বুনো ফুল

বুনো ফুল

চোখে পানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে অনিন্দিতা তাকিয়ে আছে অহনের দিকে। অনিন্দিতার আবদার শুনে চমকে গেছে ও ভয়াবহ ভাবে। আবার কথাটা রিপিট করলো অনিন্দিতা ‘আমাকে একটা বাচ্চা দিবি অহন? ‘

অহনের মাথা কাজ করছে না।মেয়েটার সাথে রিলেশন নিয়ে বাড়িতে এমনিতেই ঝামেলা হয়েছে। বাসায় কেউ কিছু বলেছে। আম্মা খুব ক্ষেপে আছে। তারসাথে মেয়েটার এই অদ্ভুত আবদার।গত কয়েকদিনে কয়েকবার মেয়েটার সাথে ফিজিক্যাল হয়েছে ওর। মেয়েটা নিজেই প্রোটেকশন নিয়েছে।আজ নিশ্চয়ই কিছু নেয় নি।

-তুই কি প্রোটেকশন নিয়েছিস?
-না

অহনের মেজাজ বিগড়ে গেল। যদিও মেয়েটার মেন্টাল স্টেবলিটি জানা আছে ওর। পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে যেয়ে হলেও সিংগেল মাদার হবে যদি চায়। কিন্তু ফিজিক্যালি মোটেই স্টেবল নয় ও জানে অহন। আটমাস আগেই ব্রেইনে সিরিয়াস লেবেলের ইনফেকশন ধরা পড়েছে। লাংস, লিভার পুরোটাই ইনফেকটেড ওর। ভোকাল কেটে ফেলার কথাও বলেছে ডক্টর। মেয়েটার উইল পাওয়ার দেখে অবাক হতে হয়।কিন্তু অহন যেটা জানে না সেটা হলো একটা বাচ্চার জন্য অনিন্দিতা সত্যিই বাঁচার চেষ্টা করে। যদি সিংগেল মাদার হতে হয় তবুও অনিন্দিতার বাচ্চা চাইই।

-অনি, এই পাগলামি গুলা একদম করবি না। সব সময় সব ঢং ভালোলাগে না।

অনিন্দিতা চুপসে গেল। ডাগর চোখ দুটো বড় বড় করে কতক্ষন অহনের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো ‘আর কখনোই কোনো পাগলামি করতে দেখবা না তুমি অহন। ‘মুখে বললো,

-আচ্ছা।

দুদিন ধরে অহনের কোনো খোঁজ নেই।অনিন্দিতা অস্থির হয়ে আছে। বাসা থেকে বাইরেও যেতে পারছে না। দুদিনের উদ্বেগ কাটিয়ে দিতে ফোনটা এলো ঠিক রাত দেড়টায়।

-কি অবস্থা?
-এইতো ।
-দুদিন কোনো খোঁজ নেই। একটা টেক্সট তো করা যায়।
-স্যরি
-ইটস ওকে।খাওয়া করছো?
-হ্যা। তুমি?
– ঋণো ভাইয়ার বাসায় আছি।না খেলে জানালা দিয়ে ফেলে দেবে।
-গুড
-মন খারাপ কেন?
-একটা কথা বলার ছিল।

অনিন্দিতা জানে অহন কি বলবে। প্রাণপণ কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে ও। মনে মনে বলছে ‘বোলো না অহন।তোমাকে ছাড়া বাঁচবো ঠিকই। ভালো থাকা হবে না। ‘

-অনি,লাইনে আছো?
-হ্যা বলো।
-আসলে তোমার সাথে রিলেশনটা কন্টিনিউ করা আর সম্ভব না। বাসায় মানছে না।মানবেও না।
-ব্যাপার না অহন।ভালো থাকো।ঠিক মতো পড়াশোনা করবা। নিজের টেক কেয়ার করবা।
-তুই ঠিকমতো মেডিসিন নিবি তো?
-হ্যা
-আচ্ছা রাখি
-আচ্ছা
ফোন রেখে অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়লো অনিন্দিতা। কিছু মানুষ পাশে
থাকলেই অনেক কিছু বলা হয়ে যায়।কিছু মানুষ পাশে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যায়।মানুষগুলো থাকেও। কিন্তু অন্য কারো পাশে। ওর কান্নার শব্দে উঠে এলো প্রিয় ঋণো ভাই।

-কাঁদছিস কেন?

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো অনিন্দিতা।

-কি হলো?

অনিন্দিতা চুপ।

ঋণো মাথায় হাত রাখতে গলা থেকে ছিটকে বের হলো কান্না।

-ভাইয়া, অহন ফোন দিয়েছিল।রিলেশনটা ও রাখতে পারবে না।

ঋণো কিছু বললো না। হৃদয় ভাঙবার কষ্টটা ও জানে।ঐন্দ্রিলার সাথে ব্রেকাপের সময় ও ও তো এইরকম ভেঙে পড়েছিল। তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল রিদিতা। তবুও অনেক সময় লেগেছিল গুছিয়ে উঠতে। অনিন্দিতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসে ফোন দিল অহনকে।

– কে বলছেন?
-আমি ঋণো,অনির বড় ভাই।
-হ্যা ভাইয়া বলেন।
-অহন আমি ছোট্ট একটা রিকোয়েস্ট করবো তোমাকে।
-জ্বি

-আমার বোনটাকে তো দেখছই।বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র চল্লিশ পারসেন্ট।ও কে এই কটা দিন মিথ্যে হলেও ভালোবেসো।

-আচ্ছা আমি ভেবে দেখি ।

ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঋণো। আদালতের কারখানায় হৃদর ভাঙার বিচার হয়না।

কয়েকদিন ধরেই অনিন্দিতাকে ব্যস্ত রেখেছে ঋণো। কখনো সুডোকু মেলাতে দিয়েছে, কখনো গল্প লিখতে দিয়েছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। ঋণোর খুব কষ্ট হয়। মুভি নিয়ে কথা বলছিল ঋণো অনির সাথে।আচমকা অনির ফোন বেজে উঠলো।

স্ক্রিনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েই আবার তাকালো। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে যুগপৎ বিস্ময় আর আনন্দ।

-ভাইয়া
ফিসফিসিয়ে ডাকলো অনি।
-বল
-অহন ফোন দিয়েছে। নয়দিন পর।
-ফোনটা ধর

অনিন্দিতা ফোন ধরলো।আনন্দ খেলা করছে ওর মুখে, হাসিতে, কন্ঠে।ঋণো উঠে গেল।বলুক ওরা কথা নিজের মত করে কিছুক্ষন।

-কি করিস অনি?
-ভাইয়ার সাথে গল্প করছিলাম।
-আমিও গল্প করবো।
-বাসা তো চেনই। আসো।
-উঁহু। এখন সম্ভব না। তোর সাথে কিছু কথা ছিল।
অনিন্দিতার বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে উঠলো উদ্বেগে।
-বল
-আমি তোমার কাছে ফিরতে পারি । কিছু শর্তে।
-বল

-আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন দেখা করবো।আমার ইচ্ছে মত ফোন করবো। সবসময় তোমার ফোন ধরতে পারবো না । টেক্সটের রিপ্লে দিতে পারবো না।তুই আমাকে তুমি করে বলবি। আমার লাইফে অন্য মেয়ে আসলে তোকে চলে যেতে হবে।

অহন, ঋণো কেউই জানলো না নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত কষ্ট নিয়ে, চোখে পানি ঠোঁটে হাসি রেখে অনিন্দিতা বললো,

-তুমি যে শর্ত দিবা আমি তাতেই রাজি। শুধু তোমাকে পেলেই আমি খুশি।
কথা শেষে ঋণো ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-মিল হয়েছে?
-হ্যা ভাইয়া
-গুড। লেটস সেলিব্রেট।

ঋণো, অহন জানলো না ওই মুহূর্ত থেকে অনিন্দিতার বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছেটাই মরে গেছে এক ছেলেমানুষি অভিমানে।

অহন অনিন্দিতার সম্পর্কটা স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। আগের মতই অহনের কেয়ার করছে। সপ্তাহে একদিন দেখা করছে। ঋণোও দেখছে অনিন্দিতা ঠিকমতো অষুধ খাচ্ছে, চেক আপ করাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার চোখের নীচের কালি চোখে পরে না। গাঢ় কাজলের আড়ালে সেটা ঢাকা থাকে। কপালের ভাঁজ চোখে পরে না চন্দনের টিপে। মেয়েটার হাসিতে প্রাণ থাকে না।রোগীর সুস্থতার জন্য ডাক্তার, মেডিসিন যতটুকু। ততটুকুই দরকার বেঁচে থাকার ইচ্ছে। জীবনের প্রতি ভালোবাসা জিইয়ে রাখতে হয়। অনিন্দিতার শারীরিক অবনতি দেখে ডাক্তার চোখ কপালে তুলে ফেললো,

-কি ব্যাপার ঋণো?অনি অষুধ নিচ্ছে না ঠিকমতো?
-নিচ্ছে তো।ফুল কোর্স ধরে।

-দুম করে ওর শরীর কেন এত খারাপ হবে?এই মান্থে নাক আর কান দিয়ে ব্লিডিং হয়েছে অলমোস্ট সাতবার। ও তো এমনিতেই এনিমিক।এত ব্লাড গেলে দুদিন পর ডোনারের জন্যই ডোনার খুঁজতে হবে।

-কিন্তু ডক ও তো সব মেডিসিন ঠিকমতো নিচ্ছে। আমি নিজেই দেখি।

-তাহলে রেজাল্ট কি দাঁড়ালো?যখন মেডিসিনে ফাঁকিবাজি করতো তখনই ভালো থাকতো?মেডিকেল সায়েন্স নাকি সাইকোলজিক্যাল সাইন্স? হচ্ছেটা কি?ফাইজলামি-তাহলে রেজাল্ট কি দাঁড়ালো?যখন মেডিসিনে ফাঁকিবাজি করতো তখনই ভালো থাকতো?মেডিকেল সায়েন্স নাকি সাইকোলজিক্যাল সাইন্স? হচ্ছেটা কি?ফাইজলামি?
ডাক্তার চোখ গরম করে তাকালো।

-কি ব্যাপার অনি?
অনিন্দিতা একেবারে নিষ্পাপ মুখ করে বললো,
-আমি তো কিছু জানি না ডক
বৃদ্ধ ডাক্তার ঠিকই দেখলো অনিন্দিতার প্রাণহীন হাসি , জলভরা চোখ।

-অহন
-বল
-আমি একটু ঢাকার বাইরে যাব।
-হঠাৎ?
-এমনি। মৌমির সাথে দেখা করতে।
মৌমি, অনিন্দিতার বেস্ট ফ্রেন্ড।সিলেট থাকে।
-কবে আসবি?
-সতেরো তারিখ
-আচ্ছা।
ও হাসলো। অহন জানে না অনিন্দিতা
কতটা অভিমানিনী। ওর অভিমান হার মানায় মারিয়ানা ট্রেঞ্চকেও।

অনিন্দিতা পালাচ্ছে। শরীর খারাপ খুব। জানে সময় খুব কম।তাই অনিন্দিতা পালাচ্ছে। এইটেই শাস্তি অহনের।
ওর শেষ নিঃশ্বাস ও ফেলবে

অহনের থেকে যোজন দূরে। নামহীন পাহাড়ের গায়ে হবে ওর কবর। পাহাড়ি বুনো ফুলের গন্ধে ভাসবে সময়। অহন জানবে না শুকিয়ে গেছে ‘অনিন্দিতা’ নামের বুনো ফুলটি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত