আপু! এই আপু! বল ভাইয়া ঐ আকাশের একটা তাঁরা তুমি আর একটা তাঁরা আমি তাই না? হুম ভাইয়া।একটা তুমি একটা আমি। আপু! তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাস? অনেক ভালবাসি।যা পরিমাপ করা যাবে না, যা বলে বোঝানো যাবে না। আচ্ছা আপু আমি তোমাকে কতটুকু ভালবাসি? অনেক ভালবাস। তুমি কিভাবে বুঝ? যেভাবে তুমি বুঝ সেভাবেই আমি বুঝি। তাই না? হুম ভাইয়া।
হঠাৎ তার আপু স্বপ্নে থেকে হারিয়ে যায়।এতক্ষণ স্বপ্ন দেখতেছিল। ঘুম থেকে উঠে অনেক ডাকাডাকি করে তারপরেও তার আপু ফিরে আসে না।তারপর বলতে থাকে আপু আপু বলে ডাকি কিন্তু আপু শুনে না। আপু আপু বলে ডাকলে কেন আপু সারা দেয় না? আপু কি আমার কথা শুনে না? শুনলে কেন উত্তর দেয় না? এই আপু একবার কথার উত্তর দিলে কি এমন দোষ হয়? একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়? এই কথা গুলো বলে আর কাঁদে।কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফেলে কিন্তু তার আপু তবুও কথা শুনে না, একটু কথা বলে না, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না।কি করে শুনবে? কি করে কথা বলবে? কি করে আদর করবে? কি করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? তার আপু যে নেই এই দুনিয়াতে। মায়ের পেটেয় যে চলে গেছে ঐ আকাশে।
কিছুক্ষণ পর তার মনে হয় তার আপু যে এই দুনিয়াতেই নেই।এই কথাটা মনে হতেই আরও কাঁদতে থাকে।কিন্তু তার এই কান্না কেউ দেখে না, কেউ শুনে না, কেউ থামাতে আসে না।কারণ তার কান্না থামানোর মত যে কেউ নেই রাতের ঐ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আপু আপু বলে কাঁদতে থাকে।তারপর বলতে থাকে জানো আপু! আজকে না মাকে বলেছিলাম একটা মোবাইল কিনে দিতে কিন্তু মা বলে কিনে দিতে পারবে না। মাকে বলি কেন কিনে দিবে না? মা বলে তোর মত ছেলেকে! কিনে দিব মোবাইল? না পারিস ঠিকমত পড়তে, না পারিস ঠিকমত চলতে। না পারিস বাবা-মার মুখ উজ্জল করতে। আবার বলিস মোবাইল কিনে দিতে! তারপর আমি বলি দিবে না কিনে? না দিব না। এখন আর আমার কথার দাম নাই! তাই না? আমি থাকলেই কি! না থাকলেই কি! তোমাদের তো কিছু আসে যায় না।
আমি তো এখন একটা অপদার্থ হয়ে গেছি তাই না? হ্যাঁ ঠিক বলছস। তুই মরলেই আমি বাঁচি তোর মত ছেলের থাকার কোনো মানে নাই। তুই মরতে পারিস না? তুই মরলেই তো আমরা বাঁচি তোর জন্য এখন আমরা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারি না, তোর পরিচয় দিতেও এখন আমাদের ঘৃণা করে, লজ্জা করে, তুই বুঝিস না? যে গুলো মরে গেছে সেগুলো মরে ভাল করেছে। থাকলে তো তোর মতই হতো(শেষের কথা গুলো বলতেই তার মা জিহবাতে কামুড় মারে, মনে মনে বলে রাগের মাথায় একি বললাম আমি) মায়ের শেষের কথা গুলো শুনে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা না বলে সরাসরি নিজের রুমে চলে আসি। আপু! এই আপু! মা তো ঠিক কথায় বলেছে, তাই না? আমার মত ছেলের তো দুনিয়াতে থাকার কোনো মানে নাই। যে ছেলে বাবা-মার মুখে হাসি ফুটাতে পারেনা, সে ছেলের দুনিয়াতে থাকার কোনো মানে হয় না। সে বেঁচে কি করবে? আপু! আমি তো তোমার ভাই হয়েও ভুল করেছি তাই না? আপু! এই আপু! কথা বল! কথা বলবে না? ও তুমি কেন কথা বলবে! আমার কথার উত্তর দিতে তোমার ও আর ভাল লাগে না, তাই না? মনের দুঃখে এসব কথা বলতে বলতে আর কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
আজ সন্ধার পর নীল তার মায়ের সাথে রাগা-রাগী করে।আর তার মা রাগের মাথায় অনেক কঠিন কথা বলে ফেলে।তাই সে মায়ের সাথে রাগ-অভিমান করে ভাত না খেয়ে রাত কাটাতে থাকে।এবং মনের দুঃখে বিভিন্ন কথা ভাবতে থাকে ও বলতে থাকে আর এক সময় এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে । তার মা! ছেলেকে গালি-গালাজ করে ছেলের চোখের আড়ালে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে কেন এসব কথা বলতে গেলাম না বললেও তো পারতাম। যে ছেলে! কে জানে রাগ-অভিমান করে কতদিন পাড় করে দিবে! নীল অনার্সে পড়ছে।কিন্তু অনার্সে পড়লে কি হবে? এখন সে ভন্ড ছাত্র হয়ে গেছে এবং ভন্ড ছেলেও হয়ে গেছে।পারিবারিক কারণে এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষার পয়েন্ট খারাপ আসে। তার যে স্বপ্ন ছিল এই খারাপ রেজাল্ট গুলোর সাথে স্বপ্ন টাও নষ্ট হয়ে যায়।এখন সে নামে মাত্র অনার্সে আছে।কোনো রকমে অনার্স টা শেষ করবে।এখন এটাই তার স্বপ্ন।
নীল ছেলে হিসেবে ভাল ছিল ছাত্র হিসেবেও ভাল ছিল ।ছোট থেকেই ভাল রেজাল্ট করে করে সে বড় হয়েছে।কিন্তু এই দুই রেজাল্টেই তার সব শেষ হয়ে যায়, সাথে তার আচার-ব্যবহার ও নষ্ট হয়ে যায়।যখন সে তার বাবা-মার কথা না মানে তখন তার বাবা-মা মনের দুঃখে গালি-গালাজ করে।মাঝে মধ্যে কঠিন কথাও বলে ফেলে।আবার মাঝে মাঝে তার বন্ধু-বান্ধুবীদের নিয়েও কথা তুলে। সে অন্য সবার কথা সহ্য করতে পারে, কিন্তু তার বাবা-মার কথা সহ্য করতে পারে না।আর তখনেই তার খুব দুঃখ ও কষ্ট হয়।
কিন্তু তার এই কষ্ট কাউকে দেখাতে পারে না, তার এই দুঃখ কাউকে বলতে পারে না।কারণ তার এই দুঃখ-কষ্ট গুলো বলার মত কোনো বড় বা ছোট ভাই-বোন নেই বা অন্যকোনো মানুষ ও নেই।নীলেরা তিন ভাই ও এক বোন ছিল।কিন্তু দুই ভাই আর ঐ বোন তার মায়ের পেটেই চলে যায়।সে তার ঐ দুই ভাইকে দেখেছে, কিন্তু তার ভাগ্যটা এমন বোনটাকে এক নজর দেখতে পারেনি বোনটার সাথে একটু কথা বলতে পারেনি। বোনটার একটু আদর ও পেতে পারেনি। আর সে জন্যই কল্পনাই বোনের সাথে দেখা করে, কথা বলে, নিজের সুখ-দুঃখ গুলো শেয়ার করে, আবার হাসে-কাঁদে। শুভ সকাল ভাইয়াটা শুভ সকাল আপুটা এই যে ভাইয়া! তোমার চা টা উমম– অনেক মিষ্টি আপুটা তাই না ভাইয়া? হুম।
আমার লক্ষি আপুর চা টা আপুর মত মিষ্টি না হয়ে পারে! ওলে ওলে আমার ভাইয়াটা(গাল টেনে ও কপালে চুমু দিয়ে) আপুপু– বলে নীল ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে উঠে।তারপর আপু আপু বলে ডাকে আর চারদিকে তার আপুকে খুজতে থাকে।কিন্তু তার আপু আসে না আর ফিরে।তারপর বলতে থাকে আপু! আপু! এই আপু! আমার ভাগ্যটা এরকম কেন? কত ভাই বোনের ভালবাসা দেখী তাদের মান-অভিমান, খুনসুটিও দেখী।তখন কত যে ভাল লাগে কিন্তু যখন আমার কথা চিন্তা করি! জানো তখন অনেক কষ্ট হয়! চোখে অনেক পানিও জমা হয়। কিন্তু আমি! তোমার ছবিটা পর্যন্ত দেখতে পারলাম না? এই দুনিয়াটাতে কেন কিছু বছর থাকতে পারলে না? থাকলেই তো তোমাকে দেখতে পারতাম! কথা বলতে পারতাম! তোমার আদর-ভালবাসা পেতাম। তোমার সাথে রাগ করতাম অভিমান করতাম আবার মিশে যেতাম।
আবার তোমার সাথে গল্প করতাম, দুষ্টামি করতাম, খেলা করতাম।আমি দুষ্টামি করলে মা-বাবা আমাকে মারতে আসলে তোমার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পরতাম। কিন্তু আপু! আমার ভাগ্যটা এমন কেন? বল না আপু! আমি কেন ভাল হতে পারি না? আমি কেন বাবা-মার মুখে হাসি ফুটাতে পারি না? কেন বাবা-মার সাথে বাজে ব্যবহার করি? কেন সবাই আমাকে ভুল বুঝে কেন সবাই এখন দূরে দূরে রাখে? জানো আপু! মাঝে মাঝে না আমার মাথাটা খুব ব্যথা করে, এই ব্যথাটা বছরে একবার ভাসে তখন মনে হয় আমি আর বাঁচব না। কিন্তু আমি না মরি না, কেন মরিনা? আল্লাহ যে কেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে সেটাই তো বুঝি না।এসব বলতে বলতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
নীলের মা নীলকে ডাকতে এসে দেখে নীল ঘুমিয়ে আছে।তখন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখের কোণে জলের ফোটা জমে আছে।এই দৃশ্যটা দেখে তার আর সহ্য করতে পারেনি; সাথে সাথে কেঁদে ফেলে।মনে মনে বলে আমি মা হয়ে ছেলেকে এত কষ্ট দিয়ে ফেলেছি এর আগে আমার মরণ হল না কেন।আমার মরণ টাই ভাল ছিল।এমনেতেই ছেলেটা অবুঝ।একটুতেই রেগে যায়, একটুতেই অভিমান করে ফেলে। আর রাগের মাথায় আমি কতকিছু বলেছি।আমি তো দুঃখ-কষ্ট গুলো আমার স্বামীর কাছে শেয়ার করতে পারি বা উনি শেয়ার করতে পারেন।কিন্তু সে তো কোনোদিন কিছু আমাকে বলে না, আবার কারো কাছে যে বলবে এমনও তো তার কেউ নেই। তাহলে সে কিভাবে থাকে! কিভাবে দুঃখ-কষ্ট গুলো বুকের মাঝে জমা রেখে দিন কাটায়! এসব বিলাপ করতে থাকে আর কাঁদতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর নাস্তা নিয়ে এসে নীলকে ডাকতে থাকে। নীল এই এই নীল ঘুম থেকে ওঠ বাবা আর কত ঘুমাবি? নীল ঘুম থেকে ওঠে চুপচাপ বসে থাকে।মায়ের কথার উত্তর দেয় না। নীল মায়ের সাথে অভিমান করে থাকবি কথা বলবি না? তারপরেও চুপচাপ থাকে।
এই নীল চুপ করেই থাকবি! কথা বলবি না? যেদিন থাকব না সেদিন কেউ গালি-গালাজ করবে না, রাগ দেখাবে না, রাগ-অভিমান ভাংগাতে আসবে না, কেউ কিছু বলতেও আসবে না, সেদিনেই ভাল হবে তাইনা? তখন নীল মাকে ধরে কাঁদতে থাকে কিছু বলতে পারে না, মা ও তার ছেলেকে ধরে কাঁদতে থাকে।কিছুক্ষণ পর বলে না মা তুমি কেন মরবে! আমি মরব আমি মরলে তো তোমাদের ভাল হবে। না বাবা এই কথা বলিস না, তখন তো রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম।তুই বুঝিস না? এই সব কথা কখনো বলবি না।তুই না থাকলে আমাদের বেঁচে কি হবে! নীল আর কিছু বলতে পারেনি; চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে।আর তার ঐ বোনটার কথা ভাবতে থাকে। এভাবেই নীল মাঝে মাঝে সপ্নে আপু আপু বলে ডাকে, তারপর দেখা করে, কথা বলে, সুখ-দুঃখ গুলো শেয়ার করে, বোনের সাথে হাসে, বোনের সাথে কাঁদে আবার বোনের সাথে দুষ্টামি করে।এভাবেই সে তার দিন গুলি কাটাতে থাকে।