আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে তৈরি করছিলাম। আজ অনেকদিন পর আবিরের সাথে দেখা হবে।ওর দেওয়া নীল শাড়ি,কাচের লাল চুরি আর লাল টিপটা পড়লাম। বেলী ফুলের মালাটা খোপায় গেঁথে দিলাম।সাইডব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে নিলাম
আয়নায় চোখটা বুলিয়ে নিলাম একবার। হুম! এবার পুরো বাঙালী নারী লাগছে। আবিরতো চোখ ফেরাতেই পারবেনা!
তারপর নিজের মনেই হেসে দিলাম।
এমন সময় আবিরের কল আসলো।
জুতোটা পড়তে পড়তে বললাম,”আবির! এইতো বেরিয়ে পড়েছি, এখন একটানে চলে আসবো।”
ওপাশটা নিরব।
আমার কথার উওর কেউ দিচ্ছেনা।
আমি খানিকটা চুপ করে থেকে বললাম,”আবির!কি হলো!”
আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আবির বলে উঠলো, “ইসরাত!তুমি আর এসোনা। ফিরে যাও!”
আমি ওর কথার আগামাথা কিছু বুঝলামনা। কি বলছে এসব!
বললাম,”আবির!কেনো!তোমার কি কোনো কাজ পড়ে গেছে?তাহলে আমরা পরে দেখা করি! হুম!”
আবির নির্লিপ্ত গলায় বললো,”ইসরাত!আই এম সরি!আমাদের আর দেখা হবেনা কোনোদিন। চৈতী ফিরে এসেছে আমার কাছে।আর আমি ও চৈতীকে ফিরাতে পারবোনা। হুম হয়তো ও ভুল করেছিল। কিন্তু এখন ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে। আমিও ফিরতে চাই ওর কাছে। তুমি চলে যাও আমার জীবন থেকে প্লিজ।
আমি নির্বাক। কি বলবো বুঝতে পারছিলামনা।চৈতী ওর এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিলো। একটু পর হেসে বললাম,”তাই হবে। আর আবির একটা কথা! আবার কোনোদিন কাউকে পেয়ে চৈতীকে ফিরে যেতে বলোনা। ভালো থেকো।”
আবির বলে উঠলো,”ইসরাত! আমি আসলেই সরি, কিন্তু আমি চৈতীকে ফিরিয়ে দিয়ে হার্ট করতে চাইছিনা । প্লিজ ফরগিব,,
ওকে আর বলতে দিলামনা। লাইনটা কেটে দিলাম।
আমি জানি ওর নাম্বার,ফেবু আইডি থাকলে আমি সহ্য করতে না পেরে ঠিকি ওকে বিরক্ত করবো। তাই সিমটা পাল্টে নিলাম। আর আইডি থেকে ব্লক দিয়ে দিলাম ওকে
ভালো থাকুক চৈতী, আবির। আমি না হয় একরকম থাকবো। চলে যাবে দিন কোনোভাবে! বেলী ফুলটা মাথা থেকে খুলতে খুলতে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো দিয়ে ঝড় বইতে লাগলো। এমন হওয়ার তো কথা ছিলোনা! একটু আগেওতো সব ঠিক ছিলো!
“দুবছর পর।
এখন আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করি।আগের বাসাটা চেন্জ করে নতুন বাসায় উঠেছি। বিয়ে করিনি। ওই চাপটারটা হয়তো আমার জীবনে আর কোনোদিন আসবেনা ও না । আবিরকে ভুলে যাওয়ার শত চেষ্টায় ও ভুলতে পারিনি। তবুও এইতো বেশ আছি একা একা। বেশ থাকবো। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম।
হঠাৎ পেছন থেকে ইসরাত বলে কেউ একজন ডাক দিলো। এ কন্ঠ!এ কন্ঠ আমার খুব চেনা! হার্টবিটটা বেড়ে গেল। একটু পর ভাবলাম,নাহ্ এ কন্ঠ আর কোনোদিনো শোনা হবেনা আমার!ভুল শুনছি। সামনে পা বাড়ালাম।
কিন্তু আবারো সেই ডাক,”ইসরাত!”
দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম।
আবির!
আমি চমকে বললাম, “আপনি?”
আবির বললো,”বাহ্!এতো পর হয়ে গেলাম!
আপনি বলে ডাকা হচ্ছে?”
আমার কাছে ওর কথাগুলো কাটার মত বিধঁছিলো কেনো জানি।
বললাম,”কোন অধিকারে তুমি বলবো?যাহোক কেমন আছেন!চৈতী কেমন আছে!আর এতবছর পর আমার সামনে কেনো?
আবির মাথা নিচু করে বললো,” ভালো নেই ইসরাত!তোমাকে হারিয়ে একটু ও ভালো নেই। “ভুল করেছিলাম আমি চৈতীকে ফিরিয়ে নিয়ে। ও আমাকে ছেড়ে আবার চলে গেছে।”
আবিরের কথাগুলোতে উওর দেওয়ার মতো কোনো কিছু ছিলোনা আমার কাছে। বললাম,”ওহ্!তো এখন কি করছেন?”
আবির বললো,”আপাতত জব করছি।”
আমি বললাম,”ভালো, আজ তাহলে আসি।আমাকে একটা টিউশনে যেতে হবে।
ভালো থাকবেন।”
বলেই সামনে হাটা দিলাম।
পেছন থেকে আবির বলে উঠলো,””ইসরাত!”ভালো থাকবনা তোমাকে ছাড়া!প্লিজ আমাকে আর একবার একটা সুযোগ দিবে? এমন ভুল আর কোনোদিন করবোনা।” আমি কথাগুলো শুনতে চাইছিলামনা। শুনা উচিতনা।
তবুও কি যেন একটা বারবার আমায় টেনে নিয়ে যেতে চাইলো আবিরের কাছে।
কি?
সে পুরনো টান?
পুরনো ভালবাসা?
কি মনে করে যেন আবার পিছন ফিরলাম।
আবিরের মুখোমুখি হলাম।
ওকে গ্রহণ করেও নিলাম। ভালবাসি যে অনেক!
আমার আর আবিরের বিয়ের আজ ৩ বছর।আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে।
ওর নাম আলাইনা।
সারাদিন বাপ বেটি মিলে যখন আমার সামনে দুষ্টুমি করে বেড়ায়, তখন সুখের হাসি আসে।নিজেকে বড় সুখী মনে হয়।এইতো বেশ আছি।বেশ থাকবো।
ঈদানীং আবিরের ব্যাস্ততা একটু বেড়ে গেছে।
আর বাসায় এসেও কেমন চিৎকার চেচামেচি করে অযথাই।
আলাইনাকেও ধমকাতে ভুলেনা।
দুদিন পর জানলাম আবিরের একটা প্রেম আছে। অফিস কলিগ। মেয়েটা নাকি বেশ সুন্দরী।
কিছু বলতে পারলামনা ওকে। বাবু আর আবির যখন ঘুমিয়ে পড়ে; আমি নিশাচরীর মতো পলকহীন দৃষ্টিতে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যাই। তারপর খুব কাদিঁ।
কে বুঝবে এ যন্ত্রনা?
চোখের সামনে একটু একটু করে প্রিয়জন হারানোর বেদনা কতটা ভয়াবহ!কে বুঝবে!
সকালে আবিরের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হলো। ঝগড়াগুলো ঈদানীং খুব বেশি হয়। তবে এগুলো অযথাই হয়।
আবির ঝগড়ার একপর্যায়ে বলেই দিলো “ভুল করেছি বিয়ে করে তোমায়!ইসরাত প্লিজ! জাস্ট লিভ মি!”
আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,”লিভ মির অর্থটা বুঝলামনা আবির।”
আবির ধমকে বললো,”ইয়ার্কি মারা হচ্ছে!লিভ মি মানে বুঝোনা!তোমাকে আমি আর নিতে পারছিনা। ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও আমায়!প্লিজ ইসরাত!ডির্ভোস মি!”
আমার পায়ের নিচ থেকে হঠাৎ মাটিটা যেনো সরে গেলো।ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,”এ আবির!কি বলছো এসব!এমন কি হলো যে আমাদের আলাদা হতে হবে!আর আলাদা হলে আমাদের বাবুটার কি হবে!”
আবির বললো,”ও নতুন মা পাবে।”
কথাটা শুনে পিছিয়ে গেলাম। কেউ যেন আমাকে একটা শিকল পড়িয়ে দিলো।নড়াচড়া করতে পারলামনা।
পরদিন ডিভোর্স পেপার আমার সামনে রাখা হলো। সাথে উকিল। তিনি বললেন,”আরো ৬ মাস দেখতে হবে।ডিভোর্স এত তাড়াতাড়ি হবেনা।”
আমি কিছু বললামনা।
উঠে গিয়ে আলাইনাকে জড়িয়ে ধরলাম,”বাবু!তোর মায়ের পরশ আর ৬ মাস পাবি তুই!ক্ষমা করিস তোর মাকে!কিছু করার নেই আমার! আবিরের খুশিই আমার খুশি।
আস্তে আস্তে মাসগুলো কেটে গেলো। একটা সময় ডিভোর্স ও হয়ে গেলো। চলে আসার দিন আবিরকে বললাম,”আবির মনে পড়ে!আরো একবার ও চলে গিয়েছিলাম!
আজ আবার যাচ্ছি।শুধু তোমাকে ভাল রাখতে!
এসব কিছুর মাঝে কখন যে নিজের ভালো থাকাটাই চলে গেছে বুঝিনি। যাইহোক!আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো।ওর নতুন মাকে বলো,ওকে যেনো কষ্ট না দেয়।”
আর বলতে পারলামনা। বোবা কান্নায় চোখ ভেসে যাচ্ছিলো।আবির সেদিকে তাকালোওনা একবার!মানুষ!বড় আজব!
আলাইনা আধে আধো গলায় বললো,”বাবা!মা কোথায় যাচ্ছে!আমিও যাবো।”
আবির বললো,”আলাইনা!বাবু মা শপিংয়ে যাচ্ছে। ফিরে আসবে একটু পর।”
গাড়িতে উঠলাম। আবির আজকাল খুব কঠিন হয়ে গেছে। একটাবার কিছু বললোনা। এতো বছরের সর্মপক ভেঙে দিতে ওর একটু ও বাধঁছেনা।
দেখতে দেখতে আবির আর আলাইনাকে ফেলে গাড়িটা অনেকদুর চলে এলো। চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো।তাকাতে পারছিনা।
আগের বাসাতেই উঠলাম। আবারো সেই একা চলা
নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টাটা করলাম
মাঝে যা ঘটেছে দুঃস্বপ্ন। হুম। শুধুই দুঃস্বপ্ন! শুধু কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে আমার আলাইনা ভালো থাকবেতো মাকে ছাড়া?হুম!থাকবে!ওর বাবা,নতুন মা আছেতো!
নাহ্ আর ভাবা যায়না।
দীর্ঘ ৫ বছর পর!
পার্কের বেঞ্চি টাতে একা বসে আছি। সামনে দুটো বাচ্চা খেলা করছে। ভীষন মিষ্টি বাচ্চাগুলো। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমার আলাইনাটা দেখতে ঠিক বা পাশের বাচ্চাটার মতো! কে জানে কেমন আছে আমার মেয়েটা!
হঠাৎ মেয়েটা এসে বললো,”আন্টি!এসোনা!আমাদের সাথে খেলবে!”
পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,”আলাইনা!অহনা! মা এদিকে এসো! বাবা তোমাদের জন্য আইসক্রিম এনেছে।এসো।”
কলিজাটা যেন কেউ খুলে নিয়ে যাচ্ছে!কি শুনলাম এটা!পেছন ফিরলাম।
চশমা পড়া,একটা লোক।
গায়ে চাদর জড়ানো,দাড়ি আছে হালকা।
ফর্মাল ড্রেস।
এসব কিছু ছাপিয়েও আবিরের চেহারা টা এখনো পরিষ্কার আগের মতই।
আবির ও হতভম্ব হয়ে গেলো আমায় দেখে।
,-ইসরাত!তুমি?
আমি কান্নাটা চেপে রাখলাম কোনোমতে!।
বললাম,”হুম!আমি ইসরাত!”
আবির বললো,”অনেকবছর পর দেখা! কেমন আছো!”
বললাম “হুম!অনেকবছর!এইতো বেশ আছি!যাহোক ওটা বুঝি তোমার মেয়ে?অহনা?তোমার স্ত্রী কই?”
আবির দ্বীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,”আল্লাহ!বোধহয় তোমার প্রতি অবিচার সহ্য করেননি ইসরাত!
তাই দুবছর আগেই আমি বিপত্নীক হয়েছি।হুম! আমার মেয়ে অহনা।”
আমি চুপ করে গেলাম।
আবির ই মৌনতা ভঙ্গ করে বললো,”তা এখানে হঠাৎ?”
আমি বললাম “মাঝে মাঝেই আসা হয়।”
আবির বললো,”ওহ্ তা!তোমার স্বামী কি করে?বাচ্চাকাচ্চা?”
হেসে দিলাম।
বললাম,”বিয়ে করিনি। করব ও না কোনোদিন।
এবার আবির চুপ করে গেলো।
পাশ থেকে আলাইনা বলে উঠলো, “বাবা!কে এই আন্টিটা?”খুব দারুনতো!একেবারে মায়ের মতো!”
বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো আলাইনার কথা শুনে।বেচারী!তার নিজের মাকেই চিনতে পারছেনা আজ দুরত্বের কারনে!
আবির বললো,”মা তোমরা ওদিকটায় খেলো,বাবা আসছে এখনি।
মেয়ে দুটো চলে গেলো।
আবির হঠাৎ বলে উঠলো,”ইসরাত”শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিবে প্লিজ!তোমায় খুব মিস করি।অন্তত বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে প্লিজ!”
আমি পিছনে সরে এলাম,বললাম
আমি বললাম,”
না আবির!কয়েক বছর আগের করা সে একি ভুল আমি করছিনা আর!
আর মেয়েরা খুব ভালো আছে মা ছাড়াই।তুমি আছোতো। যাহোক আসি।”
বলেই চলে এলাম। পিছনে ফিরে তাকালাম, আবির উদাসী হয়ে চেয়ে আছে। আহনা আর আলাইনা খেলছে
খুব সুন্দর লাগছে
ওদের দুজনকে।
ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি ওদের। চিৎকার করে বলি আমিই তোদের মা!কিন্তু নাহ!
সে একি ভুল আর করবনা।
আবিররের মতো মানুষগুলি কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। ভালবাসেওনি কোনোদিন। এরা শুধু সময়ের সৎব্যাবহার করে। যখন একা হয়ে পড়ে; তখনি একাকীত্ব গুছানোর জন্য এদের প্রয়োজন হয় ইসরাতের মতো কাউকে। আর ইসরাত!সেতো ভালবাসার চাকাতলে পিষেই মরে! জানতে ও পারেনা তাকে শুধু ব্যাবহার করা হচ্ছে!
আমি আর পারছিনা!
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। চোখের কোনে বয়ে যাওয়া ঝড়টা কেউ দেখছেনা সে অন্ধকারে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম,
হুম এইতো বেশ আছি একা একা !বেশ থাকবো।