ভালবেসে গেলাম

ভালবেসে গেলাম

দুর্ভাগ্যবশত নাকি সৌভাগ্যবশত জানিনা আমি পাশের ফ্লাটের মেয়েটার কলেজেই চান্স পেয়ে গেলাম। শুধু কলেজে না, একই গ্রুপে একই ক্লাসে। মেয়েটার কলেজ বলতে, ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা নয়, ও যে কলেজে পড়ে ওই কলেজ। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে মেয়েটাকে কখনো দেখিনি। কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছি, রাস্তাঘাট সব নতুন, বন্ধুবান্ধব গুলোও নতুন। প্রতিদিন কলেজে গিয়ে যার সাথে বসতাম তাকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলতাম। এটা আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিলো।

ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া তো দূরে থাক, কলেজে ভর্তি হতে পারবো কি না সেই টেনশনেই মরে যাচ্ছিলাম। প্রথমবার অনলাইনে ভর্তির আবেদন করার পর শহরের নামকরা ভালো একটা কলেজ আসছিলো। প্রথমবার আবেদন করেছি তাই নিয়ম কানুন কিছু জানতাম না। কলেজ কনফার্ম করিনি। পরে যেদিন ভর্তি হতে গেছিলাম সেদিন আমার ভর্তি নেয়নি। আমি একদম হতাস হয়ে গেছিলাম। উনাদের থেকেই আবার জানতে পারলাম আরো একবার আবেদন করার চান্স আছে। তারপর আবেদন করার পর কাঙ্ক্ষিত কলেজে চান্স পেলাম। মানে ওই যে মেয়েটার কলেজ।

মেয়েটাকে প্রথমবার দেখেছি কলেজে যাওয়ার দ্বিতীয় দিন। ক্লাস শেষে একটা বন্ধুকে বিদায় দিয়ে অটোতে উঠার জন্য ভিতরে উঁকি দিতেই দেখলাম একটা মেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। স্কার্ফ দিয়ে মুখ বাধা, শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখে ঘোর লাগানোর মত কিছু একটা ছিলো। অন্য কোনো মেয়ের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেলি এই মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা করতে পারলাম না। নিজেকে কন্ট্রোল করে মেয়েটার পাশে না বসে অটো ড্রাইভার এর পাশের সিটে বসলাম। তখনো জানতাম না মেয়েটা আমি যে ফ্লাটে উঠেছি সেই ফ্লাটের পাশের ফ্লাটেই থাকে। অটো থেকে নেমে দেখলাম মেয়েটাও নেমে গেছে। মনে মনে খুশি হলাম, প্রতিদিন এই মেয়েটার সাথে এখান পর্যন্ত আসা যাবে। এই অভ্যাসটা স্কুল লাইফের। একটু সুন্দরী মেয়ে দেখলেই মনে ঘন্টা বেজে ওঠে।

অটো থেকে নেমে খেয়াল করলাম আমি যেদিকে যাচ্ছি মেয়েটাও সেদিকে যাচ্ছি। এবং শেষে আমি যে বিল্ডিং এ উঠতেছি দেখি আমার দেখাদেখি মেয়েটাও সেই বিল্ডিং এ উঠতেছে। উত্তেজনা কাজ করছিলো বেশি, কন্ট্রোল করতে না পেরে দাড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটা আমার সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে সোজা আমার পাশের ফ্লাটে গিয়ে ঢুকলো। আহ কি সতী নারী, আমার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। কতকাল ধরে এমন একটা নারীর খোজে ছিলাম!

পরেরদিন আর মেয়েটাকে দেখতে পাইনি। সম্ভবত কলেজে আসেনি। সারাদিন ভালোভাবে কাটলেও বিকেলে কেন জানি আর মন মানছিলো না। যেভাবেই হোক একবার দেখতেই হবে। রুম থেকে বেরিয়ে ওদের ফ্লাটের সামনে গিয়ে দেখলাম তালা মারা নেই। তার মানে ভিতরে কেউ অবশ্যই আছে। বেল টিপবো নাকি টিপবো না সেই টেনশন নিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম দুই মিনিট, সব টেনশন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বেল টিপ দিলাম। প্রায় বিশ সেকেন্ড পর কাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখতে পেলাম। মেয়েটাই এসে দরজা খুলেছে। চোখ দেখেই চিনে ফেলেছি। আমি ডাবল অবাক হলাম। মেয়েটার শুধু চোখ না, পুরো মুখটাই যেন আমাদের জীববিজ্ঞানের সেলিনা মেডামের মত সুন্দর। আগেরবার শুধু চোখ দেখেছিলাম এবার পুরো চেহারাটাই দেখে নিলাম। আমি কিছু বলছিনা দেখে মেয়েটা বলল, “কাকে চাই?” ঘরের ভিতর এদিক ওদিক উকি দিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে বললাম “তোমাকে”। মেয়েটার উৎসুক চেহারাটা মুহূর্তে কালো বর্ন ধারণ করলো। ভিতর থেকে একটা মহিলা বলে উঠলো “নেহা কে এসেছে?”। নাম তাহলে নেহা? চেহারার সাথে নামের যথেষ্ট মিল আছে। আমি মেয়েটার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে মাথা ডানে বামে দুলিয়ে বোঝালাম যেন আমার কথা না বলে, মেয়েটা বলল “ময়লা ওয়ালা ময়লা নিতে আসছে মা”। আমার চেহারাটা আরো করুন হয়ে গেলো। এটা কি বললো? দুনিয়াতে মিথ্যে কথার অভাব ছিলো নাকি? তারপর মেয়েটা ভিতরে গিয়ে একটা ময়লাভর্তি ঝুড়ি নিয়ে এসে আমাকে বলল “যান ফেলে দিয়ে আসেন”। আমি চেহারায় করুন ভাবটা ধরে রেখে বললাম “অন্য কিছু বলা যেত না?” নেহা দুষ্টুমি মাখা স্বরে বলল, “আম্মুকে বলবো একটু আগে আপনি আমাকে কি বলেছেন?” কি আর করা! জীবনে প্রথমবার এই কাজ করতেছি। এই সব কাজ করাও একটা আর্ট যা সবাই পারেনা। মনে মনে এটা বলেই নিজেকে সান্তনা দিতে দিতে ময়লা ফেলে দিয়ে আসলাম। রুমে এসে ভাবতে লাগলাম যে করেই হোক আগে নেহার মা কে পটাতে হবে। তারপর নাহয় “মেয়ে তোমাকে দেখে নিবো” মার্কা ডায়ালগ দেওয়া যাবে।

পরেরদিন ক্লাসে ঢুকেই একটু খুজতেই নেহাকে পেয়ে গেলাম। পুরো ক্লাসে একটা বারের জন্যেও আমার দিকে তাকালো না। আমার একটু মন খারাপ হলো। পরে ভাবলাম ও আমার দিকে তাকাবে কেন? কোনো কারনই তো নেই।
ছুটি হওয়ার পর কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় নেহার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কলেজের প্রায় সব পোলাপান চলে যাওয়ার পর দেখলাম নেহা আস্তে আস্তে একটা মেয়ের সাথে হেটে হেটে আসতেছে। মেয়েটা সেকেন্ড ইয়ারের। মানে বড় আপু! ওরা এসেই একটা অটোতে উঠে গেলো। আমার কি সৌভাগ্য ওই অটোতে অবশিষ্ট আর কোনো জায়গা ছিলোনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আফসোস করলাম।

সেদিনের মত ওর পিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম। এই কয়েকদিনে এটা ভালোভাবেই বুঝে নিলাম এই মেয়ের মন এত সহজে গলবে না। সারাদিন আর নেহাকে নিয়ে ভাবিনি। ফেসবুকিং বিকালে খেলা আর রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাইছি। একটা জিনিস কছুতেই মাথায় ঢুকতেছে না, দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে এই মেয়েকে নিয়েই কেন আমার এত ভাবতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর শত চেষ্টা করেও খুজে পাইনি।

পরেরদিন আবারো কলেজ ছুটির পর নেহার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবার আর কোনো বড় আপুর সাথে আসেনি। বড় ভাইয়ের সাথে আসতেছে দেখলাম। মুহূর্তেই আমার রাগ উঠে গেলো। কিছু একটা করতে গিয়েও থমকে গেলাম, আমার তো কোনো অধিকারই নেই। বড় ভাইটা নেহাকে একটা অটোতে উঠিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমিও দেরি না করে সেই অটোতে উঠে গেলাম। অটো থেকে নেমে দেখলাম সেদিনের মতই আমার পিছু পিছু আসতেছে। বাসার কাছাকাছি আসার পিছু ফিরে পর সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম “ছেলেটা আপনার কি হয়?”। নেহা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “কোন ছেলে?” আমার রাগ যেন আরো বেড়ে গেলো। মেয়ে জাতিই এমন। জেনেও না জানার ভান করবে! আমি আর কিছু না জিজ্ঞেস করে আবার হাটা ধরলাম। রুমে এসে ছোট বোনের সাথে কারন ছাড়াই চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। রাগ কমেছে ঘুমানোর পর। আজকাল যেন কিছুই ভালো লাগেনা!

পরের দুইদিন আর নেহার জন্য কলেজ শেষে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করিনি। তিন দিনের দিন কলেজ শেষে রাস্তায় কয়েকটা বন্ধু মিলে খেলা নিয়ে তর্ক করছিলাম। তখন দেখলাম নেহা কোনো বড় ভাই বা বোনের সাথে না, একাই আসতেছে। পিছনে সেলিনা মেডাম ছিলো, আমি খেয়াল করিনি। নেহা রাস্তায় এসে একটা অটো থামালো। অটোতে উঠার সময় আমার চোখে চোখ পড়তেই আমার কি হলো জানিনা চোখ মেরে দিলাম। ততক্ষণে নেহা অটোর ভিতরে ঢুকে গেছে। বাইরে সেলিনা মেডাম আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বোঝার আগেই আমি এটা বুঝলাম আমাকে এখন দৌড়াতে হবে। সেদিন কোনোরকম মেডামের হাত থেকে পালাতে পেরেছিলাম।

বিকেলবেলা খেলা শেষে বাসায় এসে কলিংবেল টিপে দরজা খোলার অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি নেহা দরজা খুলেছে। মুড ওয়ালি আমাদের বাসায় কি করে? কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। দেখলাম মুচকি হেসে আম্মুর কাছে গিয়ে আম্মুর সাথে আড্ডা মারতেছে। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে দেখি মুড ওয়ালি চলে গেছে। আমি আর বেশি কিছু ভাবলাম না। এমনিতেই এই মেয়েকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

রাতে শুয়ে শুয়ে নিউজফিডে ঘুরাঘুরি করছিলাম। এমন সময় দেখলাম আমার নাম্বারে একটা মেসেজ এসেছে। সাধারণত অফার ছাড়া অন্য কোনো মেসেজ আসেনা। মেসেজ ওপেন করে দেখলাম একটা আননোন নাম্বার থেক লিখেছে “মেডাম কে সম্মান করা উচিৎ, চোখ মারছেন যে গুনাহ হবে আপনার” আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এটা ভাবওয়ালীর মেসেজ। নাম্বার পাইছে কোথায়? পরে মনে পড়লো বিকেলে আমাদের ফ্লাটে আসছিলো। হয়তো কোথাও নাম্বার লেখা ছিলো অথবা আম্মুর থেকে নিয়েছে। যাকগে আমার কি!

খুব বেশি প্রয়োজন না হলে রিচার্জ করিনা। ফোনে টাকা ছিলোনা তাই তাড়াতাড়ি নিচে থেকে রিচার্জ করে আসলাম। তারপর রুমে এসে রিপ্লে দিলাম “আপনি জানেন কিভাবে আমি মেডাম কে চোখ মারছি?” প্রায় সাথে সাথে রিপ্লে আসলো “মেয়েদের চোখ তিনটা থাকে”। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মোবাইল বালিশের পাশে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখে ঘুম প্রায় চলে এসেছে এমন সময় মোবাইলটা আবার ভাইব্রেট হলো। মেসেজ ওপেন করতেই দেখলাম লেখা “ছেলেটা আমার দূরসম্পর্কের ভাই হয়”। জানিনা এই মেসেজটার ভিতর কি আছে। তবে এতটুকু বুঝতে পারছিলাম এই রাতে আর ঘুম আসবেনা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত