মনে বেশ জোর দিয়ে সাহস এনে নেহাকে প্রপোজ করে ফেললাম।
নেহা এখন আমার সামনে বসে আছে।তার টানা টানা চোখ দুটো দিয়ে সে আমাকে দেখছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু ভাবছে।
আমি নেহাকে বললাম,
–“কী ব্যাপার আপনি কিছু বলছো না যে?”
নেহা একটি নিশ্বাস ফেললো।তারপর বললো,
–“সত্যি আমাকে ভালো বাসেন?”
আমি একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
–“হ্যাঁ, সত্যিই আপনাকে ভালো বাসি”
নেহা সামনে থাকা কফির মগ টা নাড়তে নাড়তে বললো,
–“আচ্ছা আমাকেই কেনো ভালো বাসলেন আপনি?আমার মধ্যে আপনি কি এমন দেখেছেন যে আপনি আমাকে ভালো বেসে ফেললে?”
–“আপনার মধ্যে অন্যরকম একটা ভালো লাগা আছে।একটা পবিত্রতা আছে।আপনি নবজাতকের মতো নিষ্পাপ”
–“তাহলে আপনি কি এখন আমায় অপবিত্র করতে চাচ্ছেন?আপনি কি আমার সেই অন্যরকম ভালো লাগা টা কেড়ে নিতে চাচ্ছেন?”
নেহার কাছ থেকে এরকম একটা প্রশ্নের জন্য আমি একদম অপ্রস্তুত ছিলাম।আমি এখন কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছি না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে নেহা বলে উঠলো,
–“কি ব্যাপার চুপ করে আছেন যে?এরকম একটা প্রশ্নের জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন?এখন কি উত্তর দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না?”
আমি বুঝতে পারলাম না নেহা আমার মনের ভেতরের কথা গুলো কিভাবে বুঝে ফেললো।
আমি গলা টা পরিষ্কার করে বললাম,
–“জ্বি,আপনি ঠিক ধরেছেন?”
আমার কেমন জানি বিরক্তিকর লাগলো।আমি মনে মনে চিন্তা করলাম নেহা আমাকে রিজেক্ট করবে।নেহার দিকে এক পলক তাকালাম। সে জানালার বাহিরে নিচ তলায় গাড়ি এবং মানুষ গুলোর চলা ফেরা দেখছে।
–“আমার সেরকম কোন উদ্দেশ্যে ছিলো না,আপনি আমাকে ভুল বুঝতেছেন।আমি শুধুই আপনাকে ভালোবাসি”
–“আচ্ছা আপনি কি এখন পর্যন্ত আমাকে দেখেছেন?”
–“নাহ্, তা দেখিনি”
–“না দেখেই আমাকে ভালো বেসে ফেললেন”
–“ভালোবাসা চেহারা দেখে হয়না”
–“এসব কথা ছবি এবং গল্পেই মানায়,বাস্তবে চেহারা টা দেখেই ভালোবাসা হয়”
–“আপনি আমাকে রিজেক্ট করলেন তাইতো”
–“দেখুন আমাকে ভুল বুঝবেন না।আমার সম্পর্কে আপনি কতো টা জানেন।আমাকে চার পাঁচ দিন দেখেছেন মাত্র।এতেই ভালো বাসা জন্মে গেলো আমার জন্য”
–“জ্বি, জন্মে গেছে।আমি জন্মাতে চাইনি তবুও জন্মে গেছে।আমি যেরকম টা ভাবতাম ঠিক সেরকম আপনি!বিশেষ করে আপনার চোখ দুটি, কি সুন্দর করে তাকান আপমি।সকল কষ্ট চলে যায়”
নেহা কিছু বললো না,আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।আমি আবারো বললাম,
–“আপনার চুল টা শুনেছি অনেক লম্বা, কোমর অব্দি।আপনার মুখে তিল ও আছে শুনেছি,ডান দিকে ঠোঁটের উপরে একটা তিল এবং গালে একটা তিল”
–“বাহ্ বাহ্,এতো কিছু জেনে ফেললেন”
–“এ তো সামান্য, এখনো জানার অনেক বাকি”
নেহা কিছু বললো না।এবার জানালার দিকে তাকিয়ে আকাশটাকে দেখে নিলো একবার।মেঘহীন মুক্ত নীল আকাশ।নেহা একটি ঘন নিশ্বাস ফেললো।আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি এখনো।
আমি নেহাকে এখনো দেখি নি।না দেখেই তাকে ভালো বেসে ফেলেছি।কখনো ভাবি নি আমি কাউকে প্রপোজ করবো, তবে নেহাকে দেখার পর থেকে একটা হারানোর ভয় শুরু হয়।সেই হারানোর ভয় টা কে দূর করার জন্য আমি তাকে প্রপোজ করে নিজের করতে চেয়েছিলাম।
নেহার গায়ে নীল রঙের একটি সাধারণ বোরখা। হাতে হাত মুজা পরা।কালো রঙের একটি স্কার্ফ দিয়ে তার পুরো মুখ টা ঢাকা।শুধু তার সেই মায়াবী টানা টানা চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।চোখে কিছুটা কাজল দিয়েছে সে।
তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে তিল এবং চুলের কথা জেনেছি,তারপর নিজের মনের ক্যানভাসে তার ছবি একেছি।
এসব কল্পনায় অন্যমনস্ক হয়ে গেছি,হঠ্যাৎ নেহা বলে উঠলো,
–“আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
–“জ্বি,অবশ্যই”
–“আপনি একটা জমি কিনলেন।এবং চাষাবাদ শুরু করলেন।প্রায় দু মাস কষ্ট করে আপনি জমিতে শাক সবজি লাগালেন। তিন মাস পার হয়ে গেলো, আপনার গাছে ফুল দিয়েছে, এখন যদি পুরনো জমির মালিক আপনাকে জমি ফেরত দিতে বলে, কিংবা অন্য কোন ভাবে বিপদে পড়ে আপনাকে সেই জমি বিক্রি করতে হয় তখন আপনার কেমন লাগবে?”
–“আমার খুব বেশি খারাপ লাগবে।আমি হয়তো নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে দিবো”
–“ঠিক তেমনি, এখন যদি আমি আপনার ভালোবাসা গ্রহণ করি তাহলে আজ এতো দিন ধরে যে আমি নিজেকে পর্দায় রেখেছি,নামাজ পড়েছি সব বৃথা চলে যাবে”
–“কিন্তু ভালোবাসা তো কোন অন্যায় না!”
–“হ্যাঁ, অন্যায় না ঠিকই।তবে বিয়ের আগে ভালোবাসা ঠিক না।এটা তখন যেনা হয়।বিয়ের আগে প্রেম অবৈধ।আমি যদি আপনার সাথে বিয়ের আগে প্রেমালাপ করি তাহলে আমার যেনা হবে”
–“আমি শুধু আপনাকে আমার করতে চাই”
–“দেখুন, আপনি হয়তো আমার কথা টা ঠিক ভাবে বুঝতে পারেন নি?”
–“নাহ্ নাহ্ আমি পেরেছি”
–“আমি ভালোবাসার কাছে আমার ইমান এবং এতোদিনের ইবাদত কে বৃথা যেতে দিতে পারি না”
–“আমাকে বিয়ে করবেন?”
–“জানি না”
–“কেনো আমাকে পছন্দ হয় নি?”
–“আসলে তা না।আমার বাবা যদি আপনাকে পছন্দ করেন তাহলে আমি বিয়ে করবো”
–“যদি রাজি হয়ে যায় এখন বিয়ে করবেন”
–“ক্ষমা করবেন, এখন আমি বিয়ে করতে চাই না।দুই বছর পর আমি বিয়ে করবো”
–“আচ্ছা”
সেদিনের পর আজ তিন বছর কেটে গেলো।আমার বিছানার পাশে শুয়ে আছে নেহা, কাঁচের জানালা ভেদ করে আলো ছিটকে এসে পড়ছে নেহার মুখে।চাদোর আলো স্নিগ্ধতা বাড়িয়ে দিচ্ছে নেহার চেহারার। কিছুটা চুল এসে নেহার গালে পড়েছে,আমি হাত দিয়ে সেই চুল গুলো কে তার কানের কাছে গুজে দিলাম।
নেহা ঘুমের ঘোরে আমার হাত টা জড়িয়ে ধরলো।আমি মৃদু হেসে হাত টা ছাড়িয়ে নিলাম।
মসজিদের মাইক থেকে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগলো,”আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”
আমি উঠে নেহাকে ডাক দিলাম।সাথে সাথেই সে উঠে গেলো।তারপর দুজনে নামাজ টা পড়লাম।এবং ছাদে গিয়ে সকালের সূর্যদয় উপভোগ করতে লাগলাম।
সেদিন নেহা চলে গিয়েছিলো,যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলো,
—“আমি জান্নাতী নারী হতে চাই এবং একজন উত্তম স্ত্রী হতে চাই,তাই আমার পক্ষে প্রেম করা কিংবা কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।আমি ভালো বাসবো আমার স্বামীকে।প্রেম টা আমি করবো বিয়ের পরে স্বামীর সাথে।সে প্রেম উত্তম। সে প্রেমে আল্লাহ্ র রহমত থাকে।
নারীরা সৃষ্টি জগতের জন্য মহান আল্লাহপাকের এক অনুপম এবং অতুলনীয় সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টিতে নর এবং নারী একে অন্যের পরিপূরক। ইসলামের দৃষ্টিতে নর এবং নারীর স্থায়িত্ব এবং শান্তি তাদের পারস্পারিক সহযোগিতা এবং সৌহাদ্যপূর্ণ সর্ম্পকের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। একটি সফল বিয়ের মাধ্যমেই একজন নারী স্ত্রী হিসেবে স্বামীর গৃহে আগমন করে স্বামীর মনোরাজ্যে স্থাপন করে স্বীয় সিংহাসন এবং বিচরণ করে তার আপন রাজত্বে। কেননা নারীরা মৃত মনে নব জীবনের স্পন্দন জাগায় সতত সর্বত্র।দুঃখ ভারাক্রান্ত মানে জাগায় আশার আলো”
এই বলে সেদিন নেহা চলে গিয়েছিলো।আমি নেহাক প্রথম কলেজ গেইটে দেখেছিলাম।দেখেই আমার ভালো লেগেছিলো।
নেহার সাথে বিয়ের আমার আজ এক বছর পার হয়ে গেছে।প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে সে দোয়া করে যেনো সে উত্তম স্ত্রী হতে পারে। নেহাকে এখনো কোন ছেলের সামনে বের হয় না।সব সময় পর্দা করে।সে আমার সেবাযত্ন করে।আমার বাব-মার খেয়াল যত্ন রাখে।প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করে। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।তার সকল ভালোবাসা আমার জন্য,বিয়ের আগ থেকে সে সেগুলো জমিয়ে রেখেছে।
–“কি ভাবছো?”
–“নাহ্ কিছুনা।অনেক্ষণ হলো চলো বাসায় যাই”
–“হ্যাঁ, চলো”
দুজনে বাসায় যেতে থাকলাম। আমি নেহার দিকে তাকালাম তার মুখে এক ধরনের হাসি।এ হাসি টা তার মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকে।তার একটাই ইচ্ছে সে একজন উত্তম স্ত্রী হবে এবং জান্নাতি নারী হবে।