ভালোবাসার অন্যরূপ

ভালোবাসার অন্যরূপ

গত চারদিন আগে চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে রিয়াদ সাহেবের। নিজের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে এ সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। মূলত সফলতাকে ছোঁয়ার জন্য সবসময়ই পরিশ্রম করেন তিনি। এরই জন্যে হয়তো দেড় বছরের চাকরিতেও একে একে সব কাজেই সফলতা পাচ্ছেন তিনি।

রিয়াদ সাহেব তার পদোন্নতিকে উদ্দেশ্য করেই ছোট একটা পার্টি এরেঞ্জ করলো কলিগদের নিয়ে। কলিগদের এমনটাই চাওয়া ছিলো রিয়াদ সাহেবের কাছ থেকে। পার্টি শেষ করার ঠিক শেষ মুহূর্তে রিয়াদ সাহেবকে ঘিরে সবাই এক সুরেই বলে উঠলো, “রিয়াদ সাহেব, অফিসের কাজে প্রমোশন তো হয়েই গেলো, এইবার ব্যক্তিগত জীবনেও প্রমোশন করুন। বিয়েটাও সেরে ফেলুন।” কলিগদের কথায় হালকা একটু হাসি দিয়ে উত্তর দিলো রিয়াদ সাহেব, “হ্যাঁ, দেখি রিয়াদ সাহেবের উত্তরটা হাসিতে হলেও দেখেই মনে হচ্ছিলো কোন অজ্ঞাত কারণে ভেতরটা জ্বলছে।

নতুন দায়িত্ব পেয়ে অফিসের কাজে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রিয়াদ সাহেব। এই ব্যস্ততার মাঝেই নতুন ব্যস্ততার খবর এলো, তার একমাত্র মামার বড় মেয়ে আয়েশার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আয়েশা রিয়াদের চেয়ে চার বছরের ছোট হলেও তাদের আচরণ ছিলো বন্ধুত্বসুলভ। একে অন্যকে তুই করে বলতো সেই ছোটবেলা থেকেই।কাজের ভীষণ চাপ, তাই রিয়াদ সাহেব ভেবেই নিয়েছিলো বিয়েতে যাবেনা। কিন্তু আয়েশা ফোন করে একপ্রকার ধমক দিয়েই বললো, “তুই যদি না আসিস, আমি বিয়ে করছিনা” এরপর রাজি হতে বাধ্য হলো রিয়াদ। তাছাড়া বিয়ে বাড়িতে রিয়াদের মত একটা ছেলে না থাকলে ভালো লাগবেনা।
বিয়ের আগের দিন বিকেলেই বিয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌছালো রিয়াদ। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে দেখা করার আগেই দায়িত্বশীলের মত কাজে নেমে পড়লো। এইদিক ওইদিক বার বার যেতে হচ্ছে কাজের জন্যই। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই দেখা হচ্ছে সব আত্মীয়দের সাথে। সবার সাথেই তার হাসিমাখা আধ-পাগলা দুষ্টুমি। হাসি মুখ থাকা অবস্থায়ই তার চিরচেনা একজন ধূসর মানুষ এসে দাড়ালো তার সামনে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মানুষটি তাকে জিঙ্গেস করলো, “কেমন আছেন?” কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস না পেয়ে সেখান থেকে প্রস্হান করতে হল রিয়াদকে। এতক্ষণ যে ছেলেটা সবাইকে হাসিয়ে গেলো আধপাগলা দুষ্টুমিতে, সে ছেলেটাই এখন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এককোণে। রিয়াদের হঠাত এমন বদলে যাওয়ার কারণ সেই মানুষটি, যে তার ধূসর চিরচেনা। সেই ধূসর চিরচেনা মানুষটির নাম জান্নাত।

“”ঠিক চার বছর আগে এই বাড়িতেই তাদের প্রথমদেখা হয়েছিল। জান্নাত ছিলো আয়েশার হোস্টেল রুমমেট এবং ক্লাস ফ্রেন্ড। কলেজে পড়ার আগে আয়েশা জান্নাতের পরিচয় ছিলোনা। তাই রিয়াদের সাথে জান্নাতের ওই দিনই প্রথম দেখা এবং পরিচয়। জান্নাত স্বভাবতই একটু লাজুক টাইপের এবং কম কথা বলতো। পক্ষান্তরে রিয়াদ সবসময়ই দুষ্টু। সেদিন আয়েশাদের বাসায় বেড়াতে এসে রিয়াদ নামক দুষ্টু বিরক্তিতে পড়তে হয়েছিলো জান্নাতকে। দুই ঘন্টা পর জান্নাত চলে যায় তার বাসার উদ্দেশ্যে, তবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দুষ্টুমির পাশাপাশি জান্নাতকে দুই টাকার নোট দিয়ে একটা লাভ বানিয়ে দিয়েছিলো রিয়াদ। সেদিনই রিয়াদও ফিরে যায় বাসায়।

কিছুদিন পর আয়েশা জান্নাতদের বাসায় বেড়াতে যায়, জান্নাত আয়েশাকে তার আধ-পাগলা কাজিনের কথা জিজ্ঞেশ করতে ভুলেনি। অতঃপর কি যেনো একটা কাজে আয়েশা রিয়াদকে কল করে, আয়েশার ফোনে ব্যালেন্স ছিলোনা বলেই জান্নাতের ফোন থেকেই কলটা করতে হয়। রিয়াদ তখন ফোন রিসিভ করতে পারেনি, তাই পরবর্তীতে কল ব্যাক করলে জান্নাত ভুল পরিচয় দিয়ে ফাইজলামি করে এবং রিয়াদ তাকে বকা দিয়ে ফোন কেটে দেয়।

দুইদিন পর রিয়াদ আয়েশার কাছে জানতে পারে নাম্বারটা জান্নাতের। অতঃপর রিয়াদ জান্নাতকে কল করে সরি বলে এবং ক্ষমা মঞ্জুরের সাথে বন্ধুত্বের সমীকরণটা জুড়ে দেয়। ক্ষমা করে দেয়ার ফলে বন্ধুত্বের সমীকরণে জড়াতে হয় জান্নাতকে। বন্ধুত্বের একমাস পার হতেই জান্নাতের আচরনগুলো মুগ্ধতা ছড়ায় রিয়াদের মনে। জান্নাত একদমই সেকেলে, আধুনিকতার কোন ছোঁয়া নেই তার মাঝে। সব মিলিয়ে খুব ভালো একটা মেয়ে জান্নাত, তাই রিয়াদ তাকে প্রপোজ করলো এবং বললো, “আমি আপনাকে পাগলের মতো সারাজীবন ভালোবাসতে চাই, বিনিময়ে যেকোনো সম্পর্কে একটু কথা বললেই চলবে।”উত্তরে কিছু বলতে পারেনি জান্নাত, তবে কথা বলা কন্টিনিউ রেখেছিলো।

এভাবেই একমাস চারদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রিয়াদের পাগল করা ভালোবাসায় মুগ্ধ হয় জান্নাতও, তবে ভালোবাসি না বলেই ভালোবাসতে শুরু করে। রিয়াদ বুঝতে পারে জান্নাতও তাকে ভালোবাসে, তাই রাগ করার অভিনয়ে জান্নাতের কাছ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনতে আকুল হয়। জান্নাতও তার সরল মনে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়। দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তবে এই দুজনের ভালোবাসায় ছিলো শতভাগ পবিত্রতা। দুবার দেখা করেছে ঠিকই, কিন্তু হাত ধরতেও বারণ ছিলো জান্নাতের। কেউ দেখে ফেলার ভয়ে নয়, বিয়ের আগে এইসব করা ভালোনা, গুনাহ হবে তার জন্য।

এইসব মুহূর্তের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় নয়মাস। একসময় জান্নাতের পরিবার সব জানতে পারে এবং তাদের যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দেয়। এমনকি দুদিনের মধ্যেই জান্নাতের বিয়ে ঠিক করে ফেলে অন্য একজনের সাথে, কারন রিয়াদ তখনও ছাত্র ছিলো। আয়েশার কাছ থেকে রিয়াদ সবকিছু জানতে পারে বিয়ের আগের দিন বিকেলে। তারপর অনেক কষ্টে জান্নাতের সাথে কথা বলে এবং পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করে রিয়াদ। কিন্তু সেখানেও বাধা হয়ে দাড়ায় দুর্ভাগা বিবেক। কারণ, রিয়াদ তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং ষষ্ঠ পর্বের ছাত্র ছিলো। রিয়াদ জান্নাতকে দুর থেকেই ভালোবাসার নিয়তে দুরে সরে যায়।

বিয়ের পর জান্নাত অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে রিয়াদের সাথে, কিন্তু রিয়াদ যোগাযোগ করতে চায়নি। কারণ রিয়াদ চায়নি ভালো মেয়েটি তার স্বামীর কাছে খারাপ হোক। মাঝে মাঝে দুই-এক মিনিট কথা হয়েছিলো ফোনে, তবে সেটা পরকীয়া কিংবা খারাপ কোন প্রক্রিয়ায় নয়।”” এসব ভাবতে ভাবতেই রিয়াদের চক্ষুদ্বয় অধঃক্ষেপণ করতে লাগলো। হঠাৎ কেউ এসে পড়ার ভয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে রিয়াদ। অধঃক্ষেপিত অশ্রুগুলো মুছতে মুছতে কারো প্রবেশ অনুভব করলো রিয়াদ। হঠাত সেই চিরচেনা কন্ঠ থেকেই একটা প্রশ্ন, “এখানে একা দাড়িয়ে আছেন কেনো?” কোনো উত্তর পাওয়ার আগেই আবার জিঙ্গেস করলো, “কেমন আছেন বললেন না তো?” অনেক্ষণ চুপ থাকার পর উত্তর দিলো রিয়াদ আমার ভালো থাকার উৎস তো আপনার উপরই নির্ভর করতো, তাই উত্তর টা আপনারই জানার কথা।

সরি, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, আসলে সেদিন আমার কিছু করার ছিলোনা। কিন্তু আমার বিয়ের পর আপনি কেনো আমাকে রিফিউজ করলেন? বিবেক আমাকে সেটাতে সমর্থন করেনি, তাছাড়া অন্যের স্বপ্ন ভেঙ্গে নিজের স্বপ্ন সাজাবো? কেমন মানুষ আমি?আমার কথাটাও ভাবতে পারেননি? কথাটা বলেই জান্নাতও কেঁদে ফেলেছে।’ বাদ দেন এইসব। আপনার স্বামীর কি খবর বলেন? আমি জানিনা, আপনি প্লিজ আর আমার সামনে আসবেন না। আয়েশা তো বলেছিলো আপনি আসবেন না, তাহলে আসলেন কেনো? আপনাকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো, তাই আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেনা? হুম, অনেক ভালোবাসে। লোকটা অনেক ভালো কিন্তু আপনার জন্য লোকটাকে আজো মনে জায়গা দিতে পারিনি। আমাকে ভুলে যান প্লিজ। আপনি আমাকে ভুলতে পারলে আমিও পারতাম। আমিতো ভুলেই গেছি। কিন্তু আপনার চোখ তো তা বলছেনা। ‘এরপর পালিয়ে যাওয়ার মতই সেখান থেকে চলে গেলো রিয়াদ।’

রাত অনেক্ষণ হয়ে গেলো, কিন্তু সেই আধ-পাগলা দুষ্টু ছেলেটি নেই কোথাও। ছেলেটার হঠাত করেই এমনভাবে উধাও হওয়া দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ফোনও বন্ধ। জান্নাতের চোখের অশ্রুকণা গুলো বেরিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় নামতে শুরু করলো। জান্নাত ধরেই নিয়েছে তার জন্যই আধ-পাগলা ছেলেটা উধাও। তখনই আয়েশার ফোনে রিয়াদের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসলো, “আমার অফিসে আগামীকাল একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তাই না বলেই চলে আসতে হল।” জান্নাত বুঝতে পারলো তার জন্যই পাগলটা পালিয়েছে। ঠিক তখনই জান্নাতের ফোনেও একটা মেসেজ আসলো, “আপনার উদাস করা ভালোবাসাময় চোখে তাকানোর ক্ষমতা ছিলোনা আমার, ভালো মানুষটাকে গ্রহন করে নিবেন প্লিজ, ভালো থাকবেন,।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত