ভাইয়া ভিতরে আসবো?”
আমি আরিতার দিকে শুকনো দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কেমন দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। আজ প্রথম আরিতা আমার রুমে আসার জন্য অনুমতি নিল। তাও আবার ভদ্রতা বজায় রেখে। অবশ্য অনুমতি নিচ্ছে তার একটা কারন আছে। আর সেটা হল সিদরাত। আমার পাশেই সিদরাত বসে আছে।
– অনুমতি নেওয়ার কি আছে। আয় ভিতরে। এর আগে তো অনুমতি নিস নিই।
– তা নিইনি। তবে এখন থেকে নিতে হবে। নতুন ভাবি আসছে, তোর রুমে থাকবে যখন তখন কি অনুমতি ছাড়া ঢোকা যায়?
আরিতা কথাগুলো ভিতরে আসতে আসতে বললো। সিদরাতের পাশে যেয়ে বসে সিদরাতকে দেখতে লাগল। আমি বোবার মত চেয়ে দেখছি। তবে সিদরাত যে বেশ অবাক চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছি। অবাক হওয়ারই কথা। কারন আরিতা তাকে ভাবি বলেছে।
– কেমন আছো ভাবি? জানো ভাইয়া না তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমিও অনেক ভালোবাসো তাই না?
কথাটি শোনা মাত্রই আমি কাশি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আরিতা সিদরাতের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর সিদরাত আমার দিকে ওর আশুরিক গোল গোল চোখে চেয়ে আছে। সিদরাত যে বেশ অবাক হয়েছে তা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি। অবাক আমিও হয়েছি। কারন সিদরাত আমার বউ না।
– আরিতা তুই যা এখান থেকে। কি সব প্রশ্ন করিস না তুই। (আমি)
– আমি কেনো যাবো? যেতে হলে তুমি যাও। আমি এখন ভাবির সাথে বসে গল্প করবো। ভাবি জানো, তোমাকে ভাইয়া কতখানি ভালোবাসে? ভাইয়া যখনি অফিস থেকে আসতো তখনি তোমার কথা খালি বলতো।
– আরিতা তুই চুপ করবি?
– চুপ করবে কেনো? তুমি চুপ করো। কি বলতো এসে তোমার ভাইয়া? (সিদরাত)
– বলতো, আজ সিদরাত শাড়ি পরে এসেছিল অফিসে। ডান চোখের ভ্রুতে কাজলটা বেঁকে গেছে। ঠোটে হালকা লিপিস্টিক এ দারুন লাগে সিদরাতকে। ইচ্ছে করে ঐ ঠোটে গভীর একটা চুমু দিই।
আমি আরিতার কথা শুনে হা হয়ে গেলাম। সব সিক্রেট ফাঁস করে দিল এই মেয়েটা। সিদরাত আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তা দেখার সাহস আমার হচ্ছে না। আমি রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে গেলাম। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আজ থেকে দুইদিন আগের ঘটনাগুলো মনে করতে লাগলাম।
দুই,
সেদিন ছিল অফিস বন্ধের দিন। অফিস বন্ধ দিলেই আমার খুব রাগ হয়। কারন আমি আর সিদরাত একই অফিসে কাজ করি। রোজ রোজ তাকে দেখা আমার নেশা। তবে মজার ব্যাপার হলো সিদরাতকে আমি ছ মাস ধরে লুকিয়েই দেখি। কিন্তু সে কখনই এই বিষয়টা বুঝতেই পারিনি।
প্রতিদিন তাকে দেখতে দেখতে আমি তাকে প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু তাকে জানাতেই পারিনি কোনোদিন। তাই অফিস ছুটি থাকলে বিরক্ত লাগে খুব।
সকালে যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছি তখনি ফোনটা বেজে উঠল। নাম্বারটা চেক করতেই দেখি আদনান ভাই এর নাম্বার।
– আবির আজ কি তুই বিজি আছিস? (আদনান ভাই)
– নাতো ভাই। কেনো?
– সিদরাতকে একটু নিয়ে আসতে পারবি?
নামটা শুনেই কেমন যেন কেঁপে উঠলাম। আদনান ভাই সিদরাতকে কেনো আনতে যেতে বলছে? আদনান ভাই আমাদেরই অফিসের সিনিওর বড় ভাই। চুপ করেই রইলাম। তখনি তিনি আবার বললেন..
– কী হল আনতে পারবি?
– হুমম।
– গুড। বাঁচালিরে ভাই। তাড়াতাড়ি যা। টি.এস.সি তে।
উনি ফোনটা কেটে দিলেন। আমি টি.এস.সির সামনে আসলাম। দূর থেকে দেখি সিদরাত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর কাছে যেয়ে নামতেই অনেক বড় রকমের অবাক হলাম। কারন সিদরাতের গায়ে লাল শাড়ি। কিন্তু কেনো? আমাকে কাছে যেতেই সিদরাত বললো..
– তুমি এখানে?
– আদনান ভাই পাঠালো।
– আসেনি কেনো ও?
– ঠিক জানিনা। তবে আমাকে পাঠালো তোমাকে নিয়ে যেতে।।
– ওহ। তা কোথায় নিয়ে যেতে বলেছে সেটা তো জানো?
– হুমম আদনান ভাইয়ের কাছে।
– সে তো ফোন ধরছে না। এখন বন্ধ পাচ্ছি।
আমি বেশ অবাক হয়। সিদরাতের গায়ে লাল শাড়ি।যা সব মেয়ে বিয়ের ক্ষেত্রেই পরে থাকে। তবে কী আদনান ভাই সিদরাতকে বিয়ে করতে যাচ্ছে? না না এটা কখনই হতে পারে না। কিস্তু আদনান ভাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। রাস্তার মানুষগুলো নতুন বউ মনে করে সিদরাত আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি সবার দিকে বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি। তখনি সিদরাত বললো “চলো এখন। কোথায় নিয়ে যাবা?”
সিদরাতের কথায় ওর দিকে তাকালাম। ওর ফর্সা মুখটা হালকা মেকাপে লাল হয়ে গেছে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। দেখি বিকেল ৫টা বাজে।
– আবির,দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সমস্যা হবে এখানে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে। (সিদরাত)
– কি সমস্যা হবে? (বোকার মত প্রশ্ন)
– আরে গাধা, বিয়ের দিন বউ পালালে কি হয় জানো না? আসলে বিয়েটা আব্বু হঠাৎ করেই দেয়ার ব্যবস্থা করেছে তাই অফিসের কাউকে বলতে পারিনি। আর আদনান ভাইকে বলেছিলাম এ বিয়েতে কোনো মত নেই আমার। তাই উনি সাহায্য করবে বলে এখানে আসতে বলে। কিন্তু উনি তো কলই ধরছে না তার উপর ফোন বন্ধ। তাড়াতাড়ি চলো।
– এ্যাঁ… কোথায় যাবো?
– মানে কি? তুমি নিতে আসছো আমাকে আর কোথায় যাবা তা জানো না?
সিদরাত আমার হাত ধরে রিকশাতে ওঠালো। আমি তখনি কেঁপে উঠি। কারন এই প্রথমবার সিদরাত এভাবে স্পর্শ করেছে। রিকশা এসে থামলো আদনান ভাইয়ের বাড়ি। দেখি বাড়িতে তালা মারা। আমি হাবার মত চেয়ে আছি। সিদরাত বিরক্তি আর রাগে পড়ে আদনান ভাইয়ের গেটে কয়েকবার লাথি দিল। তারপর আবার রিকশাতে উঠলাম।
“কোথায় যাবো এবার ভাবি?”
রিকশা চালকের কথা শুনে আমি আর সিদরাত বড় বড় চোখে তাকালাম। অল্প বয়সি ছেলেটা তার পানখাওয়া দাঁত বের করে হেসে হেসে কথা বলছে। কিন্তু সিদরাতকে ভাবি কেনো বললো? হয়ত বিয়ের শাড়ি পরা তাই। সিদরাত কিছু বলতে যাবে তখনি আমি বলে উঠলাম “যেদিকে মন চায় সেদিকে চলো আজ সারাটা সন্ধ্যা ঘুরবো”
আমার কথা শুনে দুজনেই বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমিও আমার কথায় অবাক হয়েছি। সিদরাত কিছু না বলে সামনের দিকে চেয়ে আছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। আমি যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বসেছি যাতে ওর সাথে টাচ না লাগে। মাঝে মাঝে ভূলক্রমে টাচ লেগে যাচ্ছে। আর আমি কেপে উঠছি। এভাবে কতক্ষন ঘুরেছি জানিনা। সিদরাত বললো..
– এখানে নামবো?
– এখানে কেনো? ফাঁকা জায়গা। খারাপ জায়গা।
– হোক। আমার যাওয়ার জায়গা নেই আর। বাড়িতে গেলে আব্বু মানবে না। আর কোথাও যেতে পারবো না। তাই সারারাত ফাকা এই রাস্তায় বসে থাকবো।
আমি চারিদিকে তাকালাম। সিদরাতের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া লাগছে। সারাদিনের টেনশনে সুন্দর মুখটা কেমন লালচে হয়ে গেছে। আমি একবার ভালো করে দেখে নিলাম তাকে। তারপর রিকশা ওয়ালাকে বেশ জোর গলাতেই বললাম..”
– মামা উত্তরার *** নাম্বার বাড়িতে চলুন।
– ওখানে কেনো? কার বাড়ি?
– জানিনা কেনো? তবে আমার বাড়ি।
– কিহ? তোমার বাড়িতে যাবো মানে?
– জানিনা আমি। আমি যেতে বলেছি ব্যস যাবা। না গেলে থাকো তাহলে।
সিদরাত আর কিছু বলেনি। চুপচাপ আমার সাথে আমাদের বাড়িতে আসে। তখন রাত অনেকটাই বেজে যায়। আর বাড়িতে আসার পর প্রথমে আরিতা আমাদেরকে এমনভাবে ইন্ট্রোডিউচ করে দিয়েছে বাড়ির সবার সাথে যার মানে দাঁড়ায় আমরা হাজবেন্ড ওয়াফ। বউ পালিয়ে বরের সাথে বরের বাড়িতে এসেছে।
তিন
“এই মি. ললিপপ, আমাকে ভালোবাসো তা এতদিন বলোনি কেনো?”
সিদরাতের কথা শুনে ভাবনা থেকে চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়। দেখি সেদিনকার মত সেই শাড়ি পরে সে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আসলে বাড়িতে আনার পর অনেক ঝামেলা হয়। বুঝেনিই তো বাড়ির একটা ছেলে হঠাৎ বউ নিয়ে বাড়িতে আসলে কেমন হয়? যাকগে সে কথা অন্যদিন বলবোনি।
– চুপ করে আছো কেনো? আমাকে ভালোবাসো তা বলোনি কেনো?
লজ্বা মাখা চাহনি নিয়ে চেয়ে আছি সিদরাতের দিকে। কি বলবো ভাবছি। সেদিনের পর আব্বু আম্মু আমরা যে নকল বিয়ে করেছি তা না মেনে আমাদের বিয়ে আবার দেয়ার ব্যবস্থা করেছে আজ। আদনান ভাই এর মা সেদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই সেদিন এরাকম হয়েছিল। আজ তাকেও দাওয়াত দিয়েছি।
– সরি সিদরাত?
– সরি? কেনো?
– তোমাকে ভালেবাসার জন্য। তুমি যদি বিয়েটা না করতে চাও আমাকে বলতে পারো।
– মার খাবে?
– নাহ, ওটা খাই কিভাবে তা তো জানিনা। তবে অনুভব করা যায় তা জানি।
– চুপ ডেভিল বয়।
আমি সিদরাতের ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলাম। সিদরাতের সাথে আমার একটু পর বিয়ে। বাড়িতে প্রচুর লোক। সিদরাতের বাড়ি থেকেও অনেক লোক এসেছে। তবে আমি জানিনা আমাকে তার পছন্দ কিনা। আমার চুপ থাকা দেখে সিদরাত বললো..
– বিয়ের দিন বউ পালিয়ে এসেছে। আমার বাড়ির সবাই জানে এখন তোমার জন্যই পালিয়ে ছিলাম। এখন যদি আবার বলি তোমাকে বিয়ে করবো না।তাহলে তো আমার হাত পা ভেঙে চানাচুর বানাবে।
– ওহ তা ঠিক। তবুও তোমাকে আমার পছন্দ নাও হতে পারে।
– অপছন্দের কথা একবারো বলেছি?
– তাও তো বলোনি।
– হুম এখন বলো ভালোবাসো তা বলোনি কেনো?
– ভয়ে।
সিদরাত আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি ওর হাসির গভীরতা খোজার চেষ্টা করছি। দুজনেই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তখনি সিদরাত আমার ডান হাত ধরে আমার কাধে মাথা রাখলো। আমি হাবার মত চেয়ে আছি ওর দিকে। সে আস্তে করে বললো..
– গাধা, আমি কি পেত্নি নাকি যে ভয় পেতে হবে? তবে পেত্নি হয়ে ঘাড় মটকাবো যদি সারাজীবন ভালো না বাসো। কেবল চুরি করে দেখলে হবে? এখন থেকে সামনে দাঁড়িয়েই দেখবা হুম? আর হালকা লিপিস্টিক যদি পেটে যায়,তোমার পেট খারাপ করলে আমার দোষ না কিন্তু।
আমি কিছুই বললাম না। কেবল একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম। মুচকি হাসছি আর মনে মনে আদনান ভাইকে থ্যাংকস দিচ্ছি। ভাগ্যিস তিনি সেদিন আসতে পারেনি। তাহলে আজ দুজনে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার আলাপন করতে পারতাম না।