পরিক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো তরুণিমা।পশ্চিম আকাশে লাল রক্তিম সূর্যটা হেলে পড়েছে।এ সময়টায় গাড়ি পাওয়া ভীষণ কষ্টের ব্যাপার।বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা খালি সিএনজি দেখে থামানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল সে।দু-কদম এগিয়ে অন্য একটা গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে ডান পা টা পেছনে নিলো।কিন্ত পরক্ষণেই বুঝতে পারলো,তার পায়ের ধাক্কায় কেউ একজন হোচট খেয়ে পড়ে গেলো।”সরি”বলে পেছন ফিরে তাকাতেই তরুণিমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো।অর্ক!!
অর্ক নিচ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে অগ্নীদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।তার এ দৃষ্টির সামনে চোখের পলক ফেলবার শক্তিটাও যেন হারিয়ে ফেলেছে তরুণিমা।অর্ক তার দিকে কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে একটা হাত সামান্য উঠিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে চলে গেলো।ভয়ংকর পরিস্থিতির এমন শান্ত সমাধানে তরুণিমা বেশ অবাকই হলো।ছেলেটা যেভাবে তাকিয়েছিল,সে ভেবেছিলো রাস্তার মাঝেই চিৎকার করে ঝগড়া শুরু করবে।অথচ মুহূর্তেই সে অগ্নিদৃষ্টি এমন শান্তরুপে কি করে ফিরে এলো!সে একবার রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অর্কর দিকে তাকালো।অর্ক পলকহীন চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে!
ইউনিভার্সিটিতে অর্ককে সবাই একনামে চেনে।কেবল রাজনীতি করার কারণেই নয়,তার নিজের মধ্যেই কেমন যেন একটা কঠোরতা আছে,যার কারণে সবাই তাকে ভয় পায়।কিন্তু পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা অর্ককে হেঁটে যেতে দেখলে মেয়েরা আড়চোখে তাকানোর লোভটাও সামলাতে পারেনা।সরাসরি তাকানোর সাহস অবশ্য কারোরই হয়ে উঠেনি আজ অব্দি।
সেদিন অনেক কষ্টে কলেজের একটা প্রোগ্রামের ঝামেলা শেষ করে ফিরছিল অর্ক।খালি সিএনজিটা চোখে পড়তেই উঠতে যাচ্ছিলো।তখনই মেয়েটার পায়ের ধাক্কায় হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল।প্রথমে মেজাজটা ভীষণ খারাপ হয়েছিলো তার।ভেবেছিলো মেয়েটাকে বড়রকমের একটা ঝাড়ি দেবে।আগ-পিছ দেখে চলতে শেখেনি এ কেমন মেয়ে?কিন্তু মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হতেই তার সব রাগ যেন উবে গেলো।কি ভয়ংকর সুন্দর চোখ!কি অদ্ভুত গভীর সে চাহনি!
দুপুরের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল।গত দুদিন ধরে মেয়েটা ভার্সিটিতে আসছেনা।অথচ তার সে চাহনি অর্কর দিন-রাত কেবলই তাড়া করে ফিরছে।
আজ জ্যামে পড়ে ক্লাসের দেরি হয়ে গেছে।তরুণিমা ব্যস্ত হয়ে কলেজ গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।তখনই দেখতে পেলো গেটের সামনে অর্ক দাঁড়িয়ে।ভয় পেলেও যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে হাঁটার চেষ্টা করছে সে।
-এই মেয়ে,শোন…
গেটের কাছাকাছি যেতেই অর্ক বললো।
তরুণিমা অনেক কষ্টে নিজের ভয়টা গোপন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্কর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো।অর্কর চোখের দিকে তাকালে ভীষণ ভয় হয় তার।কেমন একটা কঠোরতা আছে।
-তোমার নামটা কি?
-তরুণিমা।
-তুমি কোন ইয়ারে পড়ছো?
-জ্বি,অনার্স ৪র্থ বর্ষে।
-কোন ডিপার্টমেন্ট?
তরুণিমা নিজের রাগটা কোনমতে সামলে বললো,
-সবকিছু আপনাকে বলতেই হবে কেন?সেদিন ভুলবসত আপনাকে রাস্তার মাঝে ফেলে দিয়েছিলাম।আর তার শাস্তিস্বরূপ আমাকে আপনার সব কথার উত্তর দিতে হবে!
অর্ক কিছুটা রেগেই বললো,
-সবকিছুকে এমন খারাপ ভাবে দেখবে না।
-আমি খারাপভাবে দেখছি কে বললো?
-তাহলে বল।
-বাংলা ডিপার্টমেন্ট।
বলেই দ্রুত পায়ে কলেজ ক্যাম্পাসে চলে এলো তরুণিমা।
অর্ক হতবুদ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
এরপর থেকে অর্ক আর তরুণিমার সামনে এসে কথা বলেনি।তবে দূর থেকে তাকে দেখার ইচ্ছেটাকে সামলাতে পারেনা।মেয়েটার প্রতি তার ভালোলাগা যতই বাড়ছে,মুখোমুখি হওয়া যেন ততোই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।অর্ক বুঝতে পারে,সে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…..এক অদ্ভুত মায়ায়….
তরুণিমা প্রথম প্রথম অর্ককে ভয় পেলেও সে ভয়টা তার কেটে গেছে অনেক আগেই।বরং একটু ভালোই লাগে যেন।
এভাবে চলতে থাকে কয়েক মাস।প্রায়ই দেখা হয় তাদের দুজনার,কিন্তু কথা হয়না কখনোই।সময়ের সাথে সাথে তরুণিমার প্রতি অর্কর ভালোবাসার গভীরতাও যেন বাড়তে থাকে।অথচ সে ভালোবাসা প্রকাশ করার সাহসটা সে যেন কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।অর্ক প্রায়ই ভাবে আজ যে করেই হোক তরুণিমাকে তার ভালোবাসার কথা বলবে।কিন্তু হয়ে উঠেনা।কোনো এক অজানা কারণে তরুণিমার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে।ভয়টা কিসের?জানেনা সে।
তরুণিমাকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে পথ আগলে দাঁড়ায় অর্ক।আজ যে করেই হোক বলবে সে।
-একটু শুনবে?
তরুণিমা অর্কর দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়।অর্ক তার সামনে এসে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলতে থাকে,
-আমি জানি তুমি বিরক্ত হও,জানিনা.হয়তোবা বিরক্তই হও…….ধূর।
অর্ক পথ থেকে সরে দাঁড়ালো।কি যা-তা বলছে সে?হুট করে বিরক্তর কথায়ই বা কোথেকে এলো?সে তো এটা বলতেই চায়নি।
তরুণিমা একবার তীক্ষ্ণচোখে অর্কর দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।কিন্তু অর্কর চোখের আড়াল হতেই আপনমনে হাসতে লাগলো।সারাটা পথ মনটায় কেমন যেন একটা ভালোলাগা কাজ করছে।
-কি করিস?আসবো?
তরুণিমা চমকে দরজার দিকে তাকায়।প্রয়োজন ছাড়া বড় ভাইয়ার সাথে খুব একটা কথা হয়না তার।আর হলেও তা মায়ের রুমে।আজ হঠাৎ নিজের রুমে আসাতে অবাকই হলো।
-এসো ভাইয়া।তেমন কিছুনা।পড়ছিলাম।
-পরিক্ষা কবে?
-সামনের সপ্তাহেই।
-আচ্ছা।
-কিছু বলবে,ভাইয়া?
-তরু,সুদীপ্তর বাবা-মা কালকেই আসতে চায়।ওরা চাচ্ছে তোর পরিক্ষার পরই বিয়ের কাজটা শেষ করতে।বাবা আমাকে বললেন তোর মতামত জানার জন্য।
তরুণিমা কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলো।তারপর বললো,
-কখনো বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়েছি,ভাইয়া?এবারও হবেনা।
-আমি জানতাম তুই এমনটাই বলবি।জানিস তরু,বাবা-মা দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে সুদীপ্তকে।ওদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাসও খুব ভালো।সবাই খুব ভালোবাসবে তোকে,দেখিস।আসিরে।অনেক রাত হয়েছে।ঘুমিয়ে পড়।
তরুণিমা বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে নিজেই চমকে উঠলো সে।এ দীর্ঘশ্বাস কিসের জন্য!
আজ পরিক্ষার শেষদিন।পরিক্ষা শেষে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল সে।পেছন থেকে কেউ একজন ডাকলো,
-তরু..
তরুণিমা বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো যেন।এ কন্ঠ তার অচেনা নয়!কিন্তু পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হলোনা।সে বরাবরই অর্ককে ভয় পায়।কিন্ত কেন?অর্কর প্রতি দুর্বলতার কারণে?
অর্ক সামনে এসে দাঁড়ালো,
-বিয়ের কথাটা কি সত্যি,তরু??
তরুণিমা চমকে অর্কের দিকে তাকালো।
-হ্যাঁ,সত্যিই।
অর্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরুণিমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
-পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
-চলে যেতে চাইছো কেন,তরু?আজই তো শেষ!কখনো তো আর এভাবে কথা বলার সুযোগ হবেনা।আজ না হয় আমার মনের কথাটা শুনে যাও।ক্ষতিতো কিছু নেই।
-সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,আমাকে যেতে হবে।
তরুণিমা কঠিন গলায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করলেও সম্ভবত অর্কর কাছে তা কঠিন মনে হয়নি।সে নির্দ্বিধায় বলতে লাগলো,
-কখনো কোনো মেয়ের সাথে নিজ থেকে কথা বলা তো দুরের কথা,দ্বিতীয়বার ফিরে তাকানোর ইচ্ছেটাও হয়নি।কিন্তু,তুমি তরুণিমা…..জানিনা,কি অদ্ভুত ক্ষমতা তোমার চোখে!যে চোখ ক্ষণিকের চাহনিতে এতদিনকার সাজানো আমিকে এলোমেলো করে দিলো।এই আমার অস্তিত্বে আমার চেয়ে তোমার জায়গাটা যে অনেক অনেক বেশি!
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগলো অর্ক,
-আমি কখনোই ভীতু নই,তরু..কিন্তু তোমার কাছে এলে সব সাহস যেন হারিয়ে ফেলতাম।তাই অনেকবার বলতে চেয়েও আর বলা হয়ে উঠেনি।এ কয়েকদিন মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে করেই হোক তোমাকে আমার অনুভূতির কথা বলবো।কিন্ত গতপরশুই তোমার বিয়ের কথাটা জানলাম।এ দুটোদিন আমার কেমন কেটেছে সে শুধু আমিই জানি,তরু।
অর্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলো,
-কেন তরু??কেন সেদিন তোমার সাথেই হোচট খেলাম!কেন তোমার চোখে চোখ রাখলাম!তাহলে হয়তো আজ এমন নিঃসঙ্গ মনে হতো না নিজেকে।কি ভাগ্য আমার!তোমাকে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেললাম!!
তরুণিমার চোখজোড়া বারবার ভিজে আসছে।সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সংযত রাখার।যা কখনো হবেনা তা নিয়ে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করাটাও লজ্জার।
-আমাকে এবার যেতে হবে।
-এতটা কঠিন কেন তুমি?সত্যি করে বলবে তরু?কখনো ভালোবাসো নি আমায়।এক মুহূর্তের জন্য হলেও?
ধরা গলায় কথাগুলো বললো অর্ক।তরুণিমা কোন কথা না বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল।হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে অর্ক বললো,
-কিছুই তো হলোনা তরু,অন্তত এ গোলাপটা নাও।
পকেট থেকে একটা জীর্ণ গোলাপ বের করে তরুণিমার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।
-প্রথম যেদিন তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলাম,সেদিনের কেনা।
-আপনি নিশ্চয় জানেন,এটা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
-এতোটাও ভালো হওয়া ঠিকনা,তরুনীমা।জানি,কোন ছেলের কাছ থেকে উপহার নেওয়া তোমার স্বভাববিরুদ্ধ।কোন মেয়ের সাথে কথা বলাটাও কিন্তু আমার স্বভাববিরুদ্ধ।অথচ,কোন ভবিষ্যৎ নেই জেনেও তোমাকে ভালোবাসার কথাটা বললাম।আর তুমি…
-অনেক বাড়াবাড়ির সুযোগ দিয়েছি।সরে দাঁড়ান।
অর্কর এবার সত্যি সত্যিই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।একটা ফুলই তো।এটা নিতেও এত দ্বিধা!তার ভালোবাসার কোনো মূল্যই নেই!!
সে বরফ-শীতল গলায় বললো,
-ফুলটা নিতে বলেছি,তরু…।
তরুণিমা হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে তার মামাকে এগিয়ে আসতে দেখলো।মামা যদি এ অবস্থায় দেখে বেশ ঝামেলা হবে।এদিকে অর্কও পথ ছাড়ছেনা।সে অর্কর দিকে অগ্নীদৃষ্টিতে তাকিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া ফুলটা প্রায় মুচড়ে দলা পাকিয়ে হাতে নিলো।অর্ক ম্লান হেসে পথ ছেড়ে দিলো।
সিএনজিটা খানিকটা এগুনোর পর পেছনে তাকালো তরুণিমা।অর্ক কেমন অদ্ভুত চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে!!তরুণিমা নিজের অবাধ্য অশ্রুগুলোকে আর কিছুতেই থামাতে পারলোনা।।
বাসায় পৌঁছাতেই নিরুপমা দৌঁড়ে এলো,
-তরু এসছিস?দেরি হলো যে?
-এই তো দিদি।গাড়ি পাচ্ছিলাম না।
তরুণিমা ম্লান হেসে বললো।
-ভাইয়া আর ভাবি আসছে জানিস?আমরা সবাই এয়ারপোর্টে তাদের রিসিভ করতে যাবো।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
-আমার মাথাটা ধরে আছে দিদি।তোরা যা।আমি মায়ের সাথে বাড়িতে থাকি।
পুরো বাড়িটা সাজানো প্রায় শেষ।সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।নিচ থেকে বাচ্চাদের হৈ চৈ শব্দ আসছে।সবার ছোট হওয়ায় তার বিয়ের আয়োজনটাও বেশ বড়।প্রায় সব আত্মীয়দের দাওয়াত করা হয়েছে।
তরুণিমা তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।তারপর ব্যাগ থেকে অর্কর দেওয়া জীর্ণ গোলাপটা বের করে হাতে নিলো।পরিবারের ছোট মেয়ে বলে ছোটবেলা থেকে সবার বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসায় বড় হয়েছে সে।সে কখনো পরিবারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধতা করেনি,করবেওনা।হ্যাঁ,অর্ককে সে ভালোবাসে।অনেক বেশিই ভালোবাসে।কিন্তু তাই বলে পরিবারের মানুষগুলোর কাছ থেকে আজন্ম পাওয়া ভালোবাসাগুলোর অমর্যাদা করার শক্তি তার নেই।
-ক্ষমা করো অর্ক….
আমার এ জনম হয়তো তোমার জন্য নয়।যদি পারো,ভূলে যেও আমায়।
আপনমনে কথাগুলো বলে তরুণিমা হাতের ফুলটা ডায়রিতে রেখে ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
ইস….অর্ক যদি জানতো,তার জীর্ণ গোলাপ কত যত্নে ঠাঁই পেল তরুণিমার ডাইরির পাতায়!