“মা,আমি ক্লাসে গেলাম।”নাশতা করে গেলিনা?”না মা।সময় নেই।গিয়ে কিছু খেয়ে নিব নে।তুমি চিন্তা করনা।তুমি কিন্তু নাশতা করে নিও আর ঔষধ খেয়ে নিও কেমন।আর ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করনা মা।””বাবা,সাবধানে চলাফেরা করিস।কাল রাতে অনেক খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তোকে নিয়ে।তোর পরীক্ষা চলছে।তানাহলে আমি তোকে আজ যেতেই দিতামনা বাবা।””তোমার দোয়া আমার সাথে থাকলে আমার কিছুই হবেনা মা।বাবা নেই।তুমি কত কষ্ট করে আমাকে লালন -পালন করছ।দোয়া কর মা,আমি যেন তোমার এই কষ্ট খুব তাড়াতাড়ি দূর করতে পারি।””(খুশিতে কেঁদে ফেলে।তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।) আমি তোর জন্য সবসময় দোয়া করি বাবা।””এইতো আমার লক্ষ্মী মা।আসি মা।অনেক দেরি হয়ে গেছে।””ঠিক আছে বাবা।সাবধানে যাস্।”অনিক বাসা থেকে বের হয়ে যায়।কিন্তু তারপরও অনিকের মা অনিককে দেখার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।
অনিক আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিবে।ক্লাসের সেরা ছাত্র সে।আচার-ব্যবহারেও কলেজের সবার কাছে সে খুব প্রিয় একজন মানুষ আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে খুব প্রিয় একজন ছাত্র। অনিক যখন খুব ছোট,তখন অনিকের বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।অনিকের মা অনেক কষ্ট করে তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন অনিককে নিয়ে বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশনি করত। অনিকের মা অনিকের বাবাকে ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করে।তাদের এই বিয়ে আজ পর্যন্ত তার বাবার বাড়ি এবং শ্বশুড় বাড়ির মানুষরা কেউই মেনে নেয়নি।তাই অনিকের বাবার মৃত্যু সংবাদ তাদের কাছে আজও অজানা রয়ে গেছে।কারণ,তাদের সাথে অনিকের মা,বাবার কোনো যোগাযোগ ছিলনা। তাই অনিকের স্বপ্ন সে বড় হয়ে প্রকৌশলী হবে।আর সেভাবেই সে নিজেকে তৈরি করছে।
“কাইল রাতে একটু বেশি খাইয়া ফেলছি রে রুস্তম।অহনও চোখে ঘুমের নেশা লাইগা রইছে।মুখ ধুইলাম তারপরও গেলনা।তুই জোর কইরা খাওয়ায় দিলি।অহন মাথা ঘুরতাছে।গাড়ি চালাইতে গিয়া বারবার গাড়ির পাবলিকগো গালি শুনতে হইতাছে খালি।””আরে ওস্তাদ আমি আছিনা।আমি থাকতে এত ডরান কেন?শুধু আমার কথামতো গাড়ি চালাইবেন।”কথা হচ্ছিল একজন নেশাগ্রস্ত বাসচালক এবং বাসের হেলপারের মধ্যে।বাসচালক গতরাতে অতিরিক্ত নেশা করে অনিয়মভাবে বাস চালাচ্ছে।আর তার জন্য যেকোন দুর্ঘটনার আশংকায় বাসের যাত্রীরা বাসচালককে ধমক দিয়ে বারবার সাবধান করে দিচ্ছে। অনিকের কলেজ ছুটি হওয়ার পর বরাবরের মতই সে আর তার কয়েকজন বন্ধু একসাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে।
আর তখনি সেই নেশাগ্রস্ত বাসচালক ঘুমন্ত চোখে অনিক আর তার বন্ধুদের দিকে বাস ঘুরিয়ে নেয়। ব্যাস্!!!!!!! তখনি ঘটে গেল এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা যা সবার ধারণার বাহিরে ছিল।বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে অনিকের জীবনের প্রদীপ সাথে সাথে নিভে যায়।কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার বন্ধুরা বেঁচে যায়।সামান্য আহত হয় তারা। বাসচালক তখন সাথে সাথে পালিয়ে যায়।বাসের যাত্রীরা বাসচালককে ধরতে ব্যর্থ হলে বাসের হেলপারকে ধরে মারতে থাকে। অনিকের বন্ধুদের আহাজারি,চিৎকারে রাস্তার এবং বাসের লোকজন অনিককে অনেক কষ্টে বাসের নিচ থেকে অনিকের মৃতদেহটা বের করল আর তার আহত বন্ধুদের হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করল।
অনিকের কলেজে এই কথা পৌঁছে যাওয়া মাত্রই ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি ভাংচুর করে।এক শিক্ষক অনিকের মাকে অনিকের শোক সংবাদটি জানায়।অনিকের মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মত ছুটে যায় হাসপাতালে। ডাক্তার অনিককে যখন পরীক্ষা করছিল,তখন তার শার্টের পকেটে একটি ছবি পায় যা রক্তে ভেজা ছিল।ছবিটি ছিল অনিকের মা-বাবার যা অনিক সবসময় ওর সাথে রাখত। অনিকের বাবা যখন মারা যায়,তখন ডাক্তার অনিকের বাবার শার্টের পকেটেও একটি ছবি পেয়েছিল।সেটিও রক্তে ভেজা ছিল।আর সে ছবিটি ছিল অনিকের যা সে সবসময় তার সাথে রাখত।
অনিকের মা অনিকের লাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়।বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অশ্রুসজল চোখে তার একমাত্র প্রিয় সন্তানের লাশ দেখছে।যেভাবে আজ থেকে অনেক বছর আগে তার স্বামীর লাশ দেখেছিল।কিন্তু তখনতো অনিক ছিল।তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।আজ সে কাকে নিয়ে থাকবে?কাকে নিয়ে বাঁচবে?অনিকের মা বাস্তবতা আর ভাগ্যের হিসেব মিলাতে পারছেনা। পরিশেষে আমি কোনো মন্তব্য করবনা।মন্তব্য করার দায়িত্ব আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
তবে একটি কথাই বলব। দোষ আমাদের দেশের না।কারণ,আমাদের দেশ আমাদের মাতৃভূমি। আর আমাদের মায়ের কি কোনো দোষ থাকতে পারে বলুন? দোষতো আমাদের। আজ আমাদের মত সন্তানদের কারণে আমাদের মায়ের বদনাম হচ্ছে। আমাদের দেশের নাম কলুষিত হচ্ছে। আর আমরা হয়ে যাচ্ছি বিবেকহীন জাতি। আর এটিই হচ্ছে আমাদের,আমাদের দেশের জন্য চরম দুর্ভাগ্য।