মেয়ের মায়া ভরা মুখের পানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শফিক সাহেব।
মেয়েটা আর আগের মতো বায়না করে না।আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।বেঁচে থাকা নিয়েও সংশয়।কথাগুলো ভাবতেই কোনো এক অজানা ভয়ে শফিক সাহেবের বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে।এই মোচড়টা খুব কষ্টের,ভয়ংকর কষ্ট।
.
-এখন কেমন লাগছে রে মা?
-কখন আসলে আব্বু?
– এইতো কিছুক্ষন হলো,তুই ঘুমে ছিলি তো তাই ডাকি নি।
-বাসায় যাবো কখন,আব্বু?
-তুই আগে একটু সুস্থ হয়ে নে,তারপরই বাসায় চলে যাবো।
-সত্যিই তো?
-হে রে মা। বাবা কি তোর কাছে কখনও মিথ্যা বলেছে?
-না,কিন্তু এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে,তুমি যতোক্ষন থাকো ততক্ষন একটু ভালো লাগে।
-আমি তো সবসময়ই থাকি,তুই আগের থেকে একটু বেশি ঘুমাস তো তাই এমনটা মনে হয়। চিন্তা করিস না মা,বাসায় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা বাবা।
-এখন আব্বুর হাতে ঔষুদ টা খেয়ে নে।
.
মা মরা মেয়েটাকে নিয়েই শফিক সাহেবের সব স্বপ্ন।কিছুদিন আগে মেয়েটার মাথায় টিউমার ধরা পরেছে।টাকা পয়সা যোগাড় করাটাও অনেক কঠিন হয়ে পরেছে।অপারেশন করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন।শেষ সম্বল আছে জমানো কিছু টাকা আর বাড়িটা।
…
-টুম্পা বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো শফিক সাহেব। খুব খারাপ স্বপ্ন যা শফিক সাহেবের কাছে মৃত্যর সমান।একগ্লাস পানি খেয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসলো শফিক সাহেব।কপালে আলতু করে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়লো শফিক সাহেব।ডাক্তার এক সপ্তাহের টাইম দিয়েছে।জলদি টাকা যোগাড় করতে হবে।
.
ফজরের নামাজটা মাঝপথেই সেড়ে নিলো শফিক সাহেব,সাথে মেয়েটার জন্য মন ভরে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো।গন্তব্য নিজের গ্রাম।একমাত্র থাকার যে জায়গাটা ছিলো যেটা বিক্রি করে দিবে।আর কিছু জমানো টাকা আছে এগুলো নিয়ে আসবে।
.
-একবার ভেবে দেখো শফিক।
-কি ভাববো চেয়ারম্যান সাহেব,মা মরা মেয়েটাই যে আমার সব।আপনি তো জানেনই আপন বলতে মেয়েটাই আমার আছে।
-আচ্ছা উকিল আসলেই সব স্বাক্ষর করে দিও আর এই যে টাকাটা নাও।
-ধন্যবাদ চেয়ারম্যান সাহেব।
.
-একবার ভেবে দেখুন স্যার।এইটাকা গুলোই আপনার শেষ সম্বল।
-মেয়েটাও আমার শেষ সম্বল।
-অন্যদিক দিয়ে ম্যানেজ করা যায় না?
-হাত পাতার কি দরকার?
-এই নিন স্যার,।
.
টাকাগুলো নিয়ে বের হয়ে পড়লো শফিক সাহেব,হাসপাতালের উদ্দেশ্য আজকে টাকা দেওয়ার শেষ তারিখ।
.
টুম্পার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলো শফিক সাহেব।
-এতোদিন কোথায় ছিলে আব্বু?
-এইতো একটু কাজে বাসায় গিয়েছিলাম।
-আমি কবে যাবো?
-আমরা এখন থেকে শহরেই থাকবো মা।
-কেন?
-তোর এখানকার স্কুলেই পড়ালেখা করতে হবে তো তাই।মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাবো গ্রামে।
-ঠিক আছে আব্বু।
-এখন ঔষুদ টা খেয়ে ঘুমিয়ে পর।
-আচ্ছা।
নিজ হাতে ঔষুদ টা খাইয়ে দিল শফিক সাহেব!!
.
ডাক্তাব সাহেব,আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।
-টাকার ব্যাবস্থা হয়েছে?
-জ্বি।
-টাকাটা জমা দিয়ে এখনে একটা স্বাক্ষর করে যান।
-ঠিক আছে।
.
শফিক সাহেব খুব চিন্তিত।শেষ এমন ভাবে চিন্তিত হয়েছিলেন মেয়েটা পৃথিবীতে আসার সময়,তখন ওর মা পৃথিবী ত্যাগ করেছিলো।খুব কষ্টে লালন পালন করেছে মেয়েটাকে।একদম মায়ের মতো হয়েছে মেয়েটা।
.
-আব্বু,আমার খুব ক্ষুদা পেয়েছে।
-আসছি রে মা,এইতো শেষ।
-আজকে কিন্তু আমায় খাইয়ে দিতে হবে।
-আমার মা টা তো অনেক বড় হয়ে গেছে,এখন তো নিজ হাতে খেতে হবে।
-তাহলে আর খাব না।
-আরে এমনি দুষ্টমি করলাম।আমিই তোকে খাইয়ে দেবো।
-আব্বু আমি বড় হবো কখন?
-যখন তুই কলজে যাবি।চোখে বড় বড় চশমা আর গায়ে থাকবে ডাক্তারদের পোশাক।
-কলেজে গেলেই বড় হয়ে যাবো?
-হ্যা রে মা।
-তাহলে কলেজ যাবো না।তুমি খাইয়ে না দিলে তো আমার পেটই ভরে না।
-আরে কলেজ তো আরও অনেক পরে, এখন তুই প্রাইমারি স্কুলে পড়িস তারপর হাইস্কুল পড়বি। তার পরে কলেজ যাবি।
.
কারও হাতের স্পর্শে ভাবনার জগৎ জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরলো শফিক সাহেব।
-চিন্তা করবেন না,অপারেশন সাকসেস, আল্লাহ কে ডাকুন।ইনশাল্লাহ আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!
.
দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলেন শফিক সাহেব।মন ভরে শুকরিয়া আর মেয়ের জন্য দোয়া করলেন আল্লহর কাছে।
মেয়ের পাশে বসেই দু ফোটা চোখের জল ফেল্লেন শফিক সাহেব।এই জল কষ্টের নয় বরং সুখের।মেয়েটা আবার বায়না করবে বাবার হাতে খাওয়ার জন্য,মেয়েটা আবার পড়তে বসবে,পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করবে।মেয়েটার চুলে সুন্দর করে বিনি গেঁথে দিতে পারবে।ভাবতে যেন পৃথিবী সমান সুখ খুঁজে পায় শফিক সাহেব।এই সুখ যেনো সিমাহিন সুখ,তৃপ্তির সুখ।
.
প্রত্যেক পিতা-মাতারই যেনো সর্বশেষ কল্পনা,অভিমান,সুখ,দুঃখ থাকে তাদের সন্তানকে নিয়ে।কোনো স্বার্থ থাকে না তাদের ভালবাসায়।নিস্বার্থ ভাবে ভালবেসে যায় তাদের সন্তনকে।যে ভালবাসার শেষ হয় না,হয় না কোনো তুলনা।এ যেনো বিধাতারই নিয়ম।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা