অনিন্দিতা নিরবে বসে আছে নদীপারে, আকাশের অপেক্ষা করছে সে, একটু পাশেই শরতের কাশবন দেখছে,
এর আগে অনেকবার এখানে এসেছে সে আকাশের সঙ্গে দেখা করতে, আজও এসেছে সে জন্য ।
তাদের প্রথম দেখাও হয়েছিল এইজায়গায় কোনোএক শরৎ বিকেলে,এই নদীপারে কাশবনের ধারে. বসে বসে ভাবছিল সে।
হঠাৎ আকাশের গলায় অনিন্দিতা ডাক শুনে তার ভাবনার ছেদ ঘটল।
.
-অনিন্দিতা হঠাৎ এখানে ডাকলে কেন ? (আকাশ)
-তোমায় কিছু কথা বলার আছে, যা আজই বলা দরকার।
-কি বলো!(আকাশ)
-আকাশ বাবা মা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে, তারা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে,
তারা এই সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়েও দিয়ে দিবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। তুমি কিছু একটা করো আকাশ!
আমায় নিয়ে চল তোমার সাথে, আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবোনা, আর্তনাদের স্বরে বলতে লাগলো,, অনিন্দিতা
.
আকাশ এবার কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, তার মাথার উপর অর্ধ ধসে পরিবার,মা,ছোট তিন ভাই বোন ও অসুস্থ বাবা,
এদের যে ভরণ পোষণের দায়িত্ব সে নিয়েছে,,যা উপার্জন করে তাতে সংসার চলতে হিমশিম খাচ্ছে।
তার এই জীবনে অনিন্দিতাকে জড়িয়ে সে কষ্ট দিতে চায়না। তবে কি বলবে সে এই মুহুর্তে ঠিক ভেবে পাচ্ছেনা। তাও বললো।
.
-জীবনে শুধো একটা ভালোবাসাকে আপন করে পেয়ে মানুষ সুখী হয়না অনিন্দিতা, তোমার মা,বাবা, পরিবার তোমায় ভালোবাসে।
তোমার জীবনে তাদেরও ভালোবাসা প্রয়োজন আছে, তারা তোমায় সত্যি সুখী দেখতে চায়,
আর তুমি অন্ধ ভালোবাসায় ক্ষণিকের জন্য হয়ত একটু সুখী হবে আমায় পেয়ে, আমিও হব ।
কিন্তু বহু পরে আমার পারিবারিক অসচ্ছলতা তোমায় বুঝিয়ে দিবে যে তুমি আমার সাথে জীবন বেধে ভুল করেছিলে।
আর সাড়া জীবন তোমায় সে দুঃখ গুলা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তার চেয়ে মেনে নাও মা বাবার কথা,সুখী হবে জীবনে।
.
কথা গুলা বলে আকাশের চোখেও মনে বেদনার জল গুলা মেঘ হয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল ,
জলগুলাও যেন তার চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরতে চাইল, কিন্তু আকাশ নিজেকে সামলে নিল তখন।
.
প্লিজ আকাশ এমনটা বলোনা, তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবনা, তুমি খেলেই আমি খাবো, যেখানে রাখবে সেখানেই থাকব,
তবুও আমায় তোমার ভালোবাসার ঘরে একটু জায়গা দাও।
ফিরিয়ে দিওনা আমায়, আর যদি ফিরিয়ে দাও সত্যি অনেক দূরে হারিয়ে যাব , আকাশের দুটি হাত ধরে কান্না করে বলতে লাগল,,, অনিন্দিতা।
.
অনিন্দিতা আবারও বলছি এমন করোনা,সত্যি আমার কাছে তুমি সুখী হবেনা, ফিরে যাও।
-আকাশ একটা শেষ কথা জানতে ইচ্ছে করছে!
-কি কথা বলো (আকাশ)
-আচ্ছা যদি আমার বিয়ে হয়ে যায় তুমি কি আসবে আমার বিয়েতে ?
-হ্যাঁ আসবো (আকাশ)
.
এই কথাটা বলতেই যেন তীব্র ব্যথায় আকাশের বুক ছিঁড়ে একটা চিৎকার বের হতে চাইল, তাও সে সেই ব্যথা বুকেই চাপা দিল।
আকাশদের যে কাঁদতে নেই। ব্যথাও তাদের ছুঁইতে পারেনা, হাজারটা কষ্ট বুকে চেপে হাসতে হয় তাদের।
বেমানান সব কিছুই মেনে নিতে হয় তাদের। সেও ঠিক হাসছিল তখন,,,
কিন্তু অনিন্দিতা দেখতে ভুল করল আকাশের সেই হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকা কষ্টটাকে।
.
-অনিন্দিতা আবারও কান্না স্বরে জিজ্ঞেস করল,,,,আকাশ তবে কি আজই আমাদের শেষ দেখা ?
আর কি কখনো আসবেনা তুমি, এই শরতের কাশবনে ?
.
আকাশ এবার কোনো উত্তর না দিয়েই হাটতে লাগল। তার নিউরনে জোড়ে কিছু প্রশ্ন উকি দিচ্ছিল।
আজ যদি এখানে সব শেষ হয়ে যায় বহু পরে কি অনিন্দিতা ভুলে যাবে এই কাশবনের কথা?
যেখানে তাদের ভালোবাসার পদযুগলের চাপ রয়ে যাবে অনন্তকাল! ভুলে যাবে কি এই নদী পারে বসে থাকার কথা ?
একটা কাশফুল ছিঁড়ে নিজের হাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ঐ নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা ?
মনে পরবে কি গোধূলি বিকেলে ঐ দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট মাঝিমাল্লার গানের কথা?
.
আকাশ এক পা দুই পা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল,
কিন্তু পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিন্দিতার কাছে তার মনটা বার বার ছুঁটে যেতে চাইলো। কিন্তু সে আর মনের কথা শুনতে চাইলনা।
ধীয় গতিতে সে চলতে লাগলো । আর চোখের কোণঘেঁষা জল গুলা এক হাতে মুছে চলল।
.
আকাশ একটু দূরে চলে গিয়েও পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিন্দিতার পানে কান পেতে আছে,
কিন্তু অনিন্দিতার কোনো কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেনা,
আকাশ ভাবতে থাকে অনিন্দিতা কি আর অপেক্ষার প্রহর না গুনেই চলে গেল ?
সে এক পলকে পিছনে ঘুরে তাকালো.
.
দেখতে পেলো অনিন্দিতার নিতর দেহখানা মাটিতে আষ্টেপৃষ্ঠে পরে আছে, সেই দৃশ্য দেখে সে কিছুই বুঝে উঠার চেষ্টা করলোনা,
দৌড়ে চলে গেল অনিন্দিতার কাছে, অনিন্দিতার নিষ্প্রাণ দেহে জড়িয়ে সে অনিন্দিতা,,,অনিন্দিতা,,,,,বলে ডাকতে লাগল।
.
কি অদ্ভুত ব্যাপার যেই অনিন্দিতা একটু আগে এই কথাটা বলছিল >
(( ফিরিয়ে দিও না আমায়, আর যদি ফিরিয়ে দাও সত্যি অনেক দূরে হারিয়ে যাবো))<আকাশ এবার ঠিকই বুঝতে পারল তার সেই কথাটা।
কিন্তু আকাশ অনেক দেরি করে ফেললো। সে ই এখন আর আকাশের কোনো ডাকে সাড়া দিচ্ছেনা। যেন গভীর ঘুমে কাতরে গেছে সে।
.
আকাশ অনিন্দিতার নিতর দুটি হাতে ধরতে গিয়ে একটা ছোট্ট বোতল দেখতে পায়, বোতলের উপরিভাগের সাদা লেভেলে ”বিষ” লিখা ছিল।
হ্যাঁ ঠিকই অনিন্দিতা চিরতরে ঘুমাচ্ছিল, ততক্ষণে অনেক দুরেই চলে গিয়েছিল সে।
তখন পৃথিবীর কোনো শব্দই যেন তার কানে আর পৌঁছাচ্ছিল না।
.
চারিদিক কেমন নিস্তব্ধতা অবলম্বন করতে লাগল, নদীর জোয়ার গুলা থেমে গেল ক্রমশই ।
কাশফুলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বৈরী হাওয়া গুলাও অন্যদিকে বইতে লাগল।
আকাশও বহু পরে তার মনে জমে থাকা মেঘগুলাকে বৃষ্টি রুপে মুষলধারায় ঝরাতে লাগল।
…..
অনিন্দিতা – আকাশের এই কাশবনে শুরো হওয়া ভালোবাসার গল্পটা বহু পরে আজ এভাবেই শেষ হয়ে গেল ।
পৃথিবীতে শত অনিন্দিতা আকাশ আছে,
যাদের গল্প গুলা নিরবে লোকচক্ষুর অন্তরালে পরিত্যক্ত ডায়রিতে পরে আছে, হয়তো ধুলা জমছে ডায়রীর উপরে।
আর সেই ডায়রীর জেনে যাওয়া কিছু গল্প অর্ধ অধ্যায় পর্যন্ত লিখা হয়।
অবশেষে সেইসব গল্পেরও মধ্যখানে টানা হয়.. ইতি ।