নীরা কথনঃ
দরজা খুলেই ছোটখাট ধাক্কার মত খেলাম।অয়ন ভাই দাঁড়িয়ে আছে।তার চেহারার দিকে চোখ পড়ার আগে চোখ পড়ছে তার মাথার বিশাল চকচকে টাকের উপর।অয়ন ভাই দুইদিন পরপরই কোন না কোন উদ্ভট কাজকর্ম করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।
কিন্তু ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো চেহারা বিসর্জন দিয়ে টাকমাথা গৌতম বুদ্ধের এই বেশ নেয়ার কারণ বুঝতে পারছি না।আমি কিছু বলার আগে খ্যাঁক করে উঠে বললেন,”দরজার সামনে এরকম লাইট পোস্টের মত দাঁড়ায়ে আছিস কেন?”
ঢুকেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।তারপর একটু লাফ দিয়ে সোফায় দোল খেতে খেতে বললেন,
“ডিয়ার নীরা,ফ্রেশ করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়।দুধ,চিনি,লি
কার সবই বেশি দিবি।”
“আমার কপালের মাঝখানে কি কোথাও লেখা আছে-কাজের বেটি নীরা?”
“চা বানালেই কি কাজের বেটি হয়ে যায় নাকি!তুইতো দিনদিন কুটিল থেকে কুটিলতর স্বভাবের মেয়ে হয়ে যাচ্ছিস!”
“আমার স্বভাব নিয়ে গবেষণা করার আগে নিজের চরকায় তেল দেন।আপনার মাথার চুল গুলা সব কই গেছে?”
অয়ন ভাই এবার মুখ গম্ভীর করে বললেন,”চুলের তো আর হাত পা নাই যে নিজে থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাবে।আমিই ফেলে দিয়েছি।”
“মাথায় কি উকুন হয়েছিল?নাকি কোন মেয়ের সাথে লাইন মারতে গিয়ে তার বড় ভাইয়ের কাছে ধরা খেয়েছিলেন?সে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে?”
অয়ন ভাই এবার চোখ সরু করে বললেন,
“আজকাল স্টার প্লাস আর স্টার জলসা খুব বেশি দেখছিস মনে হচ্ছে?মাথাতো পোকামাকড়ে ছেয়ে গেছে তোর।”
“পোকামাকড় থাকলেও ভাল।আপনার মত বিশুদ্ধ গোবর তো নাই।”
“তোর জন্মের সময় খালাম্মা মুখে মধু দিতে ভুলে গিয়েছিল এইটা তো জানতাম।কিন্তু কেউ যে তার বদলে করলা পাতার রস খাইয়ে দিয়েছিল এইটা আজকে জানলাম।”
আমি চুপ করলাম।অয়ন ভাইয়ের টাক মাথায় আলকাতরা মাখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।একটু পর নিজেই উদাস উদাস ভঙ্গি করে বললেন,
“বুঝলি মাই ডিয়ার নীরা,কাল রাস্তায় বের হয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত যাওয়ার পথে যতগুলা রিকশা দেখলাম,তার মধ্যে একমাত্র আমিই একা রিকশায় যাচ্ছি।ডানে তাকাই,দেখি রিকশায় এক জোড়া ছেলে মেয়ে।বাঁয়ে তাকাই,আরেক জোড়া ছেলেমেয়ে।সামনে পিছনে যেই দিকেই তাকাই শুধু কাপল এর কাপল।আরে কেউ যদি আমার সাথে ৩ দিনের জন্যও প্রেম করত,তাইলেও জীবনটা মিনিংফুল হইত।এই বুড়া বয়সেও একা একা রিকশায় যাই।শালার এই দুঃখেই মাথার সব চুল ফেলে দিয়েছি।”
আমি কিছু না বলে উঠে চলে এলাম।এই বদ ছেলেকে এক্ষুনি কান ধরে বাসা থেকে বের করে দিতে ইচ্ছা করছে।দিন দিন ওনার ছ্যাঁচড়ামি আরও বেড়ে যাচ্ছে।কয়েকদিন আগে ফেসবুকে ঢুকে দেখি,কোন এক মেয়ের ছবিতে উনি কমেন্ট দিয়েছেন,”লুকিং সো নাইস।”
রাগে ওনাকে ফেসবুক থেকেই ব্লক করে দিয়েছি আমি। প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুকলেই দেখি হোমপেইজের প্রথম দিকের স্টোরি থাকে-
“Oyon mahmud is now friends with omuk and 5 others tomuk.”
অবধারিতভাবে এই অমুক এবং অন্য পাঁচ ছয়জন তমুক সব সময়ই মেয়ে হয়।আমার কেন এসব দেখলে মেজাজ খারাপ হয় আমি জানিনা।শুধু জানি আমার মেজাজ খারাপ হয়। অয়ন ভাই আমার বড় ভাই নিয়াজের বন্ধু।দুইজন একই সাথে ভার্সিটিতে পড়ত। ভাইয়া পাস করে বেড়িয়েছে তিন বছর হল।গত বছর অস্ট্রেলিয়া গেছে।কিন্তু অয়ন ভাই এখনও পাস করে বেরোতে পারেনি।তার নাকি কার্জন হলের জন্য মায়া লাগে।তাই প্রতি বছর তিনি ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান।পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়,সেদিন সন্ধ্যায় তিনি বিমর্ষ মুখে ফিরে আসেন এবং তার চেয়েও বিমর্ষ মুখে বলেন,”বুঝলি,এবার তো আমার অস্থির প্রিপারেশন ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হল,স্যাররা যে প্রশ্ন করবে ঐসব আসলে আমার স্ট্যান্ডার্ড এর সাথে যায়না। এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার,বুঝলি?এটা নিয়ে নিরিবিলি চিন্তা করার জন্যই বান্দরবান চলে গেলাম।অপূর্ব জায়গা।না গেলে জীবন বৃথা।”
ফিরে আসার পর দেড় দু সপ্তাহ তিনি আমাদের বাসাতেই থাকেন।কারণ ওনার বাবার একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে।রেগে গেলে সারাক্ষণ তিনি এই পিস্তল হাতে নিয়ে বাসার বারান্দায় বসে থাকেন।এই দেড় দু সপ্তাহের জন্য আমি সারা বছর অপেক্ষা করি।তখন আমি কলেজে যাইনা।সারাদিন অয়ন ভাইয়ের সাথে গল্প করি।খুব হাসাহাসির গল্পের মাঝখানেও হঠাৎ করে আমার কান্না পায়।মনে হয় জীবনটা এত অসহ্য সুখের হওয়ার কি দরকার ছিল?
আর অয়ন ভাই কিছু বুঝতে না পেরে বেকুবের মত তাকিয়ে থাকেন।তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,”মেয়ে মানুষের মন গিরগিটির মত রঙ পরিবর্তনশীল।আর পৃথিবীর সব ছেলে এই ক্ষেত্রে কালার ব্লাইণ্ড।”
অয়ন কথনঃ
বাল্যকাল থেকেই আমার হৃদয়ে সুন্দরী মেয়েদের জন্য একটা বিশেষ মমতার জায়গা আছে।যে যত সুন্দরী, তার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা তত বেশি।কিন্তু আমার বন্ধু অয়নের পুচকি বোনটার বেলায় হিসাবটা একটু গরমিল হচ্ছে।সে দেখতে “চলে” টাইপ।নাকটা চাইনিজদের মত চাপা,মুখটা ফোলাফোলা।তার চেয়েও বড় কথা, মেয়ের মেজাজ সব সময় বিপদ সীমার কাছাকাছি থাকে।এজন্যই পুরো চেহারায় “খাইয়া ফালামু” টাইপ ভাব আছে।
কিন্তু এই মেয়ের জন্য আমার এত বছরের অভিজ্ঞ প্রেমিক হৃদয় শুকনো খড়খড়ে রাস্তায়ও বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ওকে দেখলে আমার মনে হয় চারিদিকে মৃদু স্বরে পাখি ডাকছে,প্রজাপতি উড়ছে।মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা হয়।এই ব্যথা কমে না,সময়ের সাথে বাড়তেই থাকে। কবিতা লেখারও চরম ভাব আসে। ওকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কবিতা-
“নাক চাপা নীরা
তোমায় না দেখলে
হৃদয়ে হয় পীড়া
কি খাও,টমেটো নাকি খিরা?”
আজকাল তো কঠিন কঠিন দাঁতভাঙা কতগুলো শব্দ না থাকলে কবিতায় গভীরতা আসে না।তাই ঠিক করেছি কঠিন ভাষায় আরেকটা কবিতা লিখে নীরাকে দেব।তাতে একটা ভাব আসবে। গত পরশু নীরার কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছি,দেখি রোদের মধ্যে বেচারি দাঁড়িয়ে আছে।কোন রিকশা নাই আশেপাশে।আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে এলাম।বেয়াদব মেয়ে এমন ভাবে রিকশায় উঠে বসলো,দেখে মনে হল যেন আমি প্রতিদিন তার জন্য রোদের মধ্যে রিকশা নিয়ে আসব এটাই স্বাভাবিক।কোথায় বলবে,”অয়ন ভাই দেখি রোদে ঘামিয়ে গেছেন একদম!জলদি রিকশায় উঠে বসুন।একসাথে বাসায় যাই।”
তা না করে সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রিকশাওয়ালা কে বলে,”মামা,তাড়াতাড়ি যান।আর হুডটা উঠায়ে দেন।”
এত রাগের কি হল কিছুই বুঝলাম না।আমাকে ফেসবুক থেকেও ব্লক করে দিয়েছে।বিশাল বদ মেয়ে। ফর্সা গায়ের রঙ নিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।ঠিক করলাম আর জীবনেও এই মেয়ের সাথে কথা বলব না । কিন্তু বিকালের পর থেকে মনটা কেমন জানি করতে লাগলো।সন্ধ্যার পর দেখি ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রাত হতে না হতেই হাতটা কেমন নিশপিশ করতে লাগলো একবার ওর নাম্বার ডায়াল করার জন্য।গোটা ছয় সিগারেট খেয়ে মনটা শান্ত করার চেষ্টা করলাম।রাত ১২ তার পর মনে হল,আমি আসলে একটা গাধা। রোদে দাঁড়িয়ে থেকে নীরার মেজাজ খারাপ ছিল।তাই ওরকম করেছে।আমার উচিৎ এক্ষুনি ফোন করা। আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফুরফুরে মনে নীরাকে ফোন দিলাম।কোমল গলায় বললাম,
“কিরে নীরা পিচ্চি,তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস নাকি?”
সেই মেয়ে উত্তর দিল,”আপনি তো আমার বড় ভাইয়ের মত।আপনার উপর রাগ করব কেন?”
হে বিধাতা,এই কথা শোনার জন্য এতদিন বেঁচে ছিলাম!ওর বড় ভাইয়ের সাথে পড়েছি বলেই কি আমিও বড় ভাই নাকি?রাগে দুঃখে কি করব ভেবে পেলাম না।শেষমেস মাথার সব চুল ফেলে দিলাম।ভুরুটাও ফেলে দেয়ার ইচ্ছা ছিল,কিন্তু বিরক্ত হলে ভুরু কুঁচকানোর সময় ভুরু কই পাব?তাই ওটা রেখে দিলাম।
পরদিন সকালে প্রথমেই গেলাম নীরাদের বাসায়।
আমার টাকমাথা দেখে তার সে কি রাগ!রাগ করে মুখ ঝামটা দিয়ে ভিতরে চলে গেল।আমি খুশিতে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম।মেয়েরা যার উপর সবচেয়ে বেশী রাগ দেখাবে,বুঝতে হবে তার জন্য মমতা সবচেয়ে বেশি।রাগ হল মেয়েদের মমতা আড়াল করার মুখোশ। আমি ঠিক করেছি কোন এক গভীর রাতে নীরাকে ফোন করে বলব,
“নীরা,তুই আমার ছোট ভাইয়ের ভাবী হবি?”
নীরা আমার সাথে সব সময় রাগারাগি করে,কিন্তু আমার ছোট ভাইকে খুবই আদর করে।আমিতো আর নিজের জন্য কিছু চাচ্ছিনা,চাচ্ছি আমার ছোট ভাইয়ের ভাবী।ওর কথা ভেবে নীরা নিশ্চয়ই না করবে না। কথাটা সামনা সামনি বললেই অবশ্য ভাল হত।আমার প্ল্যান ছিল কোন এক বৃষ্টির দিনে হুট করে নীরাদের বাসায় এক গাদা কদম ফুল হাতে উপস্থিত হব।বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। একটা ব্যান্ডদল আনতে পারলে আরও ভাল হত।তারা ব্যাকগ্রাউণ্ড এ রোমান্টিক মিউজিক বাজাত।কিন্তু নীরার মেজাজ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত।যে কোন মুহূর্তে জ্বলে উঠে।সামনা সামনি কিছু বললে ঠাশ করে গালে চড় লাগিয়ে দেয়াও তার জন্য বিচিত্র না।তার আদব কায়দা একটু কম আছে।তাই সব ভেবে চিন্তে এবং নীরার ভিসুভিয়াস সম মেজাজের কথা ঠিক করেছি,ফোনে বলাই উত্তম।
নীরা কথনঃ
আজ নিয়ে উনচল্লিশ দিন হল অয়ন ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়না।আমি প্রতিদিন ওনাকে ফোন করি। আর প্রতিদিন তিনি একই কাজ করেন-আমার ফোন কেটে দেন।আমি নিজেই একদিন গিয়েছিলাম ওনাদের বাসায়।উনি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে ছিলেন,আমার সাথে দেখা করেননি।তার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন অনেকক্ষণ।আচ্ছা,এমন কেন হল?আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি।আমি দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করি,একদিন এই স্বপ্নটা আমাদের বাসার কলিংবেলের শব্দে ভেঙে যাবে। দরজা খুলেই দেখব অয়ন ভাই দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে ধমক দিয়ে বলবেন,”খাম্বার মত দাঁড়ায়ে আছিস কেন? তুই কি খাম্বা?যা জলদি গরম গরম পরোটা ভেজে নিয়ে আয়।”
কিন্তু আমি জানি,এরকম আর কখনও হবেনা।হুড়মুড় করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে আর কখনও উনি বাসায় ঢুকে পড়বেন না।সারাটা জীবন তাড়াহুড়া করে কাটিয়ে দিলেন।রাস্তা পার হওয়ার সময় তাড়াহুড়াটা একটু বেশিই থাকে তার।সেজন্যই উল্টো পাশ থেকে আসা গাড়িটা খেয়াল করেননি তিনি।পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ওনার মা কাঁদতে কাঁদতে যখন ফোনে খবরটা দিলেন,আমি তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি।
শুনেছি অয়ন ভাই আর কখনও স্ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারবে না।প্রতি রাতে আমি স্বপ্নে দেখি অয়ন ভাই একা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।শিশুদের মত অসহায় গলায় বলছেন,
“মাই ডিয়ার নীরা,রাস্তাটা কত বড় দেখেছিস?একা পার হব কিভাবে?”
অবশেষে অয়ন ভাই আমার ফোন ধরেছেন।ধরেই কঠিন গলায় বলেছেন,
“আর কখনও আমাকে ফোন করবি না।”
অবশ্য আজকে তিনি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন।শর্ত হল-এরপর আমি আর কোনদিন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব না।
অয়ন কথনঃ
নীরার মাথা থেকে আমার ভূত স্থায়ীভাবে নামাতে হবে।যে কোন কারণেই হোক,মেয়েটা পাগলের মত আচরণ করছে।কিছুদিন আগে হলেও ওর এই পাগলামি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা বলে মনে হত।কিন্তু আমার এই অসম্পূর্ণ জীবনের সাথে জড়িয়ে ওর সুন্দর জীবনটাকে বিকলাঙ্গ করে দেয়ার কোন মানে হয়না।ওর ফোন পেয়েও কেটে দেয়ার সময় যে অসহ্য যন্ত্রণা হয়েছে আমার,তা আরও দশবার পঙ্গু হওয়ার যন্ত্রণার চেয়েও বেশি।সবাই চায় তার ভালবাসাকে সম্পূর্ণ দেখতে,কিন্তু পূর্ণতা তো শুধু পাওয়ার মধ্যেই আসেনা।আমি আমার ভালবাসাকে না,ভালবাসার মানুষটার জীবন পূর্ণ দেখতে চাই।তাই ওর জীবন থেকে এভাবেই সরে যাব আমি।
আজকে শেষবারের মত নীরার সাথে দেখা হবে আমার… কেমন যেন বুক কাঁপছে আমার।দোয়েল চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।পাশ থেকে যেই যাচ্ছে,আমার স্ক্রাচটার দিকে করুণ চোখে তাকাচ্ছে।নীরাও কি অনেক করুণা নিয়ে তাকাবে আমার দিকে?
ঢাকা শহরের আবহাওয়া বড়সড় রসিকতা করছে আমার সাথে।একটু আগেও রোদে মাথা ধরে যাচ্ছিল,আর এখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।নীরা দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে।ওর পড়নে সাদা শাড়ী,হাতে সাদা কাঁচের চুড়ি।কপালের মাঝখানে এত্ত বড় একটা লাল টিপ।কি অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে!বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ধাঁধার মত লাগে।আমার বুকে সেই পরিচিত ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে,সুখের মত ব্যথা।
নীরা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,
“অয়ন ভাই,আমার কপালের টিপটা ঠিক মাঝখানে আছে তো?নাকি বৃষ্টিতে সরে গেছে।”
“মাঝখানেই আছে।”
“বুঝলেন অয়ন ভাই,আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল এমন এক ঝুম বৃষ্টিতে আপনার কনুই খামচে ধরে হাঁটব।”
আমি কঠিন গলায় বললাম,”যে নিজেই একটা স্ক্রাচ ধরে হাঁটে,তাকে ধরে হাঁটলে বেশিদূর যেতে পারবি না।হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবি।”
নীরা হাসতে হাসতে বলল,”কেন আপনি ছোটবেলায় ওই কবিতাটা পড়েন নাই?হাঁটিতে শেখে না কেহ না খেয়ে আছাড়?”
“কথায় কথায় রসিকতা করার চেষ্টা করবি না।”
“আপনিও কথায় কথায় ধমক দেয়ার চেষ্টা করবেন না।আসেন আমার হাত ধরেন।শেষ দেখায় একটু বর্ষা উৎসব হয়ে যাক।”
আমি বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম।তারপর কোমল গলায় বললাম,
“নীরা,তুই খুব ছোট একটা মেয়ে।জীবনে কখনও কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়িসনি।তাই কাঁচা আবেগে অনেক ভুল করে ফেলতে পারিস। এসব আবেগ যত পাত্তা দিবি,ততই জীবনে কষ্ট বাড়বে।”
কিছুক্ষণ ঠোঁট খামচে দাঁড়িয়ে রইল ও।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শুন্য গলায় বলল,
“আপনি যদি আজকে আমাকে ফিরিয়ে দেন,তাহলে এরপর প্রথম যে গাড়িটা আসবে,আমি তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।আপনি ভাল করেই জানেন আমি যেটা বলি সেটা করেই ছাড়ি।”
আমি অসহায় গলায় বললাম,”নীরা তুই প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।”
নীরা কিছুই শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে বলল,”আপনার সামনে অবশ্য আরেকটা অপশন আছে। সারাজীবনের জন্য যদি আপনি ওই বিশ্রী স্ক্রাচটার বদলে আমার হাত ধরে হাঁটতে রাজি হন,তাহলে আমি গাড়ীর সামনে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারি।”
বৃষ্টির পানির সাথে নীরার চোখের পানি মিশে গেছে।কান্নার সময় ওর নিচের ঠোঁটটা কেমন জানি বেঁকে যায়।
কারো কান্নার দৃশ্যও এত সুন্দর হয়!আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম।বিধাতা এই মেয়েটির চোখ যেন আর কখনও দুঃখের অশ্রুতে না ভাসান।বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ছে।বাড়ুক…
…বৃষ্টির পানি আজ সব ধুয়ে নিয়ে যাক। আমি শক্ত করে নীরাকে ধরে আছি।এখন পুরো পৃথিবী ভেসে গেলেও কিছু যায় আসে না।আপাতত একটা বিষয় নিয়েই আমি চিন্তিত।আশেপাশে কদম ফুল কোথায় পাওয়া যাবে?