মাঝরাতে অন্তীর ঘুম ভেঙে গেল। পাশে হাত দিয়ে বুঝতে পারল অনিক নেই। খালি গায়ে কম্বল জড়িয়ে উঠে বসল অন্তী। ড্রিম লাইটের আলোতে দেখতে সমস্যা হচ্ছে তার। অন্তী চোখে কম দেখে একটু। একটু সময় নিয়ে লাইট জ্বালালো। অনিক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে ধোয়া বেত হয়ে যাচ্ছে। অন্তীকে দেখতে পেয়ে অনিক তারাতারি করে সিগারেট লুকিয়ে ফেলল। অনিক স্বাভাবিক ভাবেই বলল, খারাপ স্বপ্ন দেখেছ কোন?
অন্তী ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, না।
তাহলে এভাবে উঠে পড়লে যে?
সিগারেট খাচ্ছিলা,তাই না?
না আসলে। একটু..
অনিক,তোমাকে তো আমি মানা করিনি খেতে। পরিমাণমত খেতে বলেছি। জানি ছাড়তে পারবেনা। লুকানোর কি আছে তাহলে?
আর লুকাবোনা।
শুতে আসো।
আমাকে না পেয়ে ঘুম ভেঙে গেছে নাকি?
হু
অনিক সিগারেট ফেলে দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল। তার মুখ দিয়ে এখনো সিগারেটের গন্ধ আসছে। অন্তী অনিকের গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘরের লাইট বন্ধ। পাশের ঘর থেকে খটখট শব্দ আসছে। অনিকের বাবার লেখালেখির শখ আছে। তিনি টাইপরাইটারে লেখা শুরু করেছিলেন। তখন এর থেকে ভালো কিছু ছিল না লেখার জন্য। এতোদিনের সঙ্গীকে কোনভাবেই ছাড়তে পারেননা তিনি। প্রায় প্রতিদিনই লিখতে বসে রাতের দিকে। খটখট শব্দে তার লেখা চলতে থাকে। অন্তী অনিকের গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে একটু উঠে বসল। বলল, বাবাকে লেপটপ কিনে দিলে ভালো হয় না?
অনিক ভ্রু কুচকে হাসিমাখা গলায় বলল, কি হবে তাতে। আমারো তো আছে। সেটাতে লিখতে পারবেনা।
ও
কিছু হয়েছে তোমার?
না তো। কি হবে?
ইদানীং রাতের দিকে জেগে উঠে বসে থাকো দেখছি।
না,কিছুনা। ঘুমাও।
হুম
শোন।
কি?
তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমালে কি তোমার সমস্যা হবে?
অনিক মুচকি হেসে ইশারায় অন্তীকে বুকে টেনে নিল। অন্তী কাঁদছে। চোখের নিচে হাত দিয়ে ধরে রাখায় চোখ থেকে বেয়ে পড়া নোনা জল অনিকের গায়ে পড়ছেনা।
ঘুম থেকে উঠে অনিকের ব্যস্ততা শুরু। প্রতিদিনের মত আজও অফিস যেতে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে চা খেয়ে বেরোলো সে৷ বের হবার আগে অন্তী বলল সে একটু বাইরে যাবে। স্কুলে নাকি কিসের কাজ আছে। অনিক তেমন মাথা ঘামায়নি। ব্যস্ততার মাঝে কিছু না বলেই চলে গেছে। অফিস পৌঁছানোর পর অনিক ধাক্কা খেল একটা। আজ অফিস বন্ধ ছিল। বোকার মত দৌড়াদৌড়ি করে অফিস আসার কোন মানেই হয়না। অনিক নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত হলো। এমন কাজ করার মানে নিজেকে বোকা প্রমাণ করা। অনিক ধিরে সুস্থে বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরতে তার আধ ঘন্টা লাগল। ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অন্তীকে ডাকল। রান্নাঘর থেকে তিসা এসে বলল, অন্তী আফা তো বাইরে গেছে।
অনিক কিছু বলল না। তিসা তাদের বাসার কাজের মেয়ে। গ্রাম থেকে আসার সময় ছোটমামা সাথে করে নিয়ে এসেছিল তাকে। নাম পরিচয়হীন মেয়েটা এখন এই পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে।
কখন ঘুমিয়ে গেছে অনিক নিজেও বুঝতে পারেনি। ঘুম থেকে উঠে শার্ট খুলে আলনায় রাখতে গিয়ে দেখল রাত হয়ে গেছে প্রায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আট’টা বাজে। অনিক হাই তুলতে তুলতে অন্তীকে ডাকল। জানা গেল অন্তী এখনো বাসায় ফেরেনি। অনিক একটু অবাক হলো। এতোক্ষণ বাইরে থাকার মেয়ে তো অন্তী না। আর স্কুলের কাজ এতোক্ষণ থাকার কথা না। অনিক ফোন হাতে নিয়ে অন্তীর নাম্বার ডায়েল করল। ফোন বন্ধ। অনিক চিন্তায় পড়ে গেল।
কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে অনিক তার শসুরবাড়িতে ফোন দিল। হয়ত বাবা-মার কথা মনে পড়ছিল তাই মিথ্যে বলে সেখানে চলে গেছে। ফোন দিয়ে জানতে পারল অন্তী সেখানেও নেই। অনিকের চিন্তা এখন দুঃশ্চিন্তায় রূপ নিল। অস্থিরতা কাটাতে সিগারেট ধরিয়ে খাটে এসে আধ শোয়া হয়ে তিসা কে চা আনতে বলল। সিগারেট শেষ হতেই তিসা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে তিসা চলে গেল। অনিক আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপ নিতে গিয়ে দেখল টেবিলে একটা খাম রাখা। খামটা আগে থেকেই ছিল। তিসা আনেনি। এতোক্ষণ চোখে পড়েনি অনিকের। খাম খুলতে খুলতে হাতে থাকা সিগারেট শেষ করল অনিক। খামের ভেতর একটা চিঠি রাখা।
“অনিক,
আমি চিঠি লিখিনি কোনদিন। এটা কোন প্রেমের চিঠিনা। এমনটা করতে চাইনি আমি। কিছু করার ছিল না আমার।
ক্লাস টেন থেকে আমি একজনকে ভালোবাসি। এখন ভালোবাসিনা। এখন বুঝতে পারছি তখনের টা শুধু আকর্ষণ ছিল। আমি কোনদিন মা হতে পারব না এটা জেনেও তুমি আমাকে বিয়ে করেছ। আমাকে কতটা ভালোবাসো তুমি তা আমার জানা নেই। বিশ্বাস করবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি? অনেক বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু সেই পুরোনো প্রেম আমাকে আটকে দিচ্ছে। জানি আমি সাজিয়ে লিখতে পারছি না। আমি তোমার মত লেখক না। না তোমার বাবার মত! সোজা কথা বলি আমি চলে যাচ্ছি। আর আশা রেখ না আমার থেকে কিছু। ভেবোনা মরতে গেছি। আমি ওই আগের প্রেমিকের কাছে চলে যাচ্ছি। নাম বলতে চাচ্ছিনা তোমাকে,এক লেখক আরেক লেখকে চিনে ফেলতে পারে। আসলে আমি প্রেম-ভালোবাসার মানেটা এখনো বুঝিনি। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না আমি। ভালো থেকো। নিজের খেয়াল নিও,আর বাগানের গাছ গুলোতে জল দিও।
ইতি,
অন্তী”
চিঠিটা পড়ে অনিক অবাক হয়ে গেল। এমন কিছু আশা করেনি সে। আরো কয়েকবার চিঠিটা পড়ে বুঝার চেষ্টা করল অন্তী মজা করছে কিনা। চিঠিটা অগোছালো। তেমন করে কিছুই লেখা হয়নি। অনিক হতাশ হয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। লাইট বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে সে। সিগারেটের প্যাকেটে বলা থাকে সিগারেট খাওয়া ভালোনা,ক্যান্সার হয়। অনিক হঠাৎ হেসে উঠল। স্কুলে থাকাকালীন এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল তার “বিয়ে করা ভালো না। বিয়ে করিস না। একবার বউয়ের প্রেমে পড়ে গেলে ক্যান্সারও আটকাতে পারবেনা ভালোবাসতে। লেখালেখি করে জীবন পার করে দে ভালো হবে”
অনিক তখন বুঝেনি কিছুই। এটা যে নিছকই মজা ছিল তা ঠিক। কিন্তু কথা গুলো কি মিথ্যা ছিল? পাশের ঘর থেকে খট খট শব্দ আসছে। মৃণাল সাহেব লিখতে বসেছেন।
পরের দিন অনিক ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে অন্তীকে ডাকত। সাথে সাথে তার মন খারাপ হয়ে গেলো। অন্তী চলে গেছে কথাটা সে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিল। বাড়িতে এতোক্ষণে বোধহয় জানাজানি হয়ে গেছে অন্তী বাসা ছেড়ে চলে গেছে। তবে কারণটা জানবেনা। হয়ত ভাববে অনিকের দোষে সে চলে গেছে।
অনিকের আজ অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। বালিশের পাশে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে দেখল প্যাকেট খালি। ফোন বের করে কয়েকজন পুরোনো বন্ধুকে ফোন দিল অনিক। সবাই কাজে ব্যস্ত। একদিন সময় করে দেখা করতে যাওয়ার লোভ সবারই ছিল,সবাই অপেক্ষা করছিল কেও একজন ফোন করে বলুক- চল বের হই আজ। ঘুরে আসি। অনিকের ফোনে কেও মানা করেনি। খুশি হয়েই কাজ ফেলে চলে এলো সবাই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে সবার নিজের বাসার কথা মনে পড়ে গেল। সবার বাসায় বউ আছে শুধু সুমিত ছাড়া। সে এখনো বিয়ে করার ধারে কাছেও নেই। বললে বলে, “কাকে বিয়ে করব? এখন তো যাকেই দেখি সব ছেলে।
জিন্স পড়ে রাস্তায় হাটে,বুক দেখিয়ে বেড়ায়! মেয়ে পাই আগে তারপর দেখা যাবে” বউ না থাকার পরও তার বাসায় যাবার তাড়া বেশি। সারাদিনের ক্লান্তি যেন অনিকের গায়ে লাগছেনা। সে ঘোরের মাঝে আছে। তার মুখ দিয়ে ভরভর করে মদের গন্ধ আসছে। এতোক্ষণে কতগুলো সিগারেট খেয়ে ফেলেছে সে তার হিসাব নেই। বাড়ির পথে হাঁটছে সে। রাস্তা অন্ধকার। মাঝে মাঝে গাড়ি যাবার সময় একটু আলোর ছোয়া দিয়ে চলে যাচ্ছে। অনিক পকেট থেকে সিগারেট বের করে কাঁপা হাতে জ্বালালো। সিগারেটে এক টান দিতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। অনিক বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটছে। তার চেহারায় এখন ক্লান্তির ছাপ পড়েছে। বৃষ্টির কারণে সিগারেট নিভে গেছে। অনিক নিভে যাওয়া সিগারেটেই টান দিচ্ছে।
বাসায় পৌছে কলিং বেলের বোতাম চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অনিক। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল। অনিকের সামনে অন্তী দাঁড়িয়ে। অন্তী অনিকের অবস্থা দেখে কিছু না বলে অনিককে জাপটে ধরল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। কান্না মাখা গলায় থেমে থেমে বলল, আমাকে মাফ করে দেও। সত্যি আমি অনেক খারাপ। আমি,আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি যাইনি ওর কাছে,স্টেশনে বসে ছিলাম সারা রাত। মাফ করে দেও প্লিজ,ভালোবাসি অনেক।
অনিক কিছু বলল না। সে এখনো ঘোরে আছে। ভেজা সিগারেট এখনো তার ঠোটে চুম্বকের মত আটকে আছে। অনিকের ঠোট কাপছে। তার ঠোট থেকে সিগারেট পড়ে গেল। অনেক কষ্টে সে বলল, ভালোবাসি অন্তী…
অন্তীর চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা সে।