এক মুঠো অপেক্ষা

এক মুঠো অপেক্ষা

জাইফের অপেক্ষায় বসে আছি সকাল থেকে। আজ প্রায় তিন মাস পর ওর সাথে দেখা হবে। বান্দরবন হিল ট্র‍্যাকে ছিল ও এই তিনমাস। আমাদের সেই প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে আছি। এলোকেশে সবুজ শাড়ি সাথে দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি,চোখে হালকা কাজল। ঠিক যেভাবে জাইফের পছন্দ।

ফুচকার দোকানের ছেলেটা দেখেই বুঝে ফেললো। এক গাল হেসে নিয়ে বললো,
– জাইফ ভাইয়া আসছেন, তাই তো বৃষ্টি আপু?
আমিও হাসি মুখে বললাম,
– হ্যা তাই।
এবার তার আবদার মাখা অনুযোগ,
– তবে কিন্তু আমার দোকানে আজ আবার কম্পিটিশন হবে দুজনের। আগের বার তো জিতে গিয়েছিলেন। এবার কিন্তু জাইফ ভাইয়াই জিতবে।
– সেটা যে কখনো হবে না তুমি তা ভালো করেই জানো সবুজ। তোমরা কি ভাব আমি বুঝি তোমাদের কারসাজি বুঝতে পারি না। তোমরা দুজনে মিলে যে কারসাজি করে আমায় জিতিয়ে দাও সেটা কি আমি জানি না মনে করেছো!
– ইশশ! কি করে বুঝলেন বলুন তো।
– সবটা যদি বলেই দেই তবে কিভাবে হবে বলো তো!
– হ্যা সেটাও ঠিক।

এরই মধ্যে ডাক পড়লো সবুজের। ও ছুটে গেল দোকানে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। এখনো জাইফ এলো না। দুপুরের রোদ এসে পড়ছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁক গলে। সবুজ বার কয়েক বার ইশারায় জানতে চাইলো, বেলা তো অনেক হলো জাইফ এখনো কেন আসছে না। আমিও বোঝালাম ইশারায়, প্রায় এসে পড়লো বলে। দুপুর গড়াতে লাগলো। এবার আমারও চিন্তা বাড়তে লাগলো। ওকে যে ফোন করে খোঁজ নেব সে উপায়ও নেই। ক্যাম্পে মোবাইল নিষিদ্ধ বলে সাথে নেয় নি ও। সপ্তাহে দু একবার যে কথা হতো ফোনে সেটা ছিল ক্যাম্পের সকলের ব্যবহারের জন্য। সবাই মিলে লাইন ধরে ফোনে কথা বলতে হতো। একজনের পর একজন। একজন অপারেটর সবসময় সামনে থাকত।

একদমই ভালো লাগছে না। ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করলাম। কিছুটা সময় তো অন্তত কাটবে এতে।

তোর ঠোঁটের রঙ দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে
সে খবর কি তোর আছে!
তোর নিঃশ্বাসে ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধে
আমার দম আটকে আসে।

তোর চোখের রং ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে
কালচে রং হচ্ছে ঘোলাটে,
তোর স্মৃতি হচ্ছে ঝাপসা
ভুলে যাচ্ছিস ভালো থাকা।

খেলতে শিখে গেছিস আগুন নিয়ে
বড্ড ভয় হয় তোকে নিয়ে
না জানি কখন সে আগুন দেয় পুড়িয়ে
ছারখার হয়ে বাতাসে দগ্ধ নিঃশ্বাসের ছাঁই উড়িয়ে।

মেতে উঠেছিস মরণ নেশায়
হারাচ্ছিস সময় মরীচিকায়
উড়ছে ধূলো পশ্চাতে
যাচ্ছিস ফেঁসে ভ্রমে।

হঠাৎই মনের মাঝে একটা শংকা উঁকি দিতে লাগলো। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো কাল রাতে দেখা দুঃস্বপ্নটা। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা।

বান্দরবন থেকে সাজেকের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এসকর্টে হঠাৎই আক্রমণ করে বসে সন্ত্রাসীরা। প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের পর আকস্মিক একটা গুলি জাইফের বুক ছিদ্র করে বের হয়ে গেছে। ওখানেই ছটফট করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করে জাইফ।

ওটা দেখার পর থেকে আর এক ফোটাও ঘুমুতে পারি নি সারারাত। সারারাত প্রার্থনা করে গেছি ওর সুস্থতার। শুধু ছটফট করেছি সকাল হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল এখনো ওর দেখা নেই। মনের মাঝে ভয় দানা বাঁধতে লাগলো।

সন্ধ্যার মিইয়ে যাওয়া আলোতে হঠাৎই ভেসে উঠল জাইফের মুখ। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ও। এক হাতে এক গুচ্ছ কদম অন্য হাত বুকের পাশে গলার সাথে ঝুলানো। আমার দুঃস্বপ্ন তবে সত্যিই সত্যি হতে চলেছিল। একটু রাগ রাগ ভাব নিয়ে তাকালাম ওর দিকে।

– এতক্ষণ কোথায় ছিলে শুনি?
– ফিরেছি তো সেই দুপুরে। কিন্তু এই গুচ্ছগুলো খুঁজে পেতেই যা দেরি হলো। একে তো এক হাত ব্যান্ডেজে মোড়ানো, কতজনকে কত অনুরোধ করে এটা এনেছি।
– হাতে কি হয়েছে?
– একটা ছোট অপারেশন ছিল। সামান্য গুলি লেগে ছড়ে গেছে। একদম ঘাবড়াবে না কেমন!

এদিকে সবুজ ব্যস্ত ফুচকা বানাতে। আর মাত্র কিছুক্ষণ। এরপরই শুরু হবে ফুচকা কম্পিটিশন।

এবার জাইফকে শুনিয়ে দিলাম লেখা কবিতাটা। কবিতাটা পড়ে ও শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো বিস্ময়ের দৃষ্টিতে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত