ক্যাম্পাস থেকে বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, পুরো রুম জুড়ে বডি স্প্রের গন্ধ ম ম করছে।। নিশ্চিত ছোট বোন ইনতুর কাজ।। আমার নতুন কেনা বডি স্প্রের স্মেল নাকি ওর বেশি ভাল্লাগে অথচ ইনতুর বডি স্প্রের সংখ্যা আমার চেয়ে বেশি।। আমি রুম থেকেই চিল্লান দিয়ে ইনতুকে ডাকলাম, উল্টা আম্মু রান্নাঘর থেকে ধমক দিয়ে বললো- চিল্লাস ক্যান, ইনতু একটু আগে কলেজে গেছে।। আমি বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি, কখন বোন বাসায় আসবে আমি একগাদা বকা দিব।।
রুমের দরজা লক করে, নিশিকে কল দিলাম। নিশির মন খারাপ সে ফেসবুক নিয়ে কি যেন একটা ঝামেলায় পড়েছে।। তার ফেসবুকে অনেক অপরিচিত লোক অটো অ্যাড হয়ে গেছে।। সে সাধারনত কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় না।। কিন্তু ইদানিং মাঝে মাঝে নোটিফিকেশন পায় অমুক এক্সেপ্ট ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।। অথচ সে বলে আমি তাদেরকে চিনিই না, রিকোয়েস্ট পাঠাবে তো দূরের কথা। আমি ভাবতে বসলাম, এর আগেও অনেকের কাছে এই সমস্যার কথা শুনেছি।। নিশিকে বললাম ফেসবুকের আইডি আর পাসওয়ার্ডটা দাও দেখি, কি সমস্যা হয়েছে।। নিশি মুচকি হেসে বলে- দরকার নেই, তোমরা ছেলেরা কেন যে মেয়েদের কাছে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড চাও।। আমি লজ্জা পেয়ে আর কথা বাড়ালাম না, ফোন রেখে দিয়ে গোসলে ঢুকলাম।।
বিকেলে ছোট বোন ইনতুকে রুমে ডাকলাম।। সে এমন ভাব নিয়ে আমার সামনে আসলো যেনো সে কিছুই জানে না। ইনতু বিছানায় আমার গা ঘেষে বসে বলে- কি হইছে ডাকলা কেন?
আমি সোজা বললাম- অই, তর বডিস্প্রে নাই।। আমারডা মাইরা শেষ করোস কেন?
ইনতু মুখ ভেঙচিয়ে বলে- আমার কাছে তুমারটাই ভাল্লাগে, আসো ভাইয়া আমরা বদলাবদলি করি।। আমার একটা তোমারে দিমু, আর তোমার এইটা আমার।।
আমি মৃদ্যু ধমক দিয়ে বললাম- গাধী আমারটা ছেলেগো বডি স্প্রে, আর তোর তো সব লেডিস।। কথা শুনলে মনয় তোরে পিটাই।।
ইনতু এবার ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানের সুরে বলে- জানি তো, আমাকে কেউ আদর করে না।। খালি মাইর দিতেই চায়।। আচ্ছা আর জীবনে আমি তোমার বডি স্প্রে ধরুম না, গেলাম গা।
বলে ইনতু গা ঝাড়া দিয়ে আমার বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলো।। আমি বোনের ভাব ধরে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নিশির সাথে বসে, ওর ফেসবুক ঘাটছি।। রাতেই নেট থেকে এই সমস্যার কারণ খুঁজে পেয়েছি।। নিশিকে বললাম- এই যে সারাদিন ফেসবুকে এপ দিয়ে ফান করো, আপনি কবে বিয়ে করবেন, কবে মরবেন, কবে হাত-পা ভাঙবে, আপনার নাকের ফুটা কয়টা, আপনার ঠোঁট কালা কেন।। এইজন্যেই এমন হয় ফেসবুকে।।
নিশি আমার পাশে বসে হাসে, আর বলে- ধুর ফাও প্যাচাল বাদ দাও, এইসব এপ দিয়ে তো সবাই খেলে, মজাই লাগে।।
আমি এবার চটে গিয়ে বললাম- না সবাই খেলে না, কই আমি তো খেলি না।।
নিশি এবার আমার হাতে আলতো টোকা দিয়ে বলে- মিথ্যা বলো কেন, ক’দিন আগেও না একটা শেয়ার দিলা।। কি যেনো ২০১৯ সালে কি হবে এমন কিছু।।
আমি এবার চুপ মেরে গেলাম, ঘটনা সত্য।। আমি এগুলো খেলি না, কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ শখ হলে খেলি।।
আমি এবার চুপসে যাওয়া কন্ঠে একনাগাড়ে বলে গেলাম- দেখো এই এপগুলো ফেসবুক নিজে প্রোভাইড করে না।। এগুলো থার্ড পার্টি এপ, এইসব এপে কিছু করার আগেই এরা একটা পারমিশন চায় আর ফেসবুকের সাথে লিংক করে।। সেই পারমিশনেই থাকে তারা চাইলে তোমার সব ম্যাসেজ ঘাঁটতে পারবে, তোমার হয়ে নতুন কাউকে রিকোয়েস্ট দিতে পারবে, ফ্রেন্ড ডিলিট করে দিতে পারবে, তোমার ছবি নামাতে পারবে আরো অনেক কিছু, আর ভয়ানক খবর হচ্ছে- সব হবে তোমার অজান্তে।। এই এপগুলো নিয়ে খেলা শুধুই নিছক মজা, এক দুইদিন পরেই ভুলে যাবা কিন্তু এরা স্পাই হিসেবে আজীবন তোমার আইডিতে থাকবে।। ক্ষতি যে কইবেই এমন না, ওদের যা দরকার হবে ততটুকু করবে।। চাইলে তোমার আমার ইনবক্সও দেখে ফেলতে পারে।। মাঝে মাঝে খবর পাও না, তারকাদের গোপন ছবি ফাঁস, আইডি হ্যাক- এগুলো এভাবেও হয়।। আর শুনো, আমি খেলছি ভুল হইছে কিন্তু সমাধান করে ফেলেছি।।
নিশি ভয়ার্ত গলায় কেঁপে কেঁপে বললো- কি সমাধান গো রায়হান, পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছো তাই না?
আমি নিশির হাতে হাত রেখে অভয় দিয়ে বললাম- না রে, পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে লাভ নাই।। সেটিংস থেকে এপের লিস্টে গিয়ে রিমুভ দিয়ে দিয়েছি সবগুলা এপ।। আর শুনো, খুব খেলতে মন চাইলে খেলে একটু পরেই সেটিংস থেকে ওদের এপ ডিলিট দিবা।। তাহলে আর এক্সেস পাবে না।। তবে, এইসব আজাইরা খেলে আইডি ঝুঁকিতে ফেলার কোন মানেই হয় না।।
নিশি ওর মাথা আমার কাঁধে রেখে বললো- আমার রায়হান কত কি জানে?
মোবাইটা আমার হাতে দিয়ে নিশি আবার বললো- নাও, কি করার করো।। ফেসবুক নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি।
দোকান থেকে আমার আগের কেনা বডিস্প্রে হুবহু আরেক পিস কিনে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ঢুকলাম।। আজ ইনতুকে চমকে দিবো।।
বাসায় ঢুকে দেখি ইনতুর মন খারাপ।। চোখ মুখ ফুলে আছে, কেমন উম্মাদের মত লাগছে ইনতুকে।। আমি বার কয়েক জিজ্ঞেস করলাম, কোন জবাব দিলো না।। আম্মুও বললো- যা নিজের রুমে যা, ওর শরীর খারাপ।।
আমি কিছুটা হতবাক, নিজের রুমে এলাম।। এমন তো হবার কথা না।। শরীর খারাপ হলে ইনতু আমাকে বলতো।। আর এই মেয়ে কথাই বলছে না, নিশ্চয় অন্য কোন ব্যাপার।। আমি ব্যাগ থেকে বডিস্প্রে বের করে আগেরটার পাশে রাখলাম।। কিছুই ভাল্লাগছে না!!
ল্যাপটপ অন করে ফেসবুকে ঢুকলাম, আদারস বক্সে একটা নিউ ম্যাসেজ আছে।। কৌতুহল নিয়ে সেখানেই আগে ঢুকলাম।। বুকের মধ্যে ভীষণ ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো আমার, অই ইনবক্সে ইনতুর কিছু স্পর্শকাতর সেলফি।। খুব যে উম্মুক্ত টাইপ কিছু তা না, সম্ভবত বাথরুমে গোসলের আগ দিয়ে মজা করে তোলা।। গায়ে টাওয়েল জড়ানো সেলফি, সিনেমাতে এমন দৃশ্য হারহামেশাই দেখা যায়।। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের একটা মেয়ের এমন ছবি প্রকাশও বিশাল হুমকি।। ছবির নিচে আবার লেখা, ২০ হাজার টাকা দিলে এই ছবি ডিলিট হবে, নইলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যাবে।। আমার মাথা কাজ করছে না, এই ছবির সাথে ইনতুর মন খারাপের যোগসূত্র আছে নিশ্চয়।। ওর আইডিতেও এটা সম্ভবত পাঠিয়েছে।। কিন্তু, এ বিষয়ে বোনকে বা আম্মুকে কিভাবে জিজ্ঞেস করবো।। আমার গা গরম হয়ে যাচ্ছে, মনে হবে জ্বর আসবে, বমি বমি লাগছে।। নিজের বোনের এমন পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিত মাথায় ধরছে না।। কে করতে পারে এমন কাজ, আমার জানা মতে ইনতুর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই এবং নিজের বোন দেখে বলছি না- ও খুব ভালো মেয়ে, এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে উঠলো মাত্র।। সবথেকে বড় কথা, ওর কোন স্মার্ট ফোন নেই।। আর ছবিগুলো আমাদের বাথরুমেই তোলা সেলফি।। ইনতুর ফেসবুক আইডি ল্যাপটপে লগিন করাই থাকে, একবার ভাবলাম চেক দেই।। আবার অন্যমন সায় দিলো না।
ক’দিন বাদে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলো।। কিন্তু ইনতু আমার সামনে আসতে লজ্জা পায়, সচারাচর সামনে আসে না। আমি কয়েকবার আম্মুকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছি- এই ব্যাপারগুলো কিভাবে হলো।। মেয়েটা বিব্রত হয়ে, লজ্জা পেয়ে কিছুই জবাব দেয় নি।। নিজের আপন বোন, তাই আর বেশি ঘাঁটি নাই।। কিন্তু, আমার মাথা থেকে ব্যাপারটা আর যায় না।। যাই করি না কেনো, মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে অই ব্যাপারটা চলেই আসে।। যে আইডি থেকে ইনতুর ছবিগুলো পাঠানো হয়েছে, সেই আইডির কোন আগামাথা পেলাম না।
নিশি আজ বিকেলে আমাকে একটা পেনড্রাইভ ধরিয়ে দিয়েছে, বলেছে বাসায় গিয়ে দেখে নিও।। ভিতরে চমক আছে তোমার জন্যে।। আমি কতবার প্রশ্ন করলাম- মানে কি? হঠাৎ পেনড্রাইভ কেনো? সে বলে- বাসায় গিয়েই দেইখো।। আমি একটু অবাক, কদিন আগে নিশিকে আমার ৩২ জিবি মেমোরিকার্ড দিছিলাম কয়েকটা মুভি ভরে দেয়ার জন্যে।। তখন ওকে পেনড্রাইভের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।। বললো আমার কোন পেনড্রাইভ নেই রায়হান, তোমার মেমোরি কার্ড দেও মুভি ভরে দিবো নে।। আর আজ কই থেকে প্রয়োজন ছাড়াই পেনড্রাইভ দিয়ে বলছে, চমক আছে।।
বাসায় এসে পেনড্রাইভ কানেক্ট করে আমার মাথায় হাত।। ইনতুর আরো কয়েকটা স্পর্শকাতর সেলফি, আমার কিছু বাজে ছবি যেগুলো তুলেই ডিলিট করে দিয়েছি সেসব দিয়ে পেনড্রাইভ ভর্তি।। নিশির কাছে এগুলো কিভাবে গেলো কি অদ্ভুত!! আমি রীতিমত দিশেহারা হয়ে নিশিকে কল দিলাম।
নিশি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কূটিল হাসি দিয়ে বললো- ওহে বোকা রায়হান, তুমি একজন এক্সপার্ট সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেটরকে ফেসবুক শেখাও।। নিজেকে খুব চালাক ভাবো তাই না।।
আমি অবাক হয়ে বললাম- এসব কি নিশি? আর তুমি সাইবার ক্রাইমের লোক হলে আমাকেই কেন আক্রমণ করছো।। আর এসব ছবি তুমিই বা কিভাবে পেলে?
নিশি এবার শীতল গলায় বলে- ডাটা রিকভারি বুঝো? আমি তোমার মেমোরি কার্ড নিয়ে ডাটা রিকভারি করেছি।। যা যা ডিলিট করছো, তার প্রায় ৮০ ভাগ ফেরত পাওয়া সম্ভব।৷ এও দেখলাম, তোমার বোন হয়তো তোমার ফোন নিয়ে এমনি বাথরুমে কিছু ছবি তুলে ডিলিট করে দিয়েছে।। কিন্তু, বাস্তবে মেমোরি থেকে কিছুই চিরতরে মুছে দেয়া যায় না।। এগুলো চাইলেই আবার ফেরত আনা যায়।। আমি তোমাকে চালাক ভাবতাম, কিন্তু এত সহজে আমার জালে ধরা দিবা ভাবি নাই।।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম- মানে কি, আমার সাথে এমন করার মানে কি? শুধু টাকার জন্যে এমন করলা নাকি?
নিশি ধমক দিয়ে বলে- চুপ থাক, ছোটলোক।। তোর টাকা কে নিবে, আর হ্যাঁ তোর বোনের ছবি দিয়ে আমি কিছুই করতাম না।। এটা শুধু তোকে উপলব্দি দেয়া, যে দেখ আপন লোকের এমন হলে কেমন লাগে।। বার বার মেয়েরাই কেনো এটার স্বীকার হবে।।
নিশির কথায় আমার খটকা লাগলো, জিজ্ঞেস করলাম- একটু ক্লিয়ার করবা প্লিজ, আর তুই তুকারি কইরো না।।
নিশি ডাইনির মত হেসে বলে- ন্যাকা সাজিস কেন? শুন, তুই আমাকে বিশ হাজার টাকা দিবি সাথে আর একটা কাজ করবি।৷ মুনিয়ার যতগুলো স্পর্শকাতর ছবি তোর ল্যাপটপে রেখেছিস সব মুছে দিবি৷। মুনিয়ার কাছ থেকে তুই রিলেশন চলাকালীন প্রায় পনের হাজার টাকা নিয়েছিস, আর পাঁচ হাজার টাকা আমার কেস ফিস।। আর, অন্যাথায় কি হবে বুঝে নে।।
আমি ভেবে হিসাব মিলালাম, মুনিয়া আমার এক্স জিএফ। মাঝে মাঝে ওর বাজে ছবি আছে বলে ওকে ব্লাকমেইল করতাম, আর আজ এভাবে নিজের পরিবার নিয়ে টানাটানি পড়ছে। এদিকে নিশির সাথে মাত্র ২০-২৫ দিনের পরিচয় সাথে রিলেশন। অথচ এগুলো সব নিশির পূর্বপরিকল্পনা। কিন্তু, মেয়েটাকে আমি অল্পদিনে ভালোবেসে ফেলেছি যে।
নিশিকে বললাম- আচ্ছা, যা হবার হয়েছে সব করবো, টাকাও দিবো কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা থাকুক নিশি।
নিশি অট্টহাসি দিয়ে বললো- নিশি! কে নিশি? এটা শুধুই আমার একটা ছন্মনাম, তুই আমার ২৩ নাম্বার টার্গেট মাত্র।। এমন কত রায়হানকে শিক্ষা দিলাম। টাকাটা দ্রুত দিস, আর মুনিয়ার ছবি নিয়ে কি করবি নিজেই ভাবিস।নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে ভালো হয় যা রায়হান, আর কি শিক্ষা পেলি সবাইকে জানিয়ে দিস। তোরে দিয়েও যে কারো অল্প বিস্তর উপকার হতে পারে, ভুলে যাইস না!