-দোস্ত আহাদ কাকার ছেলে আবিরকে তুই টিউশনি পড়াতে পারবি?প্রতিদিন এক ঘন্টা সময় দিলেই হবে।
-কোন ক্লাসে?
-দ্বিতীয়।
-ধুর আমি এতো পিচ্ছি ছাত্রের টিউশনি করতে পারবো না!এগুলা পুরো ভেজাল!শুধু শুধু প্যাঁচাইবো,প্যাঁচাল একটা!
-প্লিজ দোস্ত প্লিজ!তুই যা না,আমি টাইম ম্যান্টেন করতে পারছি না।তা না হলে আমিই যেতাম।আর সন্ধ্যা টাইমে তুইতো ফ্রি থাকিস। তো মাত্র একঘন্টা…
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে আর বলতে হবে না,তুই বললে কি আর করা!তোর কথাতো ফেলতে পারি না,তাই না যেয়ে উপায় নেই!
-ধন্যবাদ দোস্ত!
-হইছে আর আদিক্ষেতা দেখাতে হবে না,এবার বল কোনদিন থেকে যেতে হবে?
-আগামী পরশু থেকে!
-আচ্ছা যাবো।এখন বাই।
-আচ্ছা বাই।যাবি কিন্তু।
-আচ্ছা।
লিটনের কথামতো দুদিন পর আবিরকে পড়াতে এলাম। কলিং বেল বাজাতেই ভেতর থেকে এক বালিকা এসে দরজা খুলে দিয়ে আবিরকে ডাইনিং রুমে রেখে অন্য একটি ঘরে চলে গেলো।বয়স আনুমানিক আঠারোর্ধ হতে পারে!
-নাম কি তোমার?
-এমা!আপনি আমার নাম না জেনেই পড়াতে এসেছেন?
-না আসলে আমি জানি কিন্তু পরিচিতি হতে এটা বলা লাগে।
-তাই নাকি স্যার?
-হুম।
-তাহলে আমি আবির।আপনার নাম কি স্যার?
-আমার নাম হাসিব।তোমার বাসায় কে কে আছে?
-আমি,আমার আপু আর আব্বু।
-আর আম্মু?
-আপু বলে আম্মু নাকি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আর আব্বু বলে আম্মু তারাদের দেশে আছে!
-ওহ আচ্ছা।তোমার আব্বু কি করে?
-আব্বু সারাদিন নিজেদের ব্যবসা নিয়া ব্যাস্ত থাকে!আমরা একটুও সময় পাই না!আমরা কিছু বললেই বলে এসব শুধু আমাদের জন্যই করছে!কিন্তু জানেন স্যার আমি এগুলা চাই না, আমি আব্বুকে চাই আমি চাই আব্বু সবসময় আমাদের কাছে থাকুক!ভালোবাসুক!
আমি অপলক তাকিয়ে আছি এতো ছোট একটা ছেলে কি সুন্দর কথা বলে!জাস্ট অসাধারন মায়া মাখা!
-এই নিন চা!
-ও ধন্যবাদ।
-স্যার ও ছোট মানুষ,একটু আধটু দুষ্টামি করতেই পারে, কিন্তু স্যার আপনি ওকে সামলে নিয়েন।আর জানেনই তো বাবা সবসময় বিজি থাকে তাই ওর অভিভাবক বলতে আমিই।আদরের ছোট ভাই কখনো শাসন করতে পারি নি।কি করবো বলেন!মায়ের ভালোবাসা পায়নি ও,তাই বলে কি বোনের ভালোবাসা পাবে না!
-আচ্ছা ঠিকাছে আমি বুঝেছি,আমি ঠিক সামলে নিবো।
-ধন্যবাদ স্যার।
মেয়েটা এই একটু কথা বলেই চলে গেলো!ওই পাশটায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আনমনে!কিসের এতো কষ্ট মেয়েটার মনে?যাই হোক প্রথমদিন পরিচিতি পর্ব ও একটু কথাবার্তায় শেষ করলাম!
[পরেরদিন]
– আজকেও মেয়েটাই দরজা খুললো!আমি ড্রয়িংরুমে চলে গেলাম।দেখি আজ আবির আগে থেকেই বই নিয়ে বসে আছে।
-হ্যাল্লো আবির হাও আর ইউ?
-ফাইন,স্যার!এন্ড ইউ!
-মি অলসো!
মনে মনে ভাবছি ছেলেটা মোটামুটি ইন্টেলিজেন্ট, আশা করি পড়াতে বেশি হিজিবিজি লাগবে না
-আচ্ছা আবির এবার বই খুলো।আমরা আগে গনিত তারপর ইংরেজী তারপর সাধারন জ্ঞান এভাবে কঠিন থেকে সহজে যাবো এতে করি তুমি বোরিং ফিল করবে না,নাহলে তুমি টায়ার্ড হয়ে গেলে মেজর সাবজেক্টগুলায় মনোযোগী হতে পারবে না।
-আচ্ছা স্যার।
-এই নিন আপনার চা!আর বাহ আপনার সাজেশনটা ভালোই।
-ধন্যবাদ।কিন্তু ওকে তো আপনিই পড়াতে পারতেন।
-আমিই তো আমার কাছে পড়ানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম,কিন্তু ও একদমই আমার কাছে পড়তেই চায় না।শুধু দুষ্টামি করে।একমাত্র ভাই বলে ওকে শাসনও করতে পারি না।
-ওহ বুঝলাম।আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না!
-আমি নিশু।
-আচ্ছা আপনি এতো চুপচাপ কেনো?কিসের এতো চাপা কষ্ট?
-কিছু না।এমনিই।
-বললেই হলো?কিছুতো একটা আছে!
-কিছু না ওসব পারিবারিক সমস্যা।আপনি এখন আবিরকে পড়ান।আমি রান্না করছি আজ কিন্তু আপনি ডিনার করে যাবেন প্লিজ।
-আচ্ছা ঠিকাছে।
আবিরকে আজ অনেক সময় পড়াইছি নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে অনেক বেশিই কারণ নিশু যে অনুরোধ করে বললো ডিনার করে যেতে তাই।প্রায় রাত্রি দশটার দিকে আমি,আবির আর নিশু ডিনারের টেবিলে বসে আছি।
–
-একি আপনার চোখে অশ্রু কেনো?
-কই নাতো!
-যাই হোক আপনার রান্না কিন্তু অসাধারন!
-জানেন একথাটা আমাকে আগে কেউ বলে নি!
-তাই বলে আপনি কাঁদছেন কেনো?কি কারণ?আমাকে যদি না বলেন নাই কিন্তু জেনে রাখেন মনের কষ্ট মনে জমিয়ে রাখলে আরো বেশি কষ্ট হয়।
-হুম বলবো আগে ডিনার শেষ করে নিন!
ডিনার শেষে নিশু আমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে!
-দেখেছেন আমরা কতো একা?এই বাড়িতে আমার মা থাকতো তখন এতো বড় বাড়ি আর এতগুলা রুম ফাকা ছিলো না!আমার মা কে খুব আমরা খুব ভালোবাসতাম।
-এখন কি হয়েছে আপনার মায়ের?
-এখন সেই মহিলাটি আমার দুচোখের বিষ!যদিও বাবা মাঝে মাঝে আবিরকে বলে মা তারাদের দেশে আছে কিন্তু ও জানেনা সত্যিটা কি।
-কি হয়েছে?কি সত্যি?
-আমার মা তারাদের দেশে না এক লম্পটের সাথে চলে গেছে!
-মানে?
-হুম।যা বলছি সব সত্যি!বাবা তখন ব্যবসায়ের বিভিন্ন প্রয়োজনে দেশের বাহিরে থাকতেন।সময় মতো বাড়িও আসতেন না।আর আসলেও প্রায় শুনতাম বাবা আর মা ঝগড়া করছেন।একদিন আমি স্কুল থেকে এসে দেখি বাসায় শুধু আবির।বাবা তখন দেশের বাহিরে।সেই তিন বছরের ছোট আবির নিজের মাকে না পেয়ে খুব কাঁদছিল।আমি অনেক খুঁজলাম কোথাও পাই নি সেদিন আমার মাকে!তারপর বাবাকে ফোন দিলাম বাবা এসে মায়ের সাথে যোগাযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি!মা বলেছিল সে আর ফিরবে না!সেইদিন খুব কেঁদেছিল তিন বছর বয়সি আবির আর ক্লাস নাইনে পড়ুয়া পনেরো বছর বয়সি নিশু!হয়তো আবির মাকে না দেখতে পেয়ে কেঁদেছে আর আমি মায়ের চলে যাওয়া দেখে।সেই চার বছর আগে বাবাও কেঁদেছিল।তবে মায়ের জন্য নয় আমাদের একাকীত্বের জন্য!আজ আবির হয়তো জানে না সত্যিটা।কিন্তু যেদিন জানবে সেদিন হয়তো নারী জাতিকে খুব বেশি ঘৃনা করবে!কিন্তু সব মেয়ে যে এক নয় এটা বুঝাতেই ওকে আমি এতো ভালোবাসি।কখনো শাসন করিনি পর্যন্ত!কিন্তু জানেন আমাদের বাসায় একজন বুয়া আছে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রান্নাবান্নাসহ সকল যাবতীয় কাজ করে চলে যায়।বাকি সময় স্বামী-সন্তানদের সাথে কাটায়।আমারও খুব ইচ্ছে করে ভাইকে নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে থাকতে!কিন্তু বাবা সারাদিন ব্যস্ততায় কাটায়।সপ্তাহে একবার আসে।আমাদের সাথে একটা দিন কাটায়।বাবা বলে এই সব কিছু আমাদের জন্যই করছে,কিন্তু আমরা এসব চাই না।আমি বাবাকে পাশে চাই। সবসময়।বাবাকে চাই আমাদের মন ভালোর জন্য।
-হুম এতোক্ষনে বুঝলাম আপনার সারা সময় মন খারাপের কারন। আপনার ধারনাটা খুব সুন্দর সকল মেয়েই এক নয়।কিন্তু আপনি একট মেয়ে হয়েও আমাকে আপনার এই একাকীত্বের স্থানে কোন বিশ্বাসে টিউটর হিসেবে আনলেন?আমার পরিচিতি কিছু জানেন?
-মোটামুটি!আপনি অনার্স তৃতীয় বর্ষ।যদিও মধ্যবিত্ত কিন্তু ফ্যামিলি স্ট্যাটাস অনেক ভালো!আপনাকে যে আসতে বলেছে উনি আমার ফুফাতো ভাই লিটন আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড!ছেলে হিসেবে আপনি খুব ভালো,আমি না,লিটন ভাই বলেছিলো!ঠিক বলেছি কি?
-হুম।আচ্ছা ভালো থাকেন।আজকে বাই।
এভাবে চলতে থাকলো কয়েকদিন!প্রতিদিন আমি যাওয়ার পর নিশু আমাকে চা করে খাওয়ায় আর আবিরকে পড়ানোর শেষে ওদের একাকীত্বে তিনজনে মিলে কিছুক্ষন আড্ডা দেই।
-স্যার আমি সেমিস্টার পরিক্ষায় ফাস্ট হয়েছি।
-হুম গুড।এভাবে প্রত্যেক পরিক্ষায় ফাস্ট হওয়া চাই।
-হুম স্যার আপনি সবসময় থাকলে আমিও সবসময় হবো!
-ছেলেটার কথা যতই শুনি ততই মুগ্ধ হই!সত্যিই ছেলেবেলায় মানুষের মন কতটা কোমল আর মায়াময়ী সেটা আবিরকে না দেখলে এতো গভীর ভাবে অনুভব করতে পারতাম না!
-কংগ্রেস মাই সুইট ভাইয়া!আর এই যে মি. হাসিব আপনি কাল কিন্তু বিকেলেই আসবেন।আমরা একসাথে তিনজন ঘুরতে যাবো।অনেকদিন হলো বাহিরের মুক্ত জগতে মুক্তচিন্তাধারা নিয়ে বেরোই নি।
-আচ্ছা ঠিকাছে যাবো।
– কিন্তু আপনিতো আপনার ফুফাতো ভাই লিটনের সাথেও বের হতে পারতেন!
-কীভাবে বের হবো?আপনিতো জানেন,ওতো সারাক্ষণ ওই মনি নামের মেয়েটার সাথেই ঘুরে!আমাদের নিয়ে ঘুরার সময় ওর আছে নাকি?
পরেরদিন বিকেলে গিয়ে দেখি ওরা দুজন আগেই তৈরি হয়ে বসে আছে!
-চলো আবির এবার যাওয়া যাক!
-হুম স্যার।
যাই হোক নিশুদের প্রাইভেট গাড়ীতে করে অবশেষে এসে লেকের পার্ক এলাম!কি আশ্চর্য মেয়েটা ড্রাইভিংও পারে!এতো ভেবে লাভ নেই!তারপর ঢুকলাম লেকের পাড়!
-স্যার ওরা এভাবে বসে কি করছে?
-দেখছো না ওরা একজন আরেকজনের ফ্রেন্ড তাই এভাবে বসে আছে।
-ধুর এটা আবার ফ্রেন্ড হয় নাকি?শুধু ছেলে একজন মেয়ে একজন,ছেলে একজন মেয়ে একজন,ছেলে একজন…
-অনেক হয়েছে এবার থামো!
-কেনো?আমি না সিনেমায় দেখেছি!
-কি দেখেছো?
-এভাবে হিরো আর হিরোইন এইভাবে জড়াজড়ি করে!
-এই আবির চুপ!এটা তোমার স্যার,কার সাথে কি বলতে হয় জানো না?আদর করি বলে কি আদরে আদরে বাঁদর হতে হবে নাকি!আসলে ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড।
-তাহলে তো তুমি আর স্যারও পারো!
-কি?
-এরকম বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যেতে!
-চুপ!
-আচ্ছা আচ্ছা থাক।আমরা একটু ওইদিকের বেঞ্চিটায় বসি?
-আচ্ছা চলেন।
ওইদিকে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলাম দুজনের মাঝখানে আবিরকে বসালাম।
-এখানে আর এসেছিলেন?
-হুম।
-কখন?
-ছয় বছর আগে যখন মা ছিলো!বাবা-মায়ের সাথে এসেছিলাম।তখন আবির একবছরের ছিলো!জানেন তখন এই পরিবেশে একজন আরেকজনকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিলেও এতো বিশ্রীভাবে আলিঙ্গন দৃশ্য একটিও ছিলো না!আর আজ আধুনিকতার নামে এতোই… থাক এসব আমার ভেবে লাভ নেই।আমিতো এসব আধুনিকতার ধার ধারি না।
-হুম সত্যিই।আপনি এই বাহ্যিক জগৎ থেকে অনেক দূরে।
-হতে পারে!
যাক বসে বসে অনেক সময় পার করলাম এবার যাওয়া যাক।আবির চলো কিছুক্ষন পর আবার তোমার পড়ার সময় হয়ে যাবে।
-আচ্ছা স্যার চলেন বাসায় যাই।
-হুম চলো!
আবিরদের বাসায় আসার পর।
-আপনি বসেন আমি আসছি!
-আচ্ছা।
কিছুক্ষন পর নিশু এসে।
-এই নিন?
-এসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?
-আমার তো কেউ নেই তাই কাউকে ভালোবেসে কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারি না বুঝি?আমি এতো কষ্ট করে আপনার জন্য এইটুকু নুডলস রান্না করলাম কিন্তু আপনি যদি এই কষ্টের চার আনা দাম না দেন তাহলে… …
-আচ্ছা ঠিকাছে খাবো কিন্তু সবাই মিলে।
-আচ্ছা।
-আর যাই হোক আপনার রান্নার স্বাদটা অসাধারণ!
-সত্যিই?
-হুম।কিন্তু প্রশংসায় মানুষ খুশি হয় আর আপনি কাঁদছেন কেনো?
-কাঁদছি না তো!আনন্দ অশ্রু এটা!জানেন,কেউ কখনো এভাবে আমার রান্নার প্রশংসা করে নি শুধু আপনি ছাড়া কিন্তু আপনি যখন বললেন তখন নিজের থেকে অনেক বেশিই আনন্দ লেগেছে!
-ও আচ্ছা!তাহলে আপনি মোটেই ভালো রান্না করেন না!
-কেনো?একটু আগে যে…..
-না মানে প্রশংসায় যে কেঁদে দেয় আমি ভাবছি উপহাসে সে হেসে ফেলবে!
-হাহাহাহা!আপনি না একটা…..
-কি?
-নিজেও জানিনা!
-হাহাহা!
-আচ্ছা আপনি আবিরকে লেসনটা দিয়ে দিন তারপর আমার আরো একটা অনুরোধ রাখতে হবে!এই আপনি রাগ করছেন না তো আপনাকে এতো জ্বালাই বলে?
-না না আমি রাগ করি নি।
আসলে আমার কাজ শুধু আবিরকে টিউশন পড়ানো হলেও ওদের ছোটখাটো অনুরোধ গুলো ফেলতে পারি না।ফ্যামিলি স্ট্যাটাস শুনার পর মনের অজান্তেই ওদের উপর খুব বেশি মায়া পড়ে গেছে হয়তো!
আবিরের পড়া শেষে!
-একটা অনুরোধ ছিলো!
-হুম বলেন!
-আমি অনেকদিন হয়েছে চাঁদ-তারা দেখতে ছাদে যাই না।চলেন আমরা ছাদে যাই!
-ধুর দিনে কি চাঁদ-তারা একত্রে দেখা যায় নাকি?
-আমি এটা আবার কখন বললাম?
-না এইযে বললেন অনেকদিন হলো!
-আপনিও না!আমি এটা অনেক সময়ের পার্থক্য অর্থে বুঝিয়েছি।
-হুম বুঝেছি।আচ্ছা চলেন!
আমি,আবির ও নিশু ছাদে গেলাম!
-আপু দেখ দেখ আমাদের মা ওই বড় তারাটা হয়ে আকাশে চলে গেছে।
-না ভাই মা ওখানে যায় নি।
-না আমি জানি বাবা বলেছে!
-আচ্ছা থাক ও যেটা ভাবে সেটাই বলতে দিন।ছোট মানুষতো!বুঝতে পারার সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে!
-হুম।
-আচ্ছা আপনি এতো বড় বাড়িতে একা একটা বলতে গেলে একা থাকেন!আপনার ভয় করে না?
-প্রথম প্রথম করতো এখন মানিয়ে নিয়েছি!
-আচ্ছা আপনি একা না থেকে আপনার তো ফুফু আছে তাকে আপনাদের বাসায় নিয়ে আসতে পারেন!
-ফুফু বলেছিলো কিন্তু উনি নিজের ফ্যামিলিকে ছেড়ে আসতে চান না!
-তাহলে আপনি ফুফুর বাসায় চলে যেতে পারতেন?
-কি করে যাই?যে বাবা আমাদের জন্য সারা দিন ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আমাদের জন্য এই বাড়ি-গাড়ি আমাদের সুখের জন্য একে একে গড়েছেন সেইসব ফেলে আমি কোথায় যাবো!আর আমি পারবো না বাবাকে কষ্ট দিয়ে বাবার দেওয়া এই আবাস ছেড়ে কোথাও যেতে!
-আচ্ছা আপনি নানুর বাড়ী যান না?
-নাহ!মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি আর তাদের বাড়ী যাই না,তারাও কোনোদিন নিজে থেকে খোজ নেয় নি।মাঝে মাঝে আবির নানুর বাড়ী যেতে চাইলেও আমি বলি আমাদের নানুর বাড়ী নেই।আসলে কি সত্যিটা একদিন জানলে আবিরও হয়তো ভুলে যাবে তার মায়ের ঠিকানা বা নানুর বাড়ী বলে কিছু আছে।
-হুম।এবার আমায় যেতে হবে,মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।
-কিভাবে বুঝলেন?
-এই যে এতো তারাভরা আকাশটায় বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে এলো আর দেখছেন না চারিদিকে মৃদু হাওয়া বইছে?
-ওহ হুম।তাহলে আপনি আমাদের বাসায় থেকে যান আজ কারণ যদি পথে আপনাকে বৃষ্টিতে পায়!
-না আমি তার আগেই পৌঁছে যেতে পারবো!আর এমনিতে আমার উপর এতো বিশ্বাস আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।জানেন তো এগুলা থেকেই ভালোবাসার সৃষ্টি?
-সেটা হয়তো বেসেই ফেলেছি।
-মানে?
-কিছু না।আপনাকে আজ আমাদের বাসায় থাকতে হবে।
-কোন বিশ্বাসে রাখবেন?আমি যে অন্য পাঁচটা ছেলের মতোই যে আপনার একাকীত্বের সুযোগ নিবো না তা কি করে বিশ্বাস করেন?
-সরলতার বিশ্বাসে।আপনি যদি সেরকম হতেন তাহলে আগেই পারতেন সুযোগ নিতে!কিন্তু নেন নি।আপনার চোখে মুখে আমি সরলতা দেখতে পাই।সত্যিই আপনি অসাধারন ব্যক্তিত্বের অধিকারী!
-হয়তো হবে।কারন ভালোবাসাটা প্রথমে মা শিখিয়েছে বলেই কারো সরলতার বা বিশ্বাসকে ব্যবহার করতে পারি না।
-আপনার মাকে আমার পক্ষ হতে সালাম দিয়েন!
-আচ্ছা।
নিশুর অনুরোধে রাতে ওদের বাসায় থাকলাম।ওদের পাশের রুমেই।
-এই যে মি. সকাল হয়েছে আপনি উঠবেন না?
-হুম।উঠছি!
-এই নিন আপনার চা।
-ধন্যবাদ।
-কাছের (নিজের) মানুষগুলোকে ধন্যবাদ দিতে নেই।
-অদ্ভুত!আমি আবার এতো কাছের হলাম কখন?
-হুম আমারই হয়তো ভুল হয়েছে।আপনিতো আমাদের কাছের মানুষ না!জানেন আমি এতোটাই বেশি সহজ সরল যে আমি সহজেই বাবার মতো মানুষকে আপন করে নেই এই জন্যই হয়তো মা আমাদের পর করে চলে গেছে!
-না!মানে আমি ওইভাবে বুঝাইনি।আপনি কি আমাকে ওরকম স্বার্থপর মনে করছেন?তাহলে একদম ভুল ভাবছেন।
-সত্যিই?আপনি আমাদের ছেড়ে কখনো কোথাও যাবেন না তো?
-নারে পাগলি!
-কোনো প্রুফ আছে যে ছেড়ে যাবেন না?কথা দেন ছেড়ে যাবেন না!
-আরে পাগলি মেয়ে আমার ভালোবাসাটাই তো প্রুফ!
-তাহলে সত্যি ভালোবাসেন?
-হুম আপনাদের উপরে পড়া মায়াটার জন্য!
-ও মায়া থেকে ভালোবাসেন?ভালোবাসা থেকে না?যাই হোক একরকমে ভালো বাসলেই হলো!আর আপনি যাওয়ার সময় আবিরকে ওর স্কুলে ছেড়ে দিয়েন!
-আচ্ছা।ঠিকাছে।
-আজ বৃঃস্পতি বার আজ সন্ধ্যায় বাবা আসবে,আজ কিন্তু একটু তারাতারি আসবেন।গত মাসে বাবা দেশের বাহিরে ছিলো বলে আসতে পারে নি।দেশে থাকলে প্রতি সপ্তাহের এই দিনে আসে আর শনিবারে সকালে চলে যায়।
-আচ্ছা ঠিকাছে।
সন্ধ্যাবেলায় আসলাম,কলিংবেল বাজাতেই আজ দরজা খুলে দিলো মধ্যবয়সী একজন পুরুষ।বুঝলাম এ ভদ্রলোকই নিশুর বাবা!
-আসসালামু আলাইকুম!
-ওয়া আলাইকুম আসসালাম!তুমি নিশ্চই হাসিব?
-হুম।
-তো ভালো আছো?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ।আপনি?
-আমি আর ভালো এই ছেলেমেয়ে দুটোর চিন্তায় কি আর ভালো থাকা যায়!কিন্তু ওদের মুখে তোমার প্রশংসা শুনে ভালো লাগলো।
-প্রশংসা করার কারণ ছিলো না ওরা একা একা থাকে বলে ওদের একটু সমান্য সময়ের সঙ্গী হই।
-জীবনের সঙ্গী হতে পারবে?
-মানে?
-আচ্ছা আগে বলো স্টাডি কেমন চলছে?
-ভালোই।
-পরিবারে কে কে আছে?
-মা-বাবা আর আমি।
-হুম আমি নিশুর থেকে শুনেছি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।কিন্তু সমস্যা নেই চলবে।তুমি আবার সব ধনী বাবাদের একরকম ভেবো না!আমি যেটা পারিনি তুমি আমার মেয়েকে সেটাই দিবে!আর হ্যাঁ সেটা হলো তোমার ভালোবাসা।আমিতো ওদের সুখের জন্য অর্থের পিছুই ছুটেছি!ভালোবাসাটা তুমিই দিও কেমন?আমি শুনেছি তুমি নিশুকে আর নিশু তোমাকে ভালোবাসে!কি পারবে না আমার পাগলী মেয়েটাকে সারাজীবন এরকম ভালোবাসতে?
নিশুর দিকে তাকালাম!ওমাগো এই তাকানোর মানে কি!ওমন ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে ওর বাবার কথায় এখন সাই না দিলে পরে আমাকে চিবিয়ে খাবে!কিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ‘হ্যাঁ পারবো খুব পারবো!’ বলেছি ভয়ে নাকি অন্যকিছুর কারণে তা জানি না কিন্তু বলে দিয়েছি!
-যাক শান্তি পেলাম!আর হ্যাঁ প্রতি শুক্রবারে আমি ওদের নিয়ে একটা দিন বাড়িতেই স্পেন্ড করি।কিন্তু কাল আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো।অনেকদিন পর তোমার জন্য এই বাড়ীতে হাসি-খুশি ফিরে আসবে।শুধু আমার মেয়েটাকে কখনো কাঁদাইও না বাবা!
-আচ্ছা ঠিকাছে আংকেল!
-আংকেল!কেনো বাবা বলতে কোনো আর্জি আছে নাকি?নিশুর বাবাতো সম্পর্কে তোমারও বাবা!
-হুম।
পরেরদিন শুক্রবারে।গাড়ির পিছনে আমি আর নিশু আর সামনে আবির ও নিশুর বাবা।উনিই ড্রাইভ করছেন আজ।
-আচ্ছা আমি কি আপনাকে ভালোবাসি?
-হুম।বাসেন তো।
-ইস…শখ কতো!
-অনেকগুলা।
-আপনি কি জোড় করে ভালোবাসা নিবেন নাকি?
-হুম।বাবা বলেছে নিজের অধিকার না পেলে ছিনিয়ে বা জোড় করেই নিতে হয়!
-এহহ,আমি আবার আপনার অধিকার হলাম কখন?
-যখন থেকে আমি আপনাকে ভালোবেসেছি!
-কখন থেকে?
-সেটাতো জানি না!আপনি বাসেন না?না বাসলে কিন্তু বাবাকে বলে গুলি করে দিবো!
-বাসি,বাসি,ভালোবাসি!পাগলি একটা!
-ভয়ে নাকি মায়া থেকে?
-ভালোবাসা থেকে ভালোবাসি।
-কিরে তোরা কিসের এতো গুজুরগুজুর করছিস?
-কিছুনা বাবা তোমার থেকে যেটা আদায় করতে পারি নি সেটা এই হাসিব্বা থুক্কু হবু স্বামীর থেকে আদায় করছি।
-কি আদায় করছিস?
-কেনো,এতোগুলা ভালোবাসা!
-পাগলি মেয়ে একটা!
তারপর আজ আবার গেলাম লেকের পাড়!যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই।
-আবির চলো আমরা আইসক্রিম খেয়ে আসি।
-কিন্তু আপু আর স্যার?
-ওরা এখানেই অপেক্ষা করুক আমরা ওদের জন্য নিয়ে আসবো আর হ্যাঁ এখন থেকে স্যার না ও তোমার নতুন ভাইয়া।ভাইয়া বলেই ডাকবে।ঠিকাছে?
-আচ্ছা!
বুঝলাম উনি কেনো আবিরকে সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে।
-আচ্ছা পাগলি তাহলে!
-তাহলে আবার কি?(আমার কাঁধে মাথা রেখে) ভালোবাসি এটাই কথা!
-হুম আমিও!
-কি?
-ভালোবাসি!
-মায়া থেকেই?
-সত্যিই ভালোবাসার থেকে ভালোবাসি,মন থেকে ভালোবাসি,হৃদয় থেকে ভালোবাসি!
-সত্যিই?
-হুম।
অতঃপর পাগলিটা লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকালো!