একটি মানুষ যদি থাকত

একটি মানুষ যদি থাকত

চারিদিকে মেয়েরা নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরাঘুরি করছে। আমরা ক’জন বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিশোর বয়সে ভালোলাগার বিষয়গুলো অনেক বিচিত্র। সবাই আনন্দ করলেও আমার মনটা খুব খারাপ। বারবার তৈাকিরের কথাগুলো মনে পড়ছে। আমার মনে এখন আর কোনো আনন্দ নেই।

ইদের নামাজ পড়ে সব বন্ধুরা কোলাকোলি করে সিদ্ধান্ত নিলাম শিলমান্দি যাব। কিন্তু তৌকির যেতে পারবেনা। কারণ জানতে চাইলে বলল তার কাজ আছে। আমি তৌকিরকে একটু দূরে ডেকে নিলাম। বললাম, “আজ ইদের দিন। অন্য কাজগুলো অন্যদিন করিস। সব বন্ধুরা ঘুরতে যাব। খুব আনন্দ হবে।”

তৌকির আমাকে বলল, “ইদ কী সবার জীবনেই আনন্দ বয়ে আনে? গত চার বছর আগে ইদের আগেরদিন বাবা সেমাই খেতে চেয়েছিল। মা বলেছে কাল ইদ, কাল রান্না করলে খেও। ইদের দিন সকালে বাবাকে হাসপাতাল নেবার পথেই মারা গেলেন। মা আর বাবাকে সেমাই খাওয়াতে পারেনি। সেই থেকে আমাদের বাড়ি আর সেমাই রান্না হয় না। বন্ধুদের সাথে তো সারা বছরই ঘুরে আনন্দ করি। আজকের দিনটা না হয় আনন্দ না করি। সবসময় আনন্দ করতে হয় না। আমি বাবার কবর জিয়ারত করতে যাব। তোরা যা, আনন্দ কর। কাল থেকে আবার আমাকে তোদের সাথে পাবি।”

হুট করেই সাথের বন্ধুদের বললাম, “তোরা আনন্দ কর। আমার দরকারী একটা কাজ আছে।”
ওদের ছেড়ে আমি তৌকিরদের বাড়ি গেলাম। তৌকির রুমেই ছিল। চোখ বন্ধ করে আছে। পাশের রুমে তৌকিরের মা কোরআন পড়ছে। আমি তৌকিরকে ডাক দিতেই চোখ খুলল। ঘুমুচ্ছে কিনা জানতে চাওয়ার জবাবে বলল, চোখ বন্ধ করে কোরআন শুনছে।

তৌকির উঠে পাশের রুমে যেতে চাইল। আমি হাত ধরে টেনে বসালাম। আমি জানি সে আমার জন্য খাবার ব্যবস্থা করতে পাশের রুমে যাবে। আমি খেতে আসিনি। তৌকির বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবি?”

আমার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। সকালে যাকে রাজী করতে পারিনি, সে নিজের মুখে ঘুরার কথা বলছে।
তৌকির আবার বলল, “শুধু আমি আর তুই যাব। নিরিবিলি কোনো পরিবেশে চল।”

দূরে কোথাও না গিয়ে ঘাট বাঁধানো বড় দিঘির পাড়ে গেলাম। দিঘির পাশ দিয়ে বড় রাস্তা। দলে দলে মানুষ ঘুরাফিরা করছে। আমি তৌকিরকে নিয়ে নারকেল গাছে বাঁধা নৌকাটিতে উঠলাম। বাঁধন খুলে নৌকায় ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়লাম। দিঘির মাঝখানে নৌকা। আমি আর তৌকির নৌকার দুই মাথায় বসা। আমাদের কথা রাস্তার কেউ শুনবেনা। কিন্তু রাস্তার মানুষের অনেকের দৃষ্টি আমাদের দিকে। দুটি ছেলে বৈঠাহীন নৌকায় বসে আছে দিঘির জলে। আমাদের দু’জনকে প্রকৃতির অংশ মনে হচ্ছে।
“এবার থেকে দোকানে আমিই বসব।”

তৌকিরের কথা শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “তাহলে লেখাপড়া?”
উত্তরে বলল, “চাকরির বাজার মন্দা। আমাদের ছয়জনের বড় সংসার। লোক দিয়ে দোকান চালিয়ে তেমন একটা লাভের মুখ দেখছিনা, তাই নিজেই বসব। এখন আমার লেখাপড়া বা নিজের চিন্তা করার আগে বাবার দেয়া দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে।”

আমি অবাক হয়ে একজন সাহসী যুদ্ধাকে দেখছি। যে আমার সাথে একই নৈাকায় বসা।
“আমি জানতাম তুই ওদের সাথে না ঘুরে চলে আসবি।”

তৌকিরের এমন কথায় অবাক না হয়ে পারলাম না। আবারো বলল, “শ্রাবণ, সবার অনুভূতি একরকম না। সব বন্ধুর থেকে তোকে বেশি আপন লাগে। কারণ তুই মানুষের মন পড়তে পারিস। অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় কিন্তু মন জয় করে নিতে শুদ্ধ একটা মন লাগে। আর সে মন তোর আছে। তুই হাসির আড়ালের দুঃখের গল্পগুলো খুঁচিয়ে বের করতে পারিস। বাকি বন্ধুরাও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু তারা মন পড়তে পারেনা। এজন্যই তোকে আমার ভালো লাগে।”

এক বন্ধু সারাক্ষন ফোনে তার প্রেমিকার সাথে ঝগড়া লেগেই থাকে। তাকে ঝগড়ার কারণ জানতে চাইলে বলে, “মেয়ে তারটা বুঝে আমি আমারটা বুঝি। দু’জন দু’জনেরটা বুঝি, তবে আগে ঝগড়া করে নেই।”

হঠাৎ তাকে আর ঝগড়া করতে দেখিনা। তবে মনমরা থাকে খুব। সারাক্ষন কী যেন ভেবে বেড়ায়। এমন পরিণতির কথা জানতে চাইলে বলল, “তাকে জিতিয়ে দিয়েছি। আমি ভুল না করেও স্বীকার করি। তাই আর ঝগড়া হয় না। সে জিতুক। আমার মনে কী চলে সেটা যদি সে বুঝতেই না পারে তাহলে জিতুক। কিন্তু আমার মন বুঝতে না পারার জন্য আমার কাছে নীরবে হেরেই গেল।”

তৌকির নীরব। তার এখন নীরব থেকে নিজের কথা না ভেবে দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই বন্ধুটাও নীরব। প্রেমিকাকে জিতিয়ে দিতে নিজে হেরেই যাচ্ছে বারবার। তাদের মন সবাই বুঝতে পারবেনা।

মনও চিৎকার করে কাঁদতে চায়। তিলে তিলে জমাকৃত কষ্টের বাতাস বের করে দিতে। অনেকেই প্রকাশ্যে জয়ী। কিন্তু তাদের ভিতরটা কাঁদে। চাপা কষ্ট বের করে দিতে কাঁদে। আর মনে মনে ভাবে, “একটি মানুষ যদি থাকত, যে আমার মনটা বুঝতে পারত।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত