রুপা যখন ক্লাসে অঙ্ক কষে। অভি প্রায়ই জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকে। একদৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে রুপার ক্লাস করানো দেখে। তার ইচ্ছে হয় রুপার ক্লাসের শিক্ষার্থীর পাশে সেও বেঞ্চে বসে পড়ুক। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রুপার কথাগুলো শুনুক। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? অভি ও রুপা একই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা। অভি রুপাকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। কিন্তু অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেও রুপাকে তার ভালোলাগার কথাটা বলতে পারেনি।
রুপা মেয়েটা অসম্ভব রুপবতী। ঠোঁটের দিকে তাকালে মনে হয় যেন গোলাপী লিপস্টিক দেয়া। ওর হাসিটা ভীষণ সুন্দর। ঠোঁটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গজদাঁত টা তার হাসির সৌন্দর্যকে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মেয়েটা এতোটাই রুপবতী যে, তার দিকে তাকিয়ে দিনকে রাত কিংবা রাতকে দিন করে দিতে ইচ্ছে করে। তার সাথে কোনোরকম সন্দেহ ছাড়া ভিঞ্চির রহস্যময়ী মোনালিসা কিংবা প্রাচীন মিশরের ক্লিউপেট্রার তুলনা করা যায়।
রুপা যখনি হাসে তখনি তার গোলাপীরঙা ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোর মতো গজ দাঁতটা দেখা যায়। আহা! কতো অপরুপ সে দৃশ্য!
‘হাসিতে মুক্ত ঝরে’ ব্যাপারটা যে সত্যি সেটা রুপাকে দেখলে যে কেউ কোনো রকম তর্ক ছাড়া বিশ্বাস করে নেবে। অভি ছেলেটাও রুপার গজ দাঁতওয়ালা হাসি দেখেই মনটুকু রুপার প্রেম আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলো।
সেদিন অভি তিনটে কাশফুলের সাথে একটা কবিতা লিখে চুপিচুপি রুপার ডেস্কে রেখে এসেছিল। সে নিজেই কবিতাটা লিখেছিল। কবিতাটা ছিল:-
দেখে তোমার স্নিগ্ধ হাসি,
আকুল হয়েছি হায়!
বসন্তের সব কৃষ্ণচূড়া বুঝি,
ফুটলো ঠোঁটের গায়!
মুক্তোসম গজা দাঁত তব-
গোলাপী ঠোঁটের ফাঁকে।
আহা! যখনি হাসো কত অপরুপ মায়া,
উড়ে চলে ঝাঁকে ঝাঁকে!
তব হাসির সুর, সাত আসমান ঘোর,
ব্যথাহীন কাঁটা বিঁধে গেছে মোর চোখে।
তব প্রণয় মেঘের নীলাকাশে আজ
উড়বো আমি- কার সাহস?
দেখি কে রাখে আমায় রুখে?
ওগো সুহাসিনী, তুমি কি জানো?
তব হাসিচিত্র বুকের পরতে পরতে আঁকা,
তুমি কি জানো? সেসব পরতে-
কত পবিত্র প্রেম-ভালোবাসা আছে রাখা!
তুমি কি জানো,
এই হাসির মায়া আলোতেই
মনের অমাবস্যা হয় দূর,
সংগীতের মতো বেজে উঠে হঠাৎ-
অপরুপ প্রণয় যন্ত্রের সুর।
.
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অতিরিক্ত ভয়ের কারণে কবিতার সাথে তার নামটা আর লিখা হয় নি!
দুজনের বাসা একদিকে হওয়াতে ছুটির পর তারা একসাথেই বাসায় ফেরে।সেদিন বিকেলে বাসায় ফেরার সময় রুপা বলল:- বুঝলেন, অভি সাহেব! কে জানি আমার ডেস্কে একটা কবিতা আর তিনটে কাশফুল দিয়ে গেলো!
অভি বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো:- বাহ্, বেশ ভালো তো! আমার ডেস্কে তো কেউ গরুর রচনা লিখে সাথে ঘাসও দিয়ে যায় না। সেদিক থেকে বলা যায় আপনি বেশ ভাগ্যবতী!
:- ধুর! মজা করছেন কেন? আমি সিরিয়াসলি বলছি।
:- ওহ আচ্ছা! তা কবিতাটা কেমন ছিলো?
:- বাজে, অত্যন্ত বাজে! এভাবে কেউ কবিতা লিখে। ঐটারে পেলে পিটায়ে কবিতা লেখা শিখাতাম!
রুপার কথা শুনে অভি বড় করে ঢোক গিলল। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অভি মিন মিন করে বলল:- না..না.. মারপিট করার দরকার নেই। এরপর থেকে সে আর কখনো কবিতা লিখবে না।
খানিকটা অবাক চোখে রুপা বলল:- সেটা আপনি কি করে জানেন?
অভি মিন মিন করে বললো:- ইয়ে..মানে! এমনি মনে হলো আরকি!
কথাটা বলেই অভি চুপ হয়ে গেল। কেন জানি রুপাও পাল্টা কোনো প্রশ্ন করলো না! সেদিন তাদের মধ্যে আর কোনো কথাই হয়নি। এমনিতে অভি নিজ থেকে রুপাকে এই সেই প্রশ্ন করে, অকারণেই কথা বলতে চায়! কিন্তু সেদিন সে আর কোনো প্রশ্ন করে নি। ভয়ে ভয়ে ছিল রুপা না আবার বুঝে ফেলে যে অভিই কবিতাটা লিখেছিল।
(২)
আজ অভি নতুন উদ্যোগ গ্রহন করছে। এবার আর সে কবিতা লিখলো না। নীল কালিতে গুছিয়ে একটা চিঠি লিখলো।
সুহাসিনী,
তুমি ভালো আছো, আমি জানি। কিন্তু আমি ভালো নেই! তোমার গজ দাঁতের হাসি আমার বুকের ভেতরে ব্যাধির মতো আক্রমণ করেছে। তোমার হাসির রোগে আমি রোগী। রোগটা অতি কঠিন এবং জটিল। রোগটা হওয়ার পর থেকে আমার শুধু তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে, কথা বলতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতেও ইচ্ছে করে।
ডাক্তার দেখানোর কথা ভুলেও ভাবিনি, কারণ আমি চাই এ রোগটা আমার সারা জীবন থাকুক। এ রোগ হওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু তুমি যদি আমার পাশে না থাকো তবে হয়তো রোগটা কোন একসময় সেরে যেতে পারে, আমি চাই না সেটা হোক।
আমি চাই তুমি সারাটাক্ষণ আমার পাশে থাকো, পবিত্র হাসি হাসো, আর সেই হাসি বারবার আমার বুকে ব্যাধির মতো বিঁধে থাকুক। চিঠিটা নীল কালিতে লিখেছি; হ্যাঁ, আমি জানি সাদা রঙ তোমার ভীষণ প্রিয়, কিন্তু সাদা রঙে কি চিঠি লেখা যায়? তবে তিনটে কাশফুল দিয়েছি ধবধবে সাদা।
এতো ফুল থাকতে কাশফুল কেন দিলাম জানো? কারণ কাশফুল আমার প্রিয় ফুল। আর আমার প্রিয় ফুলের রঙের সাথে তোমার প্রিয় রঙের মিল আছে। ব্যাপারটা বেশ মজার, তাই না? আচ্ছা, তোমার প্রিয় ফুল কোনটি? শেষ একটা কথা বলবো? আচ্ছা, তুমি মানুষ না পরী? মানুষেরা তো এত্তো সুন্দর করে হাসতে পারে না? তুমি কিভাবে পারো?
ইতি,
অসম্ভব ভালবাসে, কিন্তু ভয়ে
বলতে পারে না এমন কেউ!
চিঠি এবং তিনটে কাশফুল রুপার ডেস্কে রেখে আসলো অভি। আজ তার মন অনেক খুশি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে চিঠি পড়ে রুপা বেশ আনন্দিত হবে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে রুপা অভিকে বললো:- জানেন, আজ ঐ বাঁদর টা আবার চিঠি লিখেছে।
অভি বেশ অবাক হয়েই বললো:- বলেন কি?
:- হ্যাঁ, তবে আজ কবিতা লিখেনি, শুধু একটা চিঠি লিখেছে।
:- কি লিখেছে?
:- অতি লজ্জাজনক ও হাস্যকর কথা! শুনলে আপনিও লজ্জা পাবেন। আপনি কি লজ্জা পেতে চান? চাইলে বলতে পারি?
:- পুরুষ মানুষেরা আপনাদের মতো এত্তো সাধারণ ব্যাপারে লজ্জা পায় না। বলুন শুনি।
রুপা কিছু একটা বলতে যাবে, অমনিই দুম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ঝুম বৃষ্টি। আশে পাশে ঠাঁই নেয়ার মতো বাড়ি ঘর নেই। রুপা তার ভুবনবিজয়ী হাসি হাসতে হাসতে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু করলো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন স্বার্থক ভঙ্গিতে রুপার গায়ে নিজেদের বিসর্জন করছে। রুপা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
কতগুলো বৃষ্টির ফোঁটা তার ঠোঁটে আছড়ে পড়ে লালরঙা লিপস্টিক ধুয়ে গোলাপী ঠোঁট বের করে দিচ্ছে। কিছু বৃষ্টির ফোঁটা তার বাঁকা চোখের উপরে পড়ে; তার কাজলকে লেপ্টে দিচ্ছে। তার গালে ও ঠোঁটের কোণায় কতগুলো বৃষ্টির ফোঁটা শিশিরের মতো জমে গেছে।
অভি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রুপার বৃষ্টিসিক্ত মায়াময়ী রুপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। আর ভাবছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গুলো কতই না স্বার্থক কতই না মূল্যবান। রুপার পবিত্র শরিরে তারা নিজেদের মিশিয়ে দিতে পারছে। ইস্ সে যদি শুধুমাত্র আজকের জন্য হলেও বৃষ্টি হতে পারতো! তবে তার জীবনটা আজ স্বার্থক হতো।
অভি মনে মনে কাব্য করে বললো:-
হে সৃষ্টিকর্তা,
পূূর্বজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে,
তবে মানুষ নয়- বৃষ্টি করে পাঠিও আমায়!
এই সৌন্দর্যখচিত পৃথিবীর বিশাল বুকে।
পরজন্মে আমি,
রুপার লিপস্টিক ধুয়া বৃষ্টি হবো
কখনো আবার- চোখের কাজল লেপ্টে দিয়ে
ঠোঁটের কোণে শামুকের মতো এঁটে রবো!
একটা ভালোবাসার জন্য,
বদ্ধ পাগল হবো কিংবা হবো ঝড়ো উদ্মাদ।
ভালোবাসায় রুপার সর্বাঙ্গ করবো সিক্ত,
যেমনি এক ঝাক বৃষ্টি করে পৃথিবীকে।
(৩)
রুপার হাতে কিসের যেন একটা কার্ড। কার্ডটা অভির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে রুপা বলল:- আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আপনার দাওয়াত রইলো। এই নিন কার্ডটা ধরুন।
অসম্ভব অবাক হয়ে অভি বলল:- কি বলছেন এসব? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক হয়ে গ্যালো?
:- বিয়ে তো হঠাৎ করেই ঠিক হয়। তাছাড়া আপনাকে তো আমি এখন বললাম ই। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাই তবে। বিয়ের দিন আসবেন কিন্তু!
.
অভি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সম্ভবত, হঠাৎ করেই রুপার বিয়ে ঠিক হওয়াটা সে মানতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে রুপা তাকে আবোল-তাবোল বলছে। কিংবা সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। রুপা চলে যাওয়ার পথ ধরলো। হঠাৎ অভি বলল:- একটা কথা ছিল!
রুপা বললো :- হ্যাঁ.. বলুন কি বলবেন!
অভি বললো:- তাহলে ঐ যে ছেলেটা চিঠি লিখতো, কবিতা লিখতো তার কি হবে?
কথাটা শুনেই রুপা হাসতে শুরু করলো। সেই গজদাঁত বের কথা স্নিগ্ধ, পবিত্র হাসি। অভি বরাবরের মতো রুপার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
উত্তরে রুপা বলল:- ঐটা তো একটা ভীতুর ডিম। ভালোবাসে অথচ সামনা সামনি এসে বলতে পারে না। ঐরকম ভীতু ছেলে আমার পছন্দ না। আমার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে অনেক স্মার্ট ও সাহসী একটা ছেলে। বিশ্বাস না করলে কার্ডটা খুলে দেখুন।
.
অভি বারবার নিজেকে ভীতু বলে বকা দিতে লাগলো। রুপা তার জীবন থেকে চলে যাচ্ছে, শুধুমাত্র তার নিজের বোকামীর জন্যেই। যদি সে সাহস করে তার ভালোবাসার কথাটা বলে দিতো তবে হয়তো রুপা আজ অন্যের হতো না!
তারপর, অনিচ্ছা স্বত্তেও অভি কার্ডটা খুলল। কার্ডের ভেতরে একটা সাদা কাগজ। সেখানে বেশ বড়সড় করে লেখা ” ভীতুর ডিম”। কাগজের অপর পাশে লেখা “ভালোবাসতে গেলে সাহস লাগে। চুপিচুপি উড়োচিঠি দিয়ে ভালোবাসা হয় না। গাধা কোথাকার! আর হ্যাঁ আরেকটা কথা আমিও আপনাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি!
কাগজটা পড়ে অভির চোখ যেন সমস্ত পৃথিবীর অবাক এসে ধরা দিল। কতক্ষণের জন্য সে থ হয়ে রইলো। সে যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। সবকিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অভি মিন মিন করে বললো:- ইয়ে..মানে! আপনি তবে সব জানতেন?
:- না জানার কি আছে! আমি কি আপনার হাতের লেখা চিনি না নাকি? আচ্ছা, আপনি কিভাবে এত্তো সুন্দর করে কবিতা লিখেন বলুন তো? কিভাবেই বা এত্তো মায়া মিশিয়ে চিঠি লিখেন বলুন তো? আর হ্যাঁ, আমার প্রিয় ফুলও কিন্তু কাশফুল। আর আমি মানুষ, পরী না। বুঝলেন?
রুপার কথা শুনে অভি হেসে দিল। সে খানিকটা লজ্জাও পাচ্ছে। লজ্জায় সে রুপার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
সেদিন অভি বলেছিল ছেলেরা নাকি লজ্জা পায় না। কিন্তু তার বলা কথা সে নিজেই রাখতে পারছে না।
হঠাৎ করেই রুপা মুচকি হেসে বললো:- এবার আপনি আমায় ভালোবাসার কথাটা বলুন!
অভি মিন মিন করে বলল:- ভালোবাসার কথাটা কি এখনি বলতে হবে? কথাটা কি কাল বললে হতো না? ইয়ে..মানে আমার না খুব ভয় করছে। এই দেখুন ঘেমে যাচ্ছি।
উত্তরে খানিকটা রেগে রুপা বললো:- ঘাম কেন? আরো ভয়ংকর কিছু ঘটলেও কথাটা এক্ষুণি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে।
অন্য কোনো উপায় না পেয়ে অভি বলল:-
“ওগো, চিরচেনা প্রণয়িনী
তোমায় ভালোবাসি আমি!