রেলিয়া ! সব মিথ্যা সব বানোয়াট
.
– বানোয়াট ?
.
– হ্যা বানোয়াট । আমি কোথাও যাইনি বাংলাদেশেই আছি ।

তোমার সাথে যেদিন শেষ দেখা করি সেদিনই চক্ষু হাসপাতাল থেকে মাত্র ফিরেছি ।

সেখানকার ডাক্তার আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল আমি আগামী ছয় মাসের ভেতর অন্ধত্বকে স্থায়ী ভাবে বরণ করে নিব ।

আমার চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যাচ্ছে । এটার আপাতত আর কোন চিকিত্‍সা নেই । ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কি করতে পারতাম বলো ।

আমার সাথে তোমাকে জড়িয়ে নিলে তুমি সুখী হতে পারতে ? পারতে একজন অন্ধ প্রতিবন্ধীর স্ত্রী হতে ?

পারতে না, আর আমি সেটা চাইওনি, আর তাই তো আমি তোমার জীবন থেকে দূরে সরে গেছি ।
.
তনু কোন উত্তর দিতে পারেনা, শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিসাদের দিকে ।

সত্যিটা যদি সেদিন সে জানতো তার করণীয় কি হতো সে সেটা জানে না তবে সে যে সুখে নেই ।

রিসাদ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বাবা মায়ের পছন্দেই একজন কে বিয়ে করেছিল তনু…..,

কিন্তু সেই লোকটার সাথে ঘর করা হয়নি অন্তত চরিত্রহীন আর নেশাখোরের সাথে ঘর করা যায় না ।

বিয়ের তিন বছর পর থেকে এক মাত্র ছেলে সন্তান নিয়ে আজও সে একাকী ।

কোন পুরুষকেই এখন আর বিশ্বাস যায় না, তবে এই অন্ধ নির্ভেজাল মানুষটার সঙ্গী হতে পারলে খারাপ হতো না ।

অন্তত এতটুকু বিশ্বাস করা যায় সামনে দাঁড়ানো মানুষটা চরিত্রহীন নয় ।
.
– আম্মু চলো না, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো ,,,,
.
– একি ! তোমার সাথে তোমার ছেলেও আছে দেখা যায় কিন্তু ছেলের বাবা কোথায় ?
.
– ছেলের বাবা নেই ।
.
– ছেলের বাবা নেই মানে ?
.
– তার সাথে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক আগেই
.
– কিন্তু কেন ?
.
– এতো কথা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলের সামনে বলতে পারবো না । এর চেয়ে বরং তুমি তোমার মোবাইল নাম্বারটা দেও রাতে ফোন করবো…
.
– কিন্তু ,,,,,,,,
.
– চিন্তা করো না, ছেলে সহ তোমার কাঁধে ঝুলে পরবো না ।
.
“আমি তো চাই সারাটি জীবনের জন্য তুমি আমার কাঁধে ঝুলে পর ,

তোমার ভালোবাসায় আমায় সিক্ত কর তনু” কিন্তু কথাটা আর সরাসরি তনুকে বলা হয় না ।

মোবাইল নাম্বার দিয়ে সেদিনকার মতো সে বিদায় নিয়েছে ।

তনুই তাকে রিকশা করে দিয়েছে কিন্তু তিন দিন হয়ে গেল তনু নামের মেয়েটার কোন ফোন আসছে না ।
.
রিসাদ, অন্ধদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরিকৃত মোবাইল নিয়ে বসে থাকে তনু নামের মেয়েটির ফোনের জন্য,

সে জানেনা মেয়েটি তাকে ফোন করবে কিনা, তার এই অন্ধ জগতে আলক বর্তিকা হয়ে তনু আসবে কিনা ।

সে জানেনা, তবুও তার খুব ভাবতে ভালো লাগে ।
.
রাত ১.৪৫ মোবাইল বেজে চলছে কিন্তু রিসাদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ।

যখন সে মোবাইলের শব্দে জেগে উঠেছে তখন তার শরীর কাঁপছে ।

এটা কি তনুর ফোন ? নাকি তার অবচেতন মনের বিক্ষিপ্ত শব্দ ? তার মন বলছে তনুই হবে হয়তো….
.
– হ্যালো কে বলছেন ?
.
– আমি তনু
.
– তুমি কি সত্যিই তনু নাকি আমি এখনও স্বপ্ন দেখছি ?
.
– স্বপ্নই দেখছ হয়তো, , হা হা হা হা ,,,,,,,,
.
হাসির শব্দ রিসাদের মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনি হয় । এই একটি মাত্র হাসির জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায় ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত