হঠাৎ একদিন

হঠাৎ একদিন

–কফি খাবেন?
এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হয়ে মিতু নামের মেয়েটির দিকে তাকালাম।

–আমাদের আলাদা করে কথা বলতে বলেছে। কফি খেতে বলেনি তো !
খুলে যাওয়া হাত ঘড়িটা লাগাতে লাগাতেই মিতুকে বললাম।

–কথা বলার সময় কফি না হলে ভালো লাগে?
কানের দুলটা খুলে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেখে মিতু বললো।

–আমি কফি কম পছন্দ করি।সুতরাং কফি এখন খাবো না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকেই মিতুকে বললাম,

–আচ্ছা মিতু, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

–জ্বী, করুন।
পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বললো।

–আপনি শাড়ি পরে আমাদের সামনে আসেন নি কেন? তার উপর কানের দুলটাও খুলে রেখে দিলেন ?

–আরে ধ্যাৎ ! শাড়ি পরতে পারলে তো শাড়ি পরবো। আর কানের দুলটা ভীষণ ভারী ছিলো ! গাড়ির চাকার মত । এমন উদ্ভট দুল পরতে আমার ভালো লাগেনা।তার জন্য এই জীবনে আমি কোনোদিন দুল নামক বস্তুটি কিনি নাই।এই দুলটা ছিলো আমার ছোট বোনের।

বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে মেয়েটা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলো। ওর মধ্যে কোনো বিষণ্ণতা নেই।বেশ চঞ্চল একটা মেয়ে।সেটা যে কেউ ই বলে দিতে পারে।

–আপনি জানেন,আপনি যে খুব চঞ্চল !

–চঞ্চল ! হ্যাঁ জানি তো । আসলে আমি না চুপচাপ থাকতে পারিনা।জানেন,আমি মাঝে মাঝে ভাবি,মানুষ কি করে কথা না বলে থাকতে পারে ?

মাথার চুল বাঁধতে বাঁধতে মিতু বললো।মেয়েটাকে যত দেখছি ঠিক ততই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, ও আমাকে অনেক আগে থেকেই চিনে।তার জন্য আমার সামনে এমন আচরণ করছে।খোলা চুল বাঁধছে মেয়েটা।অসম্ভব সুন্দর লাগছে।যদিও এতক্ষণ আমার বিরক্ত লাগছিলো মেয়েটার বকবক শুনে,কেন জানিনা হঠাৎ সব থমকে গেছে !

–একটা কাজ করে দিবেন ?
মিতু অনেকটা বিচলিত হয়ে আমায় প্রশ্ন করলো।

–কি কাজ ?

–আপনার পেছনে রাখা চুলের ক্লিপটা আমায় দিন তো ।

–আজব ! অপরিচিত ব্যক্তিকে কেউ কি ফরমায়েশ করে ?
চুলের ক্লিপটা মিতুর হাতে দিয়ে উঠে গেলাম।

–কি ? চলে যাচ্ছেন ? আমাকে পছন্দ হয়নি , তাইতো ? আমি ঠিক জানতাম !

–ঠিক আছে,আমি ড্রয়িংরুমে যাই।
সবাই অপেক্ষা করছে । এবার আমি সত্যি বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসলাম।

অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে চলে গেলাম।বাবা’কে আলাদা করে বললাম,
আমার মেয়ে পছন্দ হয় নি। এরকম চঞ্চল মেয়ে আমি বিয়ে করবো না।
যেহেতু আমার সিদ্ধান্তই ছিলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেক্ষেত্রে মিতুর সাথে আমার বিয়েটা হয়নি।সেটা ভেঙ্গে গেছে।

তার কিছুদিন পর আমি আবার দেশের বাহিরে চলে যাই।ঐ সময় আর আমার বিয়ে করা হয়নি।
সময় তার নিজ গতিতে অতিবাহিত হতে লাগলো।

প্রায় সাতবছর পর দেশে ফিরে আসি।দেশে আসার কিছুদিন পর মা বাবা বারবার বিয়ের কথা বলছে।তারা আগে থেকে পাত্রী দেখে রেখেছে।এখন আমি গিয়ে মেয়ে দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সেদিন সকালে রাস্তায় হাঁটছিলাম। রাস্তায় হাঁটার সময় হুট করে থেমে যাই।কেন জানিনা,এক অজানা অনুভূতি আমায় স্পর্শ করে গেলো।একটা মেয়েকে দেখে।

মেয়েটার বয়স ৫/৬ বছর হবে।ছোট চুলগুলো নেড়ে নেড়ে দৌঁড়াচ্ছে।দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে । নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেলো।ইশ্ ছোটবেলাটা কতই না সুন্দর ছিলো ! দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা কতই না মিষ্টি ছিলো !

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছি।হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি করতে করতে মেয়েটা পড়ে যায়।তখন কোথা থেকে যেন একটা মেয়ে দৌড়ে আসে ! একটু কাছে যেতেই দেখলাম , মেয়েটা ছিলো মিতু।ও পিচ্চি মেয়েটাকে
কোলে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে।তার মানে মিতু বিয়ে করে ফেলেছে ! এই পিচ্চিটা তাহলে মিতুর মেয়ে !

সেদিন বাসায় আসার পর কেন জানিনা খুব খারাপ লাগছিলো ! সেই সাতবছর আগের মিতুকে খুব মনে পড়ছিলো ! বুঝতে পারছিনা, আজ হঠাৎ মিতুকে দেখার পর মিতুর কথা কেন আমার মনে পড়তে যাবে ? মিতুকে তো আমি কখনো ভালবাসিনি ! তাহলে কেন ওর বিয়ে হয়ে গেছে বা ওর মেয়েকে দেখে আমার এমন লাগছে ?

পরেরদিন সকালে যথারীতি হাঁটতে বের হলাম।আজও সেই জায়গায় গেলাম।গিয়ে দেখলাম ছোট মেয়েটা আজও খেলছে।তার পাশেই মিতু দাঁড়িয়ে আছে । আমি দূর থেকেই ওদের দেখছি।কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছি না।

এভাবে প্রায় মাসখানেক কেটে গেলো।প্রায় দেখতাম মিতু ওর মেয়েকে নিয়ে এই জায়গাটাতে আসে।কিন্তু আমি কখনো ওদের সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি।

কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন দেখলাম, ছোট মেয়েটা ছুটে আমার কাছে চলে আসছে।এসেই আমাকে দেখছে । চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে মেয়েটা।আমি কিছুটা বিব্রত হচ্ছি।তখন মেয়েটা বললো,

–এই যে আঙ্কেল , একটু বসোতো।
মেয়েটার কথা শুনে হাসি পেলো।ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,

–তোমার নাম কি মা ?

–আমি নিতু।আর তুমি ?

–আমি শায়ান ।
তুমি যে এখানে এসেছো সেটা কি তোমার মা জানে ?
মিতু তাহলে নিজের মেয়ের নাম নিতু রেখেছে ! বাহ্ !

–না, জানেনা তো।মা’কে তো বলি নাই।
নিতু ভীত হয়ে বলছে।

–এটাতো ঠিক নয় মা।তুমি মা’কে না বলে এখানে কেন এসেছো ?

–আঙ্কেল আমার মনে হলো আমি তোমাকে চিনি।তাই এখানে ছুটে আসা।

–আমায় চিনো ? কি করে ?
অবাক হয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলাম ।

হঠাৎ দেখলাম মিতু এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। নিতুকে আমার পাশে বসতে দেখে হয়তো অবাক হয়েছে । আমি কিন্তু ভীষণ বিব্রত হচ্ছিলাম।কি থেকে কি বলবো বুঝতে পারছিনা।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মিতু নিজেই বললো,

–দেশে কবে আসছেন ?

–এইতো, কিছুদিন হলো।
কেমন আছো তুমি ?

–ভালোই । আচ্ছা ঠিক আছে যাই এখন।

মিতু নিতুর হাত ধরেই চলে গেলো।কিন্তু নিতু আমাকে কি করে চিনলো সেটাই বুঝতে পারলাম না।কারণ মিতুর আমাকে চেনার কথা।নিতুর নয়।এতটুকু একটা মেয়ে আমায় কোথায় বা দেখেছে যেখানে আমি দেশেই ছিলাম না !

পরেরদিন আবার ঐ একই জায়গায় গিয়ে বসে আছি।শুধু যে বসে আছি, তা নয়।বরং অপেক্ষা করছি,নিতুর জন্য।
কিন্তু সেদিন আর ওরা আসেনি।

এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ রোজ সকালে ঐ জায়গাতে গিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করি।সপ্তাহের শেষ দিনে আজ আবার নিতুকে দেখতে পেলাম।মেয়েটাকে দেখে বেশ ভালো লেগে উঠলো।

আজ আমি নিজেই চুপেচুপে ইশারায় নিতুকে ডাকতে লাগলাম।ও আমায় কিভাবে চিনে সেটা জানার কৌতুহলে নিতুকে ডাকা।

নিতু কাছে এসে বললো,

–ডাকছো কেন আঙ্কেল ?

–আমায় একটা হেল্প করবে মা ?

–বলো,কি হেল্প ?

–তুমি আমাকে কিভাবে চিনো, সেটা বলোতো ?
মেয়েটার সাথে কথা বললে বুঝা যায় যে,ভীষণ পাকা।

–আরে মিতু খালামণির কাছে তোমার একটা ছবি আছে।সেটা দেখেইতো তোমাকে চিনলাম।

–মিতু খালামণি মানে ? মিতু তোমার মা নয়?
তাছাড়া মিতুর কাছে আমার ছবি ! কি করে ? ও আমার ছবি কোথায় পেলো ?

–তুমি তো দেখছি খুব বোকা আঙ্কেল ! মিতু খালামণি আমার মা না তো।আমার মা হচ্ছে ঋতু।
আর খালামণি তোমার ছবি কোথায় পেলো,তাতো আমি জানিনা। তবে খালামণি তোমার ছবিটা নিয়ে খুব কাঁদে।তুমি খুব পঁচা । আমার খালামণি তাইতো তোমার ছবি দেখে কাঁদে।

–তোমার খালামণিকে একটু ডেকে দিবে মা ?

–আচ্ছা,তুমি দাঁড়াও।আমি ডাকছি ।
নিতু দৌঁড়ে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর মিতু আসলো।এসে বললো ,

–ডাকলেন কেন ?

–মেয়েরা এত চাপা স্বভাবের কি করে হতে পারে বলোতো ?

–মানে ?

–বিয়ে করোনি কেন ?

–বিয়ে করেনি কেন সেটা আপনাকে বলতে হবে ?

–ঠিক তা নয়। তবে চাইলে বলতে পারো ।

–আপনি কি এসব বলার জন্য ডেকেছেন ?

–না , কফি খাওয়ার জন্য ডেকেছি।

–কফি !

–হ্যাঁ, কফি ।যাবে আমার সাথে ?

–কিন্তু নিতু ?

–ওকে সাথে নিয়েই চলো।
তারপর দু’জনে নিতুকে সাথে নিয়ে কফি খেতে গেলাম।

–মিতু..
কফি খেতে খেতেই ওর সাথে কথা বলতে লাগলাম ।

–জ্বী ।

–বিয়ে করবে আমাকে ?
এই প্রশ্নটা শোনার পর মিতু কপালের চামড়া কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আর আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছি।

–এটা কেমন প্রশ্ন ?

–না বলোনা।প্রতিজ্ঞা করছি রোজ তোমার সাথে বসে কফি খাবো । তোমার তো আবার কফি ছাড়া হয় না।

–বেশি বেশি !
মিতু লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে উত্তর দিলো।

অতঃপর সেই সাতবছর আগের দেখা পাত্রীর সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেলো। আসলে জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সবই উপরওয়ালার হাতে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত