প্রেমিকার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে আমাকে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করতে হবে তা কখনো ভাবিনি। সুমার অন্য কোথাও বিয়ে হবে এটাও কি কখনো চেয়েছি আমি? আমারতো এখন কোনো অন্ধকারে বসে মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দুঃখ বিলাস করার কথা ছিল। অথচ আমি নিজ প্রেমিকার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে। ঠোটের কোণে আনন্দ ছড়িয়ে আমি সুখের অভিনয় করে যাচ্ছি। আবার ভেবে দেখলাম, আমি সত্যিই অভিনয় করে যাচ্ছি নাকি প্রকৃত সুখেই আছি।
গায়ে হলুদে আসাতে শিমু আজ একটু অভিমান করবে তা আমি জানি। শিমুও জানে আমি সুমাকে ভালোবাসতাম। আজ সুমার গায়ে হলুদে আমি আসব আর শিমু ঘরের বউ হয়ে সেটা মেনে নিবে কী করে?
শিমুকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছি সাত মাস আগে। সাতমাসে আমাদের দু’জনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছে। আর আমি মনে করি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত। তবুও কোনো মেয়ে তার স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে ভাবতে পারেনা। কোনো স্বামীও তার স্ত্রীকে অন্য কারো সাথে ভুল করেও কল্পনা করতে পারেনা। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই এমন।
গায়ে হলুদের রাতে কেউ বিরহের গান বাজায়? আমি বাজাচ্ছি। স্পিকার অপারেটর ঝিমুচ্ছিলেন। রাত প্রায় একটা। একে একে সবাই যেতে শুরু করেছে। শীতের রাত, সবাই চায় একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে। সুমার রুমের আলো জ্বলছে। হয়তো এখনো দুই পাশে দুই তিন বান্ধবী বসে আছে। প্যান্ডেলের ভিতর আমরা তিন চারজন বসা। আমিই স্পিকার অপারেটরকে জেমসের গানটি বাজাতে বলেছি। আমার প্রিয় একটি গান।
“আমি আর আমার এই দু’চোখ, কখনো জলে ভেজাবনা।
এ ব্যথা আমারই থাক, চাইনা কারো সান্তনা।”
রাত দশটার দিকে শেষ হয়েছে গায়ে হলুদ পর্ব। সুমাকে হলদে পরী সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল গায়ে হলুদের মঞ্চে। আমি আড়চোখে তাকিয়েছি অনেকবার। আমার খুব ইচ্ছে করছিল অন্য সবার মত সুমার গালে হলুদ ছুঁয়ে দিতে। ততটুকু সাহস আমার হয়নি।
আমার বিয়ের দু’দিন পর পড়ন্ত বিকেলে আমি আর শিমু বাড়ান্দায় বসে গল্প করছিলাম। তখন শিমু আমার কাছে জানতে চেয়েছে, “আচ্ছা, বিয়ের আগে তুমি কারো প্রেমে পড়েছো?”
ক্ষানিক থেমে আমি সত্যিটা বলে দিয়েছি। আমি সুমার প্রেমে পড়েছিলাম। কথাটি শুনে শিমুর চোখে মুখে মেঘের ঘনঘটা। যে কোনো সময় বৃষ্টি ঝরাতে পারে। পরক্ষনেই আবার বললাম, “ভয়ের কারণ নেই। সুমা কখনো আমার প্রেমে পড়েনি। আমি একতরফা পছন্দ করতাম সুমাকে।”
গায়ে হলুদতো শেষ। রাতও একটা বেজে গেছে। আমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। আমি জানি আমি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত শিমু ঘুমাবেনা। আসার সময় রাগ দেখিয়ে বলেছিল, “কেন যাবা তুমি সুমার গায়ে হলুদে? এখন তুমি বিয়ে করেছো, আমি তোমার বউ। কবে কাকে ভালোবাসছ, এখন তার গায়ে হলুদে যেতে হবে?”
আমি নরম স্বরেই শিমুর সাথে কথা বলেছি। আমিও যদি রাগ দেখাই তাহলে নির্ঘাত কান্না করবে মেয়েটা। আমি বলেছি, “বাড়ির পাশে একই এলাকায় একজনের বিয়ে। আজ হলুদ সন্ধা। এলাকার মানুষ হিসেবেওতো যাওয়া উচিত। তাছাড়া আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেছে। তোমাকে এত করে বললাম চলো যাই। তুমিও যাবেনা। তাই আমি যাচ্ছি।”
বলেই বেরিয়ে এসেছিলাম। বাসায় গেলে নিশ্চয় বলবে, “দশটায় গায়ে হলুদ শেষ, এখন বাজে কয়টা?”
চেয়ার ছেড়ে উঠেছি। ডানে বামে তাকিয়ে দেখি সবাই যার যার মতো। সুমার রুমের বাতি এখনো জ্বলছে। আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি।
সুমা দেখতে আহামরি সুন্দর নয়। কারো সাথে প্রেমও করেনি কখনো। পাথরের মতো মন থাকলে সুমার আছে। এতবার প্রেম নিবেদন করেও একটি বারের জন্য রাজী করাতে পারিনি। তার একটাই কথা কখনো প্রেম করবেনা। শেষবার যখন রাগ দেখিয়ে বলেছি, “আমাকে কেন ভালোবাসবেনা তুমি। অন্য কারো সাথে তোমার সম্পর্ক থাকলে তো আমি বিরক্ত করতাম না।”
সুমা মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, “আপনাকে আমার পছন্দ না। ভালো লাগেনা আপনাকে।”
তখনই বলেছিলাম, “আমি বিয়ে করলে তোমার চেয়ে সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করে আনব।”
যদিও পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু শিমু অনেক সুন্দর।
বাড়ি এসে দরজায় টোকা দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলাম, “শিমু দরজা খুলো।”
প্রথমে দুই তিনবার কোনো সাড়া শব্দ নেই। হঠাৎ বলে উঠল, “রাত অল্প বাকি আছে। যাও, বাকি রাতটুকুও বাইরে কাটিয়ে এসো।”
মধ্যরাতে আমার রাগ দেখালে চলবেনা। বাবা মা জেগে যেতে পারে। আমি আবারো ডাকলাম, “শিমু দরজা খুলো, কথা আছে।”
শিমু এবার আশ্চর্য এক কথা বলে বসল। বলছে, “আগে হাত পা ভালো করে ধুয়ে এসো। গায়ে হলুদে কত রকমের মানুষ থাকে। যাও তাড়াতাড়ি।”
কী আর করা? আমি নলকূপে যাচ্ছি।
একটা কাজ অবশ্য আমি ভালো করেছি। সুমাকে ভালোবাসতাম এটা আমি আর সুমা জানতাম। এখন শিমু জানে। সুমা প্রেম করতেই রাজী না তাহলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানোর মানে কী? তাইতো কখনো কাউকে জানাইনি।
এজন্য আজ গায়ে হলুদেও সন্দেহ করার মত কেউ ছিল না। এখন মনে হচ্ছে গায়ে হলুদে যাওয়া ঠিক হয়নি। শিমু প্রচন্ড রেগে আছে। আবার মনে হচ্ছে একই এলাকার একজনের বিয়ে। সবাই দেখতে গেল, আমি গেলে দোষ কী?
শিমু গাল ফুলিয়ে চেয়ারে বসে আছে। দু’বার ডাকলাম এসে শুয়ে পড়তে। উল্টো শুনিয়ে দিল, “ঘরে এসেছো কেন? সুমার সাথে গায়ে হলুদের স্টেজে বসে যেতে। তোমাকেও হলুদ মেখে বিয়ে বাড়ির একজন ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিত। নতুন বউ নিয়া বাসর করতে। এখানে আসছ কেন?”
মেয়েদের মাথায় কোনো কিছু একবার ঢুকলে সেটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই। বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম। শিমু চেয়ারে বসা, আমি হাটু গেঁড়ে তার হাটুতে হাত ঠেকিয়ে ওর দিকে তাকালাম। চোখ দুটো ছলছল করছে। কিছু বললেও কেঁদে দিবে। আমি তবুও বললাম, “এই যে মেডাম কান ধরেছি, আর যাব না সুমার গায়ে হলুদে।”
শিমু চোখে রাগ দেখিয়ে বলল, “অভিনয় শুরু করছ, তাইনা? সুমার গায়ে হলুদ দুই দিন পর পর হবে, তাইনা? বললে যে তুমি আর যাবেনা।”
আমি হেসে দিলাম। শিমু আরো রাগ দেখিয়ে বলল, “আবার হাসছ? যাও বের হও ঘর থেকে।”
আমিও সত্যিই উঠে দাড়িয়েছি। বাইরে বের হবার উপক্রম। অমনি শিমু বলছে, “রাত দুপুরে তোমার অভিনয় দেখতে পারব না। এখন কী আবার সুমার গায়ে হলুদে যাবে নাকি? শুতে এসো তাড়াতাড়ি। আর যদি সুমার নাম তোমার মুখে শুনেছি, সেদিন বুঝবা মজা।”
আমি বাধ্য ছেলের মত বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম। শিমু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে বলছে, “আমাকে একটুও ভালোবাসেনা। মনের মধ্যে শুধু অন্য মেয়ে।”
আমি শিমুর বাহুতে হাত রাখলাম। শিমু হাত ছাড়িয়ে বলছে, “ছুঁইবেনা আমাকে। তুমি একটুও ভালোবাসোনা আমাকে।”
আমি শিমুকে এদিকে ফিরিয়ে বুকে টেনে নিলাম। ওর চোখে পানি। আমি শিমুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, “আর কখনো এমনটি হবেনা। শুধু তোমাকেই ভালোবাসি আমি।”
শিমু মিশে আছে আমার বুকে। নীরবে, চুপটি করে আছে।