লোকাল বাসের প্রেম

লোকাল বাসের প্রেম

দুপুর দুইটা। মহাখালী সিগন্যাল থেকে কয়েকবার বাসে ওঠার চেষ্টা করে হাল যখন প্রায় ছেড়ে দিলাম, ঠিক তখনই তিনি এসে বললেন, ‘ভাইয়া, আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন?’ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মেজাজটা গরম হয়ে গেল। বয়সে বড়দের ‘ভাইয়া’ বলে ডাকার প্রচলন কে যে প্রথম করেছিল, তার দেখা পেলে আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতাম! পরির চেয়েও বেশি সুন্দরী যে মেয়েটা মাত্র ভাইয়া বলে ডেকেছে, তাকে সাহায্য না করার মতো ক্ষমতা আমার কোনো কালেই হবে না। জানতে চাইলাম, ‘কী সাহায্য?’ জানালেন, তিনি শাহবাগ যাবেন, অথচ ভিড়ের কারণে বাসে উঠতে পারছেন না। আমি যদি তাকে একটু বাসে উঠিয়ে দিতে সাহায্য করি, তাহলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।

‘দেখি কী করা যায়’—এ রকম ভাব নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় চলন্ত বাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম! নারীরা প্রেরণার উৎস, এ কথা ভুল নয়। না হলে যে আমি আধা ঘণ্টা ধরে শাহবাগের বাসে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলাম, সেই আমি কীভাবে দুই মিনিটের মাথায় অপরিচিত এক মেয়েসহ বাসে উঠে পড়লাম! তবে কন্ডাক্টরের ‘ডাইরেক গুলিস্তান, ডাইরেক গুলিস্তান’ ডাকার মাধ্যমে বুঝে ফেললাম, প্রেরণার ক্ষমতা আহামরি কিছু নয়। বাসে একটা পা রাখার জায়গা নেই অথচ সে ‘আয়া পড়েন, সিট খালি, সিট খালি, ডাইরেক…আয়া পড়েন’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছে আর বাস দাঁড় করাচ্ছে জায়গা-বেজায়গায়।

বাসের ভেতর গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটাও দাঁড়িয়ে আছে। সে নারী বলে কোনো পুরুষ সিট ছেড়ে দেয়নি। দেওয়ার কথাও নয়। ঢাকার লোকজন দিন দিন কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বাসের সিটের ব্যাপারে তারা পুরুষ-রমণী ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর! এরই মধ্যে কোনো এক জন্মে করা পুণ্যের কারণে জাহাঙ্গীর গেটে আসতেই আমার সামনের সিটে বসা একজন নেমে গেল। বিনয়ের মহাসাগর সেজে নিজে না বসে অচেনা-অজানা মেয়েটাকে সেই সিটে বসিয়ে দিলাম। আমরা যেন পূর্ব পরিচিত। অনেক সিনেমা-নাটকে দেখেছি, এভাবেই প্রেম হয়। আমারও যে হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত। বিধাতা তাহলে শেষ পর্যন্ত লোকাল বাসেই ‘ঘটনা’ ঘটে যাওয়ার কাহিনি লিখে রেখেছিলেন! আর আমি কিনা অহেতুক এত দিন ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করেছি!

গাদাগাদি ভিড়। এর পায়ে পাড়া দিয়ে ওর গায়ে ঘেঁষে কন্ডাক্টর কীভাবে কীভাবে যেন পুরো বাস চষে ভাড়া চেয়ে বেড়াচ্ছে। তবে লাভ হচ্ছে না। যার কাছেই ভাড়া চাচ্ছে, সে-ই ‘পরে দিতাছি’ বলে ব্যালান্স ঠিক রাখতে বাসের রড ধরে উদাসী হয়ে যাচ্ছে! .দুই ছাত্রের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে লেগে গেল। ভাড়া ১০ টাকা, ওরা ৫ টাকার বেশি দেবে না।

: আমরা স্টুডেন্ট, যা দিছি খুশি মনে রাখো।
: মামা, এই বাসে স্টুডেন্ট কাটে না। এটা সরকারি বাস না। মালিকরে ডেইলি ৬ হাজার ভাড়া বুঝাইয়া দিতে হয়। দ্যান, ১০ ট্যাকা দ্যান…

পরিস্থিতি তর্ক থেকে হাতাহাতির পর্যায়ে। সব যাত্রীই কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে। এসব তর্কে আমার কখনো আগ্রহ ছিল না, কিন্তু পাশের অচেনা মেয়েটাকে মুগ্ধ করতেই কিনা কে জানে, বাসসুদ্ধ যাত্রীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলাম, ‘আরে ভাই, কন্ডাক্টর তো ন্যায্য কথাই বলছে। এমন কোনো নিয়ম কি আছে যে স্টুডেন্টরা হাফ ভাড়া দেবে, বলেন?’ আমার কথা শুনে বাসযাত্রীরা তো বটেই, কন্ডাক্টর নিজেও হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি ছোটখাটো যুদ্ধ শেষে ভাড়া আদায় করাতে পারলাম না ঠিকই, তবে কন্ডাক্টরের মন জয় করে ফেললাম। ফলস্বরূপ ফার্মগেট আসামাত্রই অচেনা মেয়েটার পাশের সিটে সে আমার জায়গা করে দিল। খাতির জমিয়ে চোখে চোখে ইশারা করল। যার অর্থ, ‘মামা, আপনার পছন্দ আছে। অবশ্য আপনের মতো ভালো মানুষের পছন্দ ভালো হইব, এইটাই স্বাভাবিক।’

আমি তার দিকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে পাশের জনের দিকে মনোযোগ দিলাম। কথা জমাতে হবে। আর বেশি সময় নেই। ফার্মগেট, বাংলামোটর…
‘বাব্বাহ, আপনি তো ভালোই তর্ক করতে পারেন!’ মেয়েটা কথা বলে উঠল।
‘আর বলবেন না। মানুষ সব জায়গায় টাকা ওড়াবে আর এই গরিবদের ভাড়া দেওয়ার বেলায় দুই টাকা কম দেওয়ার জন্য এটা-ওটা অজুহাত দেখাবে। ওদের কি পেট নেই, বলেন? ওরাও তো আমাদের মতো মানুষ।’

আমার জ্বালাময়ী বক্তব্যে তিনি বোধ হয় খুশি হলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। বাস বাংলামোটর পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ফোন নম্বর, ফেসবুক আইডি—কিছুই তিনি নিজ থেকে দেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
বাধ্য হয়ে নিজ থেকেই চাইলাম আর বুঝলাম অপরিচিতদের সাহায্য করতে নেই। কোনো ধরনের রিভিউ ছাড়াই আবেদন নাকচ করে সরাসরি বলে দিলেন, ‘সরি ভাইয়া। আমার বয়ফ্রেন্ড টিএসসিতে ওয়েট করছে। ওর জন্যই এত কষ্ট করে আসা। ও ফোনে অন্যদের সাথে কথা বলা পছন্দ করে না। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না…।’

কিছুই হয়নি এ রকম একটা ভাব নিয়ে দৃষ্টি উদাস করে বাইরে তাকালাম। একটু আগে নিজের জীবন বাজি রেখে যার উপকার করলাম, আর সেই মেয়ে কিনা ফোন নম্বর দিতেও আপত্তি করছে! দুনিয়াটা যে সহজ জায়গা নয় বরং অনেক কঠিন জায়গা, নিষ্ঠুর এই মেয়ে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিল।

শাহবাগ যেতেই মেয়েটা নেমে গেল। রেখে গেল এক ফাঁকা সিট ভরা হাহাকার। মাঝবয়সী এক যাত্রী নামবেন, শুরু হয়ে গেল ক্যাচাল। কন্ডাক্টর বলল, ‘আগে বাম পা দ্যান, আগে বাম পা।’
: আগে বাম পা দিমু ক্যান?
: চাচা, এইটাই নিয়ম। বাম পা দ্যান, গেট খালি করেন।
: ওই, তুই আমারে নিয়ম শেখাস। আজীবন মুরব্বিগো কাছ থাইকা শুইনা আইলাম, যাত্রাপথে আগে ডাইন পা দিতে হয়, আর তুই নতুন নিয়ম দেখাস! কয় দিনের চ্যাংড়া তুই নিয়মের কী বুঝস!

এবারও যাত্রীর প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে বাকি যাত্রীরা কন্ডাক্টরকে একহাত দেখে নিতে লাগল। একমাত্র সাপোর্টারের আশায় কন্ডাক্টর আমার দিকে তাকাল। ভেবেছিল উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার মতো আবারও তাকে উদ্ধার করব! আমি উল্টো ঝাড়ি দিয়ে বললাম, ‘ওই ব্যাটা, এইসব নিয়ম তোরে কে শিখাইছে। মুরব্বি যেইটা বলছে ওইটাই ঠিক। ব্যাটা যাত্রীগো লগে বেয়াদবি করস, দিমু কানের নিচে একটা…।’

তর্ক থামিয়ে কন্ডাক্টর অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বলে দিচ্ছে, ‘ভাই, আপনে এরশাদ সাহেবের মতো এইভাবে পল্টি নিলেন? আপনারে আমি সুন্দরী মাইয়ার পাশে সিট কইরা দিলাম, আর আপনে…!’ তার দৃষ্টিকে পাত্তা দিলাম না। আবারও বাইরে তাকালাম। দুনিয়াটা যে এত সোজা নয় বরং অনেক কঠিন একটা জায়গা—এটা একটু আগে আমি বুঝেছি, এবার কন্ডাক্টর ব্যাটা হাড়ে হাড়ে বুঝুক।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত