বোকা প্রেমিক

বোকা প্রেমিক

কদিন ধরে ভাবছিলাম একটা প্রেমের কাহিনি লিখবো। ভাবছিলাম। কিন্তু লিখছিলাম না। কোনখান থেকে কীভাবে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না ছাই।  এখন ভাবছি ধুর, কাহিনিটা যে প্রেমেরই হতে হবে তার তো মাথার দিব্বি কেউ দেয়নি আমায়। তাহলে ! তাই আজ বসলাম তিন ইয়ার। আমি, আমার কলম আর ভবঘুরের ডায়েরির সাদা পাতা। দেখি কেমন জমে আমাদের আড্ডা ! সাদা কাগজটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বসেছিলাম। আচ্ছন্ন হয়ে। ওর সাদা ধপধপে বুকটাকে কলমের খোঁচায় কলঙ্কিত করবো আমি! যা লিখবো তাই বুক পেতে নেবে। ভালো, মন্দ, গালাগালি, অশ্লীলতা, রোম্যান্স, কমেডি, ট্র্যাজেডি যা কিছুই আমি দেব ও সেগুলো বুকে বয়ে বেড়াবে! কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই। গল্পের সময়কাল শীতের রাত।

স্থান একটা আধভাঙ্গা পোড়ো দোতলা বাড়ির নীচের একটা ঘর। ঘরে তিনটি প্রানী। এখন অবশ্য দুজনকে দেখা যাচ্ছে, তিন নম্বরটা সময়মতো দেখা দেবে।  দুজনের একজন শুয়ে, একজন বসে। বাইরে কনকনে শীতের প্রকৃতি ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া। ঘরের মধ্যে বিদ্যুত নেই। একটা জ্বলন্ত মোমবাতি আপ্রাণ চেষ্টা করছে ঘরটাকে উজ্জ্বলতর করতে তার অকৃত্রিম টিমটিমে আলো দিয়ে। মোমবাতি ছেলেটি জ্বালিয়েছিল। তাও প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। চিন্তিত সে। কারন তার সঙ্গিনী অসুস্থ। হয়তো বা জ্বর। একটি বিশেষ কারনে এখানে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাদের। মেয়েটি শুয়ে আছে ছেলেটার হাত আর ছড়ানো পায়ের উপর ভর করে। গুটিশুটি মেরে।

ছেলেটার শীত করছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সে উষ্ণতা উপহার দিয়েছে তার বাগদত্তাকে। আর সেকারনে তার গায়ের জ্যাকেটটা মেয়েটার নিস্তেজ শরীরে হার না মানা উষ্ণতা জোগাচ্ছে। মেয়েটি শুয়ে আছে ছেলেটির বাম হাত এবং বুকের অর্ধাংশ দখল করে। তাই পা ছড়িয়ে বসেও ঝুঁকে থাকতে হচ্ছে তাকে। তবে ডান হাতও চুপ করে বসে নেই। কখনো নিজের চোখে কপালে হাত বোলাচ্ছে, আবার কখনো প্রিয়তমার কপালে হাত দিয়ে দেখছে কেমন গরম। চিন্তিত সে। একটু জল পেলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় নেই। নড়াচড়ায় পাছে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে যায়, অনেক কস্টে ঘুমিয়েছে। এবার তিন নম্বর প্রাণীটির সাক্ষাত্ পাওয়া গেল। ওটা একটা কাঁকড়া বিছা। নিজস্ব ভঙ্গিতে সেটি এগিয়ে এল ছেলেটার দিকে। খল আর ক্ষিপ্র প্রাণীটির লক্ষ্যবস্তু ছেলেটির কর্তব্যরত নিশ্চুপ বামহাত।

অতর্কিত তড়িতাহত আক্রমণে দিশেহারা ছেলেটা যখন “উঃ, মাগো” শব্দটি উচ্চারণ করে আহত স্থানের দিকে তাকালো তখন সেখানে কাঁকড়া বিছাটি চরম আক্রোশে হুল ফুটিয়ে লেজ বাঁকিয়ে ধনুক ভাঙা পনে বিষ ঢালছে। ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছেলেটা ডান হাত দিয়ে বিছাটাকে ছিটকে দিল। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। মোমের আলোতে দেখা গেল। অনুভূতিতে প্রবল যন্ত্রণা। ছেলেটা এখন কী করবে? কী করা উচিত তার? প্রিয়তমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে যন্ত্রণা সহ্য করবে? নাকি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কিছু করবে! প্রিয়তমার কথা ভাববে? নাকি ভাববে না? প্রেম দিয়ে শেষ হবে? নাকি অন্য কিছু? মহান প্রেমিক? নাকি বাস্তব জীবনের “চাচা আপন প্রান বাঁচা” থিওরিতে বিশ্বাসী ছাপোষা বঙ্গ পুঙ্গব?

আমার কলম থেমে গেছে। ভাবনায় ভাঁটা। চিন্তারা এলোমেলো। এই মুহূর্তে আমি এ কাহিনির বিধাতা। কিন্তু তবুও আমি থমকে বোমকে ভাবছি দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোদুল্যমান মনে। ঠিক সেসময় আমার মৌন সাথী মোবাইলটা গোঁ গোঁ করে উঠল। ওটার নীলচে রহস্যময় তরল বুকে যে নামটা ভেসে উঠেছে সে নাম এ মুহূর্তে আশা করিনি। আমার প্রান সখী, আমার প্রিয়তমা মমতাজ ফোন করেছে! কী আনন্দ ঘরের বাতাসে।”হ্যালোওঔঔ। বেশ কায়দায় বললাম। জানি মমতাজ কথা বলার সুযোগ কম দেয়। আর খামখেয়ালি হুজ্জুতিপনা করে বেশি। খারাপ লাগে না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে অনলি মমতাজ। নো আর্গুমেন্ট, নো অজুহাত, অনলি ধুমধাড়াক্কা। একেবারে ঝোড়ো বাতাস, কিন্তু টাটকা সতেজ।

আমি কায়দা করে হ্যালো বলতেই এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,”শোনো, তোমায় বিশ মিনিট টাইম দিলাম। এর মধ্যে আমাকে শাদী করে তোমার কাছে নিয়ে যাবে। নাহলে ” নাহলে কী ? কী সোনা? কী হইসে!” আমার উৎকন্ঠাকে আর একটু উসকে দিতে মমতাজ বললে,” একুশ মিনিট পর খবর পাবে আমি কীভাবে মরেছি। তখন ওই গাধাটার মতো একটা তাজমহল বানিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদো। মনে রেখো, জাস্ট বিশ মিনিট। বাই এই হল মমতাজ। আগা আর গোড়া কিছুই বলবে না। মাঝখানের অংশ বলে এমন সমস্যায় ফেলবে যে ভেবে কূল কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই বাসায় ঝামেলা পাকিয়েছে। এখন আমি কী করি। এতক্ষণ খুব পাঁয়তারা মারছিলাম বিছা কামড়ানো বিষের জ্বালায় হরি হরি করা ছেলেটার কী করা উচিত ভেবে।  আমি এখন কী করি, হায় হায়। আমায় কোন হরিআল্লা বাঁচাবে ? আমি যদি স্পাইডারম্যান বা সুপার ম্যান হতাম তাহলেও বিশ মিনিটে মমতাজকে শাদী করতে পারতাম না। কারন দূরত্ব। প্রায় আটানব্বইয় কিমি দূরে সে থাকে তার আব্বার বাড়িতে।

ইতিমধ্যে চারবার কল দিয়েছি। নো রিসিভ। আট মিনিট ভেবেই পার করলাম। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার। ওদিকে কী হচ্ছে কে জানে! মমতাজ যা মেয়ে, ইচ্ছে করলে সব পারে। কথায় কথায় হাতের শিরা কাটতে পারে, বাকি ভাবনা মাথায় আসছে, বলতে ইচ্ছে করছে না। এ যেন টাকায় চারটে, সঙ্গে একটা ফাউ। কী যে করি এখন !
আমাদের কমন ফ্রেন্ড শম্পা কে একটা কল দিলাম। ও মমতাজদের পাড়ায় থাকে। কিন্তু বিধি বাম । শম্পা এখন জয়ের সঙ্গে নিক্কো পার্কে ইয়ে করছে। যত্তসব ইয়ের দল। বললাম, ” কাজের সময় যত অকাজ করে বেড়াস।”  অন্যসময় হয়তো কিছু বলতো ওরা। কিন্তু সবটা শুনে ওরাও চিন্তিত। একমিনিট পর ওরা জানালো যে ওদের কলও মমতাজ রিসিভ করছে না। আর ল্যান্ড ফোনে ওর কালা দাদীর ভয়ে কেউ কল করতে চায়না।

অগত্যা আমি করলাম ল্যান্ড ফোনে। বিপ বিপ বিপ। আমার হৃৎপিন্ড ধড়াস ধড়াস করে উত্তেজনায়। যাচচলে এখানে লাইন ঢুকছেই না। তিনবারের চেষ্টায় লাইন পেলাম। কিন্তু কে যেন ধরে বললে,” হেলো মানিকতলা ফায়ার ব্রিগেড। ধেত্তেরি , রঙ নম্বর হয়ে গেছে। একেবারে দমকল অফিসে চলে গেছে। আচ্ছা কেলো তো! আবার কেটে করলাম। এবার বলছে,” এই নম্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই।” ভাবা যায় ! মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই কথা। মমতাজকে বাঁচাতেই হবে। যেভাবেই হোক। সম্রাট শাহজাহান হয়ে পাবলিকের কাছে নাম কামিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম ছাপানো আমার কাম্য নয়। যা থাকে নসীবে, ভাবতে ভাবতে দা গ্রেট ভিলেন অমরেশ পুরির ফোন নম্বরে ডায়াল করলাম।” হেলো।

আমি অলরেডি হেলে গেছি। সত্যি বলতে কী এই একটা লোকই আমার মানসিক অ্যালার্জির কারন। এনার চাল চিবানো কথায় আর হিংসুটেপনা ব্যবহারে আমার অনেক জায়গায় চুলকায়। একেবারে চিড়বিড় করে। নেহাত মমতাজের আব্বু , তাই। আমি একটা বিষয় অনুভব করেছি ,প্রতিটা ঝামেলার প্রেমের কাহিনিতে দাদ হাজা চুলকানি থাকবেই। সত্যিকারের নয়। প্রেমিকার বাপ, মা আর ভাইদা হল প্রেমিকের কাছে অসহ্য দাদ হাজা চুলকানি। আমার আবার ফাউ হিসেবে জুটেছে কালা দাদি। একেবারে উটকো ব্রন। কলঙ্কিত চাঁদু। নেহাত মমতাজের মতো মলম ছিল বলে চুলকেও শান্তি। নিজে পারি না, কিন্তু মিমিক্রি শুনতে হেব্বি লাগে আমার। গলা নকল করে কথা বলা। চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই আসলে কে কথা কইছে। আজ আমি সেই চেষ্টা করলাম। গলাটাকে যথাসম্ভব মিহি করে বললাম, ” হেলো, খালু। মমতাজ আছে? ওকে একটু দিন না।”

“কে আপনে?””জ্বি, আমি ওর কলেজ ফ্রেন্ড।””আমারে ফোন দিছ ক্যান?ওর নাম্বার জানো না?” আমি বললাম, “ওর নম্বরে কল দিসিলাম। কেউ ধরলনা বলে আপনেরে কল দিসি।” আর দিউনি। আমি বাসায় নাই। আর পড়াশুনায় কাম নাই। বাপ মারে অসম্মান করা ছাড়া আর কোনো কিছু শেখায় তোমাদের কলেজ গুলা ?” কথাগুলো বলে ফট করে কেটে দিল ফোনটা। এবার আমার কান্না পেল। কী করবো বুঝতে পারছি না। মমতাজের কিছু হলে আমি কীভাবে বাঁচব? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি খেই হারিয়ে ফেললাম। কী করি কোথায় যাই এসব ভাবতে ভাবতে হঠাত্ একটা উদাসীনতা গ্রাস করলো আমায়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকা সর্বহারা মানুষের মতো সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক আছে , আমার মমতাজ যদি আমায় ছেড়ে চলে যায়, তবে আমিও পিছু পিছু যাবো। আগে জানবো , তারপর আমিও সুইসাইড করবো। যা ভাবা তাই কাজ।

মোবাইলের রাইট মেসেজ অপসনে গিয়ে মেসেজ করলাম,”চিন্তা নেই, আসছি। দুটো টিকিট কেটো। তুমি মরলে আমিও মরবো। একটা সিট রেখো প্লিজ। কিন্তু কীভাবে মরবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আগে থেকে পরিকল্পনা না থাকলে যা হয় আর কি!  একুশ মিনিট পনেরো সেকেন্ডে আমার মোবাইলে আলো জ্বলল। বুকটা ধক করে উঠল। ক্ষণিকের জন্য মনে হল এই কি শেষ ? উৎকন্ঠিত মনে মেসেজ ওপেন করলাম। মমতাজের নম্বর থেকে মেসেজ। লেখা আছে,”সুইসাইড ক্যানসেল। ব্যালেন্স নেই, কল ব্যাক করো এক্ষুনি।”আনন্দ উত্তেজনায় কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন করলাম। রীতি ভুলে আমিই আগে হ্যালো বললাম।

“হ্যালো। মমতাজ “আব্বার সাথে ঝগড়া হইছিল। সেসব তোমার না শুনলেও চলবে। তখন ইচ্ছে হয়েছিল মরে যাই। তুমি সুপারম্যানও নও, আর সালমান খানও নও। তোমাকে বোকা বললেও শব্দটার অর্ধেক বলা হয়। তুমি আমার বোকা প্রেমিক। ভেবে দেখলাম যে তোমার মতো আতা কেলানেই আমার দরকার। আমি মরলে তুমি সেদ্ধ আলুর মতো ভসকে যাবে। তাই আর মরা হল না। আর একনাগাড়ে কথাগুলো বলার জন্য বোধহয় মমতাজের দম নেওয়া প্রয়োজন হল , তাই একটু থামতেই আমি হড়বড় করে বললাম, “কী, কেন? ও মমতাজ। আর কী?”

আমার কথা শুনেও না শোনার মতো সে তার আগের কথার রেশ টেনে বললে,” আর আমার আব্বুরও বোঝা দরকার যে একটা হাফ বোকা, আনস্মার্ট, আতা কেলানেকেও কেউ ভালোবাসতে পারে। কারোর চোখরাঙানির তোয়াক্কা না করেই। কারন, তুমি বস খুব ভালো। আই লাভ ইউ। আমার “টু” বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। আমার ব্যালেন্স শেষ? নাকি মমতাজ কেটে দিয়েছে তা জানিনা। জানতেও চাই না। ওসব জানতে না চেয়ে মমতাজের তৈরি করা এখনকার এই ভালো লাগার আমেজে ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত