ফোন ধরছিস না কেন? ৩ দিন ধরে দেখা হয় না তোর সাথে৷ তোর মুখ থেকে মদনকুমারী ডাকটা শুনতে পাচ্ছি না কিছুদিন ধরে৷ হুট করে ফোন দিয়ে “বিরিয়ানী রান্না কর, আমি আসছি” এই কথাটাও মিসিং কিছূদিন ধরে৷
আমার মন খারাপের সময় যখন তোকে ফোন দিয়ে বলতাম,
শুভ্র আমার মন খারাপ৷ মনের আকাশে মেঘ জমেছে আমার৷ কালো মেঘ৷ আমি দিগ্বিহারা হয়ে যাবো৷ ”
আর তুই তখনই আমাকে বকা দিতি তোকে কোথাও হারাতে দিবো না মেয়ে৷ আর মন খারাপ কিসের জন্য? আগে বলবিনা আমাকে?
আমি আছি কিজন্য মেয়ে?” কথাগুলোর অভাব আমি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি৷
আরো হাজারটা কথা বলে ঠিকই আমার বিষণ্ণতা কাটিয়ে দিতি৷
তোর কি হয়েছে আমাকে বল৷”
ভার্সিটির মাঠের কোণায় বসেছিলাম একা৷ অন্যসময় হলে নিরু থাকতো আমার পাশে৷ দিন ১৫হলো মেয়েটাকে এড়িয়ে চলছি৷
যেদিন শুনেছি, নিরুর প্রেমিক হয়েছে একটা৷ সেদিন থেকেই মনটা ভার হয়ে রয়েছে৷ আমি জানি না এই অনূভূতিটা কেমন! এই অনূভূতির নাম কি!
নিরুকে এড়িয়ে চলার বিপরীতে আজ এসে ঝেড়েছে ইচ্ছেমতো৷
আমি এই কথাগুলোর প্রতুত্যরে কি বলব ঠিক ভেবে পাই না৷
আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করে,
তুই শুধু অামার বুঝলি মেয়ে? তোকে ছাড়া আমার এক মূহূর্তও কাটবেনা৷ তোকে ছাড়া শরতের আকাশটা ও আমার কাছে বর্ষার কালো মেঘের গুমোঢ় আকাশ৷”
কথাগুলো কন্ঠনালির কাছে এসেই আটকে যায়৷ আর বলা হয়ে উঠে না নিরুকে৷
-কিইছে চুপ কেন? উত্তর দে৷
হাতের কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বসে নিরু৷ তারপরও মুখ দিয়ে কথা বেরইনা আমার৷
-তুই বলবি? না চলে যাবো?
-চলে যা৷
কথাটা বলতেই আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠে৷ মনে মনে প্রার্থনা করি নিরু যেন বসেই থাকে৷
-আচ্ছা শুভ্র, তুই যদি কোন কারণে রেগে থাকিস বল আমাকে৷ আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?
-কি?
-আল্লাহ তোকে ভুল করে ছেলে বানিয়ে ফেলেছে বুঝলি৷ ছেলে মানুষ এত্তো অভিমান থাকা ভালো না৷ বুঝলি?
কথাটা বলেই নিরু হাসে৷ খিলখিল করে হাসে৷ নিরুর ঝকঝকা দাঁতগুলোতে রোদ পরছে হালকা৷ হাসি দিয়ে মুক্ত ঝরে পরছে৷
হাসিটা দেখে এক নিমেষেই আমার অভিমানগুলো গাঁয়েব হয়ে যায়৷
পরক্ষণেই আবার মনে হয়, মায়ার পরে লাভ কী? কিছুদিন পরেইতো অন্যের হয়ে যাবে মেয়েটা৷
-আচ্ছা শোন৷
হাসি থামিয়ে বলে নিরু৷
-হুম বল৷
-কাল কি উপহার দিবি শুনি৷
-কাল আবার কি?
-কাল বছরের প্রথম দিন জানিস না?
-ওহ৷
-ওহ মানে?
-আমি কেন গিফ্ট দিবো শুনি? তোর প্রেমিককে গিয়ে বল গিফ্ট দিতে৷
-ও তো অনেক দূরে৷ কাছে থাকলে কি তোর কাছ থেকে চাইতাম৷
নিরুর কথাটা শুনে আমার গলা ধরে আসে৷ চোখ দু’টো হুট করে টলমল হয়ে উঠে৷ আমার কেন জানি মনে হয়, আমি আসলেই নিরুর দূরের কেউ হয়ে যাচ্ছি৷ অল্পকিছুদিনের মধ্যেই নিরুর স্মৃতিতে বিলীন হয়ে যাবো আমি৷
আমার চুপ থাকা দেখে নিরুও হয়তো বুঝতে পেরেছে, কথাটা এভাবে বলা উচিত হয় নি৷
আমি টুপ করে নিরুর পাশ থেকে উঠে পরি৷ এই গোলগাল চেহারার মেয়েটার পাশাপাশি থাকা যাবে আর৷
আমি নিরুর দিকে তাকাই না আর৷ কিভাবে তাকাবো? তাকালেই ধরা পরে যাবো মেয়েটার কাছে যে আমার চোখগুলো টলমল হচ্ছে৷ কথার জবাব দিলেই বুঝে যাবে আমার গলা ধরে এসেছে৷ শেষবেলায় এসে নিরুর কাছে ছ্যাচকাঁদুনে ছেলে হয়ে যাবো৷ ছেলে হিসেবে যা একদম বেমানান৷
রুমে ঢুকেই উপুত হয়ে শুয়ে পরি আমি৷ কন্ঠনালীর মৃদ্যু ব্যাথাটা এখনও আছে একটু আধটু৷ বুকের বাঁপাশটাতেও ব্যাথা লাগে আমার৷ মাথার নিচের বালিশটা বুকে এনে শক্ত করে চেপে ধরি আমি৷ বেদনাগুলো যদি বালিশচাপা দিয়ে মারা যেত! কতইনা ভালো হতো তাইনা!
আমার মতো অনেকগুলো মানুষ প্রাণখুলে হাসতে পারতো৷ বেদনায় খুঁড়ে খুঁড়ে কেউ মরতোনা৷
রুমের দরজায় টুকটূক আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার৷ মা এসেছে৷
হাতের ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়৷
-নিরু ফোন দিবে৷ কথা বলিস৷
আমি জিজ্ঞেস করার অপেক্ষা না করেই বলে দেয় মা৷ আমি মাথা নেড়ে সায় দিই মায়ের কথাই৷
মৃদ্যু হেসে আমার ললাটে মমতাময়ী চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পরে মা৷
মিনিট দুয়েক পরেই ফোনটা বেজে উঠে৷
“বৌ মা” নাম দিয়ে সেইভ করা৷ আমার কেন জানি হাসি পেলো৷
নিরুর সাথে আমার বন্ধুত্ব ৩বছরের৷ মায়ের সাথে ও নিরুর তিনবছরের পরিচয়৷
মা ও হয়তো নিরুকে ছেলের বৌ ভেবে নিয়েছে৷
আচ্ছা মা কি কষ্ট পাবে আমার মতো?
পাবেইতো৷ সন্তানদের মনগুলোতো মায়েদের মনের কার্বন কপি৷ সন্তানদের সবকিছুই ছুঁয়ে যায় মায়েদের৷”
রিং বাজতে বাজতে কেটে যায় নিরুর ফোন৷ পরেরবার রিং হতেই রিসিভ করি৷ নিরুর শ্বাসের শব্দ শুনি আমি৷
-শুভ্র!
-হু৷
-আমাদের বন্ধুত্বটা শেষ তাহলে?
-হু অনেকটা তেমনই৷
-আমাকে মিস করবি?
-সেটা নাইবা জানলি মেয়ে৷
-জানিস, তুই যখন কথার শেষে মেয়ে মেয়ে করিস৷ এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে৷
-আমারো অনেককিছু ভালো লাগে৷ এখন আর এসব বলে লাভ নেই৷ কেন ফোন দিয়েছিস বল৷
-শেষ একটা উপকার করবি আমার?
-বল৷
-সাইমন দেশে নেই৷ এদিকে বাবা আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে৷ অনেক বলেছি, বাবা আমার পছন্দ আছে৷ কিন্তু বাবা বলছে, পছন্দ থাকলে এখনই দেখাতে৷ অন্তত কথাবার্তা পাকা করা দরকার৷ জানিস তো, বাবার হার্টের ব্যাথাটা বেড়েছে৷ কখন কি হয় তার ঠিক নেই৷
-আমার কি করতে হবে বল৷
-পরিপাটি হয়ে আসবি৷ ছন্নছাড়া হয়ে আসলে ঠ্যাং ভেঙে ফেলব৷
-কিন্তু..
-কিন্তু কি?
-পরের ব্যাপারটা কেমন হবে? যখন তোর প্রেমিক দেশে ফিরবে? তখনতো তোর বাবা এমনিতেই হার্ট এটাক করবে!
-সেটা পরে দেখা যাবে৷ বুঝিয়ে ঠিক করে ফেলবো৷ তুই আয়৷”
গত জন্মদিনে নিরুর দেয়া মেরুন রঙ্গের শার্টটা পরে রওনা দিই নিরুদের বাসায়৷
মোটা ফ্রেমের চশমা পরে পত্রিকা পড়ছে নিরুর বাবা৷ পাশে নিরু বসে আছে৷
আমি সোফাই বসতেই নিরু উঠে পরে৷ সোফার পিছনের দিকটাই নিরুর রুম৷ পর্দার আড়াল থেকে নিরু তাড়া দেয় আমাকে৷
-চাচা৷
হ্যা বাবা বলো ৷
-আমি নিরুকে ভালোবাসি৷ বিয়ে করতে চাই৷
নিরুর বাবা চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা নামিয়ে রাখে৷ এখন একটু কম ভয়ংকর দেখাচ্ছে৷ এতক্ষণ আমার প্রাক্তন স্কুলের হেডমাষ্টার মনে হয়েছিল৷
-কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের?
আমি নিরুর দিকে তাকালাম একবার৷ ঈশারায় বুঝাচ্ছে দ্রুত বল৷ আমার গলাটা আটকে আসছে৷ সামনে রাখা পানি টুকু গিলে বললাম,
-চাচা তিন বছরের বন্ধুত্ব!
বলেই জিহবায় কামড় খেলাম৷ ওদিকে নিরু কোমড়ে হাত দিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে৷
-বন্ধুত্ব!
-না মানে চাচা এই আরকি৷
-বন্ধুত্ব ভালো৷ আয় লাইক ইট৷ প্রেম ট্রেম ওসব বিয়ের পর হবে৷ তা তোমার বাবা -মা উনাদের খবর দাও৷”
এই কথার উত্তর কি দিবো! হৃৎপিন্ডটা শক্ত করে চেপে ধরে নিরুর দিকে তাকালাম৷
আমাকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হাসে৷
আমার ইচ্ছে করছিল,
এই মূহূর্তে গিয়ে গুলুমূলু গালগুলো টেনে লাল করে দিই৷
আমি চুপ থাকি কিছুক্ষন৷
নিরু ততক্ষণে সরে পরেছে৷
চাচা ডাক দেয় নিরুকে৷ চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে৷
আচ্ছা আমার কি পালানো দরকার এই মূহূর্তে? মা কে মানানো গেলেও বাবাকে অসম্ভব৷
নিশ্চিত বের করে দিবে আমাকে৷
মিনিট পাঁচেক পর নিরু আসে শরবত নিয়ে৷ আমার হাতে তুলে দেয়ার অপেক্ষা না করেই গ্লাসের শরবতগুলো গিলে ফেলি আমি৷
আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে নিরু বলে,
-শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে ফোন দিয়েছি আমি৷ আসছে!
নিজের শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে পরে নিরুর বাবা৷
আমি নিরুর দিকে তাকালাম ভালোমতো৷
-এটা কি হলো শুনি?
-কি হলো মানে? এটা কি দেখেছিস?
-হ্যা৷ গ্লাস ৷ খালি গ্লাস৷
-আরেকটা কথা বললে, এটা তোর মুখে পুরে দিবো বুঝলি ছেলে৷ আমার জন্য যে দেবদাস হয়ে যাচ্ছো সেটা আমি বুঝি! বুঝেছো ছেলে?
-আমার ডায়ালগ কপি করিস কেন?
-তোর মানে? তোর মানেই আমার৷
-সরাসরি বললেই পারতি৷ এত ঢং করলি কেন?
-তোকে মদন বানাবো বলে৷ আর আমাকে পাওয়া এত সহজ নাকি হুহ৷ ঠিক করেছি তোকে মদন ডাকবো বিয়ের পর৷
-আমি মদন বৌ ডাকবো মেয়ে৷
-কেন ছেলে? মদনকুমারীই ভালো৷ আমার পছন্দ নামটা৷
-হুম৷ কিন্তু…
-কিন্তু কি?
-না থাক৷
-তোর শয়তানী আমি বুঝি, বুঝলি ছেলে৷ এবার গিফ্ট দে৷
-কিসের গিফ্ট?
-নতুন বছরের৷
-ভাবছি নতুন বছরটা চুমু দিয়েই শুরু হোক৷
-কেন এই বুদ্ধি কেন?
ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে নিরু৷
ছোটবেলায় আম্মু বলেছে,
বছরের প্রথমদিন পিটুনি খাইলে সারাবছর পিটুনিই খাবি৷
তাই আমি আজ চুমু খাবো৷ যাতে বছরের প্রতিদিনই…
-আগে বিয়ে কর তারপর ওসব৷ আমি যাই এখন৷
-কই যাবি?
-বিরিয়ানী রাঁধতে!
-আহ! যা এই না হলে আমার বৌ৷ তারাতারি যা৷