“স্যরি আপনাকে তো দিতে পারবো না। “চকলেট গুলা তো দেওয়ার জন্যই এনেছেন তাই না?”হ্যাঁ কিন্তু আপনি তো ছোট না। “তো কি হয়েছে। আমাকে ছোট মনে করলেই হয়। মেয়েটা একটু চুপ করে রইলো। তারপর পিচ্চি ছেলে মেয়েগুলার দিকে তাকালো। চুল গুলা একটু হাত দিয়ে ঠিক করে বললো “আচ্ছা ঠিক আছে দিব। তবে সবাইকে দেওয়ার পর যদি বেচে যায় তাহলে পেতে পারেন। আপনার ভাগ্য যদি ভালো হয় আর কি।
আমি একটু হেসে হ্যা বোধক সম্মতি দিলাম। মেয়েটাকে পিচ্চি ছেলে মেয়েরা মিষ্টি পু বলে ডাকে। নামটা শুনে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটার নাম মিষ্টি। যদিও আমি মেয়েটাকে আগে চিনতাম না। গত তিন মাস ধরে মেয়েটি আমার নজর কেরেছে। শুধু আমার না, আমি খুব ভালো করেই জানি, এই জায়গাটায় যারা যারা আসে সবার নজর কেরেছে। মাঝে মাঝে আমি এই জায়গাটায় আসি। যদিও তেমন একটা আসা হয় না। এখানে একটা চায়ের টঙ আছে নিম গাছটার নিচে। এই জায়গাটায় আসলে এই টঙ থেকে এক কাপ চা অবশ্যই খাওয়া হয়। চায়ের টঙের টুলে বসে ঐদিন চা খাচ্ছিলাম হঠাত্ দেখলাম একটা মেয়ে কতগুলা ছেলে মেয়ের চুল আচড়িয়ে ঠিক করে দিচ্ছিলো। আমি একটু ভালো করেই দেখলাম। কেমন জানি লাগলো। চেহারা দেখে মনে হয়নি এই মেয়ে এই রকম কিছু করবে। মেয়েটার চেহারাটার সাথে আর পোশাক দেখে মনে হয় এই টাইপের কিছু ওর সাথে মানায় না। আমি এটা নিয়ে আর ভাবলাম না। এই জায়গাটায় গাড়ি চলাচল একদম কম। অনেকে এখানে হাটাহাটি করতে, কেউ আড্ডা দিতে, আবার কেউ আছে তার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে এসে বসে বসে সময় কাটায়। আমি চা খেয়ে উঠে গেলাম।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার আসলাম। মেয়েটার কথা আমার খেয়ালই ছিল না। সত্যি বলতে কি আমার মনে নেই। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেক কিছু আমার মনে থাকে না। চায়ের টঙে না বসে একটু হাটছিলাম। এক বাদাম ওয়ালার কাছ থেকে পাঁচ টাকার বাদাম কিনে হাটতেছি আর ছিলে ছিলে খাচ্ছি। সেদিনের মেয়েটাকে আবার দেখলাম। গোলাপি কালারের সেলোয়ার কামিজ পড়া ছিল। চুল গুলা বাম পাশে সিথি করা ছিল। আস্তে আস্তে হেটে অনেকটা মেয়েটার কাছে গেলাম। দশ পনেরো হাত দুরে আমি দাড়িঁয়ে দেখতে লাগলাম। কি নিয়ে যেন গল্প করছিল। বেশ কিছুক্ষন দাড়িঁয়ে খেয়াল করতে লাগলাম। এর একটু পর একটা পিচ্চি বসা থেকে উঠে একটা হাসি দিয়ে হাতের সব চেয়ে ছোট আঙ্গুলটা দেখিয়ে বলে”মিষ্টি পু, হিসু দিমু মেয়েটা একটু তাকিয়ে থেকে বললো “এই তাড়াতাড়ি যা।
ছেলেটা সাথে সাথেই আমার সামনে দিয়ে একটা দৌড় দিল। ছেলেটার হিসু শেষ হলে আবার দৌড়ে যখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন ছেলেটাকে ধরে বললাম “নাম কি? “মানিক। দাদা রাখছে নাম। এই নাম আমার ভাল্লাগে না। “কেন সুন্দর তো নাম টা। “কেডা কইছে সুন্দর? সবাই মানিক্কা কইয়া ডাকে। তবে এখন আমার আরেকখান নাম আছে। ” তৌসিফ” এই নামখান মিষ্টি পু রাইখা দিছে। আমি একটু চুপ করে থেকে মেয়েটার দিকে তাকালাম। তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম “থাকিস কই? “সামনের ব্রীজের নিচের বস্তিতে। “তা তৌসিফ বাদাম খাবি? তৌসিফ একটা হাসি দিয়ে মাথা নারায়। আমি বাদাম ছিলে ওর হাতে দিয়ে বললাম “এটা তোর কেমন মিষ্টি পু?”দাড়ান মিষ্টি পু রে জিগাইয়া আই মিষ্টি পু কেমন। “আরে না না কিছু বলতে হবে না। আমি তো এমনি বলেছিলাম। তোর মিষ্টি পু কি প্রতিদিন আসে? “না শুধু শুক্রবার।
এইটা বলেই তৌসিফ ছেলেটা আবার দৌড় দিয়ে তার মিষ্টি পুর কাছে চলে যায়। তৌসিফের বাদাম খাওয়া দেখে ওকে জিজ্ঞেস করলো কে দিয়েছে? তৌসিফ আমাকে দেখিয়ে দিল। মিষ্টি মেয়েটা আমার দিকে একটু দেখে আবার চোখ সরিরে ফেললো। আমি আরো কিছুক্ষন দাড়াঁলাম ওখানে। এর একটু পর মেয়েটা সব ছেলে মেয়েকে চকলেট দিয়ে চলে গেল। এইভাবেই আমার নজর কারে। মেয়েটা প্রত্যেক শুক্রবার আসে, এই ছেলেমেয়গুলার সাথে গল্প করে, বিভিন্ন কিছু শিখায়, বিশেষ করে পরিপাটি থাকা। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল এই মেয়েটার আচার আচারণ, চেহারার সাথে এইগুলা যায় না। ভাব দেখাবে, অহংকারী দেখাবে, এইসব মেয়েটার সাথে যায় আমার কাছে এইটাই মনে হয়।
এর পর থেকে শুক্রবার দিনটা আসলে আমার মাঝে এক অন্যরকম ভাব কাজ করত। অবশ্য আমার জন্য এই দিক টা ভালো যে মেয়েটা শুক্রবারে আসে। আমার অফিস ছুটির দিনে। অন্যদিন হলে তো আসা যেত না। আমি এই গত তিন মাসে মেয়েটার আচার আচারণ বেশ ভালোভাবেই উপলব্দি করেছি। একদিন ভাবলাম ওদের এই গল্পের মাঝে আমিও সামিল হবো। আর ঠিকঠিক আমি একদিন ঐ পিচ্চি ছেলে মেয়ে গুলার সাথে বসে পড়লাম। অবশ্য মিষ্টি মেয়েটা অনেকটা অবাক হয়েছিল কিন্তূ কিছুই বলে নি। আমি সব পিচ্চি ছেলে মেয়েকে বাদাম কিনে দিলাম। অবশ্য ওদের সাথে মিশতে বা পরিচয় হতে একটা না একটা কিছু করার দরকার ছিল। গল্প সল্প করার পর মেয়েটি যখন চলে যাচ্ছিল আমিও মেয়েটির পাশে হাটছিলাম। তারপর আমি নিজে থেকেই বললাম “রিকশা ঠিক করে দিব? ও আমার দিকে একটু কেমন করে যেন দেখলো। তারপর বললো “আপনার অনেক বুদ্ধি আছে দেখছি। কোথায় থাকি এইটা জানার একটা কৌশল প্রয়োগ করলেন। রিকশা ঠিক করতে হলে তো জায়গার নাম বলতে হবে। তাই রিকশা ঠিক করার নাম দিয়ে ভালোই বুদ্ধি খাটিয়েছেন।
আমি একটু হাসলাম। তারপর কিছু বলতে যাব তখন মেয়েটি আবার বললো “আমি হেটে হেটেই যেতে পারবো। কাছেই আমার বাসা। “আপনি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের অনেক ভালোবাসেন তাই না? “হুম তা বলা যেতে পারে। “কিন্তু একটা কথা কি জানেন, আপনার চেহারার সাথে না এই টাইপের কিছু মানায় না। আমার কথাটা শুনেই হাটা বন্ধ করে একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “কি বলেছেন? “না মানে আমি বলতে চেয়েছিলাম আপনার চেহারার সাথে রাগ, গাম্ভীর্য এই টাইপের কিছু মানায়। ও একটু হাসল। তারপর আবার হাটা শুরু করলো। “আপনি মানুষের চেহারা নিয়ে গভেষনা করেন নাকি? “না। কিন্তু কেন যেন আমার কাছে এইটাই মনে হয়। “আসলে আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। এইখানে একাই থাকি। এনজিওতে জয়েন করেছি এক মাসের মত হবে। বাসায় তেমন সময় কাটে না বলে এইখানে চলে আসি। প্রথম যেদিন আসলাম দু একজন ছেলেমেয়ে দেখতে পাই। তাদের সাথে গল্প করলাম। তারপর বললাম তোমাদের আরো ছেলে মেয়ে থাকলে নিয়ে আসিও।
“ও। আচ্ছা আপনার নামটা “মিষ্টি” কেন? “হি হি হি এটা আমার নাম না। আমি নাকি অনেকটা মিষ্টির মত। তাই ওরা মিষ্টি পু বলে ডাকে। “তার মানে এটা আপনার নাম না? “লামিয়া আফরোজ। এখন নিশ্চয় বলবেন ওয়াও আপনার নামটা অনেক সুন্দর। আমি একটু হেসে চুপ হয়ে গেলাম। কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আরেকটু হাটার পর ও বললো “আপনি কী করেন? “এই তো একটা চাকরি করি। অয়েল কোম্পানীতে। আমিও এখানে একাই থাকি। চাকরির কারনেই থাকি। খানিক্ষন চুপ করে হাটতে লাগলাম। একটা মানুষের সাথে প্রথম প্রথম বেশি কথা বলা যায় না। লামিয়া বলে “আমি এই বাম পাশের রাস্তাটা দিয়ে চলে যাব। আপনি কোন দিক দিয়ে যাবেন? “আমি ডান পাশের রাস্তাটা দিয়ে। “আচ্ছা ঠিকাছে যান তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।
লামিয়া বাম পাশের রাস্তাটা দিয়ে চলে যায়। আর ওর দিকে একটু তাকিয়ে ডান পাশের রাস্তাটায় হাটতে লাগলাম। একটু হেটে আবার কি মনে করে যেন তাকালাম। তারপর একদৌড়ে আবার সামনে গিয়ে দাড়াঁলাম। একটু হাপিয়ে বললাম “আমার নামটা তো বলা হয় নি আপনাকে। আর আপনিও জানতে চান নি। “ও একটু হেসে আমায় বললো “এখন কি নাম বলার জন্য দৌড়ে আসছেন? আমি মাথা দিয়ে হ্যা সূচক ইশারা দিলাম। “আচ্ছা বলেন আপনার নাম। “জাহেদ। এইটা বলেই চুপ করে রইলাম। “আর কিছু বলবেন? “না আর কিছু বলবো না। “আচ্ছা তাহলে এখন আসি। এইটা বলে লামিয়া আবার একটু হাটতেই আমি ডাক দিলাম। ও পিছনে আমার দিকে ফিরে বলে “আবার কি হলো? আমি একটু মাথা চুলকিয়ে বললাম “আপনার নামটা আসলেই সুন্দর।
লামিয়া একটু হেসে আবার হাটা দেয়। এইভাবেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়। তারপর কিভাবে যেন তিনমাস কেটে যায়। আর আজকে যখন সবাইকে চকলেট দেওয়ার জন্য ব্যাগ থেকে চকলেট বের করলো আমি বলেছিলাম আমাকে দেওয়ার জন্য। চকলেট যদি বাচে তাহলে আমাকে দিবে। তবে সত্য বলতে কি এই তিনটা মাস আমি যতই ওর সাথে মিশেছি ততই যেন একটা ভাল লাগা কাজ করত আমার মাঝে। লামিয়া চকলেট দেওয়ার পর আমার দিকে একটু তাকিয়ে বলে “স্যরি শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনার ভাগ্যে চকলেট নেই। “তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আপনার হাতের চকলেট খাওয়া হলো না। “হি হি হি। পিচ্চি ছেলে মেয়েরা চলে গেলে আমরাও উঠে হাটতে লাগলাম। তারপর বাসায় চলে আসলাম। পৃথিবীটা আমার কাছে কেন যেন অন্য রকম মনে হয়। মানুষের ভাব সাব আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কারো সাথে কথা বললে সব সময় একটা বিষয় আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে এই যে আমার কথায় মানুষটা কি মনে করছে। আমার দিন গুলো যেন বেশ ভালো ভাবেই কাটছে লামিয়ার সাথে পরিচয় হবার পর। টুকটাক ফোনেও কথা হয় ওর সাথে আমার। এই তো গত সপ্তাহে ছুটির দিনে সকালে ওরে ফোন করে বললাম “আপনি কি আজকে বিকেল যাবেন? “হ্যা তা তো যাবই। জাহেদ সাহেব আমি যে প্রত্যেক সপ্তাহে ওখানে যাই আপনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি এইটা বলার জন্য ফোন করেন নি।
আমি ফোনটা কানে ধরে একটু চুপ করে থেকে বললাম “না আসলে দুপুরে খাবারটা বাহিরে খেতে চেয়েছিলাম। “আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি তো বাহিরে তেমন খাই না। “আরে কোন ব্যাপার না। আমি এমনি বলেছিলাম। আচ্ছা বিকালে দেখা হবে। তারপর ফোনটা রেখে দেই। অনেকটা আশা নিয়ে ফোন করেছিলাম। ভেবেছিলাম ও রাজি হবে। কিন্তু দশ কি পনেরো মিনিট পর আমায় ফোন করে বলে আমার বাসার ঠিকানা দিতাম। আমি একটু অবাক হয়ে ঠিকানা দিলাম। আমি যে আশা করেছিলাম তারচেয়ে বড় কিছু পাব আমি আশা করি নি। আমার কাছ থেকে ঠিকনা নিয়েই ফোনটা রেখে দেয়। এর ঘন্টা খানেক পরই দরজার কলিং বেলের আওয়াজ শুনে খুলে দেখি লামিয়া দাড়িয়ে আছে। আমি বেশ অবাক হলাম “এই মিষ্টার এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভিতরে ঢুকতে বলবেন না? “ও হ্যাঁ আসুন। ও ঘরের ভিতর ঢুকেই ঘরের মাঝখানে দাড়িঁয়ে ঘরের চারপাশটা দেখলো।
“বাহ বেশ পরিপাটি ঘরটা সব কিছু গুছিয়ে রাখেন দেখছি। আমি ভাবলাম এখানে এসে আপনাকে একটা ঝাড়ি দিব “ঘরের একি অবস্হা করে রেখেছেন?” এই টাইপের কিছু। এখন তো দেখছি উল্টো। “তারপর আমাকে ঝাড়ি দিয়ে আপনি সব কিছু গুছিয়ে রাখতেন। আউলা ঝাউলা হলে ভালো হতো তাই না? “হি হি হি। “এর পর থেকে আউলা ঝাউলা করে রাখবো ঠিকাছে? “কেন? “আপনি ঠিক করে দিবেন তাই। এইটা বলে আমি হাসতে লাগলাম। লামিয়াও হাসতে লাগলো। আমার রুমটা একদম ছাদে। এই ঘরটা পেতে একটু কষ্ট হয়েছিল। অবশ্য অফিসের আফসার ভাই যদি হেল্প না করত পেতাম না। মূলত ওনার রেফারেন্সেই আমাকে ঘরটা দেওয়া হয়। লামিয়া খাটের কোনায় বসে আমায় বলে “বাহিরে আমি তেমন খাই না। আপনি বাজার করে নিয়ে আসেন রান্না করে একসাথে খাব ঠিকাছে? আমার কাছে ঈদ ঈদ মনে হচ্ছিল। সত্যি আমি এটা আশা করি নি। আমি কি কি খেতে পছন্দ করি লামিয়া সব আস্ক করলো। তারপর একটা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো এই গুলা আনতে।
দুপুরের খাবারটা বেশ ভালো ভাবেই হলো। মনে মনে ভাবছিলাম এমন খাবার যদি প্রতিদিন খেতে পারতাম। ও যখন আমার প্লেটে ভাত আর তরকারি বেড়ে দিচ্ছিলো আমার মাঝে একটা অন্য রকম অনুভূতি কাজ করলো। মনে হচ্ছিল আমরা স্বামী স্ত্রী। মুলত ওর সাথে পরিচয়ের পর আমি অন্য জগতে ভাসছিলাম এই টাইপের আমার কাছে মনে হতো। যেমন টা আরো দুবার আমার সাথে হয়েছিল। ক্লাস নাইনে থাকতে একবার , আর ভার্সিটি ভর্তি হবার জন্য যখন কোচিং এ কোর্স করেছিলাম তখন। ক্লাস নাইনে থাকতে ইভানাকে আমার বেশ ভালো লাগতো। ও ছিল আমাদের বাড়ি ওয়ালার মেয়ে। আমার সাথে অনেক মিশুক টাইপের ছিল। তখন ভালোবাসার ব্যাপার স্যাপার তেমন একটা ভালো বুঝতাম না। কোন মেয়ে যদি আমার দিকে একটু ভালো করে তাকাতো তখন আমার কাছে মনে হতো মেয়েটা কি আমায় লাইক করে? ইভানা ও তখন ক্লাস নাইনে পড়তো। তবে ওর স্কুল আর আমার স্কুল ছিল আলাদা।
আমার জীবনে ইভানাই ছিল প্রথম ভালো লাগা। আর এই ভালো লাগাটা আমি খুব তাড়াতাড়িই একটা অন্য নামে রুপ দিতে চেয়েছিলাম। বলেওছিলাম যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদিও এইগুলা ভাবলে কেমন জানি লাগে। নিজেকে কেমন নিচু টাইপের মনে হয়। কিভাবে প্রপোজ করে, কিভাবে কিভাবে আগাতে হবে কিছুই বুঝতাম না। আর বয়সটা তখন কতই বা ছিল। ১৫ বছর। ও প্রায় আমার সাথে হেসে কথা বলতো। মাঝে মাঝে আমার চুল গুলা ধরে বলত যাহ পাগল। আমার মনের ভিতর শিহরণ দিয়ে উঠতো। যখন ওকে ভালো লাগার কথা বলেছিলাম এর পর থেকে ও আমার সাথে আর কথা বলতো না। ও আমাকে শুধু একটা কথাই বলেছিল “যে বন্ধুত্বের দাম দিতে জানে না, বন্ধু জিনিসটা বুঝে না, তার সাথে আমার কোন কথা নেই। এক আল্লাহই জানে তুমি আমাকে নিয়ে মনে মনে কি কি ভাবো। আমি তো তোমাকে জাস্ট ফ্রেন্ড ভেবেছি। জীবনের প্রথম ধাক্কা খেয়েছিলাম তখন। তবু ওর সাথে কথা বলতে চাইতাম। ওদের রুমের দরজার সামনে সিড়ি দিয়ে বার বার ওঠা নামা করতাম। কিন্তু কিছুই হলো না, বরং আমাকে দেখলে ও বিরক্তি ভাব দেখাতো। এরপর দু মাস পরেই ওর বাবা আমাদের বাসা ছেড়ে দিতে বলে। কেন বলেছিল আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমি যে ভালো লাগার কথা বলেছিলাম এই সম্পর্কে ওর বাবা আমাকে কিছু আস্ক করে নি।
তারপর বাবা বাসা পাল্টিয়ে ফেলে। এর এক মাস পরেই আমি ক্লাস টেনে উঠলাম। ওর সাথে আমার আর কথা হয় নি। যদিও আমি প্রায় ওর স্কুলের সামনে যেতাম। সময় যেতে যেতে আমার এস এস সি পরীক্ষা চলে আসে। একটা সময় ওর জন্য আর ভাবলাম না। আর দ্বিতীয় ভালো লাগাটা ছিল অরিনের উপর। ইন্টার পাস করে ভার্সিটিতে এডমিট হওয়ার জন্য কোর্স করছিলাম। সেই কোচিং এ অরিনের সাথে আমার পরিচয়। কোচিং এর মধ্যে পড়ালেখায় আমি অনেকটা ভালো ছিলাম। সব কিছু নোট করে রাখতাম। আর অরিন আমার কাছ থেকে এইগুলা তুলে নিত। শুধু অরিন না কোচিং এর অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও। ও মাঝে মাঝে নতুন ড্রেস পড়ে আমায় বলতো “কেমন দেখাচ্ছে আমায়” সুন্দর লাগছে, ভালো লাগতেছে বলে দিতাম। কোচিং এর পর ওর বাসা অব্দি আমি পৌছে দিতাম। অনেকটা ফ্রি হয়ে গেলাম দুজনে। আস্তে আস্তে শুরু হয়ে গেল ওর প্রতি আমার ভালো লাগা কাজ করা। কিন্তু আমার ভয় হতো ভুলেও যেন অরিন বুঝতে না পারে।
সময়টা যেন খুব দ্রুত চলে গিয়েছিল। ভার্সিটিতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমি চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে ট্রাই করলাম। রাজশাহীতে টিকলাম। অরিন ঢাকা জগনাত্ ভার্সিটিতে টিকলো। আমি ওকে ভালো লাগার কথা কখনো বলি নি। শুধু ভয় হতো যদি ইভানার মত দুরে ঠেলে দেয়। তারপরো ওকে আস্ক করেছিলাম “তুই আমাকে কেমন ভাবে দেখিস? “ও একটু অবাক হয়ে বললো “তুই আমার একজন ভালো বন্ধু আজব। এই কথা কেন আস্ক করেছিস? আমি শুধু হাসলাম। তারপর অন্য কথার প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। ও ঢাকায় চলে যায়। কিন্তু আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করি নি। এর তিন কি চার মাস পর ফোন করে বললো “জানিস আমাকে একজন প্রপোজ করেছে। অনেক হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। নাম রিজবি। আমার কলিজাটা মোচর দিয়ে উঠেছিল। একটু চুপ করে থেকে বললাম “আমি জানি তুই আমার সাথে মজা নিতেছিস। “আরে না সত্য বলতেছি।
আমি আবারো একটু চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বললাম “কিন্তু আমি যে অনেক আগে থেকেই তোকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে রেখেছি। “কি বললি? এইটা বলেই অরিন চুপ হয়ে গেল। তারপর বললো “আরো আগে কেন বললি না? “আমি ভয় পেতাম। খুব ভয় পেতাম। তুই যদি আমার সাথে কথা না বলিস। অরিন একটু চুপ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। ফোনে স্পষ্টই শুনছিলাম। তারপর আমি কিছু বলতে যাব ঠিক তখন ও বললো “আমি যে রিজবীর প্রপোজ এক্সেপ্ট করে ফেলেছি। রিজবীকেও আমার ভালো লাগে। এই কথাটা শোনার পর আমি একটু চুপ করে থেকে একটা হাসি দিয়ে বললাম “আরে দুর তোর সাথে মজা করছিলাম। দেখলি তোকে ইমোশনাল করে দিলাম। হা হা হা ভয় পাইছিস? “তুই না একটা ছাগল। জানিস আমার মনটা কেমন করে উঠেছিল। “আচ্ছা পরে কথা হবেরে আব্বা ডাকতেছে।
মিথ্যে কথা বলে আমি ফোনটা রেখে দিলাম। তারপর বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলাম সত্যি আমি একটা ছাগল। তোকে আগে বলার দরকার ছিল। কিন্তু কি করে বুঝবো কেউ চায় আগে বলো নি কেন আর কেউ চায় শুধু বন্ধুত্বটা। আগে বলো নি কেন? আমি তোমায় শুধু বন্ধু ভাবতাম এই দুইটা জিনিস আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। আর এত বছর পর এসে আবার সেই ভালো লাগা কাজটা তৈরি হলো লামিয়ার উপর। আমার কাছে একবার মনে হয়, লামিয়াকে বললে ইভানার মত আচরণ করবে, আর একবার মনে হয় লামিয়া বলবে জাহেদ আমারো তোমাকে ভালো লাগে। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার লামিয়া এখানে চাকরি করে। ওর এখানে তেমন কেউ পরিচিত নেই বলে আমার সাথে মিশেছে। আমাকে বন্ধুর স্হানে জায়গা দিয়েছে। একা থাকেই বলে আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করে। এইগুলা সবি বন্ধু হিসেবেই করতে পারে। আর চাকরির কারনে চট্টগ্রাম থাকি।
যেভাবে দিন যাচ্ছে যাক। আমি কখনো বলবো না লামিয়াকে। দেখতে দেখতে আরো একমাস কেটে যায়। আগের মতই ঠিকঠাক মত কাজ করছি। অফিস ছুটি শেষে নিচে নেমে একটা রিকশা ঠিক করে উঠলাম। কিছু দর যাওয়ার পর ফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভ করলাম “আপনি কোথায় এখন? “রিকশায়। বাসার দিকে যাচ্ছি। “শুনেন বাসার দিকে যেতে হবে না। “কেন? “আপনি আমার এনজিও অফিসের সামনে আসেন। “কিন্তু কেন? কি হয়েছে? “কিছু হয় নি। এত কিছু আস্ক করবেন না তো। আসলে বলবো। আমি রিকশা ওয়ালা মামাকে বলে লামিয়ার অফিসের দিকে যেতে বলি। বিশ মিনিট পরেই ওর অফিসের সামনে যেতেই ও আমাকে দেখে রিকশা ওঠে আমার পাশে বসে। তারপর রিকশা ওয়ালাকে বলে “সানমার শপিং কমপ্লেক্স এর দিকে যান। “ভাড়া বেশি দেওয়া লাগবো। “কত দিতে হবে? “সব মিলাইয়া ১১০ টাকা। “একশ টাকা দিব। এখন চালান কথা না বলে। আমি খানিকটা অবাক হয়ে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর বললাম “ওখানে কেন যাচ্ছি? “চুপচাপ বসে থাকেন তো। গেলেই দেখতে পাবেন।
আমি আর কিছু বললাম না। আমার কাছে কেমন জানি লাগছে। একটু পর সানমার আসলে আমাকে একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে গেল। তারপর কয়েকটা পাঞ্জাবী দেখিয়ে বললো “দেখেন তো কোনটা পছন্দ হয়? আমি একটু দেখে বললাম “সব গুলোই ভালো। তবে অলিভ কালারটা মনে হয় একটু বেশি ভালো। কার জন্য পাঞ্জাবী? “আমার এক বন্ধুর জন্য আপনি চিনবেন না। “ও আচ্ছা। আকাশে মেঘ ডাকলে যেমন ছোট ছেলেমেয়েরা ভয় পেয়ে মুখটা অন্য রকম করে ফেলে আমার মুখটাও এই রকম হয়ে গেল। তারপর পাঞ্জাবীটা কিনে আমি লামিয়ার বাসা পর্যন্ত পৌছে দিলাম। রিকশা থেকে নেমে ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো “আপনি এত বড় একটা গাধা আমি জানতাম না। এই শহরটাতে আমার কয়জন বন্ধু? মুখটা এমন করে রেখছেন কেন? পাঞ্জাবীটা আপনার জন্যই কিনেছি। এখন বাসায় যান। আমি শুধু অবাক হলাম। পাঞ্জাবীটা আমার হাতে দিয়ে লামিয়া গেটের ভিতরে ঢুকে যায়। আমার মনটা কেমন করে যেন উঠলো। তারপর বাসায় চলে আসি।
সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশের অবস্হা ভালো না। কিছুক্ষন পর পর আকাশটা গুড়ুম গুড়ুম করে ডেকে যাচ্ছিল। প্রচুর বাতাস বইছিল। এবার নিশ্চিত প্রচন্ড জুড়ে বৃষ্টি আসবে। দরজার কলিং বেল বেজে ওঠে। এই ঝড়ের মধ্যে কে এলো? বাড়ি ওয়ালা নাতো? কিন্তু বাড়ি ভাড়া তো গত পর্শুই দিয়ে দিয়েছি। দরজা খুলেই আমি একটু হা করে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর বললাম “একি আপনি এখানে? এই ঝড়ের মধ্যে? “এসে ভুল করেছি নাকি? বাসায় ভীষন ভয় লাগছিল। কি করবো বুঝতে পারি নি। তাই আপনার এখানে চলে এসেছি। “আচ্ছা আসেন ভিতরে আসেন। ভালোই করেছেন চলে এসেছেন। লামিয়া দরজার ভিতরে ঢুকে চেয়ারটায় বসে। বাতাসে জানালা গুলা ঠাস ঠাস বাড়ি খাচ্ছিল। আকাশে বিদুত্ চমকানো একটা আওয়াজ দিয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টিরা নেমে পড়ে। লামিয়া চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাড়াঁয়। তারপর জানালার বাহিরে হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুয়ে বলতে লাগে “কবে বৃষ্টিতে ভিজেছি মনে নেই। “কেন ভিজতে ইচ্ছে করছে নাকি? ও আমার দিকে তাকাঁয় তারপর মাথা দিয়ে “হুম” সূচক ইশারা দেয়। আমি বললাম “না ভিজা যাবে না। ইচ্ছা করলে ও ভিজা যাবে না।
ওর মনটা কেমন জানি হয়ে যায়। আমার কথাটার মাঝে কেমন যেধ শাসনের মত ছিল। বৃষ্টির মাত্রা আরো বেডে যায়। লামিয়া জানালার পাশ থেকে সরে এসে আমার সামনের চেয়ারটায় আবার বসে। হুট করে আচমকা একটা প্রচন্ড জোরে বিদুত্ চমকায়। লামিয়া ভয়ে চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ায়। মুহুর্তের মধ্যে আবারো খুব জোরে বিদুত্ চমকালে লামিয়ে এক ঝটকায় আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আকাশে আবার বিদুত্ চমকালে ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আমার পুরো শরীরটা কেমন করে যেন উঠলো। মনে হচ্ছিল আকাশে বিদুত্ চমকায় নি। বিদুত্ তো চমকিয়েছে আমার বুকের মধ্যে। এর একটু পর আমি ওকে বললাম “সোজা হন বিদুত্ চমকাচ্ছে না এখন। বৃষ্টি এখনো পড়ছে। ও আমার কথার শব্দ পেয়ে ঝট করে আমার বুক থেকে সরে গিয়ে আবার চেয়ারটায় বসে। ওর চোখ মুখে আমি লজ্জা মিশ্রিত আভা দেখলাম। লজ্জায় ও নিচে তাকিয়ে চুল কানে গুজে বলে “খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি কিছু বললাম না। হঠাত্ করে রুমের লাইট অফ হয়ে যায়। কারেন্ট যাওয়ার সময় পেল না। তড়িগড়ি করে মোম জ্বালালাম। ওর শরীরের স্পর্শে পেয়ে আমার এক অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভূতি তৈরি হয়। তারপর দরজাটা খুলে বাহিরে চলে আসলাম। ছাদের মাঝখানে এসে দাড়াঁলাম। আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোটা গুলা আমার শরীর ভিজিয়ে দেয়। একটু পরেই পাশে তাকিঁয়ে দেখি লামিয়া আমার পাশে দাড়িঁয়ে চোখ বন্ধ অবস্হায় মুখটা আকাশের দিকে করে ভিজতেছে। আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কয়েক মিনিট পর মুখটা সোজা করে ঘাঢ়টা ঘুরিয়ে আমর দিকে তাকাঁয়। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।
বুকটা ধুক ধুক করেছে। আস্তে করে আমি ওর হাতটা স্পর্শ করলাম। ও কিছুই বললো না। আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে আমার আঙ্গুলের মাঝে আঙ্গুল রেখে মুষ্টি ময় করে আমার হাত শক্ত করে ধরলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। লামিয়া আবার চোখ বন্ধ করে মুখটা আকাশে দিকে করে রাখলো। আমি বললাম প্রতিদিন বাজারের লিষ্ট হাতে ধরিয়ে বাজার করতে বলবে, তার জন্য একটা তুমি দরকার। হবেন সেই “তুমি” টা? ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে মুখটা উপরের দিকে করলো। বৃষ্টির ফোটা গুলা টুপ টুপ করে ওরা মুখে পড়ছে। আমিও চুপ করে চোখ বন্ধ করে মুখটা আকাশের দিকে করলাম। মনে হচ্ছে ও আমার জীবনে একটা ডাকপিয়ন। বৃষ্টির মাঝে ডাকপিয়ন হয়ে আমার জীবনে এসেছে। এই ডাকপিয়নকে যে আমি হারাতে চাই না, সত্যি চাই না…..