ভালবাসার অনূভূতি

ভালবাসার অনূভূতি

মিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। স্কুল কলেজ দুটিই গ্রামে করেছে।নিজের মেধায় আর চেষ্টায় সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিয়েছে।তাই শহরে পড়াশুনার জন্য চলে আসা।

গ্রাম থেকে তার শহরে আসা মূলত বাবা মার স্বপ্ন সার্থক করে একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে নিজের পরিচয় তৈরী করার জন‍্য। তাই শহরের স্বল্প খরচার ছাত্রী নিবাসে উঠে পড়ে মিলি। বেশ ভালোই তার দিন কাটছিল।”

প্রথম প্রথম এতো লোকের ভীড়ে,এতো কোলাহলে, এতো আলোয় তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। সে পাগলের মতো এক টুকরো ফাঁকা জায়গার সন্ধান করতো শ্বাস নেওয়ার জন‍্য। আসলে ছোট থেকে খোলা মেলা গ্রাম‍্য পরিবেশে বড় হওয়া মিলির শহরকে খুব যত্নে সাজানো কোনো জায়গা মনে হতো। যেখানে সবকিছুর প্রাপ্তি সম্ভব কিন্তু একটি খোলা মেলা সুন্দর গ্রাম আর তার সরলতা পাওয়া অসম্ভব ছিল।

কিন্তু কয়েক মাস পার হওয়ার পরেই এই জমকালো শহুরে পরিবেশ যেন কেমন আপন হয়ে উঠতে থাকে তার কাছে। আর ফলস্বরূপ পরিবর্তনশীল মানুষের মতোই মিলির মনেরও পরিবর্তন হতে থাকে। ক্রমে বাহ‍্যিক চাহিদায় বন্ধুদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আত্মিক সরলতাকে এক প্রকার বিসর্জন দেয় সে।

গ্রামের মেঠো রাস্তা,ক্লাস শেষে বইয়ের সিনারির মতো সূর্যাস্তের জন‍্য আর তার মন খারাপ করেনা। বরং কলেজ শেষে লেকের ধারে বন্ধুদের সাথে অথবা নীলয়ের সাথে একান্তে সময় কাটাতেই বেশী পছন্দ করে এখন সে।
নীলয় হল তার জীবনের প্রথম পুরুষ, প্রথম প্রেম, প্রথম ভালবাসা সবকিছু।

সারাদিনে ঘরের কাজ করার পর সন্ধ‍্যাবেলায় ক্লান্ত শরীরে রান্না করার জন্য চুলায় আগুন জ্বলানো মা, সারাদিন মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করা বাবা বা ভাই কারোর কথাই এখন আর তাকে এতোটা ভাবায় না যতোটা নীলয়ের কথা তাকে ভাবায়।

তার শয়নে, স্বপনে, জাগরনে সর্বত্র নীলয়ের বিচরন। এখন শুধু তার স্বপ্ন বা লক্ষ‍্য একটাই তা হল পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর নীলয়ের সাথে বিয়ে করে তার পরিচয় নিয়ে বাঁচা।

সে ঠিক করেই রেখেছে বাবা যদি কখনো তাকে প্রশ্ন করেও তাহলে সে সাফ জানিয়ে দেবে মেয়েদের আলাদা করে কোনো পরিচয় হয়না। স্বামীর পরিচয় ই সব। তাই সেও নীলয়ের পরিচয়েই পরিচিত হবে আলাদা করে নিজের পরিচিতি বানানোর তার দরকার নেই।

নীলয় অপছন্দ করে এমন কোনো কাজ সে কখনো করবে না। আর সে ভালো মতোই জানে তার বাবার পক্ষে হাজার চেষ্টা করলেও নীলয়ের মতো ছেলেকে জামাই হিসাবে জোগাড় করা সম্ভব নয়।

পয়সা, প্রতিপত্তি , মান – সম্মান সবদিক থেকে নীলয়রা এগিয়ে। প্রতিষ্ঠিত ব‍্যবসায়ীর বউ হওয়া তার ভাগ‍্যের ব‍্যাপার। এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে । চেয়ে দেখে নীলয়ের ফোন।

ফোনটা ধরার পর কিছুক্ষণের কথপোকথন চলার পর ক্রমে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে ওঠে। তারপর ফোন কেটে গেলে সারা সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে । তার কী করণীয় সে বুঝে উঠতে পারে না। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সে ফেসবুক অ্যাপটা খুলে নীলয়কে ম‍্যাসেজ করে, “আমি রাজি।”

অপারেশন টেবিল। ছুড়ি, কাঁচি সবকিছু জায়গা মতো সাজানো। আর একটু পরেই মিলিকে অপরেশনের ও.টি. তে শিফট করা হবে। ডঃ নীলা হাতে গ্লাপস পরতে ব‍্যস্ত । সব অ্যারেঞ্জমেন্ট আর একবার চেক করে নিয়ে নার্সকে ইশারায় পেশেন্টকে ও.টি তে আনার নির্দেশ দেন ডঃ নীলা ।

নার্স এসে মিলিকে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য উদ‍্যত হলে সেই সময় ভয়ে হাত পা ঠান্ডা বরফের মতো হয়ে যায় তার। আজ তার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে, ভাইয়ের সাথে খুনসুটির মুহুর্তগুলো মনে পড়ছে, বাবার কাছে আবদারের কথাগুলো মনে পড়ছে। শহরের মেকি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কী করে সে তার শিকড়কে ভুলে যেতে পারলো। ভাবলেই তার নিজের উপর রাগ হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে। আসলে সে তার লোভ সংবরণ করতে না পেরে মোহের পিছনে ছুটতে গিয়ে ভুলতে বসেছিল আলেয়া কখনো আলো হয়ে ধরা দেয়না। তাই তো চিরকালীন সম্পর্কগুলোকে অস্বীকার করেছিল, সময়ের প্রয়োজনে তৈরী হওয়া সম্পর্কের জন‍্য। তাই হয়তো এই শাস্তি তার।

অপরেশন রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে ডাক্তার গ্লাপস হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয় সে দুচোখ বন্ধ করে, দুহাতে চাদরটাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর মনে মনে ভাবছে, আর কোনোদিনো কী সে আগের মতো তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে? সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল নিজের পরিচয় তৈরী করতে, নিজের আত্মাহুতি দিতে নয়। একজন খুনি হতে সে আসেনি।

কেনো সাময়িক মিথ‍্যে ভালবাসার প্রলোভনে পা দিয়ে সে একটা নিষ্পাপ প্রাণকে শেষ করে দিচ্ছে। আর কিছু সে ভাবতে পারে না। আর যাইহোক সে খুনি কোনোদিনও হতে পারবে না। সে ধরফর করে বিছানায় উঠে বসে। সারা শরীর তার ঘামে ভিজে গেছে।

কিন্তু একী কোথায় ডাক্তার ? কোথায় নার্স ? সে তো হোস্টেলে নিজের বিছানায় শুয়ে। তার মানে এতোক্ষণ ধরে সে যা দেখছিল তা পুরোটাই স্বপ্ন ছিল।

এবার আস্তে আস্তে উঠে সে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে আলগোছে কিছুটা জল গলায় ঢেলে ঢক ঢক করে তা পান করার পর বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে নিজের বিছানায় বসে। ভোরের আলোও তখন সদ‍্য ফুটে উঠছে চারিদিকে। আবার একটা নতুন দিনের শুরু হচ্ছে।

কয়েক মুহূর্ত কিছু ভেবে নেয় তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক অ্যাপটা খুলে নীলয়কে করা ম‍্যাসেজ বক্সটা ওপেন করে। ওপেন করার পর গতকাল তার রাজি লেখার উত্তরে নীলয়ের করা লাস্ট মেসেজ , “লাভ ইউ জানু, মুআআআআআ লেখার পর একটা লাল টকটকে হার্ট সিম্বল পাঠানো।”

সেটা চেক করার পর সে টাইপ করতে থাকে, “নীলয় কোনো কিছুই চিরন্তন নয় পৃথিবীতে, শুধু কিছু অনুভূতি ছাড়া। আর এই সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভূতিগুলোই আমাদের পরস্পরকে এক অদৃশ‍্য বাঁধনে বেঁধে রাখে।

“আমার মতে ভালবাসার কোনো মাপকাঠি হয়না, ভালবাসার কোনো প্রমাণ হয়না। ভালবাসা এমন এক অমোঘ আকর্ষণ যার প্রতিফলন একে অপরের চোখে ধরা পড়ে। আমরা আমাদের ভালবাসার প্রতি করা কর্তব‍্যকে অন‍্যের দুর্বলতা মনে করে তাকে উপভোগ করতে থাকি। তাই সময়মতো উপভোগের নেশা কেটে গেলে ভালবাসাও হারিয়ে যায় আমাদের মধ‍্যে থেকে। আর তখন আবার আমরাই কখনো পরিস্থিতিকে তো কখনো একে অপরকে দোষারোপ করি।

ভালবাসা সম্পূর্ণ মানসিক বা শারীরীক দুটোর কোনোটাই হয় না এটা আমি বিশ্বাস করি। যে ভালবাসা শরীরে আবদ্ধ সে মন বোঝেনা। আর যে মন বোঝেনা সে ভালবাসেনা।

আমরা যদি একে অপরের ভালবাসার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হই , তাহলে কয়েকটা বছরের অপেক্ষার পর বিয়ের পর আমরা আমাদের ভালবাসাকে পূর্ণতা দিতেই পারি। আমি মনে করি ভালবাসা কোনো প্রমাণ দিয়ে, কোনো শর্ত মেনে হয়না। তাই তোমার কাছে আমার ভালবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে নিজের বিবেকের কাছে আমি ছোট হতে পারবো না। তাই তোমার চাহিদা পূরণ করতে পারলাম না। পারলে ক্ষমা করো।” কথা গুলো টাইপ করে সেন্ড করার পর ফোনটা পাশে রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে।

“যেখানে ভোরের আলোর সাথে সাথে ধীরে ধীরে শহরের ব‍্যস্ততাও বাড়ছে। দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছে কংক্রিটের আবরণের নীচে একতাল নরম মাটি লুকিয়ে রয়েছে শহরেও, তাই তো কাঠিন‍্যের মাঝেও মনের সেই নরম সরসতার উপলব্ধি তার শহরে থেকেই হলো।যাকে কয়েক ঘন্টা আগেও নিজের পুরো পৃথিবী ভেবে নিজের জীবনের চরম ভুলটা সে করতে যাচ্ছিল। আজ সবকিছু হারিয়েও কষ্টের মাঝেও নিজেকে তৃপ্ত লাগছে তার।

এমন সময় ফোনের মেসেজ অ্যাপের টোনটা বেজে ওঠাতে সে বুঝতে পারে তার মানে নীলয় ম‍্যাসেজ পড়ে নিয়েছে ,হয়তো চিরতরে সম্পর্ক শেষ হলো। এইভেবে চোখ মুছে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে,নীলয় লিখেছে,

“এতোকিছু না লিখলেও হতো । আমিও কামুক প্রকৃতির ছেলে নই। আমি নিজেও জানি বিশ্বাসের রেখা লঙ্ঘন করতে নেই। ভালবাসা শেষ হলো না বরং আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল। তোমাকে না ছুঁয়েও তোমার হাসিতে, তোমার ঠোঁটে থাকা তিলে, তোমার চোখে, তোমার হাওয়ায় উড়তে থাকা চুলে সর্বত্র আমি আমার অস্তিত্ব অনুভব করি। তোমার মন জুড়ে আমি আর আমার মন জুড়ে তুমি। তাই শুধু আজ নয় আজীবন আমি অপেক্ষা করতে পারি। তাই আর ক্ষমা নয় বিকেলে সোজা দেখা করতে হবে আর কুড়ি টাকার এক্সট্রা ফুচকা খেতে হবে । লাভ ইউ।”

ম‍্যাসেজটা পড়তে পড়তে আনন্দে চোখের জল বাঁধ মানে না তার। সে ভুল করেনি গ্রামের প্রেম আজ শহরের প্রেমের কাছে হার স্বীকার করলো। আর এ হার যে পরম আনন্দের।

———— সমাপ্ত ————–

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত