বিয়ের পর এই প্রথম প্রচন্ড রকম ঝগড়া হয় শ্রাবণ আর বৃষ্টির। বৃষ্টি ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। দুপুরে শ্রাবণ অফিস থেকে এসে দেখে বাড়ি ফাঁকা! ওর খারাপ লাগে। একটু রাগারাগি হয়েছেই না হয়! তাই চলে যেতে হবে?
কিন্তু হেসে ফেলে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে। সেখানে কাগজে মার্কারি দিয়ে বড় করে লেখা, ‘বিনা তোয়ালেতে প্রবেশ নিষেধ!’ শ্রাবণের এই এক সমস্যা ওয়াশরুমে তোয়ালে নিতে ভুলে যায়। বিয়ের পর এটা আরও বেশি হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হলেও ইচ্ছে করে নেয় না। ওয়াশরুমে ঢুকে মাথায় পানি নিয়েই ডাকাডাকি শুরু করে! ‘বিস্টিইইই তোয়ালেএএএ বৃষ্টি প্রথম প্রথম কিছু মনে না করলেও এখন বিরক্ত হয়। হাতে কত কাজ থাকে! এভাবে জ্বালানোর মানে হয়?
ফ্রেশ হয়ে শ্রাবণ কোন তৈরী খাবার না পেয়ে ভাবে রেগে রান্না না করেই চলে গেছে মেয়েটা! কি রান্না করা যায় ভাবতে থাকে শ্রাবণ। একটু পরই ওর ফোনে বৃষ্টির মেসেজ আসে, ‘বয়ামে ছাতু আছে। ফ্রিজে দুধ। হালকা গরম করে মেখে খাবেন। হুহ্।’ এই আইটেমটা শ্রাবণের খুব প্রিয়। কোন কিছু খেতে ইচ্ছে না করলে সে এটা খায়। শ্রাবণ মনেমনে হেসে ওকে রাগানোর জন্য রিপ্লাই দেয়, ‘লাগবে না। অফিসে বিরিয়ানি লাঞ্চ ছিলো।’
সারাঘর জুড়ে বৃষ্টির স্মৃতি! ড্রেসিং টেবিল, বেড টেবিল, এখানে ওখানে চুলের কাটা, ছোট পাঞ্চ ক্লিপ, চুড়ি, পায়েল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চুল আঁচড়াতে নিয়ে দেখে চিরুনির সাথে ইয়া বড় দুইটা চুল। অন্যদিন হলে বিরক্ত হতো শ্রাবণ। আজ কেমন মায়া লাগে! কেমন ফাঁকা লাগে বুকের ভেতর! মনেহয় চারপাশে অদ্ভূত এক শূণ্যতা!
বিকেলে বৃষ্টিদের বাড়িতে আসে শ্রাবণ। সবার সাথে খুব ভাব, গল্প, গুজব করে বৃষ্টির রুমে এসে বলে, ‘চলো যাই।’
‘কক্ষনো না।’ ‘কবে যাবে?’ ‘কক্ষনো না।’ ‘এখানে থাকবে?’ ‘কক্ষনো না। কিহ্! হ্যাঁ থাক ‘হাহাহা থাকবেনা! তাহলে চলো।’ আমি কি তাই বলেছি? দেখো চালাকি করবে না!’ ‘আশ্চর্য! মাত্র তো তাই বললে!’ ‘শোন ‘আস্তে আস্তে! মা বাবা কিন্তু জেনে যাবে যে আপনি ঝগড়া করে এখানে এসেছেন!’ ‘আমি! আমি ঝগড়া করেছি?! জানুক। সবাই জানুক আপনি কেমন ঝগড়াটে! কিভাবে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপান।’ চাপা স্বরে বলে বৃষ্টি।
এর মাঝে বৃষ্টির মা আসে। ‘কি রে জামাই বাবাকে বসতে দে! কি হয়েছে?’ সুযোগ পেয়ে শ্রাবণ খুব স্বাভাবিকভাবে হেসে বলে ‘নাহ মা কিছু না। আচ্ছা আমি রিক্সা ডাকছি তুমি রেডি হয়ে আসো। মা আমরা বেশি দেরি করবো না। দিনকাল যা খারাপ!’ বৃষ্টি চাবিয়ে খাবো তোকে দৃষ্টি নিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবণ ভদ্র ছেলের মত সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসে। বৃষ্টি বুঝে যায় এখন না গেলে বিপদ! বাসার সবাই নানান প্রশ্নের পসরা বসাবে! জামাই বাবাকে কষ্ট দেয়া! ওরে বাপরে! তাই চুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত রাগ নিয়ে ও শ্রাবণের সাথে ফিরে আসে। শ্রাবণ জানে এই বোম বাসায় ফাটবে তাই সেও প্রস্তুুত হয়ে থাকে।
বাসায় এসে শ্রাবণের কেবিনেটে রাখা অফিসের ফাইলগুলো প্রথমে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দেয় বৃষ্টি। সাথে ননস্টপ ঝারি! ‘আমার সুখ তোমার সহ্য হয় না, না? কেন আনলে আমাকে বলো? কেন জোর করে আনলে? কেন এত অশান্তি করো? বলবে? অসহ্য হয়ে গেছি আমি। ছুটি চাই। ছুটি। শুনতে পাচ্ছো? কি হতো আমি বাড়িতে দু’দিন থাকলে? হ্যাঁ?’ শ্রাবণ এবার মুখ খোলে, ‘আমি বাড়িতে থাকতে পারতাম না।’ ‘গাছতলায় থাকতা।’ দ্বিগুণ ক্রোধে বলে বৃষ্টি। ‘গাছতলায়ও তোমাকে লাগবে। আচ্ছা, চলো না ছাদে যাই! যা সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ!’ ফাইলগুলো তুলতে তুলতে নির্বিকারভাবে বলে শ্রাবণ। ‘ঝগড়া করার সময় মনে থাকে না? এখন ঢঙ? তুমি ছাদে ঘুমাবে আজ। যাও।’ ‘তাই!’ ‘হ্যাঁ।’ শ্রাবণ উঠে ফাইলগুলো কেবিনেটে রেখে বৃষ্টির দিকে আগায়। বৃষ্টি পেছায়। ‘এদিকে আসো কেন? দূরে থাকো। খবরদার আর এক পাও আগাবে না।’
শ্রাবণ শোনে না। ওর খুব কাছে এসে বলে, ‘শোন, প্রত্যেকটি মানুষ এক একটি মৌলের মত। তুমি কি জানো আমরা মৌল থেকে যৌগ হয়েছি! তুমি মৌল + আমি মৌল = আমরা যৌগ। বিক্রিয়ার পরে যৌগকে আলাদা করা খুব কঠিন, জানো? তো আমি কি করে তোমাকে ছাড়া থাকি? ভুলচুক যা হয়েছে আসো সমতা করে নেই!’ বৃষ্টি বাঁকা করে রাগ আর সন্দেহের চোখে তাকায় শ্রাবণের দিকে। তারপর, হাত দুটো আড়াআড়িভাবে কোমড়ে রেখে বলে, ‘দেখো, আগেও বলেছি, তোমার পড়াশোনা, বিক্রিয়া টিক্রিয়া তোমার কাছেই রাখবে। আমার কাছে কেমিস্ট্রি ফলাতে আসবে না।’ ‘তো কার কাছে ফলাবো?’ হাসে শ্রাবণ। ‘যার কাছে খুশি।’ ‘রিয়েলি! এই কেমিস্ট্রি কিন্তু সেই কেমিস্ট্রি না। বুঝো! যার তার কাছে?’ মাথা ফাঁটিয়ে দেবো না!’ চোখ গরম করে বলে বৃষ্টি। তারপর দুজনেই হেসে ফেলে!
সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমের দরজায় টাঙানো নতুন কাগজে চোখ পরে বৃষ্টির। সেখানে শ্রাবণের হাতের লেখা, ‘অবশ্যই তোয়ালে নিতে ভুলে যাবো এবং বৌয়ের থেকে নেওয়ার সময় হাত ধরে টানাটানি করবো।’ বৃষ্টি হেসে ফেলে। ঘুমন্ত শ্রাবণের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদয় নিংড়ানো সুখের হাসি হাসে বৃষ্টি! এ হাসির রঙ লেগে ভোরের আকাশটা কেমন ঝলমল করে ওঠে।