তনু স্কুল থেকে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল।ভীষন ক্লান্ত সে। যেন একপাও এদিক সেদিক নড়তে পারছে না।যেন সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া কোন নবজাতক যে কিনা এখনও হাঁটতে শিখে নি। দুচোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকল ও।তনুর মা এসে তনুকে এ অবস্থায় দেখে কিছুটা ভড়কে গেলেন।বললেন, কি রে।
এই অবেলায় শুয়ে রইলই যে?স্কুল থেকে এসে কি মানুষ শুয়ে থাকে নাকি হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে? তনু আস্তে আস্তে করে বলল,ভীষন ক্লান্ত লাগছে মা।শরিরটা ভালো লাগছে না। তা তো হবেই।ক্লান্তি তো আসবেই।সকালে যে এত করে বললাম দুইটা রুটি খেয়ে যা তখন খেলি? একটা রুটিও তো পুরো খেলি না।ক্লান্তি কি এমনে এমনে আসে?উঠ দেখি।মা ভাত বেড়ে দিচ্ছি।খেয়ে নে।তোকে কত করে বললাম ঠিক মত খাওয়া দাওয়া কর।না হয় অসুস্থ হয়ে পড়বি।না! তুই শুনিস না।তোর জ্বালায় আর বাঁচি না।নে খেয়ে নে! উঠ! তনু আস্তে আস্তে উঠল। টিউবওয়েল এর পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসল।তনুকে যতটা ক্লান্তি দেখাচ্ছে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে। ওর মা এই জিনিসটা ঠিক ধরতে পারেন নি।পারলে একেবারে ধরে বসতেন।শেষমেশ শুনেই ছাড়তেন। তনু হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসল।জামাকাপড়ও চেঞ্জ করে নি।এই অবস্থায় বসে গেল।অন্য দিনের মত তনু খুব তাড়াতাড়ি খাচ্ছে না। আস্তে আস্তে খাচ্ছে।কি যেন ভাবছে। আনমনা হয়ে আছে। মরিয়ম বেগম মেয়ের এই ব্যাপারটা ঠিকই লক্ষ্য করলেন।কিন্তু কিছুই বললেন না। কেবল চেয়ে রইলেন।এই বয়সে নানান টেনশনে থাকতে হয়ে মেয়েদের।
তনু, তনুর বাবা জামিল মিঞা ও তনুর ভাই মহি রাতের খাবার খেতে বসেছে।মরিয়ম বেগম ভাত বেড়ে দিচ্ছেন।মহিকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে।ও কিছু একটা বলতে চায়।কিন্তু ভয়ে বলতে পারছে না।তবুও মুখ ফুটে বলল।যে কথাটা বাবাকে বলা প্রয়োজন সে কথাটা মাকে বলল।মহি ওর বাবাকে ভীষন ভয় পায়। রাগ মাথায় ছড়ে গেলেই হয়েছে।পুরো ঘরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।বিশেষ করে যখন টাকার কথা বলা হয় তখন।মহি ওর মাকে বলল, মা! আমার কিছু বই কিনতে হবে। মরিয়ম বেগম ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন, তো কিনবিই না।মানা করছে কে? টাকার প্রয়োজন। আমি কি টাকা আয় করি নাকি।আমাকে বলছিস কেন? তোর বাপকে বল। মরিয়ম বেগম ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে তার ছেলে কথা গুলো ঠিক উনাকে বলছে না।ওর বাবাকে শুনাচ্ছে।যাতে করে উনি টাকাটা দেয়। মহি ওর বাবাকে বলতে যাবে ঠিক তার আগেই তনু বলে উঠল, বাবা আমারও কিছু টাকা লাগবে।কয়েকদিন পর টেষ্ট এক্সাম।বইকিনতে হবে। তনু আবার এসব ভয় পায় না।সোজাসাপটা কথা বলে ও।ভীষন রাগ ওর।ওর রাগের কাছে ওর বাবাকেও হার মানতে হয়। অবশ্য এ কারনে তনুর বাবা তনুকে খুব ভালোবাসে।
তনুকে ওর বাবা বেশি ভালোবাসে।তাই ওর সকল আবদার তিনি পূরন করেন।আর মহিকে ওর মা ভালোবাসে।মহির তেমন আবদার থাকে না।মায়ের ভালোবাসা পেলেই কারো আর কোন আবদার থাকে না।মহিকে ওর বাবাও ভালোবাসে।তবে খুব কম।তনু হতে অনেক কম। তেমনি তনুও ওর মায়ের আদর কম পায়।আবার তনু ও মহি দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসে।সারাদিন জগড়া, দুষ্টামির মাঝেই কাটে।কেউ কোথাও গিয়ে বেশি দিন বেড়াতে পারে না। বিশেষ করে মহি।মহি কোথাও গেলেই তনুর ফোন এসে হাজির হয়ে যায়।ফোনে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় তনু।তাই বাধ্য হয়ে মহিকে চলে আসতে হয় তাড়াতাড়ি। এই হল এদের ভালোবাসা।এর বাইরে তনুকে ওর বড় ভাই আর মেজো ভাইও আদর করে।ভীষন আদর করে।আর ওর বড় বোন আদর করে মহিকে।মহি অবশ্য কিছু মনে করে না। কারন মহিও নিজের ছোট বোনকে খুব ভালোবাসে। তনুর এ কথা শুনে মহি বলে উঠল, :মা! দেখেছ। যখনই আমি চাইলাম টাকা।অমনি ওর প্রয়োজন টাকার প্রয়োজন হয়ে গেল।আমি চাইতেই তোকে কেন চাইতে হবে বলত। তনু বলল, তুই চাইতে মানে? আমার এখন মনে পড়েছে তাই এখন বলেছি। তুই বলাতে বলি নি।
আমি বলতেই কেন? বলেছি না তুই বলাতে বলি নি।আমার এখন মনে পড়েছে তাইবললাম। পাশ থেকে মহির মা বলে উঠল, আহ্ঃ! থামবি তোরা! কি শুরু করলি এসব।খেতে বসেছিস খা। জামিল মিঞা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,কত টাকা লাগবেরে মা! আপাতত এক হাজার টাকা হলেই হবে। তোর কত লাগবেরে মহি! আমার দু হাজার টাকা হলেই হবে। জামিল মিঞাকে একটু চিন্তিত দেখাল।বললেন মাসের মাঝে এত টাকা পাই কই।দেনা শোধ করতে করতেই তো বেতনের টাকা গুলো শেষ হয়ে গেল।এই বলে তিনি খেতে লাগলেন।তিনি আসলেই চিন্তিত! সবাই শান্ত। কেউ কথা বলছে না।নিজের মত করে খাচ্ছে।মহি একটু অবাক হল।আজ তনু একটু দুষ্টামিও করে নি।একটু হাসি ঠাট্টাও করে নি।আজ ক্লাসে এই হয়েছে,ওই হয়েছে,অমুক মেয়ে মার খেয়েছে এসব কিছুই আজ তনু বলে নি।চুপচাপ খেতে লাগল। মহি সত্যিই খুব অবাক হল।
জামিল মিঞা অফিসে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।খুব তাড়া উনার। মহিও তৈরি হচ্ছে। তনু রুটি বানিয়ে দিচ্ছে। ওর মা রুটি গুলো ছেঁকে দিচ্ছেন।তিনিও খুব ব্যস্ত।যে করেই হোক উনাকে তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাতে হবে।তা না হলে জামিল মিঞা না খেয়েই চলে যাবে।এটা জামিল মিঞার অভ্যাস। নাস্তা তৈরি হতে একটু দেরি হলেই কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে এবং চেঁচামেচি করে না খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্য চলে যান।তাই দিনের এই সময়ে মরিয়ম বেগমকে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকতে হয়। জামিল মিঞা নাস্তা শেষ করে খাটের উপর তিন হাজার টাকা রাখলেন।যাওয়ার সময় বলে গেলেন মহি এবং তনু কে। খাটের উপর টাকা রাখা আছে। নিয়ে নিস তোরা! এই বলে তিনি চলে গেলেন।তিনি একজন সরকারি অফিসের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী ।মরিয়ম বেগম বড়সড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মহি নাস্তা করে কলেজে চলে গেল। সে এবার ইন্টার ২য়য় বর্ষে। তারপর তনু বিদায় নিল।ও দশম শ্রেনিতে। বাকি রইল মরিয়ম বেগম।তিনি এখন একাই সব কাজ করবেন।বেশির ভাগ সময় একা একাই কাটে উনার।এমন কেউ নেই যে যার সাথে বসে বসে কথা বলবে।কথা বলতে বলতে কাজ করবে।
তনু তুই কি এটা ঠিক করেছিস? স্কুল থেকে ফিরার সময় তনুর বন্ধু মিরা কথাটা বলল।তনু খুশি খুশি হয়ে বলল, যা করেছি ভালোই করেছি।তুই বল! ছেলেটা আজ এক বছর ধরে আমার পিছনে পড়ে আছে, তারউপর পাঁচ পাঁচ বার আমার জন্যে নিজের হাত কেটেছে।তাহলে তুইই বল সে কি একটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নয়।বল! যোগ্য নয়। যোগ্য বড় কথা না।তোর পরিবার হচ্ছে বড় কথা।তুই কি একবারেও তাদের কথা ভাববি না।আর তোদের ফেমিলির সাথে ওর ফেমেলির ম্যাচ হবে? তার উপর তোরা উচ্চ বংশীয়। তোর বাবা এটা মেনে নিবেন না।যেখানে ছেলে জুতার দোকান দেয়। বংশ মর্যাদা দিয়ে কি ধুয়ে খাব।আমাদের উচ্চ বংশ হওয়ায় কেউ কিআমাদের দু টাকা দেয়।সেই তো ডাল ভাত খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু তোরা তো সেই মর্যাদা পাস।দেখিস না তোদের বাড়ির নাম শুনলেই সবাই কেমন যেন চমকে উঠে।বিপদে এগিয়ে আসে।
নিকুচি মারি এসবের।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে কিসের বংশ মর্যাদা। আর সে জুতার দোকানদার হওয়া কি তাকে ভালোবাসা জায়েজ নেই? আমি সেটা বলি নি।তবে তোর সাথে ওর কিছুতেই যায়।আর এইবয়সে প্রেম, তাও আবার গ্রামে,যেখানে কুকুর ভক্তি মানুষ রুপি কুকুর থাকে সেই সমাজে তুই কিভাবে ওর সাথে প্রেম করবি? ভেবে দেখ! একবার জানাজানি হয়ে গেলে যে কি হবে সেটা তুই ভালোই জানিস। দেখ! বেশি কথা বলবি না।জ্ঞান দেওয়া আমি একদম পছন্দ করি না। আমি যা করেছি ভালোই করেছি।তোকে বলতে হবে না। এই বলে তনু হন হন করে চলে গেল।মিরা দাঁড়িয়ে আছে।ওকে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে।আর যাই হোক।তনু কাজটা একদমই ঠিক করে নি। কি রে কোথায় গিয়েছিস? মহি কড়া দৃষ্টিতে তনুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। তনু আমতা আমতা করতে বলল, ওই যে মিনুদের ঘরে। মহির মেজাজটা গরম হয়ে গেল।মহি মিথ্যা বলটা একদমই পছন্দ করে না।ঠাশ করে তনুকে একটা চড় লাগিয়ে দিল।বলল, তুই আমাকে মিথ্যা বলছিস! আমাকে?
তনু কিছু বলল না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।মহি আবার বলল, তুই কিভাবে পারলি এটা।তুই আমাদের মানসন্মান এর কথা একবারেও ভাবলি না।এতটা নিচু তুই কিভাবে হলি।তাও আবার কোন জুতার দোকানদারের সাথে।তোর লজ্জা হওয়া উচিৎ। বেয়াদব।দাঁড়া মাকে বলছি।আজ প্লিজ ভাইয়া মাকে বলিস না।মা জানলে অনেক বড় সমস্যা হবে। প্লিজ ভাইয়া মাকে বলিস না।প্লিজ। বোনের চোখে পানি দেখে একটু মায়া হল ওর।তাই বলল, :ঠিক আছে।আমি মাকে বলব না।তবে তোকে ওই ছেলেকে ভুলে যেতে হবে।তোকে যেন ওর সাথে আর না দেখি। আজ যদি আমার যায়গায় তোকে অন্য কেউ দেখতে ওই ছেলের সাথে তাও আবার বাগানে তাহলে কি হত বল তো।বাবার মানসন্মান থাকত! প্লিজ ভাইয়া! আমাকে ক্ষমা করে দে।এই কসম দিয়ে বললাম আমি আর কখনই এমন কিছু বলব না।তবে প্লিজ ভাইয়া মাকে বা বাবাকে কিছু বলিস না। আচ্ছা যা।তবে খেয়াল রাখিস। আর একবার দেখি।দেখলেই তোর খবর করে ছাড়ব।
আসলে সকালে মহি পুকুর পাড়ে এসেছিল দাঁত মাজতে মাজতে। এসেই দেখল সাদিককে।একজন পরিচিত বড় ভাই।দোকান দেয়। জুতার দোকান।মহি এগিয়ে গেল কথা বলতে।সাদিক কোথাও যাচ্ছিল।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল সাদিকের এলাকা এখানে নয়। তাহলে ও এখানে কি করছে।ওর পিছন পিছন গিয়েই দেখতে পেল তনু কে।দেখেই মহি আড়াল হয়ে গেল।তনুকে এখানে মহি যেন আকাশ থেকে পড়ল।কয়েক মিনিট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল।ব্যস! এসব দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল।ওদের কথা শুনতে লাগল আড়ি পেতে।অল্প কিছুক্ষন কথা বলেছে ওরা।এই পাঁচ কি দশ মিনিট।একটা জরুরি কথা বলতে নাকি এখানে এসেছে সাদিক। এমনটাই শুনল মহি।জরুরি কথাটা ঠিক শুনতে পায় নি মহি।এ জন্যেই তনু বাড়ি ফিরার সাথে সাথে ওকে জিজ্ঞেস করল মহি। নাহ্! তনু ছেলেটাকে ছেড়ে দেয় নি।এখন তাদের প্রেম চলছে।আড়ালে! গোপনে! মায়ের ফোন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে ও।বন্ধুদের ফোন দিয়ে কথা বলে।দেখা হয় ওদের প্রতিদিন। ছেলেটার দোকান ওখানেই।স্কুলের পাশেই।ওদের ভালোবাসার ঘভিরতা আরো বাড়তে থাকে।
সমস্যাটা সেখানেই হয়।আশ্চর্য হয়ে মহি কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে।এখন সাদিক সময় পেলেই মহিদের এলাকায় চলে আসে। প্রতি জুমার নামাজ মহিদের মসজিদেই পড়ে।তারপর মহিদের বাড়ির পাশ দিয়ে নিজের বাড়ি যায়।মহি আরেকটু অবাক হয় যখন নিজের ছোট বোনকে দেখে সিড়িতে বসে থাকতে।খোলা চুলে।হালকা সাজে তনু।নামাজ শেষ হলেই সিড়িতে এসে বসে। এসব দেখে মহির যেন আশ্চর্যের সীমা থাকে না।তাহলে কি তনু ওই ছেলের সাথে কথা বলা ছেড়ে দেয় নি? ওদের প্রেম কি এখনও চলছে? রাফি স্থির হয়ে বসে আছে।কিছু বলছে না।কেবল ভ্রু জোড়া কুছকে চোখ গুলো তীক্ষ্ণ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব রেগে আছে। মরিয়ম বেগম রাফিকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হলেন।দুইটা কারনে তিন অবাক হলেন।এক হলো তিনি ঠিক রাফিকে এখানে আশা করেন নি।রাফি তনুর মেজো ভাই।মাদ্রাসায় পড়ে।ঢাকার একটা কওমি মাদ্রাসায়। তাই রাফি কখনই হুট করে বাড়ি চলে আসতে পারে না। সেখানেই থাকতে হয় এবং সেখানে থেকেই পড়াশোনা করতে হয়।রাফি কখনই হুট করে না জানিয়ে চলে আসে না।
দ্বিতীয় কারনটা হলো রাফিকে এমন অস্থির অবস্থায় তিনি খুব কম দেখেছেন। এতটা রেগে থাকতে তিনি কখনই দেখেন নি।তিনি ছেলের এমন রক্ত বর্ন চাহনি দেখে বললেন, কি রে! কি হয়েছে তোর।এমন রেগে আছিস যে? আর তুই আসবি একবার ফোন করে বলবি না? ফোন করে বললে তো আজ এমন কিছুই দেখতে পেতাম না। রাফি রাগে গদগদ হয়ে কথাটা বলল।মরিয়ম বেগম আশ্চর্য হয়ে বললেন, মানে? কি দেখেছিস তুই? আসুক আজ তোর ছোট মেয়ে! তারপর সব বুঝতে পারবে! জামিল মিঞা বাড়ি নেই।বাইরে গেছে একটু। ঘরে আছে মহি,রাফি,তনু আর মরিয়ম বেগম।সবাই চুপ করে আছে।মরিয়ম বেগম চুপ করে বসে আছে।গাল ফুলিয়ে বসে আছে।উনার চোখ ছলছল করছে।মহি দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার চেহারায়ও প্রচন্ড রাগ।রাফি বসে আছে তনুর পাশে। সে তো এমনিতে রাগে গদগদ অবস্থা । অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তনুর দিকে।
তনু মাথা নিচু করে বসে আছে।তার বাম গালটা লাল হয়ে আছে।মৃদু আওয়াজে কান্না করছে।রাফি বলে উঠল, তোর এই বয়সে আমরা এগুলো কখনই মাথায় আনি নি আর তুই? তুই এটা কিভাবে করলি? আমাদের মান সম্মান কিছু রাখলি? আজ যদি রিপাত আমাকে ফোন করে না বলত তাহলে যে সামনে কি হত সেটা আল্লাই ভালো জানে। ব্যাপারটা আমার আর রিপাতের মাঝে সিমাবদ্ধ। এটা যেন আর কেউই না জানে আর রাফি পুরো কথাটা বলতে পারল না।মহি বলে উঠল, হাহ! এটা আর সীমাবদ্ধ নয় ভাইয়া।আমার সব বন্ধুরাও জানে এটা। ওরা আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে।তনুকে আর ওই সাদিককে এক সাথে দেখেছে।স্কুলে যাওয়ার সময় দুজনেই নাকি একসাথে যায়।তখন আমি সেটা বিশ্বাস করি নি।নিজের বোনের উপর ছিল অগাত বিশ্বাস। আর বিশ্বাসের ছিল এই পরিনাম। তুই এই দিলি আমাদের ভালোবাসার পরিনাম। রাফি মুখে হাত দিয়ে বলল, আমি কি করব মা বুঝতে পারছি না।লজ্জায় বাইরে বের হতে পারছি না। মরিয়ম বেগম কিছুই বললেন না অস্রু শিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।তিনি ভাবতেও পারেন নি যে এই মেয়ে এমন কাজ করবে। তনুর সাথে সাদিকের দেখা হয় না অনেক দিন হয়েছে।নাহ্! অনেক দিন না।দুই কি তিন দিন হবে।তবে তনুর কাছে মনে হচ্ছে দুই কি তিন বছর সাদিকের সাথে ওর দেখা হয় না।তনু চুপচাপ বসে থাকে এখন।তেমন কথা বলে না।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু ও কিছুইতেই সেটা পারে না।
ওর এই অস্থির প্রানটা বারবার আবেগাইত হয়।বারবার ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে।তবুও তনু এ সব ভুলে যেতে চায়।আর যাই হোক! এই বয়সে প্রেম নয়। তাও আবার আমাদের মত গরিবের। তনু ঠিকই বুঝতে পেরেছে। ওদের বংশ ভূঁইয়া বংশ। আর ওদের ব্যাপারি।ভুঁইয়া আর ব্যাপারির মাঝে কখনই মিল খায় না। ওর বাবা বলত পূর্বে নাকি এই ব্যাপারিরা তাদের পূর্ব পুরুষদের গোলামি করত। এখানে এসে কাজ খুঁজত।তনু এসব ভেবে নিজেকে শান্তনা দেয়।তবুও নিজেকে ঠিক শান্ত রাখতে পারে না।অস্থির হয়ে উঠে। তনুর অবস্থা অনেকটাই বেগতিক।শরিরের অবস্থা বেশি ভালো না। বারবার বুমি করে।খাওয়া দাওয়া খেতে পারে না।শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে।পেটে ভীষন ব্যাথা অনুভব করে তনু।কিছু খেলেই বুমি করে সেগুলো ফেলে দেয়।ওর মা বাবা, ভাই বোন সবাই খুব চিন্তিত। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। জামিল মিঞা এখনও সাদিক আর তনুর সম্পর্কে কিছু জানে না।বাইরেও এটা আর প্রচার হয় নি খুব একটা। কোন রকম সামাল দেওয়া গেছে।
জামিল মিঞা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে দ্রুত ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন।তনুও গিয়েছে।ওর মাও! ডাক্তার সাহেব জামিল মিঞাকে কিছু কথা বলার জন্যে একা ডাকলেন। জামিল মিঞা এসেই দেখল ডাক্তার খুব চিন্তিত হয়ে বসে আছে। জামিল মিঞা হস্তদন্ত হয়ে বললেন, কি হয়েছে আমার মেয়ের!কোন বড়সড় সমস্যা।হাসপাতাল ভর্তি করতে হবে? না! তেমন কিছু না।তবে আমি আমার অভিজ্ঞাত থেকে একটা কথা বলছি।আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। জি বলুন। আপনার মেয়ের কি বিয়ে হয়েছে? কই না তো? প্রেম করে? আমার জানা মতে না। একটু ভালো করে খোঁজ নিন।প্রেগন্যান্ সির আগে এমনটা হয়।তার উপর ও এখনও ছোট? আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন ডাক্তার সাহেব।বলুন তো। কিছু মনে করবেন না।এই বয়সে মেয়েরা প্রেমের ফাঁদে পড়ে এমন ভুল করে পেলে।আপনার মেয়েও হয়ত তাই করেছে? ভুল? কিসের ভুল?
ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না।জামিল সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।হুট করে জামাল সাহেবের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।তিনি ভ্রু কুছকে ডাক্তারের দিকে তাকালেন। উনার রাগটা আস্তে আস্তে মাথায় চড়ে যাচ্ছে।হুট করেই উনি উঠে গিয়ে ডাক্তারকে একটা চড় মেরে দিলেন।বললেন, :তোর সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের সম্পর্কে এমন কিছু বলার।তাও আবার পরিক্ষানিরিক্ষা, টেষ্ট-টুষ্ট বাদে। তনুর অবস্থা আরো বেগতিক। আরো খারাপ হয়ে গেছে। ওকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে।ওর ভাই গিয়ে নিজের বোনকে নিয়ে এসেছে।যত টাকা লাগে লাগুক।তবুও নিজের বোনটা ভালো থাকুক। বড় ভাই মাহিনও জানে না তনু আর সাদিকের কথা।অনেক টাকার প্রয়োজন। অনেক বড় একটা হাসপাতালে উঠেছে ওরা।হাসপাতাল এর ভাড়া জামিল সাহেবের এক মাসের বেতনের সমান। আরো খরচ তো আছেই । তাইই বাধ্য নিজের সখের জমিটা বিক্রি করে দেয়।যেখানে তিনি একটা পাকা ঘর /বিল্ডিং করার চিন্তাভাবনা করেছেন।জমি বিক্রির টাকা দিয়ে হবে না।তাই তিনি বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিলেন।
নাহ্! ডাক্তাররা কোন কিছুই ধরতে পারেন নি।ওর বুমি কোন ভাবেই কমানো যাচ্ছে না।খেতে তো পারছেই না।ডাক্তারের আশা বাদ দিয়ে দিলেন জামিল মিঞা! গরিবের শেষ চিকিৎসা বিদেশ গিয়ে হয় না।শেষ চিকিৎসা হল হুজুরের কাছে যাওয়া।হুজুরের কাছে যেতে চাইলেন কারন কেউ তাবিজ করতে পারে।তনুর মামা ফোন করে বলেছেন কথাটা।তিনি বলতে চাচ্ছেন যে কেবল একবার দেখাতে।মানে এদিক থেকে যেন নিশ্চিত হয়ে থাকা যায়।তাই জামিল মিঞাও রাজি হলেন। জামিল সাহেব এসব কিছুই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।ভীষন অবাক হলেন হুজুরের কথা শুনে।কে উনার মেয়েকে তাবিজ করবে।আর করেওবা কি লাভ! হ্যাঁ! ওখানে গিয়ে জানা গেয়েছে যে তনুকে তাবিজ করা হয়েছে।তবে কে করেছে সেটা ঠিক বলতে পারছেন না হুজুর। কিছু ঔষধ দেওয়া হয়েছে ওকে।
তনু এখন অনেকটাই সুস্থ।নিজেকে গুঁছিয়ে নিয়েছে।সুন্দর স্বাভাবিক জিবন জাপন করতে শুরু করল।সাদিককে অনেকটা ভুলে গিয়েছে।ওর জন্যে অনেক ঘৃনা জমা হয়েছে মনে। বিশেষ করে যখন জানল এই সাদিকই ওকে তাবিজ করেছে তখন থেকে।ছিঃ! মানুষ এতটা নিচু হতে পারে? এরপরেএ সাদিককে তনুর পিছনে দেখা গিয়েছে। কথা বলতে দেখা গিয়েছে।এ নিয়ে তনুর সাথে ওর মেজো ভাইয়ের অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে।ও বলতে চাইছে ও দেখা করে নি।কিন্তু ওর ভাই বলছে ও দেখা করেছে।এই জন্যে ওর মেজো ভাই ওর সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে।বোন বলে ডাকে না আর তনুকে।এত নিশেধ করার পরেও তনু কিভাবে ওই ছেলের সাথে কথা বলতে যায়? মরিয়ম বেগম রান্না করছেন। এমন সময় উনার ফোনে একটা কল আসে।তিনি ফোন ধরলেন।কিছু সময় ওপাশের কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনলেন।কথা গুলো শুনেই উনার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি হুট করেই মাটিতে বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষন।
জামিল মিঞা অফিস থেকে ফিরছেন।এমন সময় এক লোকের সাথে দেখা।লোকটা উনাকে এক পাশে নিয়ে কিছু কথা বললেন।শুনে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল উনার মাথায়।লোকটা কিছুক্ষণ জামিল মিঞাকে বিদ্রুপ করলেন।তারপর ছিঃ ছিঃ করে বিদায় নিলেন। আরেকটু পথ আসতেই একজন বলে উঠল, আরে জামিল মিঞা যে! মেয়ের খবর টবর রাখ কিছু। কই থায় কই যায়! খবর রাখ।তোমার মাইয়া এই কাম কেম্নে করল কও তো! আমার তো বিশ্বাসই হয় না! জামিল মিঞা কিছু বললেন না।নিচের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বাড়ির পথ ধরলেন। কিছুদূর যেতেই কয়েকটা ছেলে উনাকে দেখে বলল, যারা নিজের ঘর ভালো রাখতে পারে না তারা আবার বাইরে এসে বড় বড় কথা কয়।উপদেশ দেয়।লেকচার দেয়।অন্য কে ভালো হতে বলে। নিজের ঘরই ঠিক নেই আবার বাইরে এসে অন্য কে ঠিক হতে বলে। থু থু।এরা এটারই উপযোগ্য। জামিল সাহেব কিছু বললেন না।মাথা নিচু করে চলে আসেন।তার চোখ হতে ক’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
তুই সত্যিই করে বল তোর সাথে ওর বিয়ে হয় নি।বল।সত্যিই করে বল? জামাল সাহেব উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে কথাটা বললেন তনুকে।তনু কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, না বাবা! আমি ওকে বিয়ে করি নি।সত্যি বিয়ে করি নি। পাশ থেকে মহি বলে উঠল, মিথ্যা বলিস না।তোকে এত বার নিশেধ করলাম তুই তারপরেও ওর সাথে দেখা করলি,কথা বললি। কেন? কেন করলি।তোদের মাঝে অবশ্যই কোন প্লান ছিল। প্লান করে তোরা বিয়ে করেছিস! হুম! আমি মানছি আমি দেখা করেছি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওকে বিয়ে করি নি। মহি অনেকটা রেগে গিয়ে বলল, চুপ! একদম চুপ! যে মেয়ে নিজেদের প্রথম দেখা বাগানে করে সেই মেয়ের পক্ষে বিয়ে করাটা অবিশ্বাসের কিছু নয়। ভাইয়া।মুখ সামলে কথা বল? এক কথা বলার পরই জামিল মিঞা একটা কান্ড করে ফেললেন।ঠাশ করে তনুর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন।চড় দিয়েই নিজের ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
তনু গালে হাত দিয়ে ওর বাবার দিকে তাকাল।বলল, বাবা তুমি? তুমি আমাকে! চুপ! একদম চুপ।তুই আমাকে আর বাবা বলবি না তোর ওই অপবিত্র মুখে।তোকে কত ভালোবেসে আগলে রেখেছি।এই তার পরিণাম দিলি তুই।এতটা নিচু হতে পারলি তুই কিভাবে? বাবা প্লিজ বিশ্বাস কর! আমি ওকে বিয়ে করি নি।বাবা প্লিজ! বাবা।বিশ্বাস কর। চুপ! আমাকে আর বাবা বলে ডাকবি না।আমার মান সম্মান সব তুই ধুলোয় মিশিয়ে দিলি।আগে বাইরে বের হলে মানুষ যেমন সালাম দিত আজ সেখানে থুথু দেয়।এসব তোর কারনে হয়েছে।সব তোর কারনে। তনু দিশেহারা হয়ে গেল।কেউ বিশ্বস করছে না ওকে।কেউ না। ও দৌড়ে ওর মেজো ভাইয়ের কাছে গেল।দু’পা জড়িয়ে বলল, প্লিজ ভাইয়া! আমাকে বিশ্বাস কর।প্লিজ? রাফি একটা চড় দিতে চাইল।কিন্তু দিল না।ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিল। ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, তোর এই অপবিত্র হাত আমার গায়ে লাগাবি না আর।তোর জন্যে আমরা সব হারিয়েছি।বাইরে বের হতে পারি না আমরা।লোকে কটু কথা বলে।মানুষের কথার আঘাত সব চেয়ে বড় আঘাত।এটা সহ্য করা যায় না।
তনুর মা এগিয়ে এলেন। তার চোখ ছলছল করছে।উনাকে খুব রাগি দেখাচ্ছে।মুখটা ফুলে আছে উনার তনু মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা! প্লিজ! তুমি তো বিশ্বাস কর? পাঁচটা সন্তান লালল পালন করেছি এই দুই হাত দিয়ে। কেউ আমাকে এতটা কষ্ট দেয় নি যতটা তুই দিয়েছিস।তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।আজ আমি তোকে মেরেই ফেলব। এই বলে তিনি তনুকে মারার জন্যে এগিয়ে এলেন। মহি ওর মাকে জড়িয়ে ধরল।মাকে বাধা দিল।বলল, যা হয়েছে হয়ে গেছে।বাদ দাও।এখন এই আপদটাকে এই বাড়ি হতে বিদায় দাও।আর যেন এই বাড়িতে না আসে ও। তনুর কথা বিশ্বাস করল না কেউ।কেউ না।বাড়ির সবাই ওকে দেখে ছিঃ ছিঃ করে।বলে, তোকে তো ভালোই জানতাম।তোর ভিতরটা যে এতটা নষ্ট সেটা তো জানতাম না।অন্তত তোর বাপের কথাতো একবার ভাবা উচিৎ ছিল।। বান্ধুবিদের কেউই ওকে বিশ্বাস করছে না। তনু ভয়ে মিরার সামনেও যায় না।সে কি না কি বলে। সবাই ওকে দেখলেই হাসা হাসি করে।যে ছেলে গুলো আগে দেখলে আপু আপু বলে সন্মান দিত তারা আজ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে টিটকারি কিরে।বিদ্রুপ করে।বলে, কেঁচোর গর্ত থেকে এ কি বের হল রে।সাক্ষাত কালনাগিনী। সবাই ওকে ঘৃনার চোখে দেখে।তনু আগে ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি কি হতে চলেছে।এসব কি হচ্ছে সেটা তনু বুঝতে পারে নি।কে এই মিথ্যা রটিয়ে দিল! কে ওর এত বড় ক্ষতি করে দিল?
তনু রাতে খায় না।নিজের রুমে গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে।পুরো রুম অন্ধকার করে বসে আছে ও।ওর মাথায় কিছুই আসছে না যে ও কি করবে।চুপচাপ শুয়ে রইল।নরম কোমল হৃদয়টাতে কথার তীর গুলো আঘাত হানছে তীব্রভাবে। বাবার কথা গুলো,ভাইয়ের কথা গুলো,বড় ভাই ফোনে যে কথা গুলো বলেছে, বড় বোন যে কটাক্ষ বানী গুলো ওকে শুনিয়েছে,নিজের মা যে কথা গুলো বলেছে,পরিবার, আত্মীয় স্বজন,বান্ধুবিরা যা যা বলেছিল প্রত্যেকটা কথা যেন এক একটা বিষদর তীর।এক একটা বেত্রাঘাত! যেন কেউ একটা ছুরি দিয়ে তনু খোঁচাচ্ছে। বারবার আঘাত হানছে তনুর হৃদয় পল্লিতে। একেবারে রক্তাক্ত লাল করে দিয়েছে।সেই রক্ত জল হয়ে তনুর লাল হয়ে যাওয়া চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছে।তনু চাপা কান্না করছে।শব্দহীন কান্না।যে কান্নার আওয়াজ কেউ শুনে না।শুনলেও কারো যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই। তনুর দুঃখ হয়। অনেক গুলো রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল।সেগুলো আর বাস্তবায়িত হবে না।সব একেবারে ছাঁই করে দিল।তনু আস্তে করে উঠে এল।লাইটটা জ্বালাল।তারপর আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।আজীবনের জন্যে। সেদিন যে রুমের দরজা বন্ধ হল।আর খুলে নি।খুলেছে।তবে অন্য কেউ।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে একজন জ্যান্ত মানুষ। আর বের হল একটা মরা লাশ।হ্যাঁ! তনু সুইসাইড করেছে।যেখানে নিজের আপনজনরা ওকে বিশ্বাস করে নি সেখানে বাইরের লোক তো বিশ্বাস করার কথা প্রাশ্নেই আসে না।এত জ্বালা তনু সহ্য করতে পারে নি।একদমই পারে নি।তাই ও সুইসাইড করে।নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করে দেয় যে সে সত্যি বলছে।ও মিথ্যা বলছে না।ছোট্ট একটা কাগজ তার প্রমাণ। সেখানে ছোট ছোট শব্দ গুলো মিলিত হয়ে একটা লাইন লেখা।তারপর আরেকটা লাইন লিখা। বেশ কয়েকটা লাইন সেখানে লিখা “আমি সত্যিই বলছি।আমি মিথ্যা বলি নি।নিজের জীবন দিয়ে তা প্রমান করলাম।আমি তোমাদের মুখে চুনকালি মাখি নি বাবা।বাবা আমি তোমায় ভালোবাসি।আমি তোমাদের ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।” চিঠি হাতে জামিল মিঞা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।তিনি তাকিয়ে আছে সামনে ঝুলে থাকা তার মেয়ের নিষ্পাপ চাহনির দিকে।তনুর চোখ গুলো তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। যেন বলছে,বাবা আমি ভুল করি নি। আমি বিয়ে করি নি বাবা।আমি এতটা নিচু নই।তুমিই বল তোমার মেয়ে কি এমন কিছু করতে পারে? আমি সত্যিই মিথ্যা কথা বলি নি বাবা।বিশ্বাস কর। ” জামিল মিঞা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন।মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন।বললেন, :আমায় ক্ষমা করে সে মা।আমায় ক্ষমা করে দে।
বার বার তনু তনু করে ডাকছেন জামিল মিঞা।মহি লাসের পাশে বসে কাঁদে।বোন বোন বলে চিৎকার করে।রাফি একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে হাত গুঁজে কান্না করছে।ওর খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে কান্না করার।কিন্তু পারছে না।ভিতর থেকে যেন কান্না আসছে।কোন একটা বড় অপরাধ করে পেলেছে বলে।বড় বোন আসে শশুড় বাড়ি থেকে। বড় ভাই শহরে থাকে।একটা ছোট খাট চাকরি করে।বোনের কথা শুনে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে।গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হয়।পুরো পথটা কেঁদে যায় মাহিন। নিষ্পাপ, কোমল চেহারার অধিকারীনি, প্রানবন্ত মেয়ে তনু আর কাঁদে না।হাসে না।মহির সাথে দুষ্টামি করে না আর।ভাইদের ছোট্ট বোন হয়ে সবার সাথে হাসি ঠাট্টা করে না আর। আলো জ্বলে থাকা ঘরে হুট করেই আলো নিভে।অন্ধকার হয়ে গেল। উচ্ছ্বসিত তনু হঠাৎ-ই শান্ত নিথর হয়ে গেল।মহি তনুর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বারবার অনুভব করছে তনু এখানে আছে। এই হাসছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে।মহি দৌড়ে গিয়ে ওর চুল গুলো আগোছালো করে দেয়।দিয়েই দেয় ছুট।তনু দৌড়ে আসে।মহিকে মারার জন্যে।বারবার বলছে, এই ভাইয়া দাঁড়া। দাঁড়া বলছি।
মহি এসব অবুভব করছে।ঘরের প্রতিটি কোনায় যেন তবুর হাসি লেগে আছে।এই তো এপাশ খেলে তনুর খিলখিল করে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে।মহি দৌড়ে যায়। সত্যিই তনু হাসছে। না। তনু হাসছে না।মবের ভ্রম কেবল।আস্তে আস্তে হাসির আওয়াজটা হাওয়ায় মিলা যায়।বিদায় নেয় এই অভিশপ্ত সমাজ থেকে। এই অভিশপ্ত ধরনী হতে বিদায় নেয় তনুর সেই প্রানবন্ত হাসি।সাথে তনুও। সাদিক নিজের রুমের দরজা আটকে কান্না করতে থাকে।ভীষন কান্না করে ও।নিজের একটা ভুল।কেবল নিজের একটা ভুলের কারনে আজ এত কিছু হারতে হয়েছে।নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে ওর।প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে। ভুলটা মহির! প্রথম ভুলটা ক্ষমা করে দেয় তনু।ভুলটা ছিল তনুকে তাহিজ করে ভালোবাসতে বাধ্য করা।সেটা জেনেও সাদিককে ক্ষমা করে দেয় তনু।কিন্তু এখন! এখন ক্ষমা করবে কে? কে দিবে এই ভুলের মাসুল। তনুর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় সাদিক। তনুকে নিজের করে পাবার তীব্র ইচ্ছে জাগে ওর।নিজের ঘরের বউ বানানোর ইচ্ছে জাগে।তাই তনুর নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দেয়।ফাঁসিয়ে দেয় তনুকে।দোষ নেই সাদিকেরও। আছে! তবে যে ওকে এই প্লানটা দিয়েছে তার চেয়ে কম।
তনুরই এক আস্থা ভাজন এক বান্ধুবি,নিজের বোনের মত যাকে দেখে তনু, ওদের বাড়ির পাশেরই একটা মেয়ে নাম নিশিতা।যে কিছুদিন আগে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। নিজেরই ক্লাসের একটা ছেলের সাথে।নিজের পরিবারের মান সম্মান ডুবিয়ে সে পালিয়ে যায় এক ছেলের সাথে।এতে গ্রামের সবাই ওর প্রতি ঘৃনা প্রকাশ করে।গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়।অনেক অপমানিত করে নিশিতা আর ওর স্বামীকে। তনুর বাবাও করেছিল।এমন মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। এমনটা বলেছেন তিনি বিচার সভায়।তাই নিশিতাও তার প্রতিশোধ নেয়।তবে অন্য ভাবে। সাদিককে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করায়।এমনকি এই কথা ছড়িয়ে পড়তে নিশিতার ভুমিকাই অনেক।সেদিন যে এই কথাটা তনুর বাবাকে প্রথম বলেছিল সে ছিল নিশিতার ভাড়া করা এক লোক। যাকে বলতে বলা হয়েছে তনুর মিথ্যা বিয়ের খবর।এই তৃতীয় পক্ষ যে তনুর মৃত্যর জন্যে একমাত্র দায়ী সেটা কেই জানতে পারে না।আর পারবেও না।সাদিক! সে তো তনুর গত হওয়ার পরই পাগল হয়ে গিয়েছে।এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারে নি।
তাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারয়ে পাগলে পরিনত হয় সে।তবে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করে গ্রামবাসী। যেন দিন তনুর মৃত্যু বার্ষিকী সেদিন ওই পাগল সাদিককে দেখা যায়।তনুর কবরের পাশে।চুলো গুলো বেশ বড়।দাঁড়িও।হাতপায়ের নখ বড় বড়।একটা কালো কালারের শার্ট পরা। একটা প্যান্ট পরা।যার অনেকটাই ছিড়ে গেছে।সে ধির গতিতে আসে।চুপচাপ জড়সড় হয়ে বসে থাকে তনুর কবরের পাশে। মাঝে মাঝে কবরের উপর শুয়ে থাকে।মৃদু স্বরে কাঁদে। কেবল মুখ দিয়ে একটা কথাই ভেসে আসে। “ক্ষমা কর তনু। ক্ষমা কর তনু! “আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে কেবল একটা কথা রটিয়ে দিলেই হয়েছে! কথা কতটা সত্য সেটা পরিমাপ করার আগেই শুরু হয়ে কথা শোনানো।আর সেটা যদি গ্রামে হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। কথার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা যাদের থাকে না তারা সুইসাইড করে।তনু যা করেছে সেটা একটা ভুল কাজ।
তনুর উচিৎ ছিল নিজেই নিজেকে সত্য প্রমান করা।কিন্তু তনু সেটা করে নি। আসলে কথার আঘাত গুলো সহ্য করতে পারে নি ও।তাই নিজেকে শেষ করে দিয়ে ভেবেছে সে সকল কষ্ট হতে মুক্তি পেয়েছে।কিন্তু আসলে তা না। নিজের সুখ চিনিয়ে নিয়েছে সে।এখন কেবল তাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মরতে হবে।জিবনে অনেক বড় বড় ধকল আসবেই।আমাদের সেগুলোর সম্মুখীন হয়েই এগিয়ে যেতে হবে।এটাই তো জীবন।কষ্টের ভয়ে নিজের প্রান নেওয়াটা বোকামি।বড্ড বোকামি। আর এসব সমস্যা টিন এইজেই বেশি হয়।এই বয়সে তারা এত বড় ধকল সহ্য করতে পারে না।তাই সুইসাইড নামক জঘন্য কাজটা তারা করে।আমার প্রশ্ন হল যাতে তুমি এত বড় ধকল সইতেই পারবে না তাহলে তোমাকে এই বয়সে প্রেম করতে বলেছে কে? ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে টিন এইজ হল পরিবর্তনের সময়।এই সময় এর পর থেকে কেউ যায় খারাপ পথে আর কেউ ভালো।
এই বয়সের ছেলে মেয়েরা আবেগ প্রবন হয়।এই বয়সে তারা ভালোবাসা বাঁচাতে বিছানায় যেতেও রাজি হয়ে যায়।মানুষের জিবনের একটা জঘন্যতম অধ্যায় হচ্ছে টিন এইজ। শেষে বাকি রইল নিশিতা নামক পশুটা।যার বুদ্ধির কারনে আজ এত কিছু হয়ে গেল।আমাদের বর্তমান সমাজে এই নিশিতার মত মানব মানবিতে পরিপূর্ণ।তাই আজ আমাদের ও আমাদের সমাজের এই অবস্থা। এমন লোকে যদি সমাজ পরিপূর্ণ থাকে তাহলে এই পৃথিবি ভালোর থেকে খারাপের দিকে এগুবে।ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে।উন্নতি! সে তো অনেক পিছনে ফেলে এসেছে।