কলেজ থেকে ফিরতে আজ একটু দেরি হলো মেঘার। বাবা , ও বাবা।কোথায় তুমি? এই তো মা , আমি এখানে রান্না ঘরে। তুমি রান্না ঘরে কি করছ? তোমায় বলেছি না কতোদিন যে তুমি রান্না ঘরে কোনো কাজ করবে না। আরে তেমন কিছুই না।তোর আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে ভাবলাম আটাটা একটু মেখে রাখি।তোর সুবিধা হবে।খিদে ও নিশ্চয়ই পেয়েছে তোর। আমার কথা অতো ভাবতে হবে না তোমায় এই অসুস্থ অবস্থায়। আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেবো। তোর আজকে এতো দেরি কেন হলো মা?এতো দেরি তো তোর হয় না কোনোদিনও।
সরি বাবা।তোমাকে বলা হয়নি ।একদম ভুলে গেছিলাম বাবা।আজকে থেকেই শুরু করেছি।নতুন একটা টিউশনি জোগাড় করেছি। আচ্ছা। তাই তোর ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে গেল। হ্যাঁ বাবা। তিয়া কোথায় বাবা?ফেরেনি? হ্যাঁ রে মা ফিরেছে।ওই পাশের বাড়ির শিউলি এসেছে বাপের বাড়ি। তাই দেখা করতে গেছে। ও।আচ্ছা বাবা তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।আমি ঝটপট খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি। মা মরা মেয়েটাকে দেখবার আছে খালি অসুস্থ বাবা।সামান্য কিছু টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। বাবার রোজগার। বাবা এখন অসুস্থ।কারখানার কাজটা আর নেই।ঘরে আছে ছোট্ট বোন তিয়া। সে ক্লাস টেন এ পড়ছে। মেঘার আর তিয়ার দুজনের পড়ার খরচ মেঘাই জোগায়। দিন রাত এক করে টিউশনি করে টাকা রোজগার করে। এটা মেঘার কলেজের লাস্ট ইয়ার।তাই এখন থেকেই এপিয়ারিং দেখিয়ে নানা জায়গায় চাকরির দরখাস্ত পাঠাচ্ছে। চাকরি যে তাকে পেতেই হবে। যেমন করেই হোক। বোনের পড়াশোনা বাবার দেখাশোনা সব কিছুর জন্য যে অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন।
মায়ের স্বপ্ন ছিল বোন যেন ডাক্তার হয়।আর মেঘা কোনো সরকারি কর্মচারী। বোন আগা গোড়াই পড়াশোনাতে ভীষণ ভালো। মায়ের বিশ্বাস ছিল বোন একদিন ঠিক ডাক্তার হবে।মায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী বোন আজও খুব ভালো রেজাল্ট করে।জেলাস্তরের বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতায় ও অংশগ্রহণ করে আর প্রথম পুরস্কার অর্জন করে বিদ্যালয়ের তরফ থেকে। যদিও ওর সাথে আরও দু একজন থাকে তবুও সবাই জানে যে ও না থাকলে পুরস্কার পাওয়া সহজ হতো না। স্কুল, পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই তিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মায়ের আশীর্বাদ যখন আছে তিয়া একদিন নিশ্চয়ই বড় ডাক্তার হবে। শুধু একটা সুযোগ করে দিতে হবে ওকে।আর সে সুযোগ মেঘা ওকে করে দেবেই। যত কষ্টই হয় হোক, দরকার হলে না খেয়ে থাকবে।তবুও মায়ের স্বপ্ন পূরণ তাকে করতেই হবে।
দেখতে দেখতে মেঘার কলেজের পড়া শেষ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করে চলেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যতটা সময় পায় টিউশনি করে।মায়ের রেখে যাওয়া আশীর্বাদ আর বাবার আশীর্বাদ ও প্রার্থনার জোড়ে মেঘা একটা সরকারী না হলেও বেসরকারি অফিসে যোগদান করে।তার যোগ্যতা অনুযায়ী সে চাকরি তার নয়।আরও ভালো চাকরি পাওয়ার কথা।তবুও বাবা আর বোনের কথা ভেবে হাসি মুখে কাজ করে যায়। সাথে সাথে আরও ভালো চাকরির চেষ্টাও করে যায়।মেঘা চাকরি পাওয়ায় টাকার অভাব অনেকটাই ঘুচলো।দেখতে দেখতে তিয়াও বেশ বড় হয়ে গেল।সেও ডাক্তারিতে চান্স পায়। মায়ের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।সবাই খুব খুশি।
অভাবের মধ্যে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে দিন কাটছে মেঘার। বোনের পড়াশোনার জন্য প্রচুর খরচ।দেখতে দেখতে তিয়াও তার ডাক্তারির লাস্ট ইয়ার এ এসে পড়েছে। আর কটা দিন।তারপর তিয়া ডাক্তার ডিগ্রি পেয়ে যাবে।আর তিয়ার যা ভালো রেজাল্ট করে ও ঠিক কোনো না কোনো হসপিটালে চাকরি পেয়ে যাবে। মায়ের স্বপ্ন পূরণের প্রজাপতি মথ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়ে ডানা মেলে উড়ল বুঝি।আর কিছুদিনের অপেক্ষা। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে মনে খুশির ফোয়ারা নেচে উঠল মেঘার ।
এইভাবেই স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায় দিন কাটছিল।দেখতে দেখতে তিয়ার সেই দিন এলো।যেদিন সে পরিচিতি লাভ করবে ডাক্তার হিসেবে। সে সাথে করে দিদিকে নিয়ে যেতে চাইলো। দি ভাই চল্ না দি ভাই। আজকে আমার জীবনের এতোবড় একটা দিন।মা নেই।বাবা অসুস্থ। তুই তো আমার জীবনে বাবা মা কারোরই অভাব রাখিস নি।মা চলে গিয়েও তোকে আমার কাছে মা হিসেবে রেখে গেছেন। তুই তো আমার মা বল দি ভাই। মেঘার দু গাল বেয়ে জল নেমে আসে চোখ থেকে আনন্দে , গর্বে।তার বোনকে নিয়ে তার গর্ব। আজ তার এতো দিনের সব পরিশ্রম সার্থক। বোনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করে। আর বলে যাওয়ার আগে মায়ের ফটোতে প্রণাম করে যাস।আর বাবাকেও। হ্যাঁ, দিদি।আর তুই?তুই যাবি না? আমার সাথে? না রে বোন।দুঃখ পাস না।আজ আমার শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত রে।একদম উঠতে পারছি না। কি যে করিস না তুই দি ভাই। কবে থেকে বলছি একটা ভালো ডাক্তার দেখা।তুই আর দেখালি না। তুইই আমার কাছে সব থেকে বড় ডাক্তার। আজকের পর তুই আমার চিকিৎসা করবি।ঠিক আছে। খুশি?নে তাড়াতাড়ি যা এবার। অনেক দেরি হয়ে গেল। হুম। যাচ্ছি। আর তুই তো ওই একটা বাহানা দেখিয়ে আর ভালো করে চিকিৎসাও করালি না।ফিরে এসে কিন্তু আমরা এক সাথে খাবো। আচ্ছা বেশ।
তিয়া চলে গেল তার গন্তব্যস্থলের দিকে।ফিরতে ফিরতে বিকেল প্রায়। এসে দেখে বাড়ির সামনে ভীষণ ভীড়। একটু ভয় পেল।তবে কি বাবার কিছু হলো?ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। ঢুকে দেখে খাবার জায়গায় তার পছন্দের সমস্ত খাবার সাজানো।আর একটু এগিয়ে যায়। দিদির কাছে যাবে বলে পা বাড়ায় দিদির ঘরের দিকে। এগোতে পারে না সে।বিছানায় সাদা কাপড়ে ঢাকা দি ভাই এর শরীর। আর পাশে বাবা বসে অঝোরে কেঁদে চলেছে। একি অমাবস্যা নেমে এলো তার জীবনে। আজ তো পূর্ণিমা হবার কথা। কিছুতেই বুঝতে পারে না এসব কি হচ্ছে?পাশ থেকে ডাক্তার মন্ডল এসে তাকে বলে অবাক হচ্ছিস নারে ? হবারই কথা।আসলে মেঘার পাকস্থলীতে ক্যান্সার আক্রমণ করেছিল অনেক দিন।আমার কাছ থেকে কথা নিয়েছিল কাউকে যেন না বলি।তোর ডাক্তার হওয়া অবধি যেন মুখ বন্ধ রাখি।মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে।অনেক ব্যাথা সহ্য করেছে।তোর মায়ের আশীর্বাদ আর ওর মনের জোরে ও এতদূর আসতে পেরেছে।আজ তোর জন্য সব রান্না নিজে হাতে তোর পছন্দের করেছে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোকে নিজে হাতে খাওয়াতে পারলো না।
চারদিক কেমন যেন নিস্তব্ধ লাগছে তিয়ার ।ডাক্তার মন্ডলের কথা ছাড়া যেন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। বুকের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট কষ্টের পাথর যেন জড়ো হয়ে পর্বত প্রমাণ চেহারা নিতে লাগল।বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দি ভাই কে দেখতে লাগল।মনে মনে বলল তুইও আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি?একটিবার আমায় বললি না? একটিবার আমাকে সুযোগ দিলি না?দি ভাই এই জন্মে তুই মা না হয়েও আমার মা হয়েছিস।পরের জন্মে কিন্তু তোর মেয়ে হয়ে জন্মাতে চাই।শুধু পরের জন্মে কেন ? প্রতি জন্মে যেন তুইই আমার মা হোস।আর এ জন্মে যে ঋণ আমার তোর কাছে রয়ে গেল। তা যেন পরের জন্মে মেয়ে হয়ে শোধ করতে পারি।যদিও মায়ের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যায় না।তবুও ……
সমাপ্ত