বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গেলো। অনিতার কোলে বাচ্চা আসলো না। অনিতার শ্বশুর বাড়ির পরিবারের অন্য সবার ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা থাকলেও বাড়ির বড় বউ হিসেবে অনিতা ছিলো নি:সন্তান।
এটা নিয়ে অনিতার স্বামীর যতটুকু না মাথাব্যাথা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিলো তার শ্বাশুড়ির, কারন সে নাকি পাড়া প্রতিবেশি দের কাছে মুখ দেখাতে পারে না।
অনিতা ছিলো চুপচাপ, বাসায় ননদ-জা দের খোটা এবং শ্বাশুড়ির অন্ধকার মুখ দেখে সবার আড়ালে চোখের পানি ফেললেও মাঝে মাঝে সে নিজেকেও অপরাধী মনে করে। যখন অন্য অন্য ছোট বাচ্চারা অনিতাকে আন্টি আন্টি করে ডাক দেয়, তখন অনিতার মা সত্ত্বা এসে অনিতাকে দোষী বলে গালি দেয়।
অনিতা যেনো একরকম মেনেই নিয়েছিলো,
এই ঘরটা শুধু তার ভারী ভারী কাজ করার জন্য। ঘরের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে অনিতা কখনো নিজের মতামত নিয়ে হাজির হয়নি, হয়েছে সবার জন্য চায়ের কাপ নিয়ে। সবার মাঝে থাকলেও সে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবত নিজেকে। ঈদ কুরবানি তে সবাই খুশি খুশি মনে জামাকাপড় কিনে একে অপরকে দেখিয়ে প্রশংসা কামানোর সময় ও কেউ একবার এসে জিজ্ঞেস করেনা তাকে, “অনিতাদি! আমার জামাটা কেমন হয়েছে?”
ঘরের ভিতর সে নিজে একমাত্র সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত হলেও তার মতামত এ ঘরে মূল্যহীন। এ জন্য তার অপরাধ, সে একটা বাচ্চা জন্ম দিতে পারে নি। নিজের মনের কাছেও ছিল অনিতা সমান অপরাধী। অনিতার মনে পরে যায়, ছোট বেলার কথা। আয়নার সামনে বসে যখন সে কপালে টিপ লাগাতো, তখন আয়নায় তার সুন্দর চেহারার পাশাপাশি তার একটা সুন্দর সংসারের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠত। রূপে অনিতা ছিলো অদ্বিতীয়া। যেমন লম্বা, তেমন ফর্সা, চোখ দুটোর মাঝে যেন টলমলে দিঘী বিদ্যমান। অনিতা হাসলে যেন তার মুখ থেকে মুক্তো ঝরে। কিন্তু এ সবই এখন গুরুত্বহীন। এ রূপ, তার চেহারার ঝলকানি অন্য পুরুষদের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, অনিতার মাতৃত্বহীনতা তার নিজের সংসারের সব গুরুত্ব কেড়ে নিয়েছে।
এরকম অবহেলার মধ্যেও ভালো কাটছিলো অনিতার দিন। সব কিছুর সাথে সে একরকম মানিয়েও নিয়েছিল।
হঠাৎ একদিন এক সন্ধ্যায় অনিতার বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাসার সবাই তার শ্বাশুড়িকে নিয়ে চলে যায় হাসপাতালে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও যায়, কিন্ত বাদ থাকে অনিতা ও তার শ্বশুর। তার শ্বশুর বিকেলে বের হয়েছিল, এখনো বাসায় ফেরে নি। অনিতাকে নেয়া হয়নি, কারণ অনিতা সে ঘরে মানুষদের মধ্যে একজন ছিলো না।
সবাই চলে যাওয়ার আধ ঘন্টা পর তার শ্বশুড় বাসায় ফেরে। তখনই অনিতা শশব্যস্ত হয়ে তার শ্বশুড়কে, শ্বাশুড়ির অসুস্থতার কথা শোনায়।
মাথায় আধাপাকা চুল নিয়ে বুড়ো লোকটা বারান্দায় বসে সিগারেট ধরায়।
সবার রাতের খাবার রেডি করে অনিতা তার রুমে ঢুকে শুয়ে পরে। সারাদিনের ক্লান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতেই একটু ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে।
সিগারেটের তীব্র ধোঁয়ার গন্ধে অনিতার ঘুমের ঘোর কাটে। ঘরিতে তখন সময় রাত ১০টা ৩০মিনিট। অনিতার সুন্দর, নাজুক পালকের মত ফর্সা দেহটা একটা বুড়োর ভারী দেহের নিচে চাপা পরে আছে টের পাওয়ার পর ই তাড়াতাড়ি করে উঠতে চায় সে।
কিন্তু না!
তার হাত পা বাঁধা আছে শক্ত কিছু দিয়ে। বুড়োটার ফ্যাশফেশে হাসি শুনে অনিতা চিৎকার করতে যাবে, তখন বুঝতে পারে মুখ থেকে শব্দ বের হওয়ার উপায়টুকুও তার কাছে এখন নেই।
অনিতার চোখ থেকে কষ্টে পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।
বুড়োটা সিগারেটের মতই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেতে থাকে একটা নারীদেহকে। যখন বুড়োটার সব দম শেষ হয়, তখন অনিতার বুকের উপর ওর শাড়ীর আঁচল ছুড়ে মেরে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতে দিতে বলে,
“আমার কথা বলে দিবি?
বলিস না।
বললেও কেউ কি তা বিশ্বাস করবে?? শুধু শুধু কেন নিজের ঘর হারাবি??
আমার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিব তোকে তালাক দিয়ে। একটা আঁটকুড়ে কে ঘরে বসে বসে খাওয়ানোর কোন মানে তো হয় না।।”
কথাটা বলেই চোখ ছোট করে একটা ফ্যাস ফেসে হাসি দিয়ে অনিতার হাত পা মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে রুমের বাইরে চলে যায় সে।
ঘরের লাইট টা তখনো নিভানো।
অন্ধকারেই নিজের জামাকাপড় ঠিক করে নেয় অনিতা।
বালিশ নাকে মুখে চেপে ধরে মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে কান্না করে আর মনে মনে ভাবে, ছোটবেলায় কেউ বিরক্ত করলেও বাবার কাছে বিচার দিতো সে। এখন কার কাছে বিচার দিবে অনিতা?
তারও প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর, বাসার সবাই ফিরে আসে। শ্বাশুড়ির অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো।অনিতা বুকভরা অভিমান ও কষ্টকর কথা নিয়ে সেই অন্ধকার রুমটায় ই শুয়ে থাকে, তার স্বামী ফিরলে আজ সব বলে দিবে, তার সাথে কি কি করা হয়েছে।।
কিন্তু বরাবরের মতই তার স্বামী এসে বিছানার একপাশে কোলবালিশ নিয়ে শুয়ে পরে। এটা গত চার বছর ধরেই হয়ে আসছে। অনিতার সাথে সপ্তাহে দু একটা কথা হয় এই লোকটার। অনিতা আর ভরসা পায়না তার স্বামীকে সব কিছু বলার। কারণ তার স্বামীর কাছেও সে একটা বোঝা।
এরকম ঘটনার পর কেটে যায় দুটি মাস।অনিতার অভিজ্ঞ শ্বাশুড়ি সন্দেহ করে অনিতা হয়ত গর্ভবতী অনিতাকে হাসপাতালে নেয়া হয় চেকাপ এর জন্য। পরে জানা যায়, আসোলেই সে মা হতে চলেছে।।
ঘটনাটা জানার পর পরই বদলে যায় অনিতার বাসার পরিস্থিতি।
আদর আপ্যায়নের কমতি হয় না তার জন্য। বাড়িতে নতুন কাজের লোক রাখা হয়। অনিতাকে এনে দেয়া হয় বাটি ভর্তি ভর্তি সুস্বাদু খাবার, আচার, মিষ্টি। অনিতার স্বামীও দু এক মিনিট পর পর এসে জিজ্ঞেস করে খেয়েছে কিনা, শরীর কেমন আছে, কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা।
অনিতার শ্বাশুড়ি নিজ হাতে পায়েস রান্না করে এনে অনিতাকে খাওয়ায়, ওর শ্বশুড় ওকে দেখে সেদিনের মতই ফ্যাঁসফ্যাসিয়ে হাসে।
আর অনিতা??
ওর অবস্থা কেমন??
ভালো না। অনিতার কিছুই ভালো লাগেনা এসব, দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে প্রচুর কান্নাকাটি করে ও। একটা পাপ কে এভাবে তিলে তিলে বড় করার কষ্ট ওর সহ্য সীমার বাইরে চলে যেতে থাকে। অনিতা চাচ্ছিলো ওর বাচ্চাটা যাতে মারা যায় কোনো ভাবে, কোনো ভাবে যেন না হয় ওর বাচ্চাটা।
অনিতার ছেলে দেখতে হুবুহু ওর শ্বশুড়ের মতো হয়েছে। ওর ছেলে আর ওর শ্বশুড় হঠাৎ ই দুটো জানোয়ারে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তারপর অনিতার দিকে ছুটে আসে অনিতাকে হত্যা করার জন্য। অনিতা চিৎকার করে। ঠিক তখনই ঘুম ভেংগে যায় অনিতার, বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে।অনিতাকে পানি খেতে দেয়। অনিতার স্বামী তারপর সারাটি রাত অনিতাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। অনিতার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।
তার কয়েকমাস পরেই অনিতার কোল জুড়ে একটা ফুটফুটে শিশু আসে। হাসপাতালে যখন অনিতা তার নবাগত বাচ্চাটার কান্না শুনে, তখনই প্রথম বারের মত অনিতা মাতৃত্বের ভালোবাসা অনুভব করে। পরম মমতায় বাচ্চাটা কোলে নেয় সে। কিন্তু হঠাৎ ই অনিতার দিকে তাকিয়ে ওর বাচ্চাটা বড়দের মত চোখ বাকা করে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি দেয়। অনিতা সাথে সাথে বাচ্চাটাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে। ঘটনাটা উপস্থিত সকলের সামনেই হয়।সবাই ভাবে অনিতার হাত থেকে বাচ্চাটা হয়ত ফসকে গিয়েছে। পরক্ষনেই সবাই বাচ্চাটা কোলে নিয়ে হই হুল্লোড় এ মেতে উঠে। শুরু হয় এঘর, ওঘর ও প্রতিবেশীদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ।
সদ্য জন্মগ্রহণ করা বাচ্চাটাকে নিয়ে সবাই খুশি থাকলেও অনিতা বুঝতে পারে,
তার শিশুটি অন্য শিশুদের তুলনায় খুব ই আলাদা এবং অস্বাভাবিক। কিন্তু অনিতা কাউকেই সেটা বলতে পারে না।
প্রথম দিন ই অনিতাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়।
মাঝ রাতে যখন সবাই ঘুমাচ্ছিলো, অনিতা হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেরে জেগে উঠে।
পাশে তাকিয়ে দেখে, তার পাশে ছোট বাচ্চাটি নেই।
তাদের করিডোর এর দরজাটা খোলা।
অনিতা যখন আস্তে আস্তে করিডোরে উঁকি দেয়, তখন সে দেখতে পায়,
তার ছোট্ট বাচ্চাটা হাতে একটা চাকু নিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে এবং চাকুর বাট দিয়ে আস্তে আস্তে মেঝের উপর ঠুক ঠুক করে শব্দ করছে, হঠাৎ ই বাচ্চাটা অনিতার দিকে তাকিয়েই হি হি হি করে একটা হাসি দেয়।
অনিতা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে।ঘরের সবাই যখন দৌড়ে আসে, তখন অনিতা ওর বাচ্চাটার দিকে আংগুল তুলে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ওর বাচ্চাটা তখন করিডোরে শিশুর মতই শুয়ে ছিলো।
সবাই অনিতাকে বকা বকি করে!
এতটুকু বাচ্চাকে করিডোরে এনে কেন ফেলে রেখেছে এ জন্য।
অনিতা সবাইকে বলে এইমাত্র কি কি দেখেছে তা সব।
কিন্তু কথাগুলো কেউই বিশ্বাস করে না।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওর শ্বাশুড়ি বাসায় ঢুকে। পিছনে পিছনে সবাই তাকে অনুসরণ করে।
অনিতার স্বামী আসার সময় লক্ষ্য করে করিডোরের উপর একটা ছুড়ি পরে আছে।একটু খটকা লাগে তার কাছে।
অনিতার শ্বাশুড়ি অনিতার কোলে বাচ্চাটা দিয়ে বলে ওকে দুধ পান করাতে।কিন্তু অনিতা ভয়ে কিছুটা কনফিউজড হয়ে পরে।
অনিতার কাছে বাচ্চাটা রেখে সবাই যে যার রুমে চলে যায়।
কিছুক্ষন পর আবার অনিতার আর্তনাদ শুনে সবাই ছুটে আসে। এসে সবাই দেখে অনিতার বুক থেকে রক্ত বের হয়ে শরীর ভিজে গেছে। বাচ্চাটার মুখ ভর্তি রক্ত। অনিতা সবাইকে চেঁচিয়ে বলছে, এই বাচ্চাটা অস্বাভাবিক বাচ্চা, আমি একে চাই না।কিছুতেই চাই না। আমাকে মেরে ফেলবে ও। অনিতার এ রকম রিয়াক্ট ও পরিস্থিতি দেখে সে ঘরের সব মহিলারাই একটু ভড়কে গেলো।কিন্তু অনিতার শ্বাশুড়ি বলল যে, অনিতা পাগল হয়ে গিয়েছে। যে ছেলেটার দাঁতও উঠেনি।সে কিভাবে ওর শরীরে এত জোরে কামড় বসাবে!!
অনিতার শ্বাশুড়ি বাচ্চাটা হাতে নেয়, তারপর কোলে নিয়ে বলে, এই বাচ্চাকে আমি বড় করব। তোমার মত একজন বদ্ধ পাগলের কাছে থাকলে হয়ত মারা ই যাবে বাচ্চাটা।অনিতার কাছ থেকে সেদিন বাচ্চাটি নিয়ে নেয় অনিতার শ্বাশুড়ি।
অনিতা তখনও ব্যাথায় কাতর ছিলো।
এভাবে কেটে যায় কয়েকটি দিন। কিন্তু ওলট পালট হয়ে যায় বাসার ভেতরের। অনিতার শ্বশুড় ইদানীং খুব ভীত থাকে।এমনকি সে একা একা রাতে বাথরুমেও যায়না। খুব ভয় পায় আজকাল, হঠাৎ এ ভয় পাওয়ার কারণ হল সে যখন অনিতার শিশুটিকে কোলে নিয়ে খেলা করছিল,তখন হঠাৎ ই চিকন একটা কন্ঠ শুনতে পায়,
বাবা, এই বাবা, তুমি ই তো আমার বাবা তাই না?? হিহিহিহি।
কথাটা শোনার সাথে সাথে হাত থেকে অনিতার বাবা ফেলে দেয় বাচ্চাটিকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই ছেলেটা হাত থেকে নিচে পরে গিয়েও হাসছিলো। যেনো সে ব্যাথাই পায় নি।ঘটনাটা দূর থেকে দেখে অনিতার শ্বাশুড়ি।ছুটে এসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয় সে।
অনিতার সাথে দেখা হলেই অনিতা তার শ্বাশুড়িকে বলে, ফেলে দিন বাচ্চাটাকে। ও স্বাভাবিক মানুষ না।প্লিজ ফেলে দিন ওকে।অনিতার শ্বাশুড়ি বলে, বৌ – মা, আমি তোমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিব, যদি দাদুভাইকে নিয়ে আর একবার এরকম কিছু বলো।অনিতা চুপ হয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ সকালে অনিতার শ্বশুরের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে বাসার সবাই,
এসে দেখতে পায় অনিতার শ্বশুর রুমের এক কোনায় হাত দিয়ে নাক মুখ ঢেকে বসে আছে।খাটের উপরে পরে আছে অনিতার শ্বাশুড়ির মৃত লাশ। আর তার পাশেই হাত পা ছুড়ে খেলা করছে শিশুটি। অনিতার শ্বাশুড়ির নাক মুখে যেনো এখনো কোনো একটা শংকার ছাপ। অনিতা চিৎকার করে উঠে,
বলেছিলাম না,
ও সবাইকে খুন করবে!!
ও মানুষের সন্তান না।
ও একটা ডেভিলস চাইল্ড,
শুনলে না তো আমার কথা!!
কথাটা বলেই দৌড়াতে দৌড়াতে বের হয়ে যায় অনিতা।
ডাক্তার আসে,
পুলিশ আসে।
ফরেনসিক রিপোর্টে আসে হার্ট এট্যাক এ মৃত্যু হয়েছে তার।
বাসায় বেশ বড়ো একটা সোরগোল পরে গেলেও কেউ শিশুটির দিকে আংগুল তুলে না।কারণ যে শিশুটি শক্ত বিছানায় ও শুতে পারেনা এখনো, সে কিভাবে কি করবে!! আর মৃত্যু হয়েছে হার্ট এট্যাকে।এটা কোন মার্ডার না।স্বাভাবিক মৃত্যু।
এভাবে চলে যায় কয়েকদিন।বাসার সব পরিবেশ আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসে। অনিতার আচরণ পাগলের মত হয়ে যায়। ওকে সামলাতে ওর বাবার বাড়ি থেকে বড় ভাই চলে আসে।অনিতার বড় ভাই একজন সাহিত্যিক মানুষ, সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এই ভৌতিক শিশুর কথা শুনে তিনিও বিপাকে পড়েছেন,
অনিতার শিশুর বাবা যে অনিতাত শ্বশুর, এই ঘটনা ছাড়া অন্য সব কিছুই তাকে খুলে বলা হয়েছে।সব শুনে তিনিও কিছুটা বিস্মিত। এর পর বাসায় অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড কারখানা ঘটতে শুরু করে। অনিতার বাসার অনেকেই রাতে অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পায়। তাদের বাসার জানালার গ্রীলের শক্ত লোহার দন্ড গুলো বাঁকানো পাওয়া যায়। বাসায় হঠাৎ হঠাৎ ই ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা।এরকম আতংকের ভিতরেই কেটে যাচ্ছিলো দিন গুলো।
একদিনের ঘটনা,
হঠাৎ করেই আবারও হার্ট এট্যাক এ মারা যান অনিতার শ্বশুড়।
এবার বাসার সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘাবড়ে যায়।
সবাই ধরে ফেলে বাচ্চাটার মাঝে কিছু অশুভ শক্তি রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই ভৌতিক বাচ্চাটাকে এতিম খানায় রেখে আসা হবে।
কিন্তু অতটুকু বাচ্চা,
এতিম খানা থেকে ফিরিয়ে দেয়।
বাচ্চাটাকে বাসায় এনে অনাদরে অবহেলায় ও ভয়ে ফেলে রাখা হয় বাসার এক কোনায়। অনিতাও লুকিয়ে থাকে ভয়ে।
অনিতার ভাই ঠিক করে আজ সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে কি করে রাতের বেলা এই ভৌতিক শিশুটি,
সারা রাত শিশুটির রুমের সামনে জেগে থাকে সে।
জেগে থাকতে থাকতে হঠাৎ যখন সে ঘুমে ঢুলু ঢুলু অবস্থা, ঠিক তখনই বাচ্চাটার খল খলিয়ে হাসির আওয়াজ শুনে চমকে উঠে।
আস্তে আস্তে গিয়ে রুমের জানালায় উঁকি দিয়ে যা দেখে, তা সে কল্পনাও করতে পারে নি। বাচ্চাটা একটা কালো ছায়ামূর্তির উপর বসে খেলা করছে। বাচ্চাটার ভিতর যেন আনন্দের শেষ নেই, সে রকম কল কল খল খল আওয়াজ আসছে। সব ভয় দূর করে, মনের ভিতর সকল শক্তি চেপে হঠাৎ সে রুমে ঢুকে লাইট টা অন করে দেয়।
তারপর যা দেখার সেটুকু দেখে লাইট টা অফ করে চলে যায় অনিতার রুমে। গিয়ে অনিতার বিছানায় কিছুক্ষন বসে থাকে।
মনের ভিতর অনেক হিসেব কষার চেস্টা করে, তারপর এক সময় সব কিছুর সমাধান পায়।
ফজরের আযান হচ্ছে।
অনিতার বিছানায় অনিতার পাশেই শুয়ে আছে অনিতার ভাই।
দুজনেই সজাগ।
অনিতার ভাই ই প্রথম কথা শুরু করে।
– কেনো খুন করলি ওদের??
– আমি কাউকে মারি নি। যা করার ঐ বাচ্চাটাই করেছে।
– আমাকে বোকা বানাতে চাইলেও পারবিনা। ছোট থেকেই চিনি তোকে।।
– প্রমাণ আছে কোনো?? তাদের আমি ই খুন করেছি??
– হ্যাঁ।তোর ড্রয়ার থেকে পাওয়া, পেপ্ট্রিন ঔষধ।
যেটা মানুষের হৃদক্রিয়া বন্ধ করে মানুষের হার্ট এট্যাক ঘটায়।এবং তারপর রক্তে এমন ভাবে মিশে যায়,যে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এ তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
– হ্যাঁ আমি ই খুন করেছি। আর তার কারণ ও ছিলো।
– কি কারণ??
– আমার শ্বশুড় এবং শ্বাশুড়ি দুজনে প্লান করে, আমাকে ধর্ষন করে।
আমার শ্বাশুড়ি যখন জানতে পারে , তার ছেলের সমস্যার কারণেই আমার বাচ্চা হচ্ছে না। তখন সে মানুষের সামনে তার মান সম্মান ধরে রাখার জন্য তার স্বামীর সাথে বসে ভয়ানক প্লান করে।
অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করে হাসপাতালে ভর্তি হয় সে।আর তখন বাসায় কেউ না থাকার সুবাদে, ঘুমের ভিতর আমার হাত পা বেঁধে আমাকে ধর্ষন করে আমার ই নিজের শ্বশুড়।
আর এ সব কথা আমি জানতে পারি, যখন তারা নিজেরা আমার অগোচরে এগুলো আলোচনা করছিলো।
– তাহলে এই বাচ্চা শিশুটির উপর দোষ চাপালি কেনো??
– ও আমার বাচ্চা। ওর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য আমাকে খুব প্রয়োজন। এই খুনের সন্দেহে যাতে আমি না থাকি, তাই এতদিন এই নাটক গুলো করেছি।আমি প্রতিদিন রাতে গিয়ে ওকে দুধ খাইয়ে আসতাম। কেউ টের ও পেত না।
আমি ছিলাম সন্দেহের বাইরে।
– তাহলে কি আরো একটা খুন করে ফেলবি??
– হ্যাঁ যে মানুষটা সব জেনেও কোনো প্রতিবাদ করে নি, সে আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য না।
______
পরদিন সকালে আরো একটা লাশ পাওয়া যায়, হার্ট এট্যাক এ মারা যাওয়া অনিতার স্বামীর লাশ।
মিশন কম্পলিট।অনিতা তার ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সন্তান কে বাবার বাড়ি থেকেই মানুষ করবে। একটা পাপ চক্র শেষ করে দিয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে নিজের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরে অনিতা।