ফোনটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম! এতো বার ফোন দিছে আমাকে,তাও আবার আননো নং থেকে।। ব্যাপার টা বেশ কৌতুহল জাগালো আমার ভিতরে। আমাকে তো সিম কোম্পানি ছাড়া আর কেও ফোন দেয় না,তো আজকে আবার কোন স্বহৃদয়বান ব্যক্তির আমাকে মনে হলো যে এতো বার ফোন দিছে।।
সাত পাঁচ না ভেবে ফোন ব্যাক করলাম,জানার জন্য কে এই হৃদয়বান ব্যক্তি। ওপাশে ফোনে রিং বেজে চলেছে কিন্তু কেও রিসিভ করছে না।। ধুর কে না কে মনে হয় ভুলে ফোন দিয়ে ফেলেছে।।ফোনটা রেখে বাথরুমে গেলাম। এসে দেখি আবার ১০ বারেরও বেশি ফোন দিছে এই টুকু সময়ের ভিতরে। এবার একটু রেগেমেগে ফোন ব্যাক করলাম। কিন্তু না ওপাশ এ ফোন রিং বেজে চলেছে কিন্তু রিসিভ করছে না।। এবার রাগের পরিমানটা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আজব তো ফোন দিচ্ছে অথচ রিসিভ করে না। ৫মিনিট পর দেখি আবার নং টা থেকে ফোন এসেছে,,, একবার রিং বাঁজতেই রিসিভ করলাম। কিন্তু রিসিভ করার সাথে সাথেই সব রাগ নিমিষেই হারিয়ে গেলো। দেখি ফোনের ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলছে,
:-আপনি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন।
:-কে আপনি,,আর আমাকে কেন হাসপাতালে আসতে বলছেন?
:-আমি কিছু জানি না,আপনি একটু হাসপাতালে আসেন,,,তারপর হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে ফোন টা কেটে দিলো।
আজব তো চিনি না জানি না হুট করে বলে হাসপাতালে আসতে,,কি আর করার বিষয় টা ক্ষতিয়ে দেখার জন্য হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্য রওনা দিলাম। কিন্তু কে আমাকে ডেকে আনলো,তাকেও তো চিনি না তবুও ঢুকে পড়ে হাটা শুরু করে দিলাম। এমন সময় আমাকে দেখে একটা অল্প বয়সি মেয়ে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
:-আপনি এসেছেন?
বলে আমার হাতটা ধরে নিয়ে গেলো,এবং একটু পরে দেখি ডাঃ আমার শরির থেকে রক্ত নেওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, রক্ত দিতে দিতে নার্স এর কাছ থেকে জানতে পারলাম। একজন রোগির জন্য রক্ত লাগবে। তো এতো মানুষ থাকতে আমাকেই কেন ডেকে আনলো,রক্ত দেওয়ার জন্য আর মেয়েটা কে আর কাকেই বা রক্ত দেওয়া হচ্ছে আমার থেকে নিয়ে। রক্ত নেওয়া শেষ হলে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার হাঁটতে শুরু করলাম। শরির টা দুর্বল লাগছে,তাই আসতে আসতে হাটছি। এমন সময় কেও একজন আমাকে পিছন থেকে ডাক দিলো।
:-এই যে শুনেন একটু। তাকিয়ে দেখি মেয়েটি,তাই দাড়ালাম।।
:-আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এক ব্যাগ রক্ত বার করে নিয়ে শুধু শুকনো ধন্যবাদ দিতে এসেছে,,,(বিড়বিড় করে বললাম)
:-আচ্ছা কিছু প্রশ্ন না করেও পারছি না,,আপনি কে,আমার নং কোথায় পেলেন আর এতো মানুষ থাকতে আমাকেই কেন ডাকলেন? মেয়েটি আমার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর বললো।
:-আমিও আপনাকে চিনি না,আর নং টা পেয়েছি একটা ভাইয়ার কাছ থেকে।।যখন আমার বাবার গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন অনেক খোঁজাখোঁজির পর এক ভাইয়া আপনার নং টা দিছিলো।। সেই জন্য ফোন করেছিলাম।
:-আপনি এখানে একা কেন,আর কেও নাই মানে পরিবারের আর কেও আসে নি।
:-না,আমি আর আমার বাবা ছাড়া আর কেও নাই। মেয়েটার সাথে কথা বলছিলাম এমন সময় ডাঃ বার হলো,,,
:-ডাঃ আমার আব্বু কেমন আছে? মেয়েটার কথার উত্তর দিতে গিয়ে ডাঃ মুখটা কাচোমাচু করে মাথা নিচু করে বললো..
:-দুঃখিত,আমরা তোমার বাবাকে বাঁচাতে পারি নাই।
ডাঃ এর কথা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষন নিরব হয়ে দাড়িয়ে রইলো,তারপর এক দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমিও পিছুপিছু গেলাম। কিন্তু এমন অবস্থাতেই কিভাবে শান্তনা দিবো সেটা আমার এই মুহুর্তে অজানা। শুধু মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটি খুব চিৎকার করে কাঁদছিলো,,,আর বলছিলো বাবা আমার যে আর কেও রইলো না,কে আমাকে দেখবে আমি যে একদম অসহায় হয়ে গেলাম। মেয়েটির কথা গুলো আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে উঠলো,,, এই বয়সে এই মেয়েটির একটা মানুষের প্রয়োজন না হলে মেয়েটির যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। কারন মেয়েটি এখন অবিবাহিতা আর সম্পুর্ন একা। কিন্তু আমি কি করবো,কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
মেয়েটিকে নিজের সাধ্যমতন বুঝানোর চেষ্টা করলাম,,তারপর তার বাবার দাফন কার্য শেষ করার পর আরো চিন্তাতে পড়ে গেলাম। এখন এই অবস্থাতে একাকি কিভাবে রেখে যাবো মেয়েটিকে।। আর আমারও সাহস নাই যে মেয়েটিকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো নিয়ে গেলে বাবা-মা হাজার প্রশ্ন করবে। মেয়েটির একটা বান্ধবি কে বললাম,তাকে যেন দেখে রাখে কখনো যেন একা না রাখে। বলেই বিদায়ে নিয়ে চলে আসলাম। কিন্তু বাসায় এসে শান্তি পাচ্ছিলাম না,বার বার মেয়েটির অসহায় মুখটা আর তার বলা কথা গুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। খুব সকালে বার হয়ে গেলাম মেয়েটিকে দেখার জন্য,,,দেখি মন খারাপ করে বসে আছে মাথার চুল গুলোও কেমন যানি এলোমেলো। আমার সাধ্যমতন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু তার একটাই কথা তাকে এখন কে দেখে রাখবে।
কি বলবো কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না,হুট করেই বলে বসলাম আজ থেকে তোমার দায়িত্ব আমার। তোমার সব কিছুর দায়িত্ব আমি নিবো। কথা গুলো বলে মেয়েটির দিকে তাকালাম দেখি মেয়েটির চোখ দুটি জ্বলে ভরে গেছে। অনেক বুঝিয়ে তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম সাথে আমিও খেয়ে নিলাম। ওহ্ আমাদের তো এখন ও নাম ই বলা হয় নি মেয়েটির নাম রিমি আর আমি রিফাত।সেদিন এর পর থেকে রিমির সব দায়িত্ব আমি নিলাম। যেখানে আমি নিজের দায়িত্বহীনতার জন্য রোজ বাবা-মা য়ের কাছ থেকে বকা খেতাম সেই আমি কিনা আজ একজনের দায়িত্ব নিয়ে চলেছি। রিমি লেখাপড়াতে ভালো ছিলো তাই তার লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। রিমি খুব ভালো আর শান্ত-শিষ্ট একটা মেয়ে আমার সব কথা শুনতো আর আমাকে খুব বিশ্বাস ও করতো।
আর আমিও কখনো তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই। আজ দুই টা বছর রিমি কে আমি দেখছি,,,সত্যি মেয়েটা অসম্ভব ভালো,,,আর এই দু’বছরের ভিতরে কখন যে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি নিজেও জানি না। তবে কখনো সাহস করে বলতে পারি নাই। আমার থেকে রিমি দু বছরের ছোট, ,, তাই আমার দু’জনে খুব ভালো বন্ধু ছিলাম,,আর ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর আপন বলতে শুধু আমিই ছিলাম। অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে আমার,, বাবা-মা চাচ্ছে এখন আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি অফিসের দিকটাও দেখি। কিন্তু অফিসে বসলে রিমির খেয়াল রাখবো কখন।। মেয়েটা বড্ড জেদি আমি ছাড়া কিচ্ছু করতে চাই না। সে দিন রিমির সাথে শপিং করে ফিরছিলাম হঠাৎ বাবা আমাদের কে দেখে নেই। রাতে যখন বাসায় ফিরলাম, বাবা ডাক দিলো
:-রিফাত শোনো?
:-জ্বি বাবা…
:-মেয়েটা কে ছিলো?
:-কোন মেয়েটা বাবা।
:-যে মেয়েটার সাথে আজকে শপিং করতে গেছিলে।
বাবার কথা শুনে আমতা আমতা করার পর,, বাবা-মা দু’জনেই চাপে পড়ে সব সত্যি কথা বলে দিলাম। আমার কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই মুচকি হেসে দিলো। তাদের দুজনের হাসি দেখে তো আমি অবাক যেখানে আমাকে বকা দেওয়ার কথা সেখানে তা না করে তারা হাসছে কিছুক্ষন পর মা বলে উঠলো,, রিফাত কালকে মেয়েটাকে নিয়ে আসিস তো।
:-কেন মা।
:-কেন মানে নিয়ে আসতে বলছি নিয়ে আসবি।
আল্লাহ ভালো যানে কি বলবে রিমি কে,,তবুও মা বলেছে যখন নিয়ে তো যেতেই হবে। রিমিকে বললাম,বাবা-মায়ের কথা। রিমি ১ম এ ভয় পেলেও শেষমেশ রাজি হয়ে গেলো। রিমিকে নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়,দু তিন বছরের ভিতরে এই ১ম বার রিমি কে আমাদের বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। রিমিও বেশ নার্ভাস,, রিমিকে নিয়ে গিয়ে বসতে বললাম,
:-তুমি বসো আমি মা কে ডেকে আনছি। একটু পরে মা আসলো,,মা কে দেখে রিমি সালাম দিলো। মা আর রিমি পাশাপাশি বসলো,, তারপর কথা বলতে লাগলো। কি ভাবে আমাদের পরিচয় আরো কত কিছু। অনেক্ষন পর মা এসে আমার কান চেপে ধরে বললো,,
:-আমার শয়তান ছেলেটা এতো বড় কবে হয়ে গেছে তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।।যে ছেলেকে এখনো আমি না খাওয়ায় দিলে খাই না সেই ছেলে একটা মেয়েকে এতো দিন ধরে বুকের ভিতরে আগলে রেখেছে। রিমি মা,,তোমাকে একটা কথা বলবো :-হ্যা আন্টি বলেন?
:-আমি আন্টি থেকে মা হতে চাই তোমার,,,এই শয়তান ছেলেটার দায়িত্ব নিবে তুমি। মায়ের কথা শুনে রিমি লজ্জা পেলো,আর সাথে আমিও।
:-তোমাকে আর একা একা থাকতে হবে না খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো।
তুমি আমার এই ফাজিল ছেলেটার বউ হবে। মা’য়ের কথা শুনে রিমির গালগুলো লজ্জাতে লাল হয়ে গেলো মাথা নিচু করে হ্যা দিলো। খুশিতে আমার লুঙ্গি ড্যান্স দিতে মন চাইছে,তার মানে রিমিও আমাকে এতোদিন ভালোবেসে এসেছে। ধুমধাম করে রিমির আর আমার বিয়ের কাজ সম্পর্ন হলো। আজ আমাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত (বাসর রাত) আর আজকে আমি রিমিকে প্রপোজ করবো,সবাই তো বিয়ের আগে প্রপোজ করে প্রেম করে তারপর বিয়ে করে। কিন্তু আমার টা সম্পর্ন টা আলাদা। আমি বিয়ের পর নিজের বউ কে প্রপোজ করবো আর সারাজীবন ভালোবাসবো। একটা গোলাম হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলাম।।দেখি রিমি মস্তবড় একটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। লাল বেনারসিতে রিমিকে আজকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রিমির কাছে গিয়ে ঘোমটা টা সরিয়ে দিলাম,,,
:-উফপপ আমার বউ টা এতো সুন্দর।
:-কেন আগে বুঝি অসুন্দর ছিলাম।
:-তা নই,তবে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে। পিছনে থাকা গোলাপ টা হাতে নিয়ে রিমিকে প্রপোজ করলাম। রিমি শুধু মুচকি মুচকি হাসছে।
:-রিমি আজকের এই মধুময় রাতে তুমি আমার থেকে কি চাও বলো,,তুমি যা চাইবে তাই দিবো।
:-যা চাইবো তাই দিবে।
:-হুম,,দিবো।
:-সারাজীবন তোমাকে আমার পাশে পেতে চাই।
:-এটা তো পাবেই আর কিছু চাও না।
:-না চাইতেই তো সব পেয়েছি,,বাবা মারা যাওয়ার পরর
যখন অসহায় হয়ে পড়েছিলাম তখন তুমি এসে আমার নিস্বংঙ্গতা দুর করেছিলে। কখনো বুঝতে দাও নি আমি একা। আজ আবার বাবা-মা পরিবার সব হারিয়েও নতুন করে বাবা- মা আর এমন একটা মানুষ কে পেয়েছি যে আমাকে খুব ভালোবাসে। নিড় হারা পাখির মতন হয়ে যখন গন্তব্যহীন আকাশে উড়ছিলাম কোনো ঠিকানা ছিলো না তখন তোমাকে পেয়ে আবার নতুন করে ভালোবাসার নীড় খুজে পেয়েছি।। এটাই আমার মস্ত পাওয়া তাকিয়ে দেখি রিমির চোখে জ্বল এ ছলছল করছে,,,
:-এই পাগলি আজকের দিনে কেও কাঁদে হুমম।
:-আমি আজকে পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ যে তোমার মতন একজন জীবন সংঙ্গি পেয়েছি।
:-হুম আমিও অনেক খুশি যাকে এতোদিন মনে মনে ভালোবাসতাম তাকে পেয়েছি। রিমি আমাকে জড়িয়ে ধরলো,,,
:-কখনো ছেড়ে যাবে না তো।
:-কখনো না,,সারাজীবন তোমার পাশেই থাকবো আর তোমাকেই ভালোবাসবো অতঃপর আমাদের নতুন জীবনের সুচনা ঘটালাম দু’জনে।