কিছু কিছু প্রেম গুলো বড্ড মিষ্টি হয়। প্রেম, পরিণয় তারপর একসাথে বুড়ো হওয়া।
কিছু কিছু প্রেম এক তরফাই থাকে। ওই যে আজ বলব, কাল বলব করে একদিন আফসোস থাকে শুধু।
কিছু প্রেম গুলো দুর্ঘটনা হয়।দুর্ঘটনা বশত দেখা, তারপর সারাজীবন হাতটা শক্ত করে ধরে রাখা একে অপরের।
আর কিছু প্রেম গুলো.. না গল্পটা পড়তে হবে তার জন্য…
অনেকক্ষন ধরে বসে বাবার জন্য। সেই কখন বসিয়ে চলে গেছে।স্কুল থেকে ফেরার পথে বাবার সাথে যাই, তাই আজো এসেছি। আমাদের বাড়িটা উত্তরপাড়া চেনেন? তার ঠিক সংলগ্ন মাছের বাজারটার পাশেই। রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে রোজ স্কুলে যাই। বাবার এই বাজারের থেকে একটু দূরেই মুদি দোকান। স্কুল ফেরত বসি দোকানে।বাবার সামনেই লজেন্স বের করে খাই। আজ বাবা বসিয়ে বলল,
-বাবু বস চুপ করে।ও বাড়ি দিয়ে আসছি।
কী একটা বলল!পেমেন্ট নিয়ে আসছি নাকি!বুঝলাম না। যাকগে! বাবুলগাম একটা মুখে পুড়ে বাইরে এলাম ছুট্টে।সারাদিন ই এক একটা ট্রেন দেখি, আর তারপর সেগুলো যতক্ষন না ছোট হয়ে মিশে যায় ততক্ষণ দেখতে থাকি।তারপর ওই রেল লাইনের দিকে চেয়ে থাকি। আবার ওরা একা হয়ে গেল। বড্ড ভালো লাগে সঙ্গে মন খারাপ ও হতো।বাবাকে বলতাম,
-আচ্ছা বাবা, রেল লাইনগুলো কত বড় গো? ওরা মেশে না কেন একে ওপরের সাথে?
বাবা বলত,
-ধুর পাগল, মিশলে ট্রেন দুর্ঘটনা হয়ে যাবে না! পাশাপাশি আছে বলে হয়ত বাঁচার আশা আছে।
চোখে বড় বড় করলে আদর করে কোলে নিয়ে নিত। যাকগে, বাবা এল খুব একটু পর, দোকান বন্ধ করে আমরা বাড়ির দিকে এগোলাম। শুনতে পেলাম আরো একটা ট্রেন ঢুকছে।আচ্ছা আমি নাম বলিনি না আমার? আমার নাম রাহুল, রাহুল সেন।আশাকরি নামটা সবাই শুনেছেন।
ঘড়ির কাঁটা যেমন দ্রুত এগোচ্ছিল, তেমন এগোচ্ছিলাম আমি।গুটিকতক বন্ধু, আর আবছা একটা স্বপ্ন নিয়ে।আবছা কেন বললাম জানেন? উচ্চ মাধ্যমিক শেষ! এর পর কলেজ। এই তিনটে বছর ভালো করে না পড়লে …যাকগে আমি একটা সিট পেলাম মনীন্দ্র কলেজে।দিচ্ছিল না একদম, জোর করেই নিলাম!গতানুগতিক জীবনযাত্রা হঠাৎ পরিবর্তন করতে গেলে নিজে থেকেই এগিয়ে যেতে হয়।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কিছুতেই পারছিলাম না।কলেজ, বাড়ি আর টিউশন করে যখন প্রথম বর্ষ প্রায় শেষের মুখে, ভাবলাম ছেড়ে দিই সব।দোকানে ঢুকি, “মুঝসে নেহি হোগা”। আর চার পাঁচ জনের মত যৌবনের সিঁড়িতে সবে পা দিয়েছি, এমন সময় অর্কুট নামে এক বন্ধুর সাথে আলাপ হলো।রোজ যেতাম সময় করে ক্যাফেতে।ভালো লাগত অচেনা ভার্চুয়াল জগতে গা ভাসাতে।ভাবলাম ধুর এসব আবার সত্যি হয় নাকি!একদিন এমনই দুপুরে প্রোফাইল অন করতেই দেখি একটা রিকুয়েস্ট সঙ্গে একটা মেসেজ। নাম সাঁজবাতি।ধুর!মেজাজ গেল চটে!ফেক ভর্তি সব।মেসেজটা হলো,
-হাই, তুমি রাহুল তো? অনিমেষকে চেনো?
অনিমেষ , চিনি ওকে সেই নার্সারি থেকে।বললাম,
-হু, তুমি কি করে চিনলে?
বলল,
-আমার স্কুলে পড়ত।
একটু কথা বললাম সেদিন।এ কথা , ও কথার মাঝে বললাম,
-এত কথা বলছি, নাম কী তোমার?
রিপ্লাই এল,
-শ্রেয়া, শ্রেয়া মুখার্জি।
বাড়ি এলাম পেছনে “লা লা লা লা”ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুনতে শুনতে।মানে শুধু আমিই শুনতে পাচ্ছিলাম।তারপর থেকে প্রায় অভ্যাস হয়ে গেল ও।রোজ ই প্রায় সারাদিনের মাঝে ছুটে যেতাম ক্যাফেতে।একদিন বলল,
-কাল দেখা করবি?
কি বোর্ডে “হ্যাঁ”লিখে মুছে “না” লিখতেই বলল,
-আচ্ছা।
পরের দিন অনিমেষ ফোন করল,
-ভাই আজ কিন্তু আসিস, খেয়ে যাবি।
ঠিক দুপুরে যখন পৌঁছলাম , ভেতরের ঘরে ঢুকে একটু পিছিয়ে এলাম জাস্ট।একটা মেয়ে বসে।টকটকে ফর্সা, একটা হলুদ আর কালো রঙ করা সালওয়ার পরে।চুলটা স্নান করে এসেছে জাস্ট, তাই খোলা হয়ত।দুটো ভুরুর মাঝে ছোট একটা কালো টিপ।হাসতে হাসতে বলল,
-রাহুল আমি শ্রেয়া রে!
কি, কেন, কোথা থেকে এসব প্রশ্ন ঘুরছিল মাথায়।অনিমেষ হাসতে হাসতে বলল,
-আমিই ডেকেছি ওকে।তুই নাকি দেখা করবি না? তাই …
শুধু দেখছিলাম ওকে।একটা মন ভালো করা হাসি আর অনেকটা ব্যথা ভরা চোখটা।হাসিটা চোখ অব্দি স্পর্শ করছে না।মনে হলো এর নিজের পৃথিবী আছে হয়ত।চুলগুলো হাওয়াতে অল্প উড়ে যখন সামনে আসছিল, মনে হলো বলি,
-ওরে অনিমেষ একি করলি তুই?? এবার আমি মরলে আমার বাড়ির লোককে কে দেখবে?
তারপর ভাবলাম “বালাই ষাট,মরব কেন? এখনও অনেকটা বাঁচতে হবে , শুধু ওর সাথে”।
হঠাৎ করেই শুরু হলো এবার ওকে জানা, দেখা করা আর সারাদিনের ওর রোজনামচা শোনা।শ্রেয়ারা খুব বনেদী বংশের মেয়ে।ওর বাবা, ঠাকুরদার সব কাঠের ব্যবসা আছে।মাঝে মাঝে বলতাম,
-হ্যাঁ রে আম্বানি তোদের থেকে গরীব না?
ভালো লাগত জানেন খুব! চেনা রাস্তা, চেনা শহর যেন দীপাবলীর মত আলোকে মুড়ে থাকত।ভালো লাগত ওকে, ওর খিল খিল করে হেসে আলত করে পিঠে চাপর দেওয়া, সিনেমার দুঃখের দৃশ্যে দু গাল লাল করে কাঁদা, ফুচকা খেয়ে উফ আফ আওয়াজ করা আর রাস্তা পার হওয়ার সময় আমার কড়ে আঙ্গুলটা ধরা।বারবার বলতাম,
-কিরে! হাত ধরতে কী হয়?
বলে,
-ভালো লাগে জানিস।বাবার সাথে এইভাবেই স্কুলে যেতাম।এখন না বাবা খুব ব্যস্ত, আর আঙ্গুলটা ধরাই হয় না!
চুপ করে থাকতাম।আমার না বুকটা খুব মোচড় দিয়ে উঠত।এই বদভ্যাসটা আস্তে আস্তে ক্যানসারের মত ছড়িয়ে পড়ছিল।একদিন ডাকল আমায় বাড়িতে।ঢুকতেই বলল,
-চোখ বন্ধ কর
করতেই হাতে একটা ইয়া বড় বাক্স দিল।খুলে দেখলাম একটা পোর্টেট, আমার আদলে সৃষ্ঠি ওর।একটু দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল।এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিলাম, ফিরল না।জোরে টেনে বুকে নিতেই থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে ফেলল।বললাম,
-বাসবি ভালো আমায়?
আমার জামাটা ততক্ষনে চোখের জলে একাকার।বলল,
-বড্ড দেরী করে এলি রাহুল।দু হাত দিয়ে জাপটে ছিল কিছুক্ষন।বন্ধ ঘর, ঘড়ির আওয়াজ আর দুটো হৃদস্পন্দনের শব্দ।সব মিলেমিশে সেদিন “আমি”টাকে অনেকটা বড় করে দিল।না বলে নি সেদিন “আই লাভ ইউ”আমায়।আমি আর শুনতে চাই নি।যার নিঃশ্বাসের বিষ সারা শরীরে নিয়েছি, নাই বা শুনলাম ওর ভালোলাগার কথা।
তারপর থেকে দায়িত্বটা হঠাৎ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।না, এবার খুব বড় হতে হবে।একদিন ডাকল আমায় খাওয়াবে বলে।গেলাম এই সল্টলেকের ই একটা অনামী রেস্টুরেন্টে।গিয়ে দেখি কেউ নেই, একা আমি।প্রচন্ড রাগ হয়ে ফোন করতে যাব, কোথা থেকে ঝড়ের মত এসে বলল,
-বস এখানে
বসলাম।ইশারায় আনতে বলল কিছু ওয়েটারকে।সামনে রাখল প্লেটটা।দেখলাম আলুর পরোটা আর একটু দই।আগের রাতেই বলছিলাম ওকে।আমার না চোখে জল চলে এল।বলল,
-পারি না রান্না করতে।তোর ভালো লাগত না করলে হয়ত, তাই হোটেল।খা না একটু দেখি।
মাথা নীচু করে খেতে শুরু করলাম।সেদিন ফেরার সময় প্রথম ছুঁলাম ওর মাথায় আমার ঠোঁট।লজ্জায় সেই যে মুখ ফিরিয়ে এগোলো, সারা রাস্তা ,আর পেছন ফিরে দেখেনি।
যেদিন ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার জন্য ওকে ছাড়তে গেছিলাম, হাতটা ধরে বলেছিল,
-দাঁড়াতে পারবি তো?
কিছু বলতে পারিনি।বুকের কাছে দলা মাখা কষ্টটা যখন উগরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া প্লেনটা দেখে চিৎকার করছিলাম,
-হ্যাঁ পারব, তুই থাকিস কিন্তু।
আচ্ছা অনেক টানলাম, এবার তাহলে ক্লাইম্যাক্স…
হোয়াটসএ্যপে সেদিন মেসেজটা পেলাম , ওর বিয়ের।না একটুও কষ্ট হয়নি।ভালোই করেছে ও…
কাশিটা বড্ড বেড়েছে এ কদিন।এ বছর ঠান্ডাটাও জানেন তো! বউ ঢুকল ঘরে গজগজ করতে করতে,
-এত করে বললাম মাফলার নিলে না!
চোখ বন্ধ করে আছি।একটু হাসি পাচ্ছে।মোবাইলটা ভাইব্রেট করতেই, আবছা চোখে লক খুললাম।সেন্ডার শ্রেয়া,
-ওষুধ নিয়েছিস? যতই মুখ চেপে কথা বলিস, ঠিক বুঝেছি।কালকের মধ্যে আগের মত গলা না শুনতে পেলে সব জায়গায় তোকে ব্লক করব দাঁড়া!
এ একটা মুশকিল হয়েছে।আগে আমি ব্ল্যাকমেল করতাম, আজকাল ও করে। চুপ করে শুনি।বাবার একটা কথা মনে পড়ল আজ।ঠিকই
“সব প্রেমে মিল হতে হবে এমন কি কথা আছে।কিছু প্রেম রেললাইনের মত সমান্তরাল হয়।সারাজীবন পাশে পাশে থাকবে, দেখবে একে অপরকে , শুধু ছুঁতে পারবে না।নিঃশব্দে এগিয়ে যাবে শুধু”।